অন্তর দহন পর্ব-১১+১২

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব__১১

চন্দ্রের জীবনে গত কয়েকদিনে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে।কোনোটা বিশ্রী রকমের খারাপ। কোনোটিই আবার মনে রাখার মতো ভালো।গত কয়েকদিন ধরেই স্পন্দন সারাক্ষণ ছায়ার মতো আগলে আগলে রেখেছে চন্দ্রকে। কোথাও মনের মধ্যে এক আকাশ পরিমাণ ভয় লুকিয়ে আছে স্পন্দনের চন্দ্রকে হারিয়ে ফেলার। আবার চন্দ্রের মনে প্রশ্নের পাহাড় জমে আছে স্পন্দনের জন্য। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে দুজন এখনো একসাথে রয়ে গেছে সৈয়দ বাড়িতে।

আজকে মিতুর গায়ে হলুদ। চন্দ্র বায়না ধরে বসে আছে সকাল সকাল যাবে বলে।স্পন্দনের এক কথা এতো ভিড়ের মধ্যে চন্দ্রকে একা ছেড়ে দিতে পারবে না। আবার কে কখন ছিনিয়ে নিয়ে যাবে চন্দ্রকে।তাই বিন্দু মাত্র রিস্ক নিতে চায় না স্পন্দন।দাদিমা এখন বেশ ভালো আছেন।মেয়ের ঘরের নাতনির বিয়ে তাই তাকে আগেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সৈয়দ মির্জা বেশ অনুতপ্ত। তবুও পরিবারের সবার থেকে এখনো দূরেই থাকেন। চন্দ্র ওর বড় আম্মুর কাছে গিয়ে বললো,

__বড় আম্মু? তোমার ছেলেকে বলো না আমাকে যেতে দিতে। আমি সত্যি বলছি গিয়ে কোনো উল্টাপাল্টা কাজ করবো না।

__চন্দ্র আমাকে বলে লাভ নেই মা।এই কয়দিন ধরে স্পন্দনকে দেখে এটুকু বুঝেছি যে নিজের সাথে রিস্ক নিলেও তোর জীবন নিয়ে একবিন্দুও ছাড় নেই। আমার ছেলেটাকে কি দিয়ে এভাবে বাঁধলি চন্দ্র?

__আমি আবার কি দিয়ে বাঁধবো?আর তাছাড়া আমার বয়েই গেছে ঐ গোমড়ামুখো হনুমানকে বেঁধে রাখতে।

হাসতে হাসতে বড় আম্মু বললেন,

__সে যাই হোক চন্দ্র। আমি ভীষণ খুশি রে।এই যে কিছুদিন আগেও ছেলেটার কেমন ছন্নছাড়া জীবন ছিলো। কেমন রংচটা ছিলো ওর পুরো জীবনটাই। আজকাল দেখলে মনে খুব শান্তি হয় রে চন্দ্র।ছেলেটা অবশেষে ঘরে ফিরলো। আম্মার কথা বিফলে যাইনি চন্দ্র।

__বাদ দাও তো তোমার ছেলের কথা।ওর আবার বিশ্বাস আছে নাকি?এই ভালো তো এই আবার খেপে আগুন। আমি বাপু আজও তোমার ছেলেকে চিনে উঠতে পারিনি।

__খুব পাকা পাকা কথা শিখেছিস ।তাইনা? আমি তোর শ্বাশুড়ি আম্মা ভুলে গেছিস?

__হ্যাঁ গেছি। তুমি আগেও আমার বড় আম্মু ছিলে এখনও তাই।এর মধ্যে তোমার ছেলেকে টানবে না বলে দিলাম।

স্পন্দন সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো,

__ঐ পাগলীটা তোমাকে কি বুঝাচ্ছে মা? নিশ্চয়ই আমার নাম ধরে উল্টাপাল্টা বলছে তোমার কাছে।

__আরে না বাবা। চন্দ্র আমার তেমন মেয়েই না। আমার লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে চন্দ্র।

চন্দ্র আহ্লাদে গদগদ হয়ে বড় আম্মুকে জড়িয়ে ধরলো।তা দেখে স্পন্দন বললো,

__দেখেছো একটা ভালো কথা বলেছো তো তোমার মাথায় উঠে নাচতে শুরু করেছে।এতো মাথায় উঠিও না মা। এরপর নামাতে পারবেনা।

__দেখেছো বড় আম্মু।গোমড়ামুখোর হিংসা হচ্ছে।

__হিংসা আর এই স্পন্দন।যাস্ট সাটআপ চন্দ্র। এবার কিন্তু খুব বেশি বেশি বলছিস।কানের নিচে একটা পড়লেই বুঝতে পারবি এই স্পন্দন কে কি ও কত প্রকার?

__তোমার সামনে তোমার মেয়েকে ভয় দেখাচ্ছে বড় আম্মু। তুমি কিছু বলবা না?

__ঠিক তো।স্পন্দন আমার চন্দ্রকে নিয়ে উল্টাপাল্টা বলবি না বলে দিলাম।তাহলে কিন্তু এই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে তোকে।

স্পন্দন হুহা করে হাসতে লাগলো।তা দেখে ওর মা বুকে হাত দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ঠিক কতগুলো দিন পরে ছেলেটা এমন করে হাসছে।দেখেই মনটা জুড়িয়ে গেলো ওনার। চন্দ্রের জোর করাতে এক প্রকার বাধ্য হয়ে স্পন্দন ওকে নিয়ে মিতুদের বাড়িতে গেলো।স্পন্দনের বাবা-মা পরে যাবেন বলে থেকে গেলেন।ও বাড়িতে গিয়েই চন্দ্র স্পন্দনকে রেখেই কাজিন দের সাথে চলে গেছে। চন্দ্রকে দেখেই মিতু জড়িয়ে ধরলো।নিরা বললো,

__চন্দ্র আপু? ভাইয়া তোমাকে আসতে দিলো অবশেষে?

__আরে দিবে না আবার। চন্দ্র চাইলে ঐ গোমড়ামুখোর ক্ষমতা আছে নাকি চন্দ্রকে আটকে রাখার?

__ওহ্,তাই বুঝি চন্দ্র?

__হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ।

বলেই পেছনে ফিরে দেখে স্পন্দন হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে ভ্রু কুঁচকে খানিকটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। চন্দ্র না পারছে দৌড়ে পালিয়ে যেতে আর না পারছে কিছু বলতে।তা দেখে স্পন্দন বললো,

__তা মিসেস্ স্পন্দন মির্জা সবাইকে বলি, আপনি এখানে আসার জন্য ঠিক কি কি করেছেন?

রেহান বললো,

__বলে দাও ভাইয়া।এতো সময় তো নিজেকে রাজরাণীর মতো ট্রিট করছিলো চন্দ্র।

__তুমি চুপ করো রেহান ভাইয়া।

__কেনো?ও কেনো চুপ করবে? আমার ও তো জানার অধিকার আছে যে আমার পিঠ পিছে আমাকে নিয়ে আমার বউ ঠিক কতটা গুনোগান করছে।

সিঁথি বললো,

__তোমাদের এই জামাই বউয়ের এপিসোড এখানেও থামাও প্লিজ। তোমাদের এসব শুনতে শুনতে আমাদের আজকে আর সাজতে হবে না দেখছি।

__ভাইয়া চলো তো এখান থেকে।এসব পেত্নীদের থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালো।

ওরা সবাই বেরিয়ে যেতেই চন্দ্র বললো,

__আমাকেও একটু সাজিয়ে দেনা তোরা।ঐ বেডার জন্য আমি তো সাজতেই পারিনি ঠিক মতো।

__খেপেছো চন্দ্র আপু? তোমাকে সাজাই আর ভাইয়া আমাদের খবর করে দিক আর কি।

__তোরা না আমার বোন।দেনা প্লিজ।

সবাই মিলে খুব সেজেছে।ছেলেরা হলুদ পাঞ্জাবী আর মেয়েরা হলুদ শাড়ি আর তাজা ফুলের গহনা। চন্দ্রকে দেখতে হলুদ পরীর মতো লাগছে।তা দেখে সিঁথি বললো,

__চন্দ্র আপু?স্পন্দন ভাইয়া তো আজকে তোমাকে চোখে হারাবে।আর মিতু আপু তোর বরটাকেও সামলে রাখিস।তোকে রেখে আবার আমাদের ভাবীপুর উপর লটকে না যায়।

সবাই মিলে একসাথে হেসে উঠলো। চন্দ্র মিতুকে নিয়ে স্টেজে যেতেই স্পন্দনের চোখ আটকে গেলো। মুগ্ধ নয়নে চন্দ্রকে দেখতে লাগলো।তা দেখে নিরা বললো,

__তখন যা বলেছিলাম চন্দ্র আপু।স্পন্দন ভাইয়ের অবস্থা একটু দেখো। বেচারার কেমন হাঁসফাঁস অবস্থা তার অপরূপ বউকে দেখে।না পারছে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে আর না পারছে জড়িয়ে ধরে টুসঠাস চুমু খেতে। দেখে মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস আটকে বসে আছে বেচারা।যাও না যাও একটু কাছে গিয়ে দাঁড়াও।

__বেশি পেকেছিস কিন্তু নিরা।দিবো এক থা’প্পর।

সবাই হুহা করে হেসে হেসে মজা নিতে লাগলো।সবাই একে একে উঠে এসে মিতুকে হলুদ ছোঁয়াতে লাগলো। এরমধ্যে একবার চন্দ্রের সাথে স্পন্দনের চোখাচোখি হয়ে গেলো।স্পন্দন ইশারা করলো নিচে নামতে। কিন্তু চন্দ্র পাত্তা না দিয়ে ওর মতো ইনজয় করতে লাগলো। হঠাৎ করেই দিপ্ত এসে বললো,

__চন্দ্র আপু তোমাকে বড় আম্মু ডাকছে।

চন্দ্র এবার নিরুপায় হয়ে উঠে ধীরে ধীরে নিচের দিকে এলো। লোকজন পেরিয়ে চিলেকোঠার ঘরের দিকে যেতেই কেউ হেঁচকা টান দিয়ে ওকে টেনে নিলো। চন্দ্র ভয়ে চিৎকার দিতে যাবে তার আগেই মুখ চেপে ধরলো একটা শক্ত হাত।আর একটা হাত পেছনে পিঠ মোড়া দিয়ে ধরে রাখা ।যে হাতটা ফাঁকা আছে সেটা দিয়ে ছিলোছিলি করতে লাগলো চন্দ্র।আর মুখ দিয়ে উমম্ উমম্ শব্দ করতে লাগলো। ধীরে ধীরে পেছনের হাতটার বাঁধন আলগা হয়ে চন্দ্রকে প্রসস্থ বুকের সাথে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কোমড় ছুঁয়ে দিলো।কোমড়ে ভেজা ভেজা ঠান্ডা কিছু লাগানো হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। চন্দ্র এখনো সমানে নড়াচড়া করতে চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু এমন শক্তির সাথে পেরে উঠছে না। এদিকে ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে চন্দ্র। কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

__তুই যে এতো সুন্দর করে সেজেগুজে ঘুরছিস সবার সামনে এটা তার শাস্তি চন্দ্র। এমন সাজে তোকে শুধু স্পন্দন দেখবে।আর কেউ নয়। আজকের জন্য এটা ওয়ার্নিং ছিলো। এরপর আবার এমন হলে এর থেকেও বড় শাস্তি পেতে হবে চন্দ্র।

এরপর মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে দিতেই খোঁচা খোঁচা দাড়ি অনুভব হলো চন্দ্রের। বুঝতে পারলো মুখে মখ লাগিয়ে কিছু মাখিয়ে দিয়েছে।এরপর ছেড়ে দিলো চন্দ্রকে। চন্দ্র যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। এরপর মুখ ফুলিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বললো,

__এসব কি স্পন্দন? আমি রিতিমত ভয় পেয়ে গেছিলাম। এভাবে কেউ টেনে আনে? আমি তো ভাবলাম আবার কে না কে?

__এই স্পন্দন থাকতে চন্দ্রের উপর একটা ফুলের টোকাও পড়বে না।অন্তত কেউ দিতে সাহস পাবে না চন্দ্র।

__কিন্তু আপনি এটা কি করলেন?

__কি করলাম?

__আমাকে এভাবে কেনো হলুদ মাখালেন? গায়ে হলুদ তো আপুর। এখন সবাই কি ভাববে বলুন আমাকে এভাবে ভুতের মতো দেখে।আর জিজ্ঞেস করলে আমি কি বলবো?

স্পন্দন দায়সারা ভাবে একটা ভঙ্গি করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললো,

__আমি কি জানি চন্দ্র?

এরপর শিষ দিতে দিতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো। চন্দ্র এখনো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এরপর ধীরে ধীরে উঁকি দিয়ে দেখে নিলো কেউ আছে কিনা। কাউকে না দেখে যেইনা দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাবে ওমনি পেছন থেকে সিঁথি বললো,

__একি চন্দ্র আপু? তুমি ঐ চিলেকোঠার ঘরে কি করছিলা?আরে তোমার সারা গায়ে এভাবে হলুদ মাখানো কেনো?কে মাখিয়েছে?

__আ্ আমি সিঁথি।

__কেনো?

__স্‌ সখে।

বলেই এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়লো চন্দ্র।আর সিঁথি বিজ্ঞের মতো চোখ মুখ কুঁচকে ভাবতে লাগলো,

__এ নিশ্চিত কিছু লুকাচ্ছে।বের করতে হচ্ছে তো।
#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব__১২

ভালোয় ভালোয় হলুদ অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। চন্দ্রদের যে রুমে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেখানে বসে চুল শুকিয়ে নিচ্ছে।এই অবেলায় আবার গোসল করতে হয়েছে স্পন্দনের ঐ ভাবে হলুদ মাখানোর জন্য।মনে মনে খুব অভিমান হয়েছে স্পন্দনের উপর।তাই মুখ ফুলিয়ে বসে আছে চন্দ্র। হঠাৎ করেই দরজায় শব্দ হতেই তাকিয়ে দেখে ওর মা দাঁড়িয়ে। চন্দ্র সালাম দিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো।ওর মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

__এখনো রেগে থাকবি চন্দ্র?ক্ষমা করবি না তোর আব্বু আম্মু কে?

__তোমরা কোনো অপরাধ করো নি আম্মু।তাই ক্ষমা করা বা রেগে থাকার মতো কিছু হয়নি।যা হয়েছে তা আমার নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছি।এই নিয়ে আমার অভিমান থাকলেও অভিযোগ নেই কোনো আম্মু।

__ও বাড়িতে আর আসবি না চন্দ্র?

__আসবো না কেনো?সময় হোক। তারপর আসবো।

__আমি জানি আমরা তোর মতের বিরুদ্ধ গিয়ে তোকে এভাবে জোর করে বিয়ে দিয়ে উচিত করি নি। কিন্তু বিশ্বাস কর চন্দ্র,,,,,

__বিশ্বাস বলছো কেনো আম্মু? আমি তোমাদের মেয়ে। তোমাদের যেভাবে আমি চিনি তেমন করে তো আর বাইরের কেউ চিনতে পারবে না।তাই এভাবে বলো না আমাকে।

__আমরা ভীষণ নিরুপায় ছিলাম চন্দ্র।তোর দাদিমার একটাই কথা ছিলো যেনো বিয়েটা আমরা যেভাবে হোক দিয়ে দেই।

__একটা কথা বলবা আম্মু?

__বল কি বলবি চন্দ্র।

__দাদিমা আমার সাথে এমনটা কেনো করলো?

__আমি জানিনা আম্মা এটা কেনো করেছে।তবে আমরাও তোর কাছে সমান অপরাধী।পারলেই আমরা তোর দাদিমার কথা উপেক্ষা করতে পারতাম। কিন্তু তোর আব্বু চায়নি তার আম্মার মনে কষ্ট দিতে। আজীবন তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এসেছে।তাই আর পিছপা দিতে পারেনি।

__মায়ের কথা রাখতে গিয়ে মেয়ের মুখটাই ভুলে গেলো আব্বু?

__চন্দ্র? এভাবে বলিস না মা।

__চন্দ্র এখন আর কাউকে দায়ী করে না আম্মু। কারণ চন্দ্র একটা মেয়ে।তার কোনো অধিকার নেই নিজের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়ার। সেখানে দাঁড়িয়ে অন্যকে দোষারোপ করা চন্দ্রের সাজে না আম্মু।গত কয়েকদিন ধরে চন্দ্র যতটা আঘাত পেয়েছে তা যথেষ্ট তাকে শক্ত হয়ে থাকতে। তুমি আর আব্বু ও অভ্যস্ত হয়ে যাও তোমাদের মেয়ের এই পরিবর্তন দেখে।যত তাড়াতাড়ি তোমরা সত্যিটা মেনে নিবে তত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে তোমাদের মেয়ে কেমন ছিলো আর এখন কেমন আছে।

__কিন্তু চন্দ্র?

__অনেক সময় ধরে এখানে আছি আম্মু। আমাদের এবার বাইরে যাওয়া দরকার।

__এড়িয়ে যাচ্ছিস?

__কিছুটা।

__চন্দ্র?

__আসছি আম্মু।

চন্দ্র রুম থেকে বেরিয়ে সোজা চিলেকোঠার ঘরের দিকে হাঁটতে লাগলো। পেছনে না ফিরেও স্পষ্ট বুঝতে পারলো ওর আম্মু অশ্রুসিক্ত নয়নে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চন্দ্র চিলেকোঠার ঘরে পুরোনো আসবাবপত্রের পাশেই হাঁটু গেড়ে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।আর বিরবির করে বলতে লাগলো,

__আমাকে ক্ষমা করে দাও আম্মু। আমি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিনা। তোমরা এই বিয়েটা কেনো দিলে আম্মু?তোমরা চাইলেই দাদিমাকে বোঝাতে পারতে। চাইলেই আমার হাসিখুশি জীবনটাকে এভাবে এলোমেলো হতে বাঁচাতে পারতে।কেনো করলে না আম্মু?আর দাদিমা?যাকে আমি সবথেকে বেশি ভালোবাসি সেই মানুষটি আমাকে বিনা অস্ত্রেই ক্ষতবিক্ষত করে দিলো। কিভাবে করতে পারলো?তোমরা সবাই স্পন্দনের জীবন সাজাতে চাইলে চন্দ্রের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়ে।সবাই তার ভালো চাইলে, কিন্তু কেউ আমার ভালো চাইলে না।

চন্দ্র মাথায় কারো আলতো হাতের স্পর্শে মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে স্পন্দন শুষ্ক মুখে দাঁড়িয়ে আছে। খুব শান্ত ভাবে বললো,

__আমি যদি তোকে এই মুহূর্তে কোথাও নিয়ে যেতে চাই। তুই যাবি চন্দ্র?

চন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে স্পন্দনকে বললো,

__চলুন।

চন্দ্রের হাতটা ধরে স্পন্দন সবার চোখের আড়ালে বাইরে বেরিয়ে গেলো। গাড়িতে উঠে দু’জনেই চুপচাপ বসে আছে।গাড়ি ড্রাইভ করছে স্পন্দন। চন্দ্রের চোখ মুখ ফুলে আছে অসম্ভব ভাবে।বেশ অনেক সময় ধরে কেঁদেছে তাই হয়তো এমন লাগছে।কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে একটা পার্কের পাশেই গাড়িটা থামলো।স্পন্দন নিজে নেমে চন্দ্রকেও নামতে বললো। চন্দ্র চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো।একটা ছোট্ট লেখের পাশেই পার্কটা। খুব নিরিবিলি আর গাছপালা আছে সাড়ি সাড়ি। আশেপাশে বেঞ্চ ও আছে।তার একটার কাছে এগিয়ে গিয়ে স্পন্দন বসতে বললো চন্দ্রকে।নিজেও বসে পড়লো। এরপর আবার পিনপতন নীরবতা।সূর্য কিছুটা হেলে এসেছে। গোধূলির ঠিক কিছুটা আগে হবে বোধহয়। চন্দ্র চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলো।মনে মনে ভাবলো,

__এখানে কেনো আনলো স্পন্দন? আবার আমাকে মে’রে টেরে গুম করে দিবে না তো? অসম্ভব!স্পন্দধ এমন করতেই পারেনা। আবার মানুষের মন কখন কি হয় বলা যায় না।হয়তো দিতেও পারে।

এসব জল্পনা কল্পনার মধ্যে স্পন্দন বললো,

__আমি তোকে এখানে মে’রে টেরে রেখে যেতে পারি এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি কিছু বলার জন্য তোকে এখানে এনেছি। আমার জীবনের কিছু কথা তোর জানা দরকার চন্দ্র।

চন্দ্র কি সব উল্টাপাল্টা ভাবছিলো স্পন্দনকে নিয়ে তা আবার মনে করতে দাঁত দিয়ে জিভ কামরে ধরলো।স্পন্দন বললো,

__আমি তখন মাস্টর্স করছি। ছেলে বন্ধু থাকলেও মেয়ে বন্ধু ছিলো না বললেই চলে। স্বভাবতই আমি হৈচৈ আড্ডা এগুলো এড়িয়ে চলতে পছন্দ করতাম। নিজের মতো থাকতাম বেশিরভাগ সময়। একদিন বন্ধুগুলো অনেকটাই জোর করে অডিটোরিয়ামের কোনো একটা ফাংশানে নিয়ে যায়। সেখানে তখন স্টেজে একটা মেয়ের পারফরম্যান্স হচ্ছিলো।তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্পন্দন থমকে গেলো। মেয়েটির চোখে মুখে অদ্ভুত একটা স্নিগ্ধ হাসি লেগেই ছিলো।সেটাই স্পন্দনকে আকৃষ্ট করছিলো বারবার।ক্ষণে ক্ষণে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলো স্পন্দন। অনেকটাই বিমোহিত হয়ে পড়লো মেয়েটির উপরে।মেয়েটিই ছিলো হৃদি। এরপর অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় ওর সাথে পরিচয় করতে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এরপর তা ভালোবাসায় রূপ নেয়।

এটুকু বলেই স্পন্দন থেমে গেলো। চন্দ্রের বুকটা ভারী হয়ে আসছে। তবুও নিজেকে সামলে রেখেছে।স্পন্দন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আগের ন্যায় চুপচাপ বসে আছে। চন্দ্র বললো,

__হৃদি আপু কোথায় এখন স্পন্দন?

__জানিনা চন্দ্র।

__কেনো জানেন না?

__সে যে ঠিকানায় চলে গেছে সেখান থেকে তার খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি স্পন্দনের।

__কোথায় গেছে স্পন্দন?

স্পন্দন আবার নীরব। চন্দ্র আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললো,

__কি হয়েছে হৃদি আপুর?

__সেদিন আমাদের দেখা করার কথা ছিল।হৃদি ফোনে খুব কান্নাকাটি করছিলো।ওর বাড়ি থেকে আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছিলো।তারা রাজী ছিলোনা।তাই হৃদিকে বিয়ের জন্য প্রেসার দিচ্ছিলো। এদিকে আমি তখনও বেকার। চাকরি হয়নি। বাবার টাকায় চলছি। তবুও ওকে কথা দিয়েছিলাম যাই হয়ে যাক না কেনো আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরে রাখবো। কখনো ছেড়ে দিবো না তাকে।ও ভরসা করতো। কিন্তু বাবা ভাইয়ের চাপের জন্য প্রচন্ড ছটফট করতো। আমার সাথে দেখা করা কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলো।মাঝে মাঝে লুকিয়ে বাড়ির ফোন থেকে ফোন করতো। নিজের ফোনটা ওরা নিয়ে নেয়। আমি ও ছটফট করতে থাকতাম ওর একটা খবর নেওয়ার জন্য।একটু কথা বলার জন্য।ও ভীষণ কান্নাকাটি করতো ফোন করে।আমি অসহায় হয়ে শুধু দেখতাম।কিছুই করার ক্ষমতা ছিলো না তখন আমার।

__সেদিন দেখা করেছিলেন?

__নাহ্।ও আসেনি সেদিন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত অব্দি আমি এই বেঞ্চিতে বসে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা বাড়তে থাকে যত সময় গড়াতে থাকে ততই।ভয়ে বুক কাঁপতে লাগলো আমার।কি হয়েছে না হয়েছে এগুলো নিয়ে ভয়ংকর সব কথা মাথায় আসতে থাকে।

__এরপর কি হয়েছে?

__আমি এখনো সেই বেঞ্চিতে বসে লাস্ট দু’বছর ধরে অপেক্ষাই করছিলাম।যদি কখনো হৃদি ফিরে আসে তাই। কিন্তু আমার অপেক্ষার শেষ হয় যেদিন দাদিমাকে ওয়াদা করি তোকে বিয়ে করার জন্য। আমি দাদিমাকে কথা দেই তার বলা কথাটা আমি রাখবো।

__দাদিমাকে হৃদি আপুর কথা বলেননি কেনো?

স্পন্দন একটু হাসলো। তারপর বললো,

__বললে কি হতো চন্দ্র?

__আপনার আমাকে বিয়ে করতে হতো না। আপনার সাথে হৃদি আপুর বিয়ে হতো। আমি তখন আপনাদের মাঝে কাঁটা হয়ে আসতাম না স্পন্দন।

কিছুক্ষণ আবার শুনশান নীরবতা। চন্দ্র আবার বলে উঠলো,

__আপুকে খুব ভালোবাসেন। তাইনা স্পন্দন?

__হুম ভীষণ ভালোবাসতাম।

__এখনো ভালোবাসেন?

__এখন ভালোবাসি কি-না তা জানিনা।তবে তার স্মৃতি এখনো বুকের মধ্যে তাজা হয়ে রয়ে গেছে।

__ভালোবাসলে কি ভুলে যাওয়া যায়?

__না তা হয়তো যায় না। আমি ও পারিনি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে।তবে,,,,,,,

__তবে কি স্পন্দন?

#চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here