অন্তর দহন পর্ব-১৩+১৪

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব__১৩

স্পন্দন একটু চুপ করে থেকে বললো,

__এতোদিন ওর স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে ছিলাম চন্দ্র। কিন্তু যেদিন দাদিমা তোকে বিয়ে করতে বাধ্য করলো তার পর থেকে আমার জীবনটাও পাল্টে যেতে লাগলো। ধীরে ধীরে আমি যেনো আবার এলোমেলো ছন্নছাড়া জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলাম। খুব চেষ্টা করেছি নিজেকে ঐ স্মৃতিতে ডুবিয়ে রাখতে। কিন্তু একটা চঞ্চল মেয়ে সারাক্ষণই আমার হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে পাথর গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমাকে আবার সেই আমিতে আনতে চেষ্টা করছে। আমি আবার সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে যেখানে দু’বছর আগে আমার ভালোবাসার শুধু স্মৃতি ছিলো আমার কাছে। আমি এখন তোর মধ্যে হৃদির ছায়া খুঁজে পাই চন্দ্র। তুই আমার আসেপাশে থাকলে মনে হয় আমি যেনো ভালো থাকি। আমার ভালো থাকার জন্য হলেও তোকে আমার লাগবে চন্দ্র। আমাকে ভালোবাসার নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে হলেও তোকে আমার চাই চন্দ্র। চন্দ্র ছাড়া স্পন্দন কিচ্ছু না।তার কোনো অস্তিত্বই নেই আজ।তাইতো ভয়ে ভয়ে থাকি এই বুঝি আমাকে ছেড়ে চন্দ্র হারিয়ে যায়।এই বুঝি আমার সবটাই আবার ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। এবার তোকে হারিয়ে ফেললে স্পন্দন আর বাঁচতে পারবেনা।নিঃস্ব হয়ে যাবে চন্দ্র।

চন্দ্র স্পন্দনের হাতটা শক্ত করে ধরে বসলো। সাথে সাথে স্পন্দন বাচ্চাদের মতো চন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। চন্দ্র এবার কাঠ হয়ে বসে আছে। বুকের মধ্যে ভীষণ রকম তোলপাড় শুরু হয়েছে ওর।স্পন্দন কাউকে এতোটা ভালোবেসে কাছে পায়নি।অথচ কেমন করে এখনো তার মধ্যে হৃদির অস্তিত্ব খুঁজে চলেছে। শুধু একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য।

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে স্পন্দন।জড়ানো গলায় বললো,

__আমাকে ছেড়ে যাস না চন্দ্র। আমাকে ছেড়ে যাস না। আমি তোকে পেয়ে আবার বেঁচে থাকতে শিখেছি। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। আমাকে এভাবে আগলে রাখার জন্য হলেও আমার জীবনে থেকে যা চন্দ্র। আমি এবার তোকে হারিয়ে ফেললে আর আমাকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা।তোর মতো করে এভাবে আর কেউ আমাকে বুঝে না চন্দ্র।প্লিজ তুই আমাকে ছেড়ে যাস না।

চন্দ্র মুখে কিছুই বললো না।আস্তে আস্তে করে একটা হাত স্পন্দনের পিঠে দিয়ে স্পন্দনকে আরেকটু কাছে টেনে নিলো।ভাবতে লাগলো,

__এমন করে স্পন্দনকে ফেরাস না চন্দ্র।ওর এই অসহায় আবেদন উপেক্ষা করিস না তুই। নাইবা হলি তুই ওর প্রথম ভালোবাসা তবুও তো তোকে ভালোবেসে সে নতুন করে বাঁচতে চাইছে। এমন ভালোবাসার মানুষ কে পায়ে ঠেলে দিস না চন্দ্র। জীবনে এমন সুযোগ বারবার আসেনা রে।স্পন্দনের এই ভালোবাসা পাওয়ার লোভে হলেও তুই ওকে ফেরাস না আজ।

ঠিক কতটা সময় ধরে ওরা এভাবে বসে আছে তার হিসাব নেই।চারপাশটা অন্ধকার হতে শুরু করেছে।রোড লাইট গুলো জ্বলেছে বেশ কিছু সময় আগেই। চন্দ্র খেয়াল করলো স্পন্দন এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে। তবুও চন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে আছে স্পন্দন।এত সময় একবার ও চন্দ্র স্পন্দনকে থামায় নি। বহুদিন ধরে স্পন্দনের বুকে যে কষ্টের পাহাড় জমে ছিল সেখানে এখন শীতলতা দরকার। কাঁদলে স্পন্দনের মনটা হালকা হবে।তাই চন্দ্র চুপচাপ বসে আছে।স্পন্দনকে আরেকটু শান্ত হতে দেখে চন্দ্র বললো,

__স্পন্দন?

__হু হুম।

__বাড়িতে ফিরে চলেন স্পন্দন। অনেক সময় গড়িয়ে গেছে।সবাই হয়তো চিন্তা করছে। কাউকে কিছু বলেও আসিনি।

__হু হুম যাবো।তবে আগে বল তুই আমায় ছেড়ে,,,

কথা শেষ করতে না দিয়ে চন্দ্র বললো,

_কোথাও যাবো না স্পন্দন। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।এই যে হাতটা ধরেছি এটা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধরে থাকবে চন্দ্র।

স্পন্দন মাখা তুলে চন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু সময়। এরপর চন্দ্রের কপালে একটা ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দিয়েছে স্পন্দন। চন্দ্র চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।এতো সময় ধরে ওর হৃদয়ে যে তোলপাড় করা ঝড় উঠেছিলো সেটা এখন থেমে গেলো।

ওরা দুজন বাড়িতে পৌঁছাতেই শোরগোল পড়ে গেলো।সবাই এতো এতো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো স্পন্দন আর চন্দ্রকে।স্পন্দন এখনো চন্দ্রের হাতটা তেমন করে ধরে আছে। সবাইকে তাদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে অবশেষে রুমের দিকে যেতে পেরেছে দুজন। চন্দ্র ফ্রেশ হয়ে আসতে না আসতেই ওকে হির হির করে টেনে নিয়ে গেলো সবাই। মেহেদী পড়বে বলে এতো সময় ধরে সবাই অপেক্ষা করছে।স্পন্দন ফ্রেশ হয়ে এসে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানতে টানতে ভাবতে লাগলো,

__কি থেকে কি হয়ে গেলো। কোনোদিন যে হৃদিকে ছাড়া অন্য কাউকেও যে ভালোবাসতে পারবে এটা ভাবতেই পারিনি কখনো। কিন্তু এখন যাই হয়ে যাক না কেনো চন্দ্র শুধু আমার। আমার থেকে কেউ চন্দ্রকে কেড়ে নিয়ে যেতে পারবে না। আমি দিবো না।নাহ্ কিছুতেই না।যে করেই হোক চন্দ্রকে আগলে রাখবে স্পন্দন। দরকার হলে এই শহর এই বাড়ি এই আত্মীয় স্বজন সব কিছু ছেড়ে দিয়ে দূরে অনেক দূরে চলে যাবে চন্দ্রকে নিয়ে। তবুও চন্দ্রের কিছু হতে দেবো না।নাহ্ কিছুতেই নাহ্।

অনেক সময় হয়ে গেছে চন্দ্র গেছে।আসার আর নাম গন্ধ ও নেই।স্পন্দন এবার ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে লাগলো। অস্থির হয়ে উঠেছে ওর মন।আর থাকতে না পেরে ধুপধাপ পা ফেলে ছাদে গিয়ে হাজির হলো। গিয়ে দেখে চন্দ্র সবাইকে মেহেদী পড়িয়ে দিচ্ছে।স্পন্দনকে দেখেও চন্দ্রের কাজে কোনো বিরতি নেই।তা দেখে স্পন্দন বললো,

__তোদের কি আক্কেল টাক্কেল উড়ে গেছে নাকি?

মিতু বললো,

__কেনো ভাইয়া?

__আমার বউকে দিয়ে এভাবে কাজ করাতে তোদের খারাপ লাগছে না?

__খারাপ লাগবে কেনো? চন্দ্র খুব ভালো মেহেদী দিতে পারে।ওর মতো করে কেউই দিতে পারে না।তাই আমাদের সবাইকে মেহেদী পড়াতে হবে চন্দ্রের।

__মায়ের বাড়ির আবদার আর কি? আমার বউ এর আর খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই না?

__আরে ভাইয়া তুমি রাগ করছো কেনো?আর একটুখানি বাকি আছে। এরপর তোমার বউ তুমি যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারো।

__হয়েছে হয়েছে।এতো বকবক করতে হবে না। নিজেদের টা নিজেরাই দিয়ে নে। আমার ঘুম পাচ্ছে।

__তোমার ঘুম পাচ্ছে তুমি ঘুমাও না ভাইয়া। আমাদের জ্বালাতন করতে এসেছো কেনো?

__আমার ঘুম পাচ্ছে।আর ঘুম পেলে আমার বউ লাগবে।তাই বউ যেহেতু চন্দ্র তাই এখন আমার চন্দ্রকেই লাগবে।

কথাটা শুনেই চন্দ্রের কান গরম হয়ে গেলো।ছোট ছোট ভাই বোনদের সামনে এগুলো কি শুরু করেছে স্পন্দন। ভাবতেই লজ্জায় নুইয়ে পড়লো।স্পন্দন বললো,

__চন্দ্র ঘরে চল।

__আরে ও ঘরে যাবে কি ভাইয়া?ওর এখনো মেহেদী ই পড়া হয়নি।

__আর পড়তেও হবে না। অনেক হয়েছে তোদের এই মেহেদী পড়া।এতো সময় বউ ছাড়া থেকে তোদের কাজে হেল্প করেছি এটাই বেশির বেশি। আমার এখন বউ লাগবে মানে লাগবেই।তাতে তোদের মেহেদী পড়া হোক আর না হোক।

বলেই স্পন্দন কোনোদিকে না তাকিয়ে ফট করে চন্দ্রকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা দিলো।তা দেখে সবাই যেনো ৪৮০ ভোল্টে ঝটকা খাওয়ার মতো চোখমুখ করে তাকিয়ে পড়লো। সেদিকে স্পন্দন থোড়াই কেয়ার না করে চন্দ্রকে কোলে তুলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই ওর মায়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো। চন্দ্র তো লজ্জায় না পারছে মাটির নিচে ঢুকে যেতে।স্পন্দনের বুকের দিকে আরো চেপে মুখ লুকিয়ে নিলো।উনি চিন্তিত ভঙ্গিতে বিচলিত হয়ে বললো,

__চন্দ্র কি হয়েছে তোর?শরীর খারাপ করেছে? আমাকে বলিস নি কেনো স্পন্দন।দেখি কোথায় কি হয়েছে চন্দ্র।

চন্দ্র এবার আরো গুটিয়ে গেছে।স্পন্দন যে এমন কান্ড করবে তা ও ভাবতেই পারেনি।স্পন্দন এবার আবার বিরক্ত হয়ে বললো,

__আরে মা থামো তো।কিছু হয়নি ওর।

__তাহলে তোর কোলে উঠে আছে কেনো?

__ও কেনো কোলে উঠে থাকবে।ওতো আসতেই চাইনি তাই কোলে তুলে নিয়ে আসছি।

__আসতে চায়নি তো আনলি কেনো?

__আমার ঘুম পেয়েছে।

স্পন্দনের উত্তর শুনে উনি আরো অবাক হয়ে বললো,

__তোর ঘুম পেয়েছে তো চন্দ্রকে কোলে নিয়ে কি করছিস?যা ঘুমা।

__আমার বউ ছাড়া ঘুম আসে না।দেখি সরো তো।এ বাড়িতে আমার বউকে নিয়ে সবাই পড়ে আছে। আমার আর তার আশেপাশে থাকার সুযোগ ই নেই।আজব তো । তোদের বউ চাই থুরি জামাই চাই তো বিয়ে করে নে না। আমার বউ নিয়ে এতো কাজ করানোর কি আছে?

বলেই গটগট করে হেঁটে বেরিয়ে রুমে ঢুকে গেলো স্পন্দন।ওর মাও মনে হয় কারেন্টে ঝটকা খাওয়ার মতো চোখ মুখ করে তাকিয়ে আছে।তা দেখে ইরা বললো,

__কি হয়েছে ভাবী? এভাবে দাঁড়িয়ে কি দেখছো?

__দেখছি কি সেটা পরে।আগে একটা চিমটি দে তো ইরা।দেখি আমি স্বপ্ন দেখছি না জেগে আছি।

ইরা ও সাত পাঁচ না ভেবে একটা চিমটি বসিয়ে দিল।ওমনি উনি আহ্ করে লাফিয়ে উঠে বললো,

__আমি তো জেগেই আছি ইরা।তাহলে সব ঠিকঠাক দেখেছি বল।

__আরে কি দেখেছো তুমি ভাবী?

__কিছু না।সর তো? আম্মা কোথায়?

__নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন।

স্পন্দনের মা খুশিতে ডগমগ করতে করতে সেদিকেই ছুটলো।মাঝ খানে কি হয়েছে তার আগামাথা কিছু না বুঝতে পেরে হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে থাকলো ইরা।

#চলবে,,,,,,,

লেখার ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।লাইক কমেন্ট করে লেখিকাকে লেখায় উৎসাহিত করবেন।#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব__১৪

__হয়েছে তো স্পন্দন। এবার কোল থেকে নামিয়ে দিবেন দয়া করে।এতো সময় ধরে তো কম লোক হাসালেন না। এবার কি জনাবের মর্জি হবে কোল থেকে নামাতে?

__আমার বউ। আমি কোলে নিয়ে থাকবো না মাথায় নিয়ে নাচবো সেটা নিয়ে তুই কথা বলার কে চন্দ্র?

__আচ্ছা মসিবত তো। আচ্ছা আপনার হয়েছে টা কি বলেন তো?

স্প্দন আর কিছু না বলেই চন্দ্রকে কোলে নিয়েই টুপ করে বিছানায় গিয়ে বসলো। চন্দ্র এবার স্পন্দনের কপালে হাত রেখে বললো,

__কোথায় শরীরে তো জ্বর নেই। তাপমাত্রা তো ঠিকই আছে।

__তো আমি কখন বললাম যে আমার জ্বর আসছে।

__নাহ্।তা বলেন নি। কিন্তু আপনার হাবভাব দেখে আমার মনে হলো হয়তো জ্বর টর এসেছে।তাই আপনার মাথার স্ক্রু গুলো ঠিকমতো কাজ করছে না।

চন্দ্র এবার নাক এগিয়ে স্পন্দনের গায়ের থেকে ঘ্রাণ নিতে নিতে বললো,

__নেশা টেসাও তো করেন নি বলে মনে হচ্ছে।গায়ে তো কোনো নেশার ঘ্রাণ পাচ্ছিনা।

__আমি নেশায়ই ডুবেছি চন্দ্র।তবে এ নেশা সে নেশা নয় যেটা তুই ভাবছিস।

__আল্লাহ বলেন কি?এই জন্যই তো তখন থেকেই উল্টাপাল্টা কথা আর কাজ করছেন।চলেন ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিবেন স্পন্দন।

__তুই কিন্তু আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছিস চন্দ্র।

__আরে রেগে যাচ্ছেন কেনো? আমি তো শুধু বলছি আপনি যদি কিছু খেয়ে থাকেন? তাই আর কি?

__আমি কিছু খাইনি চন্দ্র।তবে তুই বললে খেতে পারি।

স্পন্দনের কথায় থতমত খেয়ে চন্দ্র তোতলাতে তোতলাতে বললো,

__ক্ কি খাবেন আপনি?

__চুমু।

চন্দ্রর আবার কান গরম হয়ে উঠলো।এই লোকটি আজকে আমাকে ইচ্ছা মতো লজ্জায় ফেলতেই উঠে পড়ে লেগেছে দেখছি। তারপর একটু পিছিয়ে স্পন্দনের থেকে দূরে বসে চন্দ্র বললো,

__দেখুন স্পন্দন।

__দেখা চন্দ্র।

__এমন উদ্ভট আচরণের কারণ কি স্পন্দন?জ্বীনে টিনে ধরেনি তো?

__ধরেছে কঠিন অসুখে ধরেছে।

__বলেন কি? তাহলে বাইরে চলেন।সবাইকে বলে একটা ডাক্তার আনা যায় কিনা দেখি।

স্পন্দন একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে চন্দ্রের কোলের উপর শুয়ে পড়ল। এরপর বললো,

__ডাক্তার আনতে হবে না। তুই পাশে থাকলে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।ঘুম পাচ্ছে। নড়াচড়া না করে ঘুমাতে দে চন্দ্র।

অগত্যা চন্দ্র বসে থেকে স্পন্দনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। এদিকে স্পন্দনের মা এসে উনার শ্বাশুড়ি আম্মাকে সালাম করে চোখ মুছতে মুছতে বললো,

__আম্মা আমার স্পন্দন ফিরে এসেছে।

__দাদুভাই কোথাও গিয়েছিলো বড় বৌমা?

__দু’বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আমার সেই স্পন্দন আবার ফিরে এসেছে আম্মা। আমার হাসিখুশি ছেলেটাকে এতো দিন পরে আবার সেই আগের মতোই স্বাভাবিক ভাবে দেখলাম আম্মা।

এরপর একটু আগে যা যা ঘটেছে সব খুলে বললেন স্পন্দনের মা।সব শুনে উনার শ্বাশুড়ি বললেন,

__আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো না বড় বৌমা। আমি জানতাম চন্দ্র দিভাই যা পারবে তা আর কেউ পারবেনা বৌমা।

__কিন্তু আম্মা চন্দ্র আমাদের উপর এখনো রেগে আছে যে।আমরা সবাই স্পন্দনের জীবন বাঁচাতে গিয়ে ওর সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি আম্মা।জানি এর জন্য চন্দ্র আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না আম্মা।

__জানি বড় বৌমা। কিন্তু সত্যিটা যখন চন্দ্র জানবে তখন এই রাগ অভিমান আর থাকবে না বৌমা। তুমি দেখে নিও।আসলে ওকে আমার সব কিছু খুলে বলা উচিত। কিন্তু ও আমার উপর যেভাবে অভিমান করে আছে তাতে এই মুহূর্তে এসব বললে ও বিশ্বাস করতে পারবেনা।সময় আসুক আমি নিজেই সব বলবো বড় বৌমা।

__হ্যাঁ আম্মা। আপনি যা বলবেন তাই হবে।

__আমি জানতাম আমার ভেঙে পড়া দাদুভাইয়ের মনটা যদি কেউ জোড়া লাগাতে পারে সেটা শুধু চন্দ্র দিভাই ই পারবে। তুমি আর এসব নিয়ে চিন্তা করো না বড় বৌমা।

__জ্বী আম্মা।

পরদিন সকালে কারো ধাক্কাধাক্কিতে চন্দ্রের ঘুম ভাঙলো। উঠে বসে দেখে সিঁথি। চারপাশে তাকিয়ে দেখে স্পন্দন নেই।চোখ ডলতে যাবে তখনই সিঁথি চন্দ্রের হাতটা ধরে বললো,

__চন্দ্র আপু?কি সুন্দর করে মেহেদী পড়েছো তুমি।কখন পড়লে?

চন্দ্র নিজেও অবাক। তবুও সিঁথিকে বুঝতে না দিয়ে বললো,

__রাতে পড়েছি সিঁথি।

__খুব সুন্দর হয়েছে আপু। এখন উঠে পড়ো। অনেক বেলা হয়ে গেছে।বড় মামানি তোমাকে ডাকতে পাঠিয়েছেন।কাল রাতে বুঝি ভাইয়া তোমাকে ঘুমাতে দেয়নি?

চন্দ্র ওর কানটা টেনে ধরে বললো,

__বেশি পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছিস সিঁথি।দিবো এক থা’প্পড়।

সিঁথি মুখ ফুলিয়ে পড়লো।তা দেখে চন্দ্র ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,

__তুই যা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

সিঁথি চলে যেতেই চন্দ্র হাতটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। আসলেই সুন্দর লাগছে দেখতে মেহেদী।ওর আর বুঝতে বাকি নেই যে এসব স্পন্দন করেছে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে। আবার ওকে বিছানায় ঠিক করে শুইয়ে ও দিয়েছে। এরপর ফ্রেশ হয়ে নিচে নামার সময় চন্দ্রের মনে হল মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।হয়তো কাল থেকে না খেয়ে থাকার জন্য হয়েছে। মেহেদী দিতে গিয়ে খাবার যে খায়নি সেটাই ভুলে গেছে ও। এখন এই কথা যদি স্পন্দন শুনতে পায় তাহলে বাড়ি মাথায় তুলে হাঙ্গামা খাড়া করে দিবে।তাই নিরার কাছে গিয়ে বসলো চন্দ্র।বললো,

__বাড়ির সবাই কোথায় রে নিরা?

__ছেলেরা বাজারে গেছে।আর বাবা বড় আব্বু মেজো আব্বু বাইরে ডেকোরেশনের ওদিকটা দেখছে।আর তোমার জ্ঞাতার্থে বলে রাখি ভাইয়াও বাজারে গেছে।যাবার আগে বড় আম্মুকে বলে গেছে তোমাকে যেনো দশটার আগে কেউ না ডাকে।আর এরপর উঠিয়ে খেতে দেয়।তো এবার তুমি খেয়ে এসো আপু। অনেক বেলা হয়ে গেছে যে।

__মিতু আপু কোথায় নিরা?

__ঘরেই আছে।ফুপির সাথে কথা বলছে।জানো তো সকাল থেকেই কান্নাকাটি করছে আপু।

চন্দ্র আর কিছু না বলে উঠে ডাইনিং এ গিয়ে বসলো।মাথার ভেতর ভীষণ খারাপ লাগছে।বসে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে। তবুও বড় আম্মুকে ডেকে বললো,

__বড় আম্মু? খাবার দাও।

__বস চন্দ্র।আমি খাইয়ে দেই।

মায়ের কথাটা আর ফেলতে পারলো না।তাই মায়ের হাতে খেতে লাগলো। চন্দ্রের যেমন চোখ ছলছল করছে তেমন ওর মায়ের ও করছে। আরেকজন রান্না ঘরের আড়ালে বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে আর হাসছে।সে আর কেউ নয়।স্পন্দনের মা। চন্দ্র যে ওর মায়ের সাথে ঠিকমতো কথা বলতে চায়না সেটার জন্য উনি নিজে না এসে এই সুযোগে চন্দ্রের মা’কে পাঠিয়েছেন। খাবার শেষের পথে। এমন সময় চন্দ্র বললো,

__আর দিও না আম্মু। কেমন বমি বমি পাচ্ছে।মাথাটাও ঘুরাচ্ছে।আর খাবো না।

__কি হয়েছে চন্দ্র?শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?

__তেমন কিছু না আম্মু।কাল রাতে খাওয়ার কথা মনে ছিল না।তাই হয়তো এমন লাগছে।

__আচ্ছা তুই তাহলে একটু শুয়ে রেস্ট নে।আমি একটু শরবত করে আনছি।

চন্দ্র মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই আবার কেমন ঘুরে উঠলো মাথাটা। সামনে আবছা আবছা দেখতে পেলো স্পন্দন মনে হয় দৌড়ে ওর দিকে আসছে। এরপর আর কিছুই মনে নেই।যখন জ্ঞান ফিরলো দেখে একটা হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে স্পন্দন।মুখটা শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে।চোখে মুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট।আরেক পাশে ওর বড় আম্মু মেঝো আম্মু ওর আম্মু ফুপা ফুপিরা দাঁড়িয়ে।ডাক্তার প্রেসার মাপতে ব্যস্ত। চন্দ্র নড়ে উঠতেই স্পন্দন দুই হাতে ওর হাতটা ধরে বললো,

__এখন কেমন লাগছে চন্দ্র?শরীর কি একটু ভালো লাগছে?

__তোমাদের বাপ ছেলের জন্য আজকে আমার মেয়ের এই অবস্থা।তোমরা ওকে এতো মানসিকভাবে বির্পযস্ত করে দিয়েছো যে মেয়েটা আমার মরতে বসেছে।

হঠাৎ করেই আব্বুর এসব কথা শুনে বুঝতে পারলো চন্দ্র নিশ্চিত এতো সময় ওর অসুস্থতার জন্য এমন আরো অনেক কথা বলাবলি হয়েছে।তাই স্পন্দনের চোখ মুখের এই অবস্থা। চন্দ্র খেয়াল করলো স্পন্দনের চোখ মুখ আরো পাংসুটে বর্ণের হয়ে আসছে।সাথে চোখে রাগের চিহ্ন। চন্দ্র স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললো,

__আমি ঠিক আছি স্পন্দন। বিশ্বাস করেন আমার কিছু হয়নি স্পন্দন।

স্পন্দন কিছু না বলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

__এসব কিছু নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না চন্দ্র।চোখ বন্ধ করে একটু শান্ত হয়ে থাক।আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

প্রায় সাথে সাথেই চন্দ্রের আব্বু আবার হু’ঙ্কার দিয়ে উঠলো। বললেন,

__এখন আর লোক দেখানো আদর সোহাগ দেখাতে হবে না তোমাকে স্পন্দন। শুধু আম্মার কথাতেই আমি এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম।না হলে আমার মেয়েকে সারাজীবন ঘরে বসিয়ে রাখলেও তোমার মতো ছেলের সাথে বিয়ে দিতাম না।আর ছেড়ে দেবো না। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে আজকেই আমার বাড়িতে যাবো। এভাবে তোমাদের কাছে ফেলে রাখলে মেয়েটা আমার এভাবেই মরে যাবে।তা আমি ওর আব্বু হয়ে কিছুতেই সহ্য করতে পারবোনা।

স্পন্দন সহ সেখানে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সামান্য একটা ঘটনা নিয়ে জল এতো দূরে গড়াবে সেটা বোধকরি কেউই ভাবতে পারেনি।

#চলবে,,,,,,,

আসসালামুয়ালাইকুম পাঠক পাঠিকারা। আমি কোনো বড় মাপের লেখিকা না।আর তা বলে নিজেকে দাবিও করি না।সখের বসেই লেখালেখিতে আসা। এখন এটাই আমার ধ্যান জ্ঞান হয়ে গেছে। আমি হয়তো সব সময় আপনাদের মন মতো লিখতে পারি না।তবে চেষ্টা করি।যে চেষ্টা করে তাকে সুযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করি। আশাকরি সবাই সবার উত্তর পেয়েছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here