#অন্তহীন💜
#পর্ব_২৯
#স্নিগ্ধা_আফরিন
গগনে বসবাস রত রজনীকান্ত বিভাসিত কিরণ ছড়িয়ে যাচ্ছে ধরিত্রীতে। চাকচিক্যে ভর পুর নগরীর আনাচে কানাচে। পূর্ণিমা তিথি যে।লক্ষ লক্ষ তারার মেলা বসেছে অম্বরে। মিটিমিটি জ্বলছে তারা। চাঁদের গা ঘেঁষে ও আছে তারারা। শূন্য গগন আজ যেন চাঁদ তারায় সেজেছে।রাত্রির প্রগাঢ় তিমির রুপ ঘুঁচে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে থালার মত চাঁদ। স্নিগ্ধময় রশ্নি এসে পড়েছে উঠোনের ডান দিকে।বা দিকে গাছ থাকায় সে দিক আঁধারে ছেয়ে আছে। সুন্দর একটা সময়ে রুমে বসে বিরক্ত হচ্ছিল চৈতি।জুনাইদার রান্না বান্না মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে সবাইকে নিয়ে উঠোনে পাটি বিছিয়ে বসলো। সাদিক কত করে বললো,”বনু চল আমরা সবাই ছাদে গিয়ে বসি।উঠানে ঠিক ভালো লাগছে না।”
কে শুনে কার কথা। চৈতি তো শুনবেই না। সবাইকে নিয়ে উঠোনে পাটি বিছিয়েই বসে গল্প করবে এবং চাঁদের আলোয় ঝাল ঝাল মুড়ি মাখা খাবে। চৈতির আবদারে সায় দিল সবাই। শুধু সাদিক বাদে। চৈতির এক রোখা জেদের কাছে জিম্মি হয়ে অবশেষে সাদিক নিজেও রাজি হয়ে যায়।
শুধু শুধু বসে থাকলে তো কোনো মজাই হবে না।তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয় গানের কলি খেলবে। জুনাইদা আর মিসেস ইয়াসমিন বসা থেকে উঠে যেতে যেতে বললেন,”তোরা খেল বাবা। আমরা এই সব গান টান পারি না। আমরা বরং রাতের রান্না টা শেষ করি।”
জুনাইদা আর মিসেস ইয়াসমিন কে বাঁধা দিলো না কেউ। সেখানে উপস্থিত ছিল শুধু, চৈতি,রুপা,সিফা, সজিব,সাদিক।তারা নিজেদের মধ্যে খেলা শুরু করতে যাবে এমন সময় বাড়ির গেট খোলার শব্দ পেয়ে সবার দৃষ্টি সে দিকে চলে যায়। প্রহন এসেছে। চৈতি কে দেখেই এক গাল হেসে এগিয়ে এলো প্রহন। নিচে মাটিতে বিছানো পাটির দিকে তাকিয়ে বললো,”কী করছো তোমরা এখানে?”
চৈতি কোলের উপর রাখা কুশন জড়িয়ে ধরে প্রহনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,”গানের কলি খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। খেলবেন আমাদের সাথে?”প্রহন কোনো উত্তর না দিয়ে চৈতির পাশের খালি জায়গায় বসে পড়লো। ছোট করে বললো,”শুরু করো।”
চৈতি মুচকি হেসে বোতল ঘুরায়। বোতলের মুখ যার দিকে যাবে সে আগে গান গাইবে এবং পরের বার যার দিকে যাবে তাকে প্রথম জনের গাওয়া গানের শেষ অক্ষর দিয়ে গাইতে হবে। খেলার নিয়ম মাফিক বোতলের মুখ গিয়ে থামলো সিফার দিকে।
সিফার উদ্দেশ্যে চৈতি বললো,”ছোট ভাবী তোমার দিকে থেমেছে আগে। তাহলে তো তুমি আগে গাইবে তাই না।শুরু করো।”
সবার সামনে গান গাইতে সিফার একটু লজ্জা করছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে গাইলো,”আমারো পরানো যাহা চায়।
তুমি তাই,তুমি তাই গো,,,
আমারো পরানো যাহা চায়।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই কিছু নাই গো,, আমারো পরানো যাহা চায়।”
থামলো সিফা।হাত তালি দিয়ে উঠলো সবাই।
সাদিক মুচকি হেসে বললো,”বাহ সুন্দর গেয়েছো তো সিফা।”স্বামীর প্রশংসা শুনে লাজুক হাসে সিফা। চৈতি ফের বোতল ঘুরায়।বোতলের মুখ গিয়ে থামে রুপার দিকে। রুপা আমতা আমতা করে বললো,”য় দিয়ে তো কোনো গান পারি না।”
চৈতি দ্বিমত করে বললো,”য় দিয়ে কেন?আ দিয়ে গাও।”
রুপা চৈতির কথা অনুযায়ী আ দিয়ে গাইলো,”আমাদের গল্প গুলো অল্প সময় ঘর পাতালো।
তারপর পথ হারালো তোমায় আমায় মিলে।
আগে যদি বুঝতো তারা মনের নদীর তল পাবে না, বেহায়া মুখ পুড়াতো অন্য কোথাও গিয়ে।”
“তোমার দুইজন একই। অদ্ভুত তো!শুরু করলা আ দিয়ে শেষ ও করলা য় দিয়ে।”চৈতির কথা শুনে হেসে ফেললো সবাই। রুপা ধীর কন্ঠে বললো,”এখন কোনো গানই মনে পড়ছে না।এমনিতেই সারাদিন এটা ওটা ঠিক মনে পড়ে।”
চৈতি আবারো বোতল ঘুরালো। এই বার থামলো প্রহন এর দিকে মুখ করে। চৈতি ওরেহএএ বলে উঠে। প্রহন দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে বলে,”শুধু শুধু এমন চিৎকার দেওয়ার কী আছে?”
চৈতি খুশিতে গদগদ করে বলে,”কত কিছু আছে জানেন আপনি? আপনার গান শুনতে পাবো। এই প্রথম আহা।”
প্রহন বিড়বিড় করে বললো,”কাকের গলার কা কা নামক গান শুনতে চাও বললেই পারতে। অনেক আগেই শুনাতাম।”
চৈতি চোখ পাকিয়ে ধমকের স্বরে বললো বললো,”এখন জলদি গান তো।সময় চলে যাচ্ছে।”
প্রহন চৈতির দিকে ফিরে বসলো।নেত্র পল্লব চৈতির মুখোশ্রীর দিকে তাক করে চেয়ে রইলো।কী অদ্ভুত মায়াময়ী লাগছে তার কিশোরী বউকে। চাঁদের মোহনীয় আলোয় আরো বেশি মোহনীয় লাগছে যেন। তার সামনে হাসি মুখে বসে থাকা প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে প্রেমাসক্ত প্রেমিক সুরালো গলায় গেয়ে উঠে,”Mere aakhon mein nazar teri hai..
Meri sham o seher teri hai.
To jo nehi toh main kahan..
Khil gai meri kismat
Paake teri yeh chaht
Hum pe meherbaan do jahan..
প্রহনের গানের এইটুকু শেষ হতেই চৈতি গেয়ে উঠে,
Shukran Allah wallahalam dulillah
অবাক হয়ে যায় সবাই। প্রহন হেসে ফেললে বাকিরাও খিলখিল করে হেসে উঠে। চৈতি লজ্জা পেয়ে যায়।
“খেলবো না আমি আর।”কথা টা বলে সেখান থেকে উঠে রুমে চলে যায় চৈতি।
প্রহন ও উঠতে গেলে রুপা বলে উঠে,”যান ননদাই সাহেব। আমার ননদিকে আরো কয়েক গুণ লজ্জায় ফেলতে যান।”রুপার কথা শুনে মুখে হাত দিয়ে হাসে সিফা।সাথে সজীব,সাদিক ও।
সেদিন রাতে এশার নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরেন রেদোয়ান চৌধুরী এবং সরদার সাহেব। দুপুর থেকেই শরীর টা খারাপ লাগছিল সরদার সাহেবের। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে শরীরের সব খারাপ লাগা হজম করছেন তিনি। বসার ঘরের সোফায় বসে বসে রেদোয়ান চৌধুরীর সঙ্গে টুকিটাকি কথা বলার মাঝখানে রেদোয়ান চৌধুরী বলে উঠলেন,”ভাই আপনি বই পড়েন তো?”
সরদার সাহেব কথা বলছিলেন প্রহন আর চৈতি কে নিয়ে।যে তাদের সম্পর্ক টা স্বাভাবিক হয়েছে কিনা সে বিষয়ে। তার মধ্যে হঠাৎ বইয়ের কথা বলায় কিঞ্চিত বিরক্ত হলেন সরদার সাহেব।কিয়ৎক্ষন রেদোয়ান চৌধুরীর মুখোশ্রীর দিকে চেয়ে থেকে বললেন,”বেয়াই সাহেব আমি আপনাকে অন্য কিছু জিজ্ঞেস করছিলাম।”
রেদোয়ান চৌধুরী নরেচরে বসে বললেন,”আসলে হলো কী,”রেদোয়ান চৌধুরীর কথা সম্পূর্ণ না করতেই মিসেস ইয়াসমিন বললেন,”আসলে,নকলে কিচ্ছু না। বিষয় টা হচ্ছে কী ভাই, আপনার ভাইয়ের এখন একটু বই পড়তে হবে। না হলে খাবার খাবে যে ঐ গুলো হজম হবে না।”
মিসেস ইয়াসমিন এর কথা শুনে মৃদু হাসলেন সরদার সাহেব। রেদোয়ান চৌধুরীর কাঁধে হাত রেখে বললেন,”যান ভাই। আপনি বরং বই পড়ুন।”
“এই বই গুলো আমার জীবন টা বরবাদ করে দিলো।”বিড় বিড় করতে করতে জুনাইদার কাছে চলে গেলেন মিসেস ইয়াসমিন। রেদোয়ান চৌধুরী ও সুযোগ পেয়েছেন বই পড়ার। সেই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য চলে গেলেন রুমে।আসার সময় যত গুলো বই নিয়ে এসেছেন সে গুলো পড়ে শেষ করতে হবে তো। না হলে যে বই গুলো তাকে দারুন লজ্জা দিবে।বই পড়ুয়া হয়ে বইয়ের দেওয়া লজ্জা সহ্য করা কষ্ট দায়ক বটে।
.
খাবার খেয়ে যে যার রুমে চলে গেছে। রুপা আর সিফা সব কিছু গুছিয়ে তারাও রুমে চলে গেল। লাইটের আলোয় আলোকিত হয়ে থাকা সরদার বাড়ী অল্প সময়ের মধ্যেই অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে জানান দিচ্ছে রাত্রি তখন ১২টা বেজে ৪৫ মিনিট।গ্রাম্য এলাকা। মধ্যে রাতে দূর থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে।এক দল কুকুর ও ডেকে উঠলো।ঝি ঝি পোকার ডাক। গভীর রাতে এই সব ডাকে ভয় পাবে না এমন মানুষ হাতে গোনা কয়েকজন। হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই ঘুম ভেঙ্গে যায় চৈতির। কুকুর শিয়ালের ডাক কানে যেতেই সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে দেখলো, প্রহন ঘুমিয়ে আছে।যাকে বলে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চৈতির ভীষণ জল তেষ্টা পেয়েছে। কিন্তু উঠে যেতেও সাহসে কুলাচ্ছে না। এই দিকে প্রহনের এমন সুন্দর ঘুম টাও ভাঙ্গতে মন চাইছে না।কী জ্বালা! এইদিকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, এমন হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, কোনো কিছু তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা।মাঝ রাতে ঘুম ভাঙলেই কেন সব ভূতুড়ে কাহিনী মাথায় আসে বুঝে না চৈতি। বাড়ির পেছনের বাঁশ ঝাড় থেকে হুতুম পেঁচার ডাক শুনে ভয়ে প্রহন কে পেছন থেকে খামচে ধরে। ঘুমের ঘোরেই প্রহন জিজ্ঞেস করলো,”কী হয়েছে চৈতি? ঘুমাচ্ছো না কেন?”
চৈতি আরেকটু জোরে ধরে বললো,”ভূত।”
ঘুমের মধ্যে হাসে প্রহন। চৈতির দিকে ফিরে চৈতি কে জড়িয়ে ধরে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,”ভূত বলতে কিছু হয় না বুঝছো। জ্বীন বলতে হয়। এখন ঘুমাও।”
চৈতি মনে মনে প্রহন কে বকা দিলো।বকতে বকতে বললো,”ভূতের ভয় দূর করতে গিয়ে আসল জ্বীনের ভয় এনে দিলো।খাটাশ একটা।”
#চলবে,,,#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩০
#স্নিগ্ধা_আফরিন
রজনীর অমা পুরোপুরি কাটেনি এখনো।মেদিনী মৃদু আভায় আলোকিত। হিমেল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে নিস্তব্ধ পরিবেশে। পূর্ব দিগন্তের অম্বর লালচে প্রভায় বিভাসিত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।তপ্ত আদিত্যের উদয় হবে জানান দিচ্ছে প্রকৃতি।গ্রাম্য এলাকা! খুব ভোরে জেগে উঠা পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত চার পাশ। দূরে কোথাও থেকে মোরগের ডাক ভেসে আসছে।স্পষ্ঠ শুনতে পেল চৈতি। ঘুমন্ত মানবের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে গলার কাছটায়। বেসামাল চুল গুলো বালিশের উপর এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। পুরুষালি শক্ত হস্তদ্বয়ের মধ্যে আবদ্ধ কিশোরীর কোমল দেহ। চৈতি নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমের মধ্যেই ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেললো প্রহন। বাঁধন আলগা করে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,”এত নড়াচড়া করছো কেন?”চৈতি শোয়া থেকে উঠে বসলো। খোলা চুল গুলো কে হাত খোঁপা করতে করতে বললো,”সকাল হলো যে। নামাজ পড়বেন না?”
প্রহন উত্তর দিলো না। প্রত্ত্যর না পেয়ে পাশ ফিরে তাকায় চৈতি। ঘুমিয়ে পড়েছে প্রহন। চৈতি বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। ভাঁজে ভাঁজে থাকা শাড়িটা কুঁচকে গেছে।টান টান করে শাড়ি ঠিক করে জানলা মেলে দিলো। জানলা খুলতেই হিম শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিলো চৈতির গা।পরম শান্তিতে নেত্র পল্লব বুজে ফেললো। বাইরে আবছা আলো বিরাজ মান। ফজরের নামাজের সময় এখনো শেষ হয়নি।একটু পরেই শেষ হয়ে যাবে। চৈতি আবারো প্রহনের কাছে এগিয়ে যায়। কাঁধে হাত রেখে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকে,”শুনছেন? উঠুন না। ফজরের নামাজ এর সময় পার হয়ে যাচ্ছে।”
প্রহন ঘুমের মধ্যেই উঠে বসে। চৈতি ওয়াস রুমে যেতে যেতে বলে,”তাড়াতাড়ি উঠে অযু করে আমার রুমেই নামাজ পড়ে নিন। মসজিদে যাওয়ার সময় নেই।”
দুই হাত দিয়ে চোখ কচলিয়ে দৃষ্টি পরিষ্কার করে। লম্বা হাই তুলে বালিশের পাশ থেকে মোবাইল নিয়ে সময় দেখে চট করে উঠে দাঁড়ায়। চৈতি দ্রুত অযু করে বের হতে বলে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। শহরের মতন কোনো গাড়ি দেখতে পেল না। শহরের হিজিবিজি, গাড়ির হর্নে, মানুষের কোলাহল নেই। উঁচু উঁচু অট্টালিকা ও নেই। বাইরে দৃষ্টি দিলেই শুধু সবুজ আর সবুজ। সুন্দর অনুভূতি।ওয়াস রুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে প্রকৃতির চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসে প্রহন। চৈতি কে পাশ কাটিয়ে দ্রুত ওয়াসরুমে চলে যায়। প্রহন অযু করে বের হতে হতে চৈতি নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। প্রহন বের হলে দুই জন এক সাথে নামাজ আদায় করে নেয়। ফজরের নামাজের মধ্যে দিয়ে সুন্দর একটা দিনের শুরু করে এক জোড়া দম্পতি।
সরদার সাহেব বেলকনিতে রাখা আরাম কেদারায় বসে চোখ বন্ধ করে তসবিহ পড়ছেন।রাতে ঠিকমতো ঘুমটা হয়নি তার।জুনাইদা বিছানা গুছিয়ে সরদার সাহেবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,”চা খাবেন?এক কাপ বানিয়ে এনে দিবো?”
সরদার সাহেব ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানালেন।
তা দেখে জুনাইদা বললেন,”আপনার তো চা ছাড়া সকাল শুরু করতেই ভালো লাগে না। তাহলে আজ!”কথা টা বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন জুনাইদা। হয়তো কিছু চিন্তা করার চেষ্টা করলেন। তার পর আবার বললেন,”আপনি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
সরদার সাহেব চোখ মেলে জুনাইদার দিকে তাকালেন। চিন্তিত তো তিনি সত্যি। কিন্তু তা জুনাইদা কে বলা যাবে না।দেখা যাবে সেই বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে করতে প্যাশার বাড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বে।কী দরকার?এত ঝামেলা পোহানোর। তার চেয়ে বরং এটাই ভালো নিজের চিন্তা নিজের কাছেই থাক।
সরদার সাহেব কথা না বাড়িয়ে বললেন,”চৈতিরা আজ চলে যাবে। সকাল ১০টায়। ওদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করো। আমার আজ চা লাগবে না।”
“সেকি কথা! মাত্র গতকাল আসলো মেয়েটা আর আজই চলে যাবে?এটা কেমন দেখায় বলুন তো।”
“দেখো জুনাইদা, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। আমরা চাইলেও ওকে আমাদের কাছে রাখতে পারবো না।আর তুমি তো জানোই রিফাতের কথা।ও যে গ্রামে আছে।”
সরদার সাহেবের শেষের কথা টুকু শুনে বুঝতে অসুবিধা হলো না জুনাইদার। এই নিয়েই যে তার স্বামী চিন্তিত। তিনি আর কী বলবেন?বাবা হয়ে মেয়ের ভালোটাই যে চান তা তো আর নতুন কিছু নয়।জুনাইদা চলে গেলেন।
মেয়ের পছন্দের নাস্তা বানাতে হবে যে। আবার কখন মেয়েকে নিজের হাতের বানানো খাবার খাওয়াতে পারবেন জানা নেই।
.
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৮টা। চৈতিদের বাড়ির কিছুটা সামনে রফিক মিয়ার টং এর দোকান। এলাকার মুরব্বিদের অনেকেই অবসরে সেখানে বসে চা, সিগারেট খান এবং ঠান্ডা দেন। কিন্তু আজ সকাল থেকেই সেই টং এর দোকান দখল করে রেখেছে রিফাতের ছ্যালারা। চৈতিদের বাড়ির আশেপাশে ও ঘুর ঘুর করছে কয়েক জন। রেদোয়ান চৌধুরী কে সাথে নিয়ে রফিক মিয়ার হাতের দারুন এক চা খেতে যেতে চেয়েছিলেন সরদার সাহেব। মাথা থেকে রিফাতের চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আবার আগের মত স্বাভাবিক হতে চেয়ে ও এক ঝাঁক চিন্তায় আটকে পড়লেন বাড়ির বাইরে এসে।
রফিক মিয়ার দোকানের বেঞ্চে বসে থাকা সেদিন কার সেই ছেলে টা যে রিফাতের হাতে থাপ্পড় খেয়েছিল মাঠে,নাইম বললো,”আসসালামুয়ালাইকুম চাচা। ভাইয়ের হবু শ্বশুর বলে সালাম দিলাম। ভাবী কে শ্বশুড় বাড়ি থেকে নিয়ে এসে ভালোই করছেন। ভাইয়ের একটা সুযোগ হলো।”
নাইমের কথা শুনে রাগ হচ্ছে সরদার সাহেবের। কিন্তু তিনি রাগারাগী করতে চান না।তাই তাদের পাশ কাটিয়ে চলে আসার সময়,পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,”ও হবু শ্বশুড় আব্বা। আপনার মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। হোক না বাসি তাতে কিচ্ছু হবে না।”
সরদার সাহেব পেছনে ফিরে দেখেন রিফাত দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখে মুখে শয়তানি হাসি ফুটিয়ে কোমরে হাত রেখে সরদার সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে সরদার সাহেবের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,”কী দিবেন না বিয়ে?”
সরদার সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,”তোর লজ্জা করে না? আমাকে এই কথা বলতে? আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তোর কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য আমি ওকে না চাইতেও বিয়ে দিয়েছি।”
ঠোঁট কামড়ে হাসে রিফাত।গাল ঘুরিয়ে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে বা গালে চুলকাতে চুলকাতে বলে,”তাহলে একদিনের জন্য আমাকে দিয়ে দিন।”
রিফাত মুখটা সরদার সাহেবের মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে,”খেয়ে ছেড়ে দিবো প্রমিস।”
ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পর পড়ে রিফাতের দুই গালে। সরদার সাহেব পায়ের জুতা খুলে হাতে নিয়ে রিফাত এর কাঁধে এক বারি দিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলেন,”কুত্তার বাচ্চা। তোর এত বড় সাহস আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে এতো বাজে কথা বলিস।তোরে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।”
রিফাতের চোখ থেকে আগুন বের হচ্ছে যেন।ক্রোদে চোখ লাল হয়ে আছে।এক দৃষ্টিতে সরদার সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট আবার হাসি। কাঁধের কাছের শার্টের উপর জুতার বারির ছাপ টা স্পষ্ঠ। সরদার সাহেবের কাছে এক পা এগিয়ে এসে বলে,”জেলের ভাত খাওয়ার অভ্যাস আমার আছে। কিন্তু আজকের এই দুই টা থাপ্পড় আর জুতার বাড়ি বারিটা খাইতে আমার একদম ভালা লাগে নাই।আর যা আমার ভালা লাগে না তা আমি উপড়ে ফালাই দি। আজকের কামডা আমনে ভালা করেন নাই সরদার। একদম ভালা করেন নাই।”
রিফাত রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে সেখান থেকে চলে গেল। সরদার সাহেব মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। চিৎকার করে কান্না করতে মন চাচ্ছে তার। কোন অভিশাপের কারনে রিফাতের মতো বাজে গুন্ডা একটা ছেলের চোখ পড়লো তার মেয়ের উপর। মাটিতে বসে চিৎকার করে আল্লাহ কে ডেকে কান্না করতে চাচ্ছেন তিনি। কিন্তু পারবেন না।কারন তিনি একজন পুরুষ। একজন বাবা, একজন স্বামী।আর একজন বাবা কে সব পরিস্থিতি তে শক্ত থাকতে হয়।এক জন পুরুষ হলে সবার সামনে চিৎকার করে কান্না করা যায় না।যতই কষ্ট হোক না কেন? তা একান্তই নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে হয়। চোখের পানি টা লুকাতে হয় লোক চক্ষুর আড়ালে। সরদার সাহেব কিছুটা বুঝতে পারছেন এর পরবর্তী সময়টা ভালো যাবে না। নিশ্চিন্তে কাটাতে পারবেন না। ঘুমাতে পারবেন না অনেক রাত। সরদার সাহেব হাঁটতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে চায়, রেদোয়ান চৌধুরী ধরে ফেলেন।অভয় দিয়ে বলেন,”কিচ্ছু করতে পারবে এই ছেলে। আপনি এত চিন্তা করিয়েন না ভাই। আল্লাহ ভরসা। খারাপ এর জয় কখনো হয়নি, হচ্ছে না আর ভবিষ্যতে ও হবে না। ইনশাআল্লাহ।”
সরদার সাহেব এর বাড়িতে খিলখিল করে হেসে, দৌড়ে বেড়াচ্ছে তার আদরের মেয়ে চৈতি। মায়ের সাথে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে যে চুলার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে শাড়ির আঁচলটা আদতেও আঁচ করতে পারছে না কিশোরী।
#চলবে,,,,