অন্তহীন পর্ব -২৭+২৮

#অন্তহীন💜
#পর্ব_২৭
#স্নিগ্ধা_আফরিন

রান্না ঘর থেকে জুনাইদার কন্ঠ‌ ভেসে আসছে। তিনি উচ্চ শব্দে চৈতি কে ডাকছেন। প্রহন কে রুমে রেখে চৈতি চলে যায় মায়ের কাছে। রুপা আর সিফা মিলে ডাইনিং টেবিলে নাস্তা সাজাচ্ছে। রুপা কে দেখে কেমন জানি অন্যরকম লাগছে চৈতির কাছে। মুচকি হাসিটা সরছেই না অধর থেকে।জুনাইদা চৈতি কে দেখে চৈতির উদ্দেশ্যে বললেন,”কীরে মা, তোর শ্বশুড় শ্বাশুড়ি কে ডেকে নিয়ে আয় নাস্তা করার জন্য। অনেক বেলা হয়ে গেছে। সাথে প্রহন কে ও ডেকে নিস।”
চৈতি কিছুক্ষণ মায়ের ঘর্মাক্ত শরীরের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল।আজ যেন মাকে আলাদা রকম সুন্দর লাগছে। হয়তো কখনো এমন করে তাকিয়ে থাকা হয়নি দেখে মায়ের ক্লান্ত মুখটার মায়া দেখা হয়নি। চৈতি
রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রুপা ভেতরে ঢুকে।পাশ কাটিয়ে যখন আসছিল চৈতি তখন বললো,”কী খবর ভাবি?এত খুশি খুশি লাগছে কেন?”
চৈতির কথা শুনে রুপা যেনো একটু লজ্জা পেল। চৈতি মৃদু হেসে চলে গেল মিসেস ইয়াসমিন এবং রেদোয়ান চৌধুরী কে ডাকতে।
জার্নি করে ক্লান্ত মিসেস ইয়াসমিন। বিছানার এক পাশে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন তিনি। রেদোয়ান চৌধুরী বসে বই পড়ছেন। গতকাল রাতে নতুন একটা উপন্যাস পড়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি।ব্যাগে করে সেই বইটা ও নিয়ে চলে এসেছেন। চৈতি দরজায় টোকা দিয়ে বললো,”আসবো বাবা?”
রেদোয়ান চৌধুরী বই থেকে চোখ সরিয়ে দরজার দিকে তাকালেন। চৈতি কে দেখে মুচকি হেসে বললেন,”আয় মা।”ততক্ষণে মিসেস ইয়াসমিন ও শোয়া থেকে উঠে বসেছেন। চৈতি রুমের ভেতর এসে বললো,”আম্মু তোমাদের নাস্তা করার জন্য ডাকতেছে।”রেদোয়ান চৌধুরী বইয়ের ভেতর চোখ রেখে উত্তর দিলেন,”এই পৃষ্ঠা শেষ করে যাচ্ছি।”
মিসেস ইয়াসমিন বিরক্ত হয়ে রেদোয়ান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন,”কোথাও যেয়ে ও কী তোমার শান্তি নাই? আমার জীবনটা তুমি শেষ করে দিলা। আমার শ্বশুড় যে কেন তোমার সাথে বইয়ের বিয়ে দিলো না। আমারে পুড়লা।‍”
রেদোয়ান চৌধুরী শুনেও শুনলেন না। মিসেস ইয়াসমিন রাগে গজগজ করে রুমে থেকে বেরিয়ে গেলেন। চৈতি হাসলো।”যলদি আসুন বাবা।”রেদোয়ান চৌধুরীর উদ্দেশ্যে কথাটা বলে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেল চৈতি।
প্রহন বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে মোবাইল টিপছিল। চৈতি কে ভেতরে ঢুকতে দেখে নড়ে চড়ে উঠলো। হাতের মোবাইল টা বিছানার উপর রেখে চৈতির উদ্দেশ্যে বললো,”ক্ষুধা লাগছে বউ। তোমাদের বাড়িতে কী খাইতে ও দিবে না নাকি?”
চৈতি ভ্রু কুঁচকে বললো,”আমাদের বাড়িতে খাবারের অভাব পড়ছে। আপাতত কোনো খাবার নাই। আপনি আজ না খেয়েই থাকেন।”

প্রহন অসহায় কন্ঠে বলে,”আমার সত্যি ক্ষিধা লাগছে তো।রাতে ও খাইনি তোমার জন্য।”

“আপনাকে খাইতে যাওয়ার জন্যেই ডাকতে আসছি আমি। আসুন।”প্রহন কে কথা টা বলেই চলে গেল চৈতি। পেছন পেছন প্রহন ও চলে গেল।
সরদার সাহেব নিজ হাতে মেয়ের শ্বশুড় বাড়ীর লোকজনদের জন্য বাজার করতে বেরিয়েছেন। জুনাইদা নিজের হাতে সবাই কে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। চৈতি কে খেতে বসার জন্য বললে সে বলে পরে খাবে। রুপার পাশে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিড় বিড় করে বলে,”সত্যি করে বলো তো কী হয়েছে বড় ভাবি। একটু বেশিই অন্যরকম উৎফুল্ল হয়ে আছো যেনো।”
রুপা এক পলক চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চোখের সামনে আসা চুল কানের পিছে গুঁজে দিয়ে বললো,”একটা সুখবর আছে ননদীনি।”
চৈতি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,”কী সুখবর ভাবি?”
রুপা লাজুক হেসে বললো,”আল্লাহর রহমতে তুমি ফুফু হতে যাচ্ছো।”
রুপার মুখে এমন কথা শুনে খুশিতে আল্লাহ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো চৈতি। রুপা জলদি করে চৈতির হাত জোরে চাপ দিয়ে ধরলো। চৈতি বিড়বিড় করে বললো,”সরি সরি একটু বেশিই খুশি হয়ে গিয়েছিলাম।”
এই দিকে চৈতির এমন চিৎকার শুনে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সবাই। প্রহন তো জিজ্ঞেস করেই ফেলেছে,”কী হয়েছে?”
চৈতি মিনমিনে গলায় বলে,”কিছু হয় নাই।”
_______________
রৌদ্রময় ঝলমলে মধ্যান্হ!
ভাসমান তুলোরাশিদের ধীর গতির চলন স্পষ্ঠ অম্বরে।
সরদার সাহেবের বাড়ির ভেতর থেকে দারুন সব রান্নার ঘ্রান ভেসে আসছে। বিয়ের পর এই প্রথম বার শ্বশুড় বাড়িতে এসেছে প্রহন। আয়োজনের কোনো রকম ক্রুটি রাখেননি সরদার সাহেব এবং জুনাইদা। সকাল থেকেই এক নাগাড়ে কাজ করে যাচ্ছেন জুনাইদা। হাঁটুর ব্যাথাটা বেড়েছে। কিন্তু তবুও নিজের হাতেই মেয়ের জামাই কে রেঁধে খাওয়ানোর জেদ চেপেছে যেনো। মিসেস ইয়াসমিন হাতে হাতে টুকিটাকি কাজ করে দিতে চাইলেও নারাজ তিনি।কড়া গলায় নিষেধ করে বলেন,”আপনি হলেন অতিথি বেয়ান। আপনি কাজ করবেন কেন?এটা একদম উচিত না। আপনি বসে থাকুন। আমি এবং আমার ছেলের বউয়েরা মিলে করছি তো।”
মিসেস ইয়াসমিন আর কিছু বলতে পারলেন না।
রেদোয়ান চৌধুরী সরদার সাহেবের সাথে গ্রামের পথে হাঁটতে বেরিয়েছেন এই ভরদুপুরে। অনেক বারন করার পর ও শুনেনি তারা।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছতে ব্যস্ত চৈতি।পরনে কালো রঙের জামদানী শাড়ি।আর হালকা গয়না। জুনাইদা কিনে রেখেছিল মেয়ের জন্য শাড়িটা। চৈতির হাতে দিয়ে বলেছেন,যেন দুপুরে গোসল করে শাড়ি টা পরে।শাড়িতে যে মেয়েকে দেখতে একটু বেশিই সুন্দর লাগেপ্রহন গোসল করছে। সেই কখন গোসল করতে ডুকেছে বের হবার নাম নেই। চৈতি বাথরুমের দরজায় কয়েক টা টোকা দিল।
ভেতর থেকে প্রহন দুষ্টুমি করে বলে উঠলো,”আরে বউ বুঝছি তো আমাকে ছেড়ে এক মুহুর্ত ও থাকতে পারো না। কষ্ট হয় তোমার জানি তো আমি।তাই বলে কি গোসল করতে ও দিবা না?”
এপাশ থেকে চৈতি অবাক হওয়া গলায় বলে,”অদ্ভুত তো! আমি আবার কখন আপনার জন্য এমন পাগল ছিলাম?যাই হোক জলদি বেরিয়ে আসুন তো।আর কয়েক মিনিট পরেই এক ঘন্টা হয়ে যাবে গোসল করতে ঢুকলেন যে।”

সরদার সাহেবের সামনে হঠাৎ কেউ একজন এসে পথ আটকে দাঁড়ায়। অগত্যা ব্যাক্তিকে এই সময় এখানে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি।
তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ টা বাঁকা হেসে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সরদার সাহেব ভ্রু কুঁচকে রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,”কী হচ্ছে কী রিফাত? তুমি আমার পথ আটকে দাড়িয়েছো কেন?”
রিফাত বাঁকা হেসে বললো,”হবু শ্বশুড় মশাই আমাকে ছেড়ে অন্য কারো সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দেয়ার মাশুল কিন্তু গুনতে হবে আপনাকে।”
সরদার সাহেব বিরক্ত মাখা গলায় বললেন,”হবু শ্বশুড় মশাই মানে কি? এই সব কোন ধরনের অভদ্রতা?”
রিফাত কোমরে দুহাত রেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।হাসতে হাসতে বলে,”আপনার বর্তমান মেয়ের জামাই কে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়ে চৈতি কে আমার করে নিবো। আপনি শুধু দেখতেই পারবেন কিচ্ছু করতে পারবেন না।”
রিফাতের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেলেন সরদার সাহেব। এই রিফাতের নামে অনেক খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছে। সব কিছু জানা আছে তার। কিন্তু তাই বলে ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা রিফাত কে বুঝতে দিলে চলবে না। তিনি কঠোর গলায় বললেন,”আমার মেয়ের জামাই এর দিকে চোখ তুলে তাকালেও চোখ তুলে ফেলবো তোর। শুধু মাত্র তোর জন্য আমার মেয়েকে এত জলদি বিয়ে দিয়েছি আমি। তুই যদি এখন ওদের কোনো ক্ষতি করতে চাস তাহলে এই আসমান জমিন কে স্বাক্ষি রেখে বলছি তোকে আমি নিজের হাতে কুকুরের মতো মারবো। একদম দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়ে দরকার হলে নিজে জেল খাটবো।”

সরদার সাহেব এর কথা শুনে হো হো করে হাসতে রিফাত। সরদার সাহেব যেনো তাকে কোনো চমৎকার হাসির জোকস শুনিয়েছে। রেদোয়ান চৌধুরী এমন ভিলেন শুধু গল্পেই পড়েছেন। বাস্তবে দেখেননি।আজ বাস্তবে দেখে খুশি হবেন না কষ্ট পাবেন বুঝতে পারছেন না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিফাত এবং সরদার সাহেব এর দিকে তাকিয়ে আছে এবং কথা গুলো মনো যোগ দিয়ে শুনছেন।আচমকা হাসি বন্ধ করে সরদার সাহেবের দিকে এগিয়ে যায় রিফাত। সরদার সাহেব এর চোখে চোখ রেখে, দাঁতে দাঁত চেপে ধীর গলায় বলে,”মেয়ের জামাই এর আগে দেখছি মেয়ের বাপকেই দুনিয়া থেকে সরাতে হবে।”
#অন্তহীন💜
#পর্ব_২৮
#স্নিগ্ধা_আফরিন

দুপুরে খাবার খেয়ে একটা ভাত ঘুম দেওয়ার জন্য রুমে যাওয়ার সময় চৈতির নেত্র পল্লব আবদ্ধ হলো সোফায় বিষন্ন মনে বসে থাকা সরদার সাহেবের উপর। তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। কিছু একটা নিয়ে গভীর চিন্তায় বিভোর হয়ে আছেন তিনি।
বাবাকে এমন চিন্তিত দেখে চৈতি তার কাছে এগিয়ে গেল। বাবার পাশে নিঃশব্দে বসে ডাক দিলো,”আব্বু”
সরদার সাহেব তাকালেন না। তিনি চিন্তায় এতটাই মগ্ন ছিলেন যে চৈতির ডাক তার কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছায়নি। চৈতি বাবার কাঁধে হাত রাখতেই চমকে উঠেন সরদার সাহেব। চকিতে পেছন ফিরে চৈতি কে দেখে জোর পূর্বক হাসার চেষ্টা করেন। চৈতি সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সরদার সাহেবের মুখের দিকে।
সরদার সাহেব ঠোঁটে কোনো রকম হাসি ফুটিয়ে বললেন,”আম্মা কিছু বলবি?”
সরদার সাহেবের প্রশ্ন শুনে চৈতি বলে উঠলো,”কী নিয়ে এত চিন্তা করছো আব্বু?”
সরদার সাহেব স্বযত্নে মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,”কিচ্ছু নিয়ে না আম্মা।যা তুই রুমে গিয়ে একটা ঘুম দে।”
সরদার সাহেব যে মিথ্যা বললেন তা বুঝতে অসুবিধা হলো না চৈতির।বাবা যখন এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন বিষয়টা তখন তা নিয়ে বেশি প্রশ্ন করাটা উচিত হবে না।এতে হয়তো বাবা রেগে যেতে পারেন। চৈতি এক পলক বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে রুমে চলে গেল। মেয়ের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সরদার সাহেব।সব কথা চাইলে বলা যায় না। একটা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা থাকে। বলেই সব কিছু উলোটা পালোট হয়ে যাবে।
রিফাত কে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তিত সরদার সাহেব। রিফাত যে বাড়িতেই আছে তা জানতেন না তিনি।দোকানে বসে শুনে ছিলেন কেউ একজন বলছিল যে রিফাত শহরের বাইরে গেছে।তাই তো তিনি এতো তাড়া দিয়ে মেয়ের শ্বশুড় বাড়ীতে দাওয়াত দিলেন।

খালি গায়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে প্রহন। চৈতি রুমের ভেতর প্রবেশ করতেই চোখ পড়লো প্রহনের অনাবৃত পিঠে।সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিল চৈতি। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে গায়ের উপর পাতলা একটা নকশিকাঁথা টেনে দিল।
প্রহন মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করা অবস্থায় বললো,”তোমারই তো সম্পদ দেখতেই পারো।”

“উফফফ দিন দিন বড্ড অসভ্য হয়ে উঠছেন তো আপনি।”বিরক্ত মাখা কন্ঠে বললো চৈতি।

প্রহন শোয়া থেকে উঠে চৈতির দিকে তাকিয়ে শয়তানি হেসে বললো,”অসভ্য আমি তাই না?কী অসভ্যতামি করেছি বলো।যদি বলতে না পারো তাহলে আজ তোমাকে অসভ্যতামি কী করে বুঝাবো।”

চৈতি শুকনো ঢোক গিললো। আমতা আমতা করে বললো,”আপনি তো এখনি বললেন,”

প্রহন ভ্রু নাচিয়ে বললো,”কী বলেছি?”

“একটু আগেই তো বললেন,”

“হুম কী বলেছি ওটা বলো।”

“আমার সম্পদ”

“কী তোমার সম্পদ?”

চোখ মুখ খিঁচে ফেললো চৈতি। দ্রুত বললো,”আপনি আমার সম্পদ।”
প্রহন হেসে ফেললো। হেসে হেসে বললো,”যাক শিকার তো করলে যে আমি তোমার সম্পদ।”
প্রহনের কথা শুনে তাজ্জব বনে গেল চৈতি। অবাক চোখে প্রহনের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”আপনি সত্যিই একটা বদ লোক।”
প্রহন বিছানা থেকে নেমে চৈতির দিকে এক পা এক পা করে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,”আমি বদ লোক তাই না? এই বদ লোকের বদ কাজ গুলো দেখবা না বউ?অবশ্য তুমি দেখতে না চাইলে ও এখন দেখতে হবে।”
চৈতি এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে যেতে কাঁপা গলায় বললো,”মানে?”
প্রহন চট করে চৈতির ডান হাত ধরে টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে এসে কোমর জড়িয়ে ধরে বললো,”মানে বুঝাচ্ছি।”

হঠাৎ বাইরে থেকে চিৎকারের শব্দ ভেসে এলো। প্রহন চৈতি কে ছেড়ে দিয়ে বললো,”তোমার ভাবির চিৎকার শোনা গেল না?”
“হুম দেখছি”বলে চৈতি জলদি করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বিছানার উপর থেকে টিশার্ট টা গায়ে দিয়ে প্রহন ও ছুটলো চৈতির পিছনে পিছনে।
রুপা ফ্লোরে পড়ে দুই হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে কান্না করছে। রুপার এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যায় চৈতি। ছুটে যায় রুপার কাছে। রুপা কে জড়িয়ে ধরে উঠে বসায় চৈতি। রুপা অসহায় দৃষ্টিতে চৈতির দিকে তাকিয়ে কাতর কন্ঠে বলে,”আমার বাচ্চা চৈতি। আমার বাচ্চা।”
বাড়ির সবাই ততক্ষণে এসে হাজির হয়েছে ড্রইং রুমে। রুপার মুখে বাচ্চার কথা শুনে থমকে যায় সজিব।সে বাবা হতে যাচ্ছে অথচ সে নিজেই জানে না। বাড়ির সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুনাইদা আর সিফা গিয়ে ধরলো রুপা কে। রুপা অসহায় কন্ঠে জুনাইদার দিকে তাকিয়ে বললো,”আম্মা আমার বাচ্চার কিছু হবে না তো?”কথাটা বলেই রিতীমত কেঁদে দিল। বাড়িতে নতুন সদস্য আসছে সেই আনন্দে সবাই আনন্দিত হবে নাকি এই অঘটনে সবাই শোক প্রকাশ করবে বোধগম্য নয় কারো।
জুনাইদা রুপার মাথায় তেল পানি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন”কী করে পড়েছিস মা?”

“সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় পিছলে পড়ে গেছি।”

“শুকনো জায়গায় পিছলে পড়ে কেউ?”
সজিবরে দিকে তাকিয়ে সরদার সাহেব বললেন,”সজিব রুপা কে এখনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা। বেশি ক্ষতি যেন না হয় আবার।”
সজিব সম্মতি জানিয়ে রুমে চলে যায় শার্ট আর টাকা নিতে। কিছুক্ষণ পর এসে রুপা কে নিয়ে হসপিটালে চলে যায়। মিসেস ইয়াসমিন গিয়ে জুনাইদার পাশে বসলেন।জুনাইদার কাঁধে হাত রেখে অভয় দিয়ে বললেন,”চিন্তা করবেন না আপা। হয়তো রুপা আজ জানতে পারছে সে কনসিভ করেছে তাই আপনাদের জানায়নি। এখন কিচ্ছু হবে না। আল্লাহ ভরসা।”
জুনাইদা মাথা নেড়ে বললেন,”মেয়েটা অনেক ভয় পেয়ে গেছে। কিছু না হলেই ভালো। আমাদের প্রথম নাতি বা নাতনি।”
_______
পড়ন্ত বিকেল!
অম্বর যখন মেহেদী রাঙ্গা রঙিন রঙে ছেয়ে যাচ্ছে প্রহন তখন চৈতি কে নিয়ে বাড়ির পেছনের বড় মাঠটায় হাঁটছে। চৈতি আজ ও শাড়ি পড়েছে।নিজে নিজে শিখে গেছে যে। হলুদ রঙের শাড়িটায় বেশ মানিয়েছে।জুনাইদার কিনে রাখা শাড়ি। চৈতি দের এলাকাটা ঘুরে দেখা হয়নি প্রহনের।অবশ্য হবেই বা কী করে? বিয়ের পর এই প্রথম শ্বশুর বাড়িতে এসে বেড়াচ্ছে সে।
মাঠের এক পাশেই ক্রিকেট খেলছিলো রিফাতের দলের কিছু ছেলে। চৈতি কে দেখে তাদের মধ্যে কার কেউ একজন রিফাত কে ফোন করে মাঠে ডাকে। রিফাত সেই সময় ঘুমিয়ে ছিল। চৈতির কথা শুনতেই সব ঘুম এক পাশে রেখে গায়ে শার্ট জড়িয়ে ছুটে যায় মাঠের দিকে। কিন্তু হায়!
মাঠে গিয়ে চৈতি কে দেখতে পেলো না সে।যে তাকে ফোন করে ডেকেছিলো তার গালে ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পর মেরে রাগে গজগজ করতে থাকে রিফাত। মাঠে ক্রিকেট খেলার ছেলে গুলো কে বেশ ভালো করেই চিনতো চৈতি।তাই তো প্রহন কে নিয়ে জলদি করে ছেলে গুলোর চোখের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে বড় একটা গাছের পেছনে।
রিফাত চলে গেলে চৈতি প্রহন কে নিয়ে জলদি করে বাড়িতে ফিরে যায়।
প্রহন বুঝলো না চৈতির এমন তাড়াহুড়ো করার ব্যাপারটা।
বাড়িতে এসে দেখলো সজিব রুপা কে নিয়ে ফিরেছে। রুপার মুখ মলিন। কেমন চুপসে আছে মুখখানি। হয়ত শরীরের ব্যাথায়। সজিব কে দেখে জুনাইদা জিজ্ঞেস করলেন,”ডাক্তার কী বলেছে আব্বা? বেশি কিছু হয়নি তো?”
সজিব মাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ছমুচকি হেসে বললো,”চিন্তা করো না মা।সব কিছু ঠিক আছে। শুধু রুপা একটু বেশিই কোমরে ব্যাথা পেয়েছে।”
তীব্র ব্যথায় দম বন্ধ হয়ে আসা রুপার মন ও খুশিতে ভরে আছে যে তার অনাগত সন্তানের কোনো ক্ষতি হবে না হয়তো ভবিষ্যতে। কিন্তু এর নিশ্চয়তা এক মাত্র মহান সৃষ্টিকর্তাই দিতে পারবেন।

বসুন্ধরা সবে নিশিথীনির মৃদু আঁধারে আচ্ছাদিত হচ্ছে।সাঝঁ বেলা। মসজিদের মাইক থেকে ভেসে আসছে নামাজের আহবানের সুর। সরদার সাহেব আর রেদোয়ান চৌধুরী চলে গেছেন মসজিদে। প্রহন যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু ঘড়িটা কোথায় রেখেছে মনে নেই। গলার স্বর উঁচু করে চৈতি কে ডাক দিলো।
“চৈতি,শুনছো? একটু এদিকে আসো তো। আমার ঘড়িটা খুঁজে পাচ্ছি না।”
রুপার রুমে ছিলো চৈতি। প্রহনের এমন ডাক শুনে রুপা দুষ্টু হেসে বললো,”আমার ননদাই দেখছি ননদিকে চোখে হারাচ্ছে।”
চৈতি প্রত্ত্যরে বললো,”আরে না ভাবি।ঘড়ি খুঁজে পাচ্ছে না তাই ডাকছে।আর পাবেই বা কী করে আমি নিজেই তো ড্রয়রে রেখেছি।”
“বুঝি,বুঝি সব বুঝি। বিয়ে টা তোমার আগে আমার হয়েছে তো। এখন যাও দেখো কেন ডাকছে।”
চৈতি রুপার রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল নিজের রুমে।রুমে এসে দেখলো, প্রহন বিছানায় বসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চৈতি কে দেখে প্রহন বললো,”ঘড়িটা পাচ্ছি না।একটু খুঁজে দাও তো।”
চৈতি কিছু না বলে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ঘড়ি বের করে প্রহনের দিকে বাড়িয়ে দিল।
প্রহন মুচকি হেসে চৈতির হাত থেকে ঘড়িটা নিয়ে হাতে পড়তে পড়তে বললো,”তুমি নিজেই রেখেছো তাহলে। আচ্ছা আমি নামাজ পড়ে আসি।”
বলে রুম থেকে বেরিয়ে যাবার সময় থামলো প্রহন। চৈতির দিকে এগিয়ে গিয়ে চৈতির কপালে আলতো করে অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলে,”নবির সুন্নাত পালন করছি।আসি।”
চলে যায় প্রহন। মৃদু হাসে চৈতি। ভালোবাসার চাদরে জড়িয়ে রাখার মতো একটা মানুষ না চাইতে ও পেয়ে গেছে সে।আর কী লাগে?

#চলবে,,,,
#চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here