অন্তহীন পর্ব -৩৫+৩৬

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩৫
#স্নিগ্ধা_আফরিন

প্রভাতের বিশুদ্ধ হাওয়ায় হেলেদুলে পড়ছে গাছের পাতা।শীতল বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছেন মিসেস ইয়াসমিন।চোখ দুটো ফুলে আছে।লাল ও কিছু টা।রাতে ঘুম হয়নি তার উপর কান্না করেছেন সারা রাত। পূর্ব দিগন্তে আদিত্য কে এখনো দেখা যাচ্ছে না।ভোরের আলো ফুটেছে কিছুক্ষণ আগে।
হসপিটালের করিডোরে পাইচারী করছে প্রহন। রাতের শেষ দিকে চোখ লেগে এসেছিল। ঘন্টা খানেক পর তন্দ্রা ভাব কেটে গেল।
রেদোয়ান চৌধুরীর জ্ঞান ফিরেছে কিনা জানতে পারছে না।
সারা রাতে চৈতির কিছুটা ঘুম হয়েছে আবার ভেঙ্গেছে।
এত অশান্তির মধ্যে শান্তির ঘুম ঘুমানো যায় না।
শোয়া থেকে উঠে মা কে খুঁজতে লাগলো চৈতি। কিন্তু পুরো রুমে সে একা।
নামাজ পড়তে উঠে গেছে মনে করে সে আর খুঁজলো না। উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজের প্রস্তুতি নিতে চলে গেল।

“এত সকালে ছাদে কি করছেন আপা?”
কারো গলা শুনে চমকে পিছনে তাকান মিসেস ইয়াসমিন।জুইনাদা দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,”নামাজ পড়েই এলাম কিছুক্ষণ আগে।। ভালো লাগ ছিল না।”
মিসেস ইয়াসমিন এর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছেন জুনাইদা। কথা না বাড়িয়ে বললো,”নাস্তা তো বানাতে হবে। আপনি যদি আমাকে জিনিস গুলো দেখিয়ে দিতেন সুবিধা হতো আর কি।”
“সে কি আপনি কেন নাস্তা বানাবেন আমি যাচ্ছি বানিয়ে নিবো।”
জুনাইদা কাপট রাগ দেখিয়ে বললেন,”হয়েছে আপনাকে বানাতে হবে না আজ। আমি জানি আপনার মনে শান্তি নেই।তার পর ও আপনাকে কাজ করতে দিতে পারি না।”
মিসেস ইয়াসমিন মৃদু হাসলেন। অনেক গুলো বছর পর কেউ তাকে বুঝলো।একটু হলেও বুঝলো।
মিসেস ইয়াসমিন কে সাথে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেল জুনাইদা। রান্না ঘরে এসে দেখেন চৈতি চায়ের পানি বসিয়েছে। বিয়ের পর এই প্রথম নিজের হাতে কিছু বানাতে রান্না ঘরে এসেছে।এই অসময়ে কিছু না করা টা কে বিবেকে সায় দিচ্ছে না।তাই তো নামাজ পড়ে এক মিনিট ও দেরি না করে রান্না ঘরে চলে এলো।
চৈতি কে কাজ করতে দেখে মনে মনে খুশি হলেন জুনাইদা। মেয়ে বুঝতে শিখেছে পরিস্থিতি।বড় হয়ে গেছে যে।
.
রেদোয়ান চৌধুরীর জ্ঞান ফিরেছে। বাবার ডান হাতটা ধরে বেডের পাশে বসে আছে প্রহন।চিত্ত জুড়ে বয়ে যাচ্ছে খুশির দমকা হাওয়া। আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করে মাকে জানিয়ে দিলো।বাবা আগের চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ আছে।
মিসেস ইয়াসমিন এর বুকের উপর থেকে যেন বড় কোনো পাথর সরে গেল। আল্লাহ তার কথা শুনেছে দেখে এক বেলা এতিম শিশুদের খাওয়ানোর নিয়ত করলেন তিনি। রেদোয়ান চৌধুরী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে তাকে নিয়ে এক সাথে এতিম শিশুদের খাবার পরিবেশন করবেন। বুকের ভেতর যে অশান্তি টা ছিল তা চলে গেছে প্রহনের কথা শুনে।
আজ আবার চৈতির পরীক্ষা আছে।ঘড়িতে তখন সময় সকাল আটটা। মিসেস ইয়াসমিন চৈতিকে জোর করে খাইয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিলেন।যেতে না চাইলেও শুনলেন না মিসেস ইয়াসমিন। চৈতি কে স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়ার পর সরদার সাহেব,জুনাইদা আর সজীব সাদিক এর সাথে হাসপাতালে চলে গেলেন রেদোয়ান চৌধুরীর সাথে দেখা করতে। লোকটাকে তিনি আচ্ছা মতন বকে দিবে বলে মনে মনে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন মিসেস ইয়াসমিন।সব কিছুতেই মানুষটার বাড়া বাড়ি। বুকের ব্যথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল তা যদি একটা বার বলতো তাহলে আজ এই ভয়াবহ দিন দেখতে হতো না। গতকাল রাত থেকে সকাল পর্যন্ত যে কীসের উপর বেঁচে ছিলেন তিনি তা শুধু মহান সৃষ্টিকর্তা আর মিসেস ইয়াসমিন জানেন।
.
“আমাকে তুমি কেন বললে না আব্বু যে তোমার শরীর প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেছে।মাকে ও তো বলতে পারতে তোমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তুমি জানো তোমার এই অবস্থা দেখে আমি নিজেই ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছিলাম।”
রেদোয়ান চৌধুরী কোনো সাড়া দিলেন না প্রহনের কথায়।ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন শুধু।পাশ থেকে ডাক্তার বলে উঠলেন,”পেশেন্ট কে দিয়ে এখন কোনো কথা বলানোর চেষ্টা না করাই উচিত।সবে তো জ্ঞান ফিরেছে। কিছুক্ষণ সময় যাক।নিজে থেকেই কথা বলবে। আপনি বরং সকালের নাস্তা টা করে আসুন।আর পেশেন্ট এর জন্য কিছু ফল নিয়ে আসুন।”
ডাক্তারের কথায় সায় দেয় প্রহন।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এক পলক বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।

রেদোয়ান চৌধুরী কে দেখে মুচকি হাসলেন মিসেস ইয়াসমিন। তার মানুষ টা এখন ও তার কাছেই আছে। ভাবতেই তো ভালো লাগে। শান্তি তে ভরে উঠে মন।
রেদোয়ান চৌধুরী ধীর কন্ঠে বললেন,”মরতে মরতে ও বেঁচে গেলাম ইয়াসমিন। তোমার সাথে বই নিয়ে ঝগড়া করার জন্য।”
মিসেস ইয়াসমিন কান্না করে দিলেন। রেদোয়ান চৌধুরী কে কিছুটা ধমকের স্বরে বললেন,”একদম উল্টা পাল্টা কথা বলবা না তুমি। আমি আর আমার ছেলে মেয়েরা জানি তুমি ছাড়া আমরা কতটা অসহায়।আমরা না থাকলেও তোমার কিচ্ছু যায় আসে না। তোমার তো বই আছে। কিন্তু আমাদের তো তুমিই ভরসা।”
“তোমরা ছাড়া আমি বই দিয়ে কী করবো?তোমরা ছাড়া যে আমি ভীষণ একা।মরে গেলে একা হয়ে যাবো দেখে আল্লাহ আমাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন।”
এমন সময় প্রহন হাতে পলিথিনে করে ফল নিয়ে কেবিনের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,”শুরু হয়ে গেছে না তোমাদের বই নিয়ে ঝগড়া? এই দুটো বুড়ো বুড়ি কে নিয়ে আমি আর পারলাম না।”
মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের দিকে তাকিয়ে বললেন,”আমি স্যুপ রান্না করে নিয়ে এসেছি। ওটা খাইয়ে দিলেই তো হবে।”
“ভালো করেছো। আমি আরো তোমাকে ফোন করে বলতাম সেই কথা।”

রেদোয়ান চৌধুরী কে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেওয়ার পর মিসেস ইয়াসমিন প্রহনের উদ্দেশ্যে বললেন,”চৈতি আজ একা একা স্কুলে গেছে। তুই ওকে গিয়ে নিয়ে আসিস। মেয়েটা যেতে চাচ্ছিলো না। আমি জোর করে পাঠিয়েছি। পরীক্ষা ছিল তাই।”

প্রহনের ফোনে কল আসায় সে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে ছোট্ট করে উত্তর দিলো,”আচ্ছা।”

সকালে রোদ থাকলেও দুপুরের দিকে আকাশ মেঘলা হয়ে এলো। ক্লাসে গাল ফুলিয়ে বসে ছিল চৈতি। দৃষ্টি তার বাইরের বিশাল মাঠে। কোনো রকম পরীক্ষা টা দিয়েছে সে।মন শুধু ছুটে যেতে চাচ্ছে হাসপাতালে। মনের গভীর থেকে খুব করে চাচ্ছে সে যেন সব কিছু আগের মতো হয়ে যায়।বিপদ আপদ একদম ভালো লাগে না।সুখে ভরা সংসার গুলোতেই যেন বিপদ এসে কড়া নাড়ে।সুখে আর থাকতে দেয় না।
নতুন স্কুলে চৈতির একজন ভালো বান্ধবী হলো। মেয়েটার নাম মনিকা। চৈতি কে উদাসীন ভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,”কী হয়েছে তোর চৈতি?মন খারাপ?”
চৈতি বাইরের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মনিকার দিকে তাকালো। ঠোঁট উল্টে বললো,”আমার আব্বু অনেক অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি ভালো লাগছে না কিছু।”
মনিকার অজানা চৈতি যে বিবাহিত।সে ভেবে নিয়েছে যে হয়তো চৈতি তার নিজের বাবার কথাই বলেছে।
সে চৈতির উদ্দেশ্যে বললো,”তাহলে তুই এক কাজ কর,স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যা।”
মনিকার কথায় রাজি হলো চৈতি। কিন্তু পরে মনে পড়লো সব গুলো ক্লাস না করলে প্রহন বকা দিবে সাথে মিসেস ইয়াসমিন ও।তাই আবারো মন খারাপ হয়ে গেল তার।বামে ডানে মাথা নেড়ে বললো,”নারে মনি,যাবো না।সব ক্লাস না করে গেলে কপালে শনি আছে।”

এই রোদ তো এই ধূসর মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে অন্তরীক্ষ।মেঘ সূর্যের এমন লুকোচুরি খেলা দেখতে মন্দ লাগছে না চৈতির।স্কুল ছুটি হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই।স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে প্রহনের জন্য অপেক্ষা করছে সে। সকালে আসার সময় মিসেস ইয়াসমিন বলে ছিলেন প্রহন নিতে আসবে। পাঠাবেন তিনি প্রহন কে। চৈতি ও তাই অধির আগ্রহে প্রহনের পথ চেয়ে আছে।আজ সারাদিন এ একটা বারের জন্য ও দেখা হয়নি মানুষ টার সাথে।অথচ যাকে দেখে তার প্রত্যেকটা দিনের শুরু হয়।রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা চেনা মুখটা চোখের সামনে পড়তেই অধর জুড়ে বয়ে গেলো হাসির রেখা। প্রহন কে দেখে চৈতি রাস্তা পার হতে গেলে প্রহন রাস্তার উপাশ থেকেই চিল্লিয়ে বললো,”তুমি ওখানেই থাকো চৈতি। আমি আসছি তো।”

কিশোরীর অবচেতন চিত্ত তখন বার বার বলে উঠছিল,”আপনার কাছে যাওয়ার তর সইছে না আমার।”
#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩৬
#স্নিগ্ধা_আফরিন

রাস্তা পার হয়ে প্রহন চৈতির কাছে আসতেই প্রহনের উদ্দেশ্যে চৈতির একটাই প্রশ্ন,”আব্বু কেমন আছে?”
মেয়েটার চোখে মুখে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠেছে। চিন্তিত সে। প্রহন মৃদু হেসে বলে,”জ্ঞান ফিরেছে। ভালো আছে।
আলহামদুলিল্লাহ।”
.

আদিত্যের প্রখর তাপে ঝলসে যাচ্ছে প্রকৃতি। জৈষ্ঠের মাঝামাঝি সময়। চৌধুরী ভিলা সুনসান। দুপুর ৩টা বাজে। কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে ঘর্মাক্ত ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত ক্ষুধার্ত শরীর টা এলিয়ে দিল বিছানায়।মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। বাতাস গুলো গায়ে লাগতেই ঘুমে চোখ বুজে আসছে চৈতির। রান্না ঘর থেকে এক গ্লাস শরবত বানিয়ে রুমে এসে চৈতি কে শুয়ে থাকতে দেখে ডাক দেয় প্রহন।
“চৈতি উঠো।ফ্রেশ হয়ে ঠান্ডা শরবত খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।”
পিট পিট করে চোখ মেলে প্রহনের দিকে তাকালো চৈতি। প্রহন হাতে গ্লাস নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এত কেয়ার দেখে নিজেকেই নিজের হিংসা হয় চৈতির।এতটা ভালোবাসা,যত্ন পাওয়ার যোগ্য সে নয়।মনে মনে এটাই চিন্তা করে চৈতি।এইতো কিছুক্ষণ আগেই কী সুন্দর সিনেমার প্রেমিক এর মতো করে রাস্তা পার করে নিয়ে এলো।আপন মনে হাসলো চৈতি। মানুষ টা একটু বেশিই ভালো।
আলসেমির পরীরা এসে চেপে ধরেছে চৈতি কে।সাথে তন্দ্রা পরী ও।এক চোখ বন্ধ করে আরেক চোখ মেলে প্রহনের দিকে তাকিয়ে বললো,‍”একটু ঘুমাই?উঠতে ইচ্ছে করছে না।”
প্রহন কিছু বললো না।এক পলক চৈতির দিকে তাকিয়ে হাতের গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে বিছানায় শুয়ে থাকা চৈতির হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল বিছানায়। চৈতি আবারো শুয়ে পড়তে চাইলে টেনে দাঁড় করিয়ে দেয়। ঠোঁট ফুলিয়ে প্রহনের দিকে তাকালো চৈতি। প্রহন চোখের ইশারায় বললো,”ফ্রেশ হয়ে নাও।”
চৈতি প্রহনের বুকে একটা কিল মেরে বললো,”অসহ্য। অসভ্য লোক একটা।”
অগত্য চৈতি কে ফ্রেশ হতে যেতেই হয়। প্রহন মৃদু হেসে পকেট থেকে মোবাইল বের করতে করতে ব্যালকনির দিকে চলে গেল।
“হ্যালো আম্মু, আব্বুর এখন কী অবস্থা? আগের চেয়ে ভালো আছে তো?”
“হুম আগের চেয়ে অনেক টা ভালো। আলহামদুলিল্লাহ।”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ। খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়েছো?”
“হুম খাইয়েছি।”
“তুমি খেয়েছো?আর চৈতির আব্বু আম্মু ভাইয়েরা?”
“খেয়েছি।চলে গেছেন উনারা। আমি পাঠিয়ে দিয়েছি।বাড়ি রুপা সিফা একা।রুপা এমনিতেই অসুস্থ।”
“ওহ আচ্ছা। ভালো করেছো। আমি একটু পর আসবো।”
“এখন আসতে হবে না। চৈতি কে নিয়ে আসছিস স্কুল থেকে?”
“এই তো কিছুক্ষণ আগেই নিয়ে আসলাম।”
“আমি সকালে রান্না করে রেখে এসেছি। চৈতি কে নিয়ে খেয়ে নিস।আর শোন, চৈতি রোদ থেকে এসেছে,এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত বানিয়ে দিস। তোর জন্য ও।যা গরম পড়েছে আজ।”
মিসেস ইয়াসমিন এর সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিলো প্রহন। কথা শেষে পেছনে ফিরতেই দেখলো চৈতি এক হাতে তোয়ালে আরেক হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রহন বিস্ময় নিয়ে দেখলো চৈতি কে। মিনিট দশেক এর মধ্যে মেয়েটা গোসল করে ফেলেছে।
“এত জলদি গোসল করে ফেললা যে? তোমার তো আবার ঘন্টা খানেক সময় লাগে।”
“সব সময় ঘন্টা খানেক সময় লাগে না।”
চৈতি প্রহনের হাতে তোয়ালে ধরিয়ে দিয়ে বললো,”চুল মুছে দিন।আলসেমি লাগে আমার। আপনি আমার কাছে যত দিন আছেন গোসলের পর আমার চুলের পানি মুছিয়ে দেওয়ার কাজটা ও আপনার।মনে রাখবেন সব সময়।”
প্রহন চৈতির চুল মুছতে মুছতে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”তোমার ভেজা চুল মুছার কামলা নাকি আমি? বেতন কত দাও মাসে?”
চৈতি শরবতের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বললো,”মাসে নাই টাকার বেতন।”
প্রহন চৈতির চুল মুছচে এবং খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চৈতির শরবত খাওয়া দেখছে। হঠাৎ চৈতির চুলে টান মারতেই ব্যাথায় আহ করে উঠলো চৈতি।
প্রহন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,”তোমাকে শরবত খেতে দিয়েছি।চা খেতে না। এখন যদি তিন ঢোকে শরবত না গিলছো তাহলে তোমার মাথার একটা চুল ও থাকবে না কিন্তু।”
প্রহন কথা গুলো শুনে চোখ মুখ খিঁচে শরবত গুলো শেষ করলো চৈতি। প্রহনের কাছ থেকে সরে এসে বললো,”দিন দিন বেশি বকা দিচ্ছেন আমাকে। খুব বেড়ে গেছেন। আব্বু সুস্থ হয়ে নিক তারপর আপনার নামে নালিশ করবো।”
চৈতির কথা শুনে হাসলো প্রহন। মুচকি হেসেই বললো,”আচ্ছা যত খুশি নালিশ করো। এখন একটু খাবার বেড়ে এখানে নিয়ে চলে আসো। আমি গোসল টা করে নি।”
চৈতি যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে পেছন থেকে প্রহন আবারো ডাক দিয়ে বললো,”শুনো…”
চৈতি পেছনে ফিরে তাকায়। প্রহন মুচকি হেসে বললো,”এক প্লেটে নিয়ে এসো।”
চৈতি মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। প্রহন ও গোসল করার জন্য কাপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। হসপিটালের ভ্যাপসা একটা গন্ধ জেনো গায়ে লেগে আছে এখনো। সাথে জৈষ্ঠের ভ্যাপসা গরম ফ্রী।
এই গরমে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল মানেই শান্তি।

রান্না ঘর থেকে এক প্লেটেই খাবার নিয়ে রুমে এলো চৈতি। ভাগ্যে ভালো যে সময় টা এখন দিন।রাত হলে এত বড় বাড়িতে তাও মাত্র দুজন মানুষ,তাকে যদি রাতে খাবার আনতে বলা হতো জীবনেও আনতে রাজি হতো না সে। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে প্রহন। বিছানার উপর চৈতি কে বসে থাকতে দেখে মুচকি হাসলো।
তার কথা মতো এক প্লেটেই খাবার নিয়ে এসেছে।
নিজের হাতে চৈতি কে খাইয়ে দেয় প্রহন। সাথে নিজেও খেয়ে নেয়। বাইরের তাপমাত্রা কিছুটা কমলে সন্ধ্যার দিকে হসপিটালে যাওয়ার কথা বললেন মিসেস ইয়াসমিন।এই রোদের মধ্যে এখন হসপিটালে যাওয়ার দরকার নেই।
বিছানায় প্রহনের পাশেই শুয়ে ছিল চৈতি।আর চৈতির কোমর জড়িয়ে ধরে শুয়ে ছিল প্রহন। বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোন টা অনর্গল বেজেই চলেছে সেই কখন থেকে।হাত বাড়িয়ে মোবাইল টা নেয় প্রহন।স্ক্রিনে সিইও স্যারের নাম্বার।
কিছুটা বিরক্ত হলো প্রহন।কল রিসিভ করে সালাম দিয়ে কুশোল বিনিময় করে নিলো। কিন্তু সিইও স্যারের কন্ঠটা কেমন গম্ভীর শোনা যাচ্ছে।সব প্রশ্নের উত্তর কেমন যেন ত্যাড়া ভাবে দিচ্ছেন। এই যেমন,
“ভালো আছেন স্যার?”
বললে তিনি অপর প্রান্ত থেকে বলছেন,”ভালো থাকি আর না থাকি তাতে কি আসে যায়?”
প্রহন বুঝলো ব্যাপার টা সিরিয়াস।এই টাকলা নিশ্চিত রেগে আছে। সিইও স্যার কে টাকলা বলার একটা বিশেষ কারণ হচ্ছে তার মাথার মাঝখানে চুল নাই।
সিইও স্যার কে ঠান্ডা করার জন্য বললো,”স্যার আমার আব্বু ভীষণ অসুস্থ। হসপিটালে ভর্তি আছেন।”
সিইও স্যার ঠান্ডা হলেন না।বরং আরো এক ধাপ রেগে গেলেন। রাগান্বিত কন্ঠে বললেন,”ফাজলামি করার জায়গা পাও না তুমি?মা হাসপাতালে ভর্তি তো বাবা হাসপাতালে ভর্তি। একটা কাজ করো তোমার চাকরী টা করারই দরকার নাই। তুমি বরং তোমার বাবা মায়ের জন্য হাসপাতালের নার্স কে বিয়ে করে তাদের নিয়েই থাকো।”

“দেখুন স্যার, আমি সত্যি বলছি। আমি দরকার হলে আপনাকে হসপিটালের নাম, কেবিন নাম্বার, আমার আব্বুর নাম সহ সব ধরনের ডিটেলস পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনি খোঁজ খবর নিয়ে দেখেন।”

“ওকে ডান। তুমি বরং তোমার পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসো। তোমাকে ফ্যামেলি কোয়াটার দেওয়া হবে।”

“হ্যালো,হ্যালো স্যার শুনতে পারছি না কীছু।হ্যালো,হ্যালো,কী নেট প্রবলেম। ধুর।”
বলেই কল কেটে দিলো প্রহন। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। চৈতি হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।
নেট প্রবলেম এর অজুহাতে কল কেটে দেওয়ার ব্যাপারটা দারুন লেগেছে তার।
প্রহন চৈতির দিকে ভ্রু কুঁচকে নিঃশব্দেঅন্তহীন পর্ব -৩৩+৩৪ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। মেয়েটা হাসলে তার চোখ গুলো ও হাসে। প্রহনের ভয় হয় তা দেখে।হাসলে যাদের চোখ ও হাসে তারা নাকি বেশি দিন বাঁচে না। তার বড় বোনের ও এমন হতো।মা বলতে শুনেছে সে।যদি ও এই সব আজগুবি কথায় সে বিশ্বাস করে না।তার পর ও মনের ভেতর কেমন যেন উশখুশ করে।
প্রহন চৈতি কে ধমকের স্বরে বলে,”হাসি থামও চৈতি।এত হাসির কি আছে?”

হঠাৎ প্রহনের ধমক শুনে চুপসে যায় চৈতি।হাসির মাঝে আচমকা এই ধমকটা হজম হলো না। চৈতির মন খারাপ দেখে নিজেই নিজের উপর চরম বিরক্ত হলো প্রহন। শুধু শুধু মেয়েটার মন খারাপ করে দেওয়া টা একদম উচিত হয়নি।
এখন নিশ্চয় অভীমানে গা ভাসাবে।মেয়েটা বড্ড অভীমানি!

#চলবে,,,
চলবে,,,,
(অসুস্থ ছিলাম ভীষণ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here