অন্তহীন পর্ব -৩৩+৩৪

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩৩
#স্নিগ্ধা_আফরিন

অরুণ রাঙা প্রভায় বিভাসিত অপরাহ্নের প্রহর।নীরদ ছোঁয়া তরুর মগডালে বসে আছে এক ঝাঁক পরিযায়ী পাখি। শান্ত, স্নিগ্ধ পড়ন্ত বিকেলের সোনা রাঙা এক ফালি নরম রোদ এসে পড়েছে ছাদের রেলিং এর উপর।যুগল বন্দি পায়রা দুটো সেই রোদে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। ঠোঁট দিয়ে একে অপরকে ঠোকর মেরে খুনসুটির প্রমান দিচ্ছে যেন।ঝুঁটি ওয়ালী পায়রা টা বাক বাকুম বাক বাকুম করে ডেকে উঠে সরে গেল কিঞ্চিৎ দূরে।কার কবুতর কে জানে। তাদের থেকে কিছু টা দূরে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে সেই পায়রা দুটো কেই দেখছে চৈতি। ভেজা চুল থেকে এখনো পানি ঝড়ছে। ঘন্টা খানেক আগেই ফিরে এসেছে।জার্নি করে ফেরা তার উপর জ্যামে আটকে থেকে গা গুলিয়ে উঠেছিল।একটা ঝাঁকা নাকা গোসল না করলেই নয়।
ছাদে আসার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে কেউ।মুখে তার একটাই কথা,”চৈতি, কোথায় তুমি?”
কন্ঠটা তার অতি প্রিয়।
জবাব না দিলে ধমক দিবে তা চৈতির জানা আছে।তাই ছোট্ট করে বললো,”আমি এখানে।”
“হুম দেখতেই পাচ্ছি ম্যাডাম আপনি এখানে।”
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো চৈতি।হাতে তোয়ালে। প্রহন কে দেখে মুচকি হেসে বললো,”একটা বায়না করতে পারি?”
প্রহন চৈতির দিকে এগিয়ে এসে বললো,”সব বায়না টায়না পরে।আগে বলো তো গোসলের পর চুল মুছোনি কেন?”
চৈতি ঠোঁট ফুলিয়ে উত্তর দিলো,”আলসেমি”

“একটা মাইর ও কম পরবে না।”
কড়া গলায় বললো প্রহন।নিজ হাতে চুল মুছতে মুছতে কন্ঠ নরম করে বললো,”আমি না থাকলে এই ছোট খাটো কেয়ার গুলো কে করবে তোমার?”

“থেকে যান আপনি। আমার যত্ন করার জন্য। ছোট্ট একটা চাকরী করুন। এই যেমন ১০ হাজার টাকার বেতনের।দিব্যি চলে যাবে দিন।”

“হ্যাঁ বলছে তোমাকে।১০ হাজার টাকায় দিব্যি যাবে দিন?শুনো চৈতি আবেগে জীবন চলে না।”

চৈতি মিটিমিটি হাসলো। উত্তর দিলো না। চুল মুছা শেষে
রেলিং এর কাছে চলে যেতে নিলে চৈতি প্রহনের হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় বুঝালো,”সে দিকে না যেতে।”
প্রহন অবাক হয়ে বললো,”কেন?কী হয়েছে?”
চৈতি আঙ্গুলের ইশারায় দেখালো”ঐ যে কারণ।”
প্রহন চৈতির দৃষ্টি অনুসরণ করে রেলিং এর উপর তাকালো।দুটো পায়রা কে প্রেম করতে দেখে হেসে বললো,”আমার তো আর ওদের মতো প্রেম হচ্ছে না।যাই ওদের একটু বিরক্ত করে আসি।”
চৈতি ভ্রু কুঁচকে রাগি কন্ঠে বললো,”যাবেন না। দূরে থাকুন ওদের থেকে।আপনাকে দেখলেই উড়ে যাবে।”
চৈতির কথা শুনলো প্রহন। গেল না রেলিং এর কাছে।বা হাত দিয়ে চৈতির কাঁধ জড়িয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে মুখের উপর ফুঁ দিয়ে বললো,”কী জানি বায়না ধরবে বলে ছিলে?”
চৈতি পায়রা গুলোর দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,”এক জোড়া পায়রা কিনে দিবেন?একটা হবেন আপনি আরেকটা হবো আমি।”

“বাহ আমার বাচ্চা বউ দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছে।কত কিছু বুঝে।”

ইশশ লজ্জা! প্রহন ছেলে টা বড্ড খারাপ। শুধু মেয়েটাকে লজ্জা দিবে।কী আনন্দ পায় সে ভালো জানে।একটু ভালো করে পরক্ষ করলেই তো দেখতে পাবে, লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলার জন্য হাঁসফাঁস করছে।
চৈতি প্রহনের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যেতে নিলে হাত ধরে বাঁধ সাধলো প্রহন।
চোখের ইশারায় মাথা নাড়িয়ে বুঝালো,”যেও না।”
চৈতি অবাধ্য হলো।স্পষ্ঠ করে বললো,”থাকবো না। আপনি শুধু লজ্জায় ফেলেন।”

প্রহন ঠোঁট কামড়ে হাসে।ধীর গলায় বলে,”তোমার লজ্জা বেশি।লাজুক লতা কী আর সাধে বলি? সামান্য কথায় ও এত লজ্জা পেলে নাতি নাতনির মুখ দেখতে হবে না আর।”

“ধ্যাত ছাড়ুন তো। আপনি লোকটা একটু বেশি বেশি। খারাপ লোক একটা।”

চৈতি কে আর পায় কে? প্রহন কে বকতে বকতে দ্রুত পায়ে ছাদ থেকে নেমে যায়। চৈতির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো প্রহন।প্রহনের হাসির শব্দে পায়রা যুগল উড়ে গেল।ডানা মেললো শূন্য গগনে। এতেই যেন শান্তি।আহাহ স্বাধীনতা!
_______
নিশুতির আঁধারের জন্য সবে মাত্র প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রকৃতি।রুপ বদল করতে হবে যে। এখন সকাল,একটু পর দুপুর, তার পর বিকেলে,প্রত্যেক দিনের এক রুপ। সায়াহ্নের রুপ নেবার প্রহর এখন। রান্না ঘর থেকে টুং টাং শব্দ আসছে।
শব্দ শুনেই উপলব্ধি করলো প্রহন,যে চৈতি এখন রান্না ঘরে।সে ছাড়া রান্না ঘর থেকে এত শব্দ কেউ করতে পারে না। মিসেস ইয়াসমিন তো একদম না।কারন তিনি খুব নিরবতা প্রেমি মানুষ। এমন বাসন কোসনের শব্দ তার অসহ্য লাগে।আলতো হাতে ধরেন এবং আলতো হাতে কাজ করেন।
নবাবের মতো চৈতি কে হুকুম করলো প্রহন।
“বেগম সাহেবা এক কাপ কফি দিয়েন তো।”

রান্না ঘর থেকে চৈতির গলার স্বর শোনা গেল।সে বললো,”বেগম এখন মহা ব্যস্ত। অনেক কাজ!ফ্রী হলে কফি পাবেন।”
বেগমের স্পষ্ঠ কথা শুনে আর কিছু বললো না প্রহন।
চুপ করে সোফায় বসে রইলো।

রেদোয়ান চৌধুরীর শরীর টা ভালো লাগছে না বিকেল থেকেই। বুকের ব্যথাটা আবার বেড়েছে। বিছানায় শুয়ে ছিলেন তিনি।আজ আর কোনো নতুন বই পড়া হয়নি। শরীরে শান্তি থাকলেই তো সব কিছুতে মন বসে।
চলতি মাসের শেষ প্রায়।আর দুই দিন বাকি। এই মাসে একবার ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া উচিত ছিল। হার্টের পেশেন্ট কিছু টা সতর্ক না থাকলে হয় না।
মিসেস ইয়াসমিন চা আর নাস্তা নিয়ে রেদোয়ান চৌধুরীর কাছে গেলেন।
মিসেস ইয়াসমিন এর হাতে খাবার দেখে বললেন,
“ইয়াসমিন, আমার চা খেতে ইচ্ছে করছে না। এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত বানিয়ে দাও তো।”
মিসেস ইয়াসমিন সম্মতি জানিয়ে বললেন,”তা দিবো। কিন্তু তোমার কী শরীর খারাপ লাগছে?মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।”

“ঐ একটু বুকে ব্যথা করছে। ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ।”

বাড়ির সামনের বড় আম গাছটার কোনো এক ডালে বসে এক নাগাড়ে ডাকছে সন্তান হারানো হুতুম পেঁচা টা।কী গম্ভীর এবং কষ্ট দায়ক সেই ডাক।গা ভাড় হয়ে আসে চৈতির। রাতের বেলায় পেঁচার ডাক টা ঠিক হজম হয় না তার। কেমন যেন একটা হারিয়ে ফেলার ভয় হয়।
পড়ার টেবিলে বসে ক্লাস টেস্টের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। পাশেই বিছানার উপর বসে আছে প্রহন। মোবাইলের স্ক্রিনে দৃষ্টি তার।কারো সাথে চ্যাট করছে হয়তো।
হঠাৎ চৈতি বলে উঠলো,”আপনি আমার থেকে দূরে যাবেন না তো কখনো?”
আচম্বিকে চৈতির এমন প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকে যায় প্রহনের। কিছুটা গম্ভীরভাবে চৈতির প্রশ্নের উত্তর দিলো,”না যাবো না। কিন্তু তুমি হঠাৎ এই কথা বলছো কেন?পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার নিনজা টেকনিক ব্যবহার করতে চাচ্ছো?”
চৈতির মুখ মলিন।ভীতু কন্ঠে বললো,”প্রিয় মানুষ গুলো কে হারিয়ে ফেলার ভয় হয়।”
কথাটা বলেই হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো চৈতি।তাজ্জব বনে গেল প্রহন। হঠাৎ মেয়েটার এমন কান্নায় প্রস্তুত হয়ে গেছে। বিছানার উপর মোবাইল টা রেখে দ্রুত চৈতির কাছে গিয়ে চৈতি কে দুই হাতের বাঁধনে আগলে নেয় বুকের ভেতর। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”কান্না করছো কেন বোকা মেয়ে? শুধু শুধু কেউ কান্না করে? কিচ্ছু হয়নি তো।কারো কিচ্ছু হয়নি সবাই ঠিক আছে।কান্না থামাও পাগলী।”
হঠাৎ কী হলো চৈতির বুঝলো না প্রহন।প্রিয় মানুষ গুলো কে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কত মানুষ কাঁদে সে খবর কে রাখে?কেউ না।
নাক টেনে লম্বা শ্বাস নেয় চৈতি।কান্না থামে। ভালো লাগছে না কিচ্ছু। কেমন জানি করছে বুকের ভেতর। অচেনা এক ভয় ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে চিত্ত কোণে।
চৈতি কে স্বাভাবিক করে প্রহন বললো,”সকালে উঠে বাকি পড়াটা শেষ করে নিও। এখন আর পড়তে হবে না।”

ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত প্রায় ১০টা।
মিসেস ইয়াসমিন ডাকছেন চৈতি আর প্রহন কে। খাবার খেয়ে যাওয়ার জন্য।রাত হয়েছে অনেক।জার্নি করায় ক্লান্ত তিনি। ঘুম এসে ভীড় করছে চোখে। চৈতি কে নিয়ে খাবার খাওয়ার জন্য চলে যায় প্রহন।
রেদোয়ান চৌধুরী কে ডাকার জন্য রুমে গেলেন মিসেস ইয়াসমিন। রেদোয়ান চৌধুরী শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছেন। পাশেই আরিফ আজাদের লেখা বেলা ফুরাবার আগে বই টা পরে আছে বিছানায়।
মিসেস ইয়াসমিন রেদোয়ান চৌধুরী কে বেশ কয়েক বার ডাক দিলেন।সাড়া পেলেন না। গভীর নিদ্রায় মগ্ন তিনি।
সাধারণ ডাকে ঘুম ভাঙ্গবে না। মিসেস ইয়াসমিন রেদোয়ান চৌধুরীর পাশে রাখা বই টা নিয়ে বুকশেলফ এর তাকে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বললেন,”খাবার খেয়ে ঔষধ খাবে না?উঠো জলদি। ছেলে মেয়ে অপেক্ষা করছে তো তোমার জন্য।”
সাড়া না পেয়ে মিসেস ইয়াসমিন রেদোয়ান চৌধুরীর মাথার পাশে গিয়ে বসলেন। বুকের উপর হাত রাখতেই কেঁপে উঠলেন তিনি। মনের অশুভ চিন্তা টা দূর করতে শ্বাস প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া পরীক্ষা করতেই চিৎকার দিয়ে প্রহন কে ডেকে বললেন,
“প্রহন রে বাবা আর নাই।”#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩৪
#স্নিগ্ধা_আফরিন

ভাতের লোকমা টা মুখে নেওয়ার আগে হাত থেকে পরে গেলো প্লেটে। মায়ের কথা টা শ্রবণেন্দ্রিয়তে পৌঁছাতেই ঝংকার দিয়ে উঠলো বা পাশের চিত্তে।চিন চিন করে উঠলো অসহনীয় যন্ত্রনায়। কোনো রকম হাতটা ধুয়ে ছুটে গেল বাবার রুমে। চৈতির কান্নায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। খাবার মুখে নিয়ে ছিল শুধু।গিলতে পারলো না।গলা দিয়ে নামলো না যে। প্রহনের পিছু পিছু সে ও ছুটলো বাবা তুল্য শ্বশুড়ের রুমে।
দরজার কাছে আসতেই শরীর টা যেন অসাড় হয়ে গেল প্রহনের। মিসেস ইয়াসমিন রেদোয়ান চৌধুরীর বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছেন আর বিড় বিড় করছেন,”শুনছো উঠো না প্রহনের আব্বু। কথা দিচ্ছি তোমার বই পড়া নিয়ে আর কখনো কিচ্ছু বলবো না।”
প্রহন এগিয়ে গেল মায়ের দিকে। রেদোয়ান চৌধুরীর অচল দেহটা পড়ে আছে বিছানায়।
প্রহনের গলায় কথা আটকে যাচ্ছে।
কান্না পাচ্ছে খুব।কোথা থেকে চৈতি দৌড়ে এসে রেদোয়ান চৌধুরী কে জাপটে ধরলো। কান্না করে দিয়েছে সে। প্রহন কে দেখে মিসেস ইয়াসমিন বসা থেকে উঠে জাপ্টে ধরলেন।
“কী থেকে কী হয়ে গেল প্রহন।বাবা এত তাড়াতাড়ি কেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন? আমি তো একেবারে একা হয়ে গেলাম। আমার ভালোবাসা হারিয়ে গেল দুনিয়া থেকে।”
কী করবে প্রহন বুঝতে পারছে না সে। নিজেকে সামলাবে,নাকি চৈতি আর মাকে সামলাবে? মাথায় কাজ করছে না।
চৈতি হঠাৎ কান্না থামিয়ে দেয়। রেদোয়ান চৌধুরীর বা হাতের কব্জি ধরে ছিল সে।
“বাবা বেঁচে আছে ভালো মা। উনার হাতের রগ কাঁপছে।”
চৈতির কথায় চমকে উঠলো প্রহন। সাথে খুশি ও হলো। নিজের কাছ থেকে মিসেস ইয়াসমিন কে ছাড়িয়ে দ্রুত বাবার কাছে গেল। হাতের নাড়ি ছুঁয়ে দেখলো খুব ধীর গতিতে কাঁপছে। বুকের বা পাশে হাত রেখে অনুভব করার চেষ্টা করলো হৃদস্পন্দন হচ্ছে কিনা। খুবই ধীর গতিতে কাঁপছে হৃদয়।
মিসেস ইয়াসমিন এর দিকে তাকিয়ে চোখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,”আব্বুর কিচ্ছু হয়নি আম্মু। তুমি দ্রুত এম্বুল্যান্সকে ফোন করো। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
মিসেস ইয়াসমিন মাথা নেড়ে সায় দিলেন। দ্রুত মোবাইল নিয়ে ফোন করলেন। চৈতির দিকে তাকিয়ে প্রহন বললো,”অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে চৈতি। তুমি যদি না বলতে হয়তো বাবার সত্যি কিছু হয়ে যেত।”
চৈতির চোখ থেকে টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। নিজের বাবার মতই এই মানুষ টা ও সে অনেক বেশি ভালোবাসে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই তিন টা মানুষ তার অতি থেকে ও অতি প্রিয় হয়ে গেছে। তাদের কিছু হয়েছে ভাবলেই তো দম আটকে আসে। দিশেহারা মনে হয়।
_________
আইসিইউ রুমের এর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস ইয়াসমিন। পায়চারি করছেন তিনি। তার পাশেই বসে আছে চৈতি। প্রহন সরদার সাহেব কে ফোন করে সব কিছু জানাতে ব্যস্ত। এই বিপদে তারাই হয়তো পাশে থাকবে।চাচারা তো সেই কবেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত।বড় ভাইয়ের খোঁজ রাখার প্রয়োজন বোধ করে না তারা।মরলো নাকি বাঁচলো এতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না।
রেদোয়ান চৌধুরীর শরীরের অবস্থা প্রচন্ড খারাপ হওয়ায় তাকে ইমার্জেন্সি আইসিইউ তে নেওয়া হয়।” বুকের ব্যথায় জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি ও খুব ধীরে। হৃদয় স্পন্দন প্রক্রিয়া ও কমে গেছে। অনভিজ্ঞ যে কেউই তাকে দেখলে মৃত মনে করবে।”
ডাক্তারের কাছ থেকে এই সব কথা শুনে মিসেস ইয়াসমিন মৃত মনের প্রান ফিরে পেলেন যেন।

“আব্বু এখন কেমন আছেন ডক্টর?”

“আপনার আব্বুর জ্ঞান ফিরেনি এখনো। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আপনার আব্বু হার্টের পেশেন্ট যেহেতু উনার একবার হার্ট সার্জারি হয়েছে সেহেতু আপনাদের উচিত ছিল তাকে দেখে রাখার। ভাগ্যে ভালো যে কিছু হওয়ার আগে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।আপনারা যদি তাকে মৃত মনে করে রেখে দিতেন তাহলে হয়তো আজ সত্যি সত্যি তিনি মারা যেতেন।”

ডাক্তারের কথা শুনে মায়ের দিকে এক নজর তাকালো প্রহন।ডাক্তার চলে গেছে।
মিসেস ইয়াসমিন এখন ও কান্না করছেন।ইশশ আজ যদি চৈতি অনুভব করতে না পারতো তাহলে কি হতো? আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করছেন তিনি।দিক না মানুষ টা কম সময়।তাতে কি? বেঁচে থাকবে,পাশে থাকবে,এক সাথে থাকবে এটাই তো অনেক।
সরদার সাহেব কে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো চৈতি। সজীব সাদিক আর জুনাইদা ও এসেছে। সরদার সাহেব কে দেখে মনে কিছু টা সাহস পেল প্রহন।বাবা নামক ছায়াটা মাথার উপর থেকে চলে যাওয়ার ভয়ে ভীত ছিল সে।প্রিয় জন হারানোর যে যন্ত্রনা তা কি আর সবাই বুঝে?যার যায় সেই বুঝে তার কী গেল।অন্যরা তো মিথ্যে শান্তনা দেয় শুধু।

“প্রহন আমি বাড়ি যাবো।”কান্না ভেজা কঠিন গলায় বলা কথা শুনে পাশ ফিরে মায়ের দিকে তাকালো প্রহন।
প্রত্ত্যথে বললো,”আর কিছুক্ষণ থাকো। আব্বুর জ্ঞান ফিরলেই চলে যেও।”
প্রহনের কথা শুনলেন না মিসেস ইয়াসমিন।এক রোখা জেদ করে আবারো বললেন,”আমি থাকবো না।এখনি বাড়ি যাবো। তুই আমাকে আর চৈতি কে নিয়ে চল।”
“কিন্তু আম্মু, আমি চলে গেলে এখানে কে থাকবে? আমার তো এখানে প্রয়োজন পড়তে পারে।”
প্রহনের কথা শুনে শান্ত হলেন মিসেস ইয়াসমিন।
সরদার সাহেব সজীবের দিকে তাকিয়ে বললেন,”সজীব, চৈতি আর আপাকে নিয়ে বাড়িতে দিয়ে আয়।”
জুনাইদার দিকে তাকিয়ে বললেন,”তুমি আর একা থেকে কী করবা? তুমি ও যাও সাথে।”
সজীব তিন জনকে নিয়েই চলে গেল বাড়িতে। এই দিকে রেদোয়ান চৌধুরীর জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত অশান্ত মনটা শান্ত হচ্ছে না প্রহনের। সম্পূর্ণ ভয়টা ও দূর করতে পারছে না মন কে।
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো সে।
.
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ঘুড়ছে।১২টা বেজে ৩৪ মিনিট।গগনে আজ চন্দ্রিকা নেই। স্নিগ্ধ, মোহনীয় নজর কাড়া চাঁদের আলো নেই ধরিত্রীতে।থেমে থেমে ডাহুক পাখির ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে।এত রাতে ও নগরী শান্ত হয়নি। হাসপাতালে এত মানুষ থাকার অনুমতি নেই দেখে প্রহন বাদে আর সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে সে।
একাই রয়ে গেল হসপিটালে।

একটা শান্ত নিরিবিলি রুম। মৃদু আলো জ্বলছে শুধু।ড্রিম লাইটের লালচে প্রভায় একজন মধ্যবয়স্ক নারীর অবয়ব স্পষ্ঠ। তাহাজ্জুদের নামায পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। এই মহা বিপদে এক মাত্র আল্লাহই তার ভরসা। নিজের ভুলের জন্যই ছেলে মেয়ের রাতের খাবার টুকু ও খাওয়া হয়নি।ভয়ে ছিলেন তিনি খুব। রেদোয়ান চৌধুরীর কখন কী হয়ে যায় সেই ভয়েই থাকেন মিসেস ইয়াসমিন। বুকের ভেতরকার সেই ভয় থেকেই আজ কী একটা ভয়ানক কথা বলে ফেলেছেন তিনি। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে মনে।
তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে নাকি মহান আল্লাহ কে নিজের খুব কাছে পাওয়া যায়।সব সময় না পড়লেও মাঝে মধ্যে রেদোয়ান চৌধুরী কে সাথে নিয়ে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতেন। আল্লাহর দরবারে দুই হাত পেতে নামাজে দাঁড়িয়েছেন আজ। সুস্থতার মালিক যে তিনি।
গভীর রাত।
দেয়াল ঘড়িটা টুং টুং করে শব্দ করে উঠলো। ঘড়ির শব্দে কিছু টা ভয় পেলেন মিসেস ইয়াসমিন। সালাম ফিরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন ৩টা বেজে গেছে।
জুনাইদা আর চৈতি বেশ কিছুক্ষণ জেগে ছিলেন।শেষে ঘুমের সাথে যুদ্ধ করে জেগে থাকতে না পেরে ঘুমিয়ে পড়ে। সরদার সাহেব আর সজীব সাদিক ও ঘুমিয়ে গেছেন।পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ।নিশি রাতে একা জেগে নামাজ পড়ে নিজের প্রিয় মানুষটার প্রান ভিক্ষা চাচ্ছেন মিসেস ইয়াসমিন।নিরব কান্নায় ভিজে যাচ্ছে গাল।অশান্তি ঝড় বয়ে যাচ্ছে মনের গভীরে।
আজ কেন জানি ভয় হচ্ছে না। শুধু মনের ভেতর একটাই চিন্তা মানুষ টা আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে তো?ঠিক হয়ে যাবে তো?

হসপিটালের করিডোরের শেষ প্রান্তে বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে প্রহন। হাসপাতাল টা ও চুপচাপ হয়ে গেছে। কখন বাবার জ্ঞান ফিরবে সেই চিন্তায় চিন্তিত সে।
বাবা মানেই তো একটা বিশাল আকাশ মাথার উপরের। হারিয়ে গেলে যে সব কিছু উলোট পালোট হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে।সব শান্তি!

#চলবে,,,

(এত সুন্দর সুখি পরিবারটা কে নষ্ট করতে মন চাইলো না 😊)

#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here