অন্যরকম ভালোবাসা, পর্ব:১৩

#অন্যরকম_ভালোবাসা

#পর্ব_১৩

অন্তরা আর স্পন্দনের দিনগুলো উড়ে চলেছে প্রজাপতির ডানায় ভর করে। প্রেমের শুরুতে তাদের একবারও মনে হয়নি এভাবে রঙিন রংধনুর মত আনন্দে কাটবে দিনগুলো। সেইসাথে শুরুর এত অসঙ্গতির পরও ওদের দুই পরিবার এতটা মিলেমিশে যাবে ভাবেনি কখনো তারা!!

স্পন্দনের বাবা মাকে রাজী করানো কোনো ব্যাপারই ছিলো না। মা শারমিন তো আগে থেকেই অন্তরাকে পছন্দ করে বসেছিলেন, বাবাও জানার পর অমত করলেন না। এক সন্ধ্যায় ওরা সপরিবারে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে গেলো অন্তরাদের বাড়ী। মুশফিক সাহেব আর সাবিনা স্পন্দনের বাবা মায়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে রীতিমতো মুগ্ধ হলেন। স্পন্দনের মতই আন্তরিক আর মিশুক উনারা।

যেই শর্ত নিয়ে ওরা এত টেনশনে ছিলো সেটা ছিলো…

অন্তরা তার প্রফেশনের ব্যাপারে কোন কম্প্রোমাইজ করতে পারবে না। সে যদি ভবিষ্যতে উচ্চতর ডিগ্রীও নিতে চায় তবে স্পন্দন বা তার পরিবার বাঁধা দিতে পারবে না।

স্পন্দনের মা শারমিন সাবিনার হাত দুটো ধরে আন্তরিক হাসি হেসে বললেন,
– ওমা, এতো অলিখিত শর্ত আপা! না বললেও আমরা তা’ই করতাম। আমার তো মেয়ে নেই , স্পন্দনের বউ হিসেবে অন্তরার মত লক্ষী আর মিষ্টি একটা মেয়ে পাবো, আর কি চাই? ও আমাদের মেয়ে হয়েই থাকবে। তাই মেয়ে তার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবলে আমরা খুশীই হব। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না আপা।

স্পন্দনের মায়ের এমন কথা শোনার পর সাবিনা আনন্দে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। শুধুমাত্র এতোটুকু সুবিধা পাবার জন্যই তো সে তার বান্ধবীর হাতে মেয়েকে সঁপে দিতে চেয়েছিলেন মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। স্পন্দনের বাবা-মা যদি তার এই আবদারটুকু সানন্দে মেনে নেন তাহলে আর এই সম্পর্কে বাধা কোথায়?

মোটের উপর… সবকিছু যেনো নিমিষেই কোন এক অদৃশ্য যাদুবলে মধুময় হয়ে যায়! এক বর্ণিল সন্ধ্যায় ওদের পারিবারিকভাবে আংটি বদলও হয়ে যায়। বিয়েটা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।

অতঃপর একদিন …..

অন্তরা সবে ঘুমোতে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, ঠিক এমন সময় প্রীতির কল আসে। কল রিসিভ করতেই সে গদগদ কন্ঠে জানতে চায়,
– কী করিস জানেমন , ঘুমায় পড়ছিলি ?

অন্তরা নিস্তরঙ্গ কন্ঠে জবাব দেয়,
– তোদের জ্বালায় ঘুমাই ক্যামনে !!

– তোদের বলতে ?

– তুই ,স্পন্দন ।

– এইটা তুই একটা কথা বললি! আমি গুনে গুনে ঠিক তিনদিন পর রাত্রে তোকে কল দিলাম, তাও কল ওয়েটিং খেতে খেতে আমি পুরাই খাম্বা! আর তুই কল ধরেই বিরক্ত ?

– হইসে! এখন বল এত রাতে জুবায়ের ভাইকে বাদ দিয়ে আমারে জ্বালাইতে আসছিস কেন ?

– দোস্ত আমাদের তো ইন্টার্ণশীপ শেষ । আর কয়দিন পরই জীবন যুদ্ধে নামতে হবে, কে কই যাই না যাই !

– ত্যানা প্যাচানোর স্বভাব তোর আর গেল না! সোজা পয়েন্টে আয় দেখি, অনেক রাত হইছে কিন্তু!
অন্তরা মৃদু ধমক দিয়ে বলে প্রীতিকে।

প্রীতির অবশ্য অন্তরার ধমক খেয়ে অভ্যাস আছে তাই সে ধমকের তোয়াক্কা না করে মিনতির সুরে বলে,
– চলনা দোস্ত, একটু ঘুরে আসি দূরে কোথাও থেকে ?

– দূরে কোথাও! কই যাবি ?

– এই ধর …বান্দরবান কিংবা খাগড়াছড়ি।

– বাবা, এত দূর! তা কাকে কাকে নিয়ে যাবার প্ল্যান?

– তুই ,আমি , জুবায়ের আর স্পন্দন ভাই।

– ওওও ….. এতক্ষণে বুঝলাম! আসলে পেটে পেটে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান তোমাদের দুই লাভ বার্ডের আর হালাল করতে চাও আমারে।

– ছিঃ দোস্ত, তুই এইটা বলতে পারলি !! আমাদের কাবিন হয়ে আছে , একলা যেতে মানা কই ? ভাবলাম গ্রুপ করে গেলে মজা হবে…চলনা অন্তু। প্লিজ প্লিজ!

প্রীতির কাকুতি মিনতি শুনে হেসে দেয় অন্তরা।
-আব্বা , আম্মাকে কী বলবো ? তোদের নাহয় কাবিন হইছে কিন্তু আমাদের তো সার্টিফিকেট নাই।

– আরে , তুই কি প্রেম করতে যাচ্ছিস নাকি? এইটা একটা ফান ট্যুর , জাস্ট রিফ্রেশমেন্টের জন্য যাওয়া। আর আঙ্কেল আন্টিরে বলার দরকার কি ওরা যাচ্ছে ? তুই এত স্বতী নারী হইলি কবে থেকে !!

– তাইলে কী বলবো?

– বলবি শুধু বন্ধুরা যাচ্ছি , আর আমি তো আছিই তোর তুরুপের তাস !

– আহা, বিয়ের পর কলিজা মনে হয় সাইজে বড় হয়ে গেছে !!

– আমার কলিজা সবসময়ই বড়! শুধু তোর হুঙ্কারের জন্য সবসময় চিপশে থাকে বেচারা কলিজাটা!

– তাইলে আর আমার যাওয়ার দরকার কি? তুই তোর ঢোলের মত বড় কলিজা নিয়া একলা একলাই ঘুরে আয়।

– এটা তুই একটা কথা বললি! তুই জানিস না, আমার কলিজার অর্ধেক জুড়ে খালি তুই আর তুই?

– ওরে আল্লাদ ! আচ্ছা দেখি ভেবেচিন্তে।

– দেখি টেখি না , যাচ্ছি এইটাই ফাইনাল! ট্যুর প্ল্যান নিয়া ভাবিস না সেইটা জুবায়ের দেখবে।

অন্তরা শেষমেষ প্রীতির কাকুতি-মিনতির কাছে আত্মসমর্পণ করে বলে,
– ওকে বেবী , যাচ্ছি তবে। এখন যা নিজেও ঘুমা আর দয়া করে আমাকে একটু ঘুমাইতে দে। গুড নাইট!

অন্তরা ফোন সাইলেন্ট মোডে দিয়ে ঘুমাতে যায়, নইলে প্রীতির জ্বালায় বাকী রাতটুকুও তাকে জেগে কাটাতে হবে। আস্ত একটা পাগল মেয়ে প্রীতি! এত বড় হয়ে গেছে, বিয়ে পর্যন্ত হয়ে গেছে তবুও তার ছেলেমানুষি স্বভাব গেল না! কোনো একটা বিষয় পেলে তাই নিয়ে অকারনে লাফালাফি করা তার পুরনো অভ্যাস। সুতরাং অন্তরা যখন একবার যাবার জন্য হ্যাঁ করেছে তখন বাকি রাত সে কল করে করে ট্যুর প্ল্যান নিয়ে আলাপ করে ওর মাথা নষ্ট করতে চাইবে নানাভাবে। তাই মোবাইল আপাতত সাইলেন্ট মোডে থাকাই ভালো। অন্তরা চোখ বুজে প্রীতির কথা ভাবতে ভাবতে বিড়বিড় করে আপন মনে বলে,” সব পাগল কিভাবে কিভাবে যে আমার ভাগ্যে এসে জোটে, আল্লাহ মালুম!”

***

প্রীতির প্রস্তাবে স্পন্দন এক পায়ে খাড়া। দেখা গেলো এক অন্তরা ছাড়া বাকি সবাই বাড়িতে আসল ব্যাপার বলতে নারাজ। কিন্তু অন্তরা তো আর প্রীতি স্পন্দনের মত বাচ্চা স্বভাবের না। সত্যি বলতে এভাবে মিথ্যে বলে যাবার কোন মানেই হয় না! একে এত দূরের জার্নি তার উপর শুধু তারা বন্ধুরা, পথে যদি ঝামেলা কিছু হয় তাহলে বাড়িতে তো সে কথা বলাও যাবে না। সবকিছু চিন্তা করে, প্রচুর বাক-বিতণ্ডার পর অবশেষে সকলে অন্তরার যুক্তি বাণে পরাজয় বরণ করে। তবে ঘটনা হচ্ছে প্রীতি আর জুবায়েরের যাওয়াটা সহজ মনে হলেও অন্তরা আর স্পন্দনের এখনো সম্পর্কের কোনো গতি হয়নি, তাই তারা ভেবে পায়না কোন মুখে তারা বাড়িতে বলবে যে তারা দুই জোড়া কপোত-কপোতী পাহাড় দর্শনে যেতে চায়। অনেক চিন্তা ভাবনার পরে ঠিক করা হয় সঙ্গে তাদের আরো দুজন বান্ধবী রুবী আর ঈশিতাকেও নেয়া হবে। এতে করে বাড়িতে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা সহজ হবে এবং অন্তরা আর স্পন্দনের একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়াটাকে কেউ বাঁকা চোখেও দেখবে না।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে অন্তরা আর স্পন্দনের একসঙ্গে যাওয়া নিয়ে তাদের এত মাথা ব্যথা দেখা গেল অন্তরার বাবা মা যখন জানলেন যে অন্তরার সব বন্ধুদের সঙ্গে স্পন্দনও বেড়াতে যাচ্ছে, তখন তারা মানা করার বদলে বরং খুশীই হলেন। স্পন্দন সাথে গেলে নাকি ওদের নিরাপত্তা ভাবনা নিয়ে তারা নিশ্চিন্তে থাকবেন। এই শুনে অন্তরা খুব একচোট হাসল, যা দেখে স্পন্দন পারলে ওকে আস্ত গিলে খায়।

বাড়ি থেকে এত সহজে অনুমতি পাওয়ায় সবাই সীমাহীন আনন্দে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলে, ফলে এক সপ্তাহ চলে গেলো শুধু প্ল্যান করতে করতেই। স্পন্দন আর জুবায়ের আগে বহুবার একা ঘুরতে গেলেও তাদের চার বান্ধবীর এই প্রথম একা একা এত দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, তাই সবকিছুতেই তারা এক ধরনের চাপা উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ অনুভব করে।

অবশেষে ঠিক হল ওরা জুবায়েরদের নিজস্ব হায়েস কার নিয়ে ট্যুরে যাবে। গাড়ির ড্রাইভার ওলি ভাই খুবই মজার মানুষ! ওরা ঘুরতে যাচ্ছে শুনে তিনি নিজেও সমান আগ্রহ দেখালেন। পুরনো চাকরির সুবাদে তিনি অনেকদিন খাগড়াছড়ি ছিলেন, তাই সেখানকার রাস্তাঘাট হাতের উল্টোপিঠের মতই তার নখদর্পনে। তার কথা শুনে ওদের সকলের সব চিন্তা-ভাবনা-কিন্তু এক ফুৎকারে উড়ে গেল। বহুদিন বাদে শুধু বন্ধুরা নিজেদের মত হইচই করতে করতে বেড়াতে পারবে…এই আনন্দ ভাবনায় তাদের যাওয়া অব্দি আর ঘুম হল না ঠিকমত।

প্ল্যান মোতাবেক এক সকালে সবাই ওলি ভাইকে নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। জুবায়ের গাড়িসহ প্রীতিকে নিয়ে প্রথমে অন্তরাদের বাড়িতে এলো। স্পন্দন ওখানেই অপেক্ষা করছিলো ওদের জন্য। এরপর ওরা চারজন মিলে গেলো ঈশিতাদের বাড়িতে। কথা ছিল রুবী ওখানেই ঈশিতার সঙ্গে ওদের অপেক্ষায় থাকবে, কিন্তু গিয়ে দেখা গেলো রুবী আসেনি। ওর মা নাকি হঠাৎ বেঁকে বসেছেন। খবর শুনে সবাই কমবেশি বিমর্ষ বোধ করে। এত প্ল্যান প্রোগ্রাম করার পর শেষ মুহূর্তে এসে এমন ভজঘট বাধায় প্রীতি বিরক্ত হয়ে বলে,

– ধুর, বাদ দে তো অন্তু! চল আমরা আমরাই রওনা দেই। এতদিন ধরে আন্টি সব জানার পরেও কিছুই বলল না অথচ আজকে যাওয়ার সময় তার এমন করার মানে আছে?

– তাড়াতাড়ি রওনা না দিলে যাইতে যাইতে রাইত হইবো আপুরা, পাক্কা আট ঘণ্টা লাগে কিন্তু।

ওলি ভাই ওদের স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু অন্তরার মন কিছুতেই রুবীকে এভাবে ফেলে রেখে যেতে সায় দেয় না। পাহাড় দেখার এত সাধ মেয়েটার, তাকে একা ফেলে ওরা যায় কি করে! স্পন্দন অন্তরার মুখ দেখে ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারে। সে সিটে চাপড় মেরে গাড়ির সবার উদ্দেশ্যে ভাষণের স্টাইলে বলে,

– যাব যখন ঠিক করেছি, তখন সবাইকে নিয়েই যাব। কাউকে ফেলে রেখে যাওয়া চলবে না। আজ যত রাতই হোক যেতে যেতে রুবীকে ছাড়া আমরা ঢাকা শহর ছাড়ছি না। চলুনতো ওলি ভাই, আমরা না হয় একবার রুবীদের বাড়িতে গিয়ে দেখি ব্যাপারটার কোন ফয়সালা করা যায় কিনা।

স্পন্দনের কথামতো ওরা রুবীদের বাড়ী গেলো। রুবীর মা সঙ্গে দুটো উপযুক্ত ছেলেকে দেখে প্রথমটায় আরো বেঁকে বসেন, তবে অন্তরাকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে খুব পছন্দ করেন। আর কারো ওপর তেমন ভরসা না থাকলেও অন্তরার উপর তার অগাধ বিশ্বাস এবং ভরসা রয়েছে। তাই দীর্ঘ এক ঘণ্টার চেষ্টা চরিত্রর পর অবশেষে মেয়েকে ছাড়তে রাজী হন তিনি।

সব ঝুট ঝামেলা শেষ করে ওরা বেলা এগারোটায় খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দলছুট আনন্দে সবার আত্মহারা অবস্থা, মেয়েরা অল্পতেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে এর ওর গায়ের ওপর।

তবে ওলি ভাইয়ের কপালে চিন্তার রেখারা ঈষৎ আঁকিবুকি কাটে। তিনি চিন্তিত কন্ঠে জুবায়েরকে বলেন,

– দেরী কইরা ফেললেন ভাইজান! আরো আগে রওনা দেওন উচিত ছিলো। যাইতে যাইতে রাইত হইবো।

– হুমম, এইজন্য মেয়ে মানুষ নিয়া প্ল্যান করাই ঠিক না। খালি ভেজাল বাধায়!

মুখে যাই বলুক স্পন্দনের কন্ঠে চিন্তার রেশ মাত্র নেই। ওর কথা শেষ হতেই মেয়েরা হইহই করে প্রতিবাদ করে ওঠে।

– শোনেন , আমরা কিন্তু দলে ভারী তাই ভেবে চিন্তে খোঁচা দিবেন। এমনিতেই আপনি হচ্ছেন হাফ টিকেট।
রুবী স্পন্দনকে উদ্দেশ্য করে বলে ।

– হাফ টিকেট?
স্পন্দন জিজ্ঞাসু চোখে রুবীর দিকে চায়।

– তাইতো! আপনি তো এখনো অন্তরার বর হবার পুরা অনুমতি পাননি, শুধু এনগেজমেন্ট হইসে। তাই আপনি হইলেন হাফ টিকেট আর জুবায়ের ভাই ফুল টিকেট।

– শুনলে অন্তু , তোমার জামাইরে বলে হাফ টিকেট !!! এই মেয়েরে এত ঝুলাঝুলি করে ট্রিপে আনাই ভুল হইসে! স্বভাবে তো এই মেয়ে একদম মীরজাফর গোত্রের।
স্পন্দনের কথায় সবাই হেসে দেয়।

দিনটা সবার খুব আনন্দে কাটতে থাকে। আড্ডা, গল্প, ইচ্ছে হলেই গাড়ী থামিয়ে চা খাওয়া এভাবেই ওদের গাড়ী ধীরগতিতে এগিয়ে চলে সময়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।

সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে ওরা একটা চা বাগানের কাছে থামে। ইচ্ছে খানিকটা চা বিরতি নেয়ার। গাড়ি থেকে নেমেই মেয়েরা চা বাগানের দিকে ছোটে, তবে বাগানের গার্ড তাদেরকে সাবধান করে বলে তারা যেন বেশি দূরে না যায় কেননা একটু পরেই আধার নামবে।

স্পন্দন গার্ডের সাথে আলাপ করে জানতে পারে জায়গাটা ফটিকছড়ি। ততক্ষণে মেয়েরা চা বাগানে ঢুকে এলোমেলোভাবে ঘোরাফেরা করতে শুরু করেছে। স্পন্দন তাই আলাপ রেখে অন্তরাকে অনুসরণ করে বাগানে ঢুকতে যেতেই পেছন থেকে ওলি ভাই তাকে ডাক দেয়।

– কী ওলি ভাই , কোনো সমস্যা ?

– ভাইজান বেশি দেরী কইরেন না , অলরেডি সন্ধ্যা হইয়া গেসে কিন্তু।

– সন্ধ্যা হলে সমস্যা কোথায়? আপনি না বললেন আপনার পাহাড়ী রাস্তায় রাতেও গাড়ী চালাতে প্রবলেম নাই ?

– ভাইজান, এম্নে তো কোনো সমস্যা নাই কিন্তু দেকসেন কেমুন মেঘ করতেসে? মনে হয় বৃষ্টি হইবো। যদি বৃষ্টি হয় তাইলে কিন্তু একটু সমস্যা আছে।

– কী সমস্যা ?
স্পন্দন ভ্রু কুঁচকে জানতে চায়।

– এইসময় বৃষ্টি নামলে মাঝে মইধ্যে পাহাড়ী রাস্তায় খোয়া নামে।তখন গাড়ী চালাইতে সমস্যা হয়।

– খোয়া মানে?

– মানে কুয়াশার মতো মেঘ নিচে নাইমা আসে।

-ও আচ্ছা! আমি ওদের আসতে বলছি, আপনি বরং পাশের দোকানে সবার জন্য চায়ের কথা বলুন। চা খেয়েই আমরা আবার রওনা দেবো।

স্পন্দন ওলির কথায় তেমন গা করে না। ওলি ভাই স্পন্দনকে ব্যস্তসমস্ত পায়ে বাগানের দিকে যেতে দেখে আপন-মনে কাঁধ ঝাঁকায়, তারপর চায়ের স্টলের দিকে পা বাড়ায়।

বাগানে ঢুকে একটু খোঁজাখুঁজির পর স্পন্দন দেখতে পায় অন্তরা একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে পাহাড়ের কোলে সূর্য অস্ত যাওয়া দেখছে। স্পন্দন পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সে বিস্মিত কন্ঠে বলে,

– দেখছো কি সুন্দর! তাই না? খালি তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে হয়।

সূর্য গলা লাল আলোয় অন্তরাকে পটে আঁকা ছবির মতো সুন্দর দেখাচ্ছে। স্পন্দন তাই অন্তরার দিকে চেয়ে মুগ্ধ কন্ঠে বলে,
– তোমারও তো দেখি আমার মতই অবস্থা! খালি তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

অন্তরা স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে দেখে স্পন্দন ওর দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে। স্পন্দনের কথার মানে বুঝতে পেরে অন্তরা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। তাই দেখে স্পন্দন বিস্মিত কন্ঠে প্রায় চেঁচিয়ে বলে,

– মাই গড, অন্তু! তুমি রাগ করলে আর লজ্জা পেলে তোমার গালদুটো এমন লাল হয়ে যায়! দারুণ লাগে, বিলিভ মি!

– ধুর, কি শুরু করছো!

স্পন্দন ঠোঁট উল্টে একটা কপট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে,
– শুরু নারে শেষ করতে এসেছি ! ওলি ভাই যেতে বলেছেন। বললেন বৃষ্টি আসতে পারে , তখন নাকি গাড়ী চালাতে প্রবলেম হবে পাহাড়ি রাস্তায়। তাই দেরী না করাই ভালো।

– তাই? ইস! এত সুন্দর একটা জায়গা রেখে যেতে ইচ্ছে করছে না যে!

– বাস্তববাদী মাস্টারনীর কন্ঠে আজ অন্য সুর বাজে দেখি!

স্পন্দনের কৌতুকে অন্তরা তার পিঠে মৃদু কিল মেরে বলে,
– বেড়াতে এলে সব অনিয়মই চলে! বুঝলা মশাই? ওকে , চল তাইলে ফেরা যাক।

অন্তরা আর স্পন্দন সবাইকে ডেকে নিয়ে চা বাগান থেকে বেরিয়ে টি স্টলে গিয়ে দেখে ওলি ভাই ইতিমধ্যে এক কাপ চা আর তিনটে পুরি পেট পূজায় নিবেদন করে ফেলেছেন।
তারাও তাই আর সময় নষ্ট না করে দুটো টেবিল দখল করে নিয়ে চা খেতে বসে পড়ে।

ঠান্ডা ঠান্ডা ভেজা পাহাড়ি পরিবেশে খোলা টিস্টলে বসে চায়ে চুমুক দিতে মন্দ লাগছিল না কারো। চা খেতে খেতে তারা আলাপ করছিল খাগড়াছড়ি পৌঁছে কাল সবার আগে তারা কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবে। ঠিক এমন সময় একটা মেয়ে এসে ওদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– আপনাদের সাথে একটু কথা বলতে পারি?

স্পন্দন তাকিয়ে দেখে এক অল্পবয়স্ক শাড়ি পরিহিতা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির চোখে উদভ্রান্তের দৃষ্টি, যেন কোনো কারনে সে ভীত সন্ত্রস্ত।

চলবে …..

#আফসানানীতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here