অন্যরকম ভালোবাসা, পর্ব:১৫

#অন্যরকম_ভালোবাসা

#আফসানানীতু

#শেষ_পর্ব

কতক্ষণ অজ্ঞান অবস্থায় ছিল বলতে পারবে না অন্তরা। ওর মনে হল, একগাদা কুয়াশার মাঝে ও পথ হারিয়েছে আর দূর থেকে কেউ বোধহয় ওর নাম ধরে ডাকছে। আস্তে আস্তে চোখ খুলে অন্তরা, প্রথমে দৃষ্টি ঝাপসা থাকলেও ধীরে ধীরে সব পরিস্কার দেখতে পায়। স্পন্দন ওর মুখের উপর ঝুঁকে ওর নাম ধরে ডাকছে বারবার। স্পন্দনের মুখ রক্তে মাখামাখি , বা’চোখটা ফুলে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায়। অন্তরার মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে, নড়াচড়ার চেষ্টা করতেই পুরো শরীরে এক অবর্ণনীয় ব্যথা অনুভব করে সে।

– তুমি ঠিক আছো অন্তু ?

স্পন্দন উদ্বেগ ভরা কন্ঠে জানতে চায়। প্রথমে অন্তরা কিছুই মনে করতে পারে না, কিছুক্ষণ স্পন্দনের দিকে বোবা চোখে তাকিয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে তার সব মনে পড়ে। তারা গাড়িতে করে যাচ্ছিল আর হঠাৎ গাড়িটা রাস্তা ছেড়ে নিচে পড়ে যায়। অন্তরা মাথা নেড়ে স্পন্দনকে আশ্বস্ত করে যে সে সুস্থ আছে, তারপর মাথা ঘুরিয়ে গাড়ীর ভেতরটা দেখার চেষ্টা করে। স্পন্দন মোবাইলের টর্চ জ্বেলে রেখেছে, তবে সেই ক্ষীণ আলো গাড়ির ভেতরের জমাট অন্ধকার পুরোপুরি দূর করতে পারেনি। আবছা আলো আঁধারে সে তার পাশে বসে থাকা রুবী ও ঈশিতাকে স্পষ্ট দেখতে পায়না তবে এক ধরনের গোঙ্গানির শব্দ শুনতে পায়।

– আমরা কোথায় স্পন্দন।
অন্তরা ক্ষীণ কণ্ঠে জানতে চায়।

– কপাল কতটুকু ভালো বলতে পারবোনা অন্তু, তবে এতটুকু বলতে পারি… ভাগ্যের জোরেই বোধহয় গাড়িটা খাড়া ঢালে না পড়ে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তাই একদম নীচে না পড়ে আটকে আছে কোথাও। অন্ধকারে আশেপাশের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আমার দিকের দরজাটা মে বি জাম হয়ে গেছে কিংবা কিছুর সাথে আটকে আছে, অনেক চেষ্টা করেও খুলতে পারলাম না। অবশ্য না বুঝে শুনে বাইরে পা রাখাটাও বোধহয় ঠিক হবে না, কে জানে হয়তো পা দিলাম আর দেখলাম একেবারে নিচে পড়ে ঘাড় মটকে কুল্লু খালাস!

– এই বিপদের মাঝেও তোমার মজা করতে ইচ্ছে হয় স্পন্দন? তুমি কি!

– সরি অন্তু, আসলে ভীষণ আপসেট বোধ করছি, আর সেজন্যই হয়তো উল্টোপাল্টা বকছি। তুমি ঠিক আছো তো? কোথাও লাগেনি তো তোমার?

– আমি ঠিক আছি, আর সবার কি অবস্থা? সবাই ঠিক আছো তো?
অন্তরা গলা চড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে জানতে চায়।

স্পন্দন নিজের মোবাইলের আলোটা চারদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করে। সে জোর গলায় সবার উদ্দেশ্যে বলে,
– যার যার হাতের কাছে মোবাইল আছে তারা টর্চ জ্বালাও, প্লীজ!

স্পন্দনের কথা শেষ না হতেই ঈশিতা কোকিয়ে ওঠে,
– আমার পা দুটো বোধহয় ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে স্পন্দন ভাই । সামনের সিটের নীচে আটকে গেছে, একচুলও নাড়াতে পারছি না পা দুটো। প্রচন্ড ব্যাথা …..

রুবী টেনে টেনে জবাব দেয়,
– আমার হাত-পা বোধহয় ঠিক আছে, তবে পুরো শরীরে প্রচন্ড ব্যথা!

ঈশিতা জানালার ধারে ড্রাইভিং সিটের ঠিক পেছনের সিটে বসেছিল। অ্যাক্সিডেন্টের সময় সে তার পাদুটো খুব সম্ভবত ড্রাইভিং সিট বরাবর সোজা করে রেখে দিয়েছিল। ড্রাইভিং সিটটা পেছনদিকে ভয়ংকরভাবে দেবে যাওয়াতে ওর পা দুটো সিটের নিচে বিচ্ছিরিভাবে বাকা হয়ে আটকে গেছে। স্পন্দন তার মোবাইলের আলোটা ঈশিতার দিকে ফেলতেই পুরো দৃশ্যটা দেখে অন্তরা শিউরে ওঠে।

– এখন কী হবে, স্পন্দন ?
কণ্ঠে উদ্বেগ নিয়ে জানতে চায় অন্তরা।

– ভয় পেয়ো না অন্তু। আমার মোবাইলে ধানমন্ডি থানার ওসি সাহেবের নাম্বার ছিল, তার কাছে সবকিছু খুলে বলার পর তিনি এখানকার থানার সাথে যোগাযোগ করেছেন। একটু আগে ওখান থেকে কল আসছিল। ওরা বলসে, আমার কল লোকেশন ট্রেস করার চেষ্টা চলছে। সেটা করতে পারলেই ওরা ওদের রেসকিউ টিম পাঠিয়ে দেবে। তুমি একটুও ভেবো না, শুধু একটু ধৈর্য ধরো। সব ঠিক হয়ে যাবে।

অন্তরা মাথা নাড়িয়ে স্পন্দনের কথায় সায় দেয়। স্পন্দন তার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে অল্প হাসে।

– আমরা কি গাড়ী থেকে নামবো?
রুবী জানতে চায় ।

– দেখো… গাড়ী কোথায় কতটা নীচে আছে জানি না। অনেক চেষ্টা করেও আমি গাড়ির পজিশন বুঝতে পারছি না। যদিও গাড়ীর হেডলাইট জ্বলছে কিন্তু এত অন্ধকারে আশেপাশের গাছের জটলার ভেতর কিছুই ঠাওর করা যাচ্ছে না। তাছাড়া এদিকের জঙ্গলে কোনো বন্য প্রাণী আছে কিনা তাও আমরা জানিনা। তাই সাহায্য না আসা পর্যন্ত গাড়ীর ভেতর থাকাই ভালো।

স্পন্দনের কথায় যুক্তি আছে, রুবী তাই মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দেয়। হঠাৎ পেছনের সিট থেকে কারো কাতর কণ্ঠ শুনতে পেয়ে অন্তরার মনে পড়ে, তাইতো পেছনের সিটে তো প্রীতি আর জুবায়ের বসেছিল! অন্তরা তার হাতের মোবাইলের টর্চ ঘুরিয়ে গাড়ির পেছনে দেখার চেষ্টা করে। আলো ফেলতেই পেছনের দৃশ্যটা দেখে অন্তরার বুকটা ভেঙ্গে যায়। পেছনের সিটে জুবায়ের অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে মাথা এলিয়ে পড়ে আছে। তার সাদা শার্ট রক্তে ভেজা , চোখ দুটো খোলা। ওর চোখের শূন্য দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে ও আর বেঁচে নেই! প্রীতির শরীরের অর্ধেকটা জুবায়েরের শরীরের নীচে চাপা পড়ে আছে। প্রীতি তার মাথাটা জুবায়েরের কাঁধে রেখে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। উৎকণ্ঠায় অন্তরার বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে, প্রীতি বেঁচে আছে তো?

– প্রীতু ….

আর্তনাদ করে ওঠে অন্তরা। তবে ওকে অবাক করে দিয়ে প্রীতি চোখ খুলে তাকায়। তারপর বোকা বোকা চোখে খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকার পর আবার জুবায়েরের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে।

প্রীতি বেঁচে আছে এটাই অন্তরার জন্য অনেক! অন্তরা এবার সুরমার দিকে আলো ধরে। সুরমা অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রায় কাত হয়ে শুয়ে আছে সিটে। ওর একটা পা সামনের সিটের নীচে আটকে আছে আর আরেকটা পা প্রীতির গায়ের ওপর তোলা। মেয়েটার শরীরের নিম্নাংশে চোখ যেতেই আঁতকে ওঠে অন্তরা। সুরমার পরনের শাড়িটার নিচের অংশ সম্পূর্ণ ভেজা। সেটা রক্তে কিনা, অন্ধকারে ঠাওর করতে পারে না সে। প্রচন্ড ব্যথায় সুরমার ঠোঁট নীল হয়ে গেছে, অস্পষ্টভাবে কাতরানোর শব্দটা তার মুখ থেকেই বের হচ্ছে।

অন্তরার বুঝতে দেরী হয়না যে তীব্র ঝাকুনিতে সময়ের আগেই সুরমার পানি ভাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। সে কোনমতে হাচড়ে পাচড়ে সিটের উপর দিয়ে সুরমার যতটুক সম্ভব কাছাকাছি যায়, তারপর তার পেটে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে বাচ্চাটা বেঁচে আছে কিনা। অনেক চেষ্টার পর বাচ্চার মৃদু নড়াচড়া টের পায়। এত উচাটনের মাঝেও অন্তরা কিছুটা স্বস্তি পায় যেন। অন্তরা স্পন্দনকে মৃদুস্বরে জানায়,
– বাচ্চাটা এখনো বেঁচে আছে, তবে খুব শিগগিরই মারা যাবে।

– মারা যাবে ! কিন্তু কেন?

– কেনো মানে ? দেখছো না, উনার লেবার প্রসেস শুরু হয়ে গেছে? কিন্তু এই অবস্থায় ডেলিভারি কিভাবে সম্ভব? আর সময় মতো বাচ্চাটাকে বের করতে না পারলে কিছুক্ষণ পরই অক্সিজেনের অভাবে মরে যাবে বাচ্চাটা।

অন্তরার কথা শুনে এত ভয়ংকর অবস্থার মাঝেও সুরমা আর্তনাদ করে ওঠে,
– দোহাই আপনার, আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান প্লিজ!

স্পন্দন অন্তরাকে প্রায় ফিসফিস করে বলে,
– ডেলিভারি তোমরা করাতে পারবানা অন্তু?

– তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? এখন কীভাবে ! তাছাড়া আমি এখনো কিছুই পারিনা..

স্পন্দন আশ্চর্য শান্তকণ্ঠে জবাব দেয়,
– অন্তু আমি সব বুঝি , কিন্তু একবার ভাবো তোমরা এতগুলা ডাক্তার থাকতে বাচ্চাটা যদি মরে যায় নিজেকে সারাজীবন মাফ করতে পারবা? চেষ্টা করার পরে যদি কিছু হয়ও তবুতো মনকে স্বান্তনা দিতে পারবা যে দোষ তোমাদের ছিলনা।
স্পন্দন অন্তরার কাঁধে মৃদু চাপ দিয়ে বলে,
– এটলিস্ট ট্রাই করো ! আমি জানি তুমি পারবা অন্তু ।

স্পন্দনের ব্যথায় কাতর শান্ত চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে অন্তরার সবকিছু কেমন ওলট পালট হয়ে যায়। তাইতো, তারা যাই পারে আর না পারে অন্ততপক্ষে চেষ্টা তো করতে পারে! নইলে সত্যি যদি সে বেঁচে ফিরতে পারে, শুধু বাচ্চাটা সঙ্গে না থাকে তাহলে ভবিষ্যতে এই কথা ভেবে কমবেশি মর্মবেদনা তাকে অবশ্যই দংশন করবে। স্পন্দনের কথায় নিজের ভেতরে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় অন্তরা। নিজেই নিজের মনকে প্রশ্ন করে,তাইতো ….চেষ্টা করতে ক্ষতি কি ?

এদিকে তার ভাবনার মাঝে হঠাৎ করেই স্পন্দন হরহর করে গাড়ি ভাসিয়ে বমি করে দেয়। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে শার্টের হাতার কোনায় মুখ মুছে অন্তরার দিকে ফিরে ক্লান্ত কন্ঠে বলে,
– ইস্, কেন যে বারবার বমি হচ্ছে ! সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হইলো, এত ঝামেলার মাঝেও আমার খুব ঘুম পাচ্ছে অন্তু।

অজানা আশঙ্কায় অন্তরা কেঁপে ওঠে। স্পন্দন মাথায় আঘাত পেয়েছে ,ওর এই বমি আর ঘুম ঘুম ভাব বলে দিচ্ছে মস্তিষ্কের কোথাও রক্তক্ষরণ হচ্ছে। খুব দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে স্পন্দনের মৃত্যুও হতে পারে। ভয়ে শঙ্কায় তার ভেতরটা কুকড়ে গেলেও ব্যাপারটা বুঝতে দেয়না স্পন্দনকে অন্তরা। আসলে এই ক্ষেত্রে অন্তরার কিছুই করার নেই, শুধু খেয়াল রাখতে হবে স্পন্দন যেন ঘুমিয়ে না পড়ে। যেভাবেই হোক ওকে জাগিয়ে রাখতে হবে, ও ঘুমিয়ে গেলেই সর্বনাশ হবে। হয়তো এই ঘুম থেকে ও আর ফিরতে নাও পারে। অন্তরা স্পন্দনকে ব্যস্ত রাখার জন্য তার হাতটা ধরে বলে,

-ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করবো স্পন্দন। কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে, পুরোটা সময় তুমি আমার পাশে থাকবে। ঘুমিয়ে গেলে চলবেনা।

– আমি আছিতো … সবসময় ….

স্পন্দনের কন্ঠে স্পষ্ট ক্লান্তির ছোঁয়া। তবুও সে অন্তরার হাতটা ধরে তাকে আশ্বস্ত করে। অন্তরা আর রুবী মিলে প্রথমে প্রীতিকে টেনে হিচড়ে কোনমতে সামনের সিটে নিয়ে আসে। জুবায়েরের শরীরের নীচে পড়ে ওর ডান হাতটা বিশ্রীভাবে ভেঙ্গে গেছে। বেচারী এখনো ট্রমাতেই আছে, তাই এত টানা হেচড়ার পরও চোখ খুলে বারকয়েক কেবল ওদের দিকে তাকায়, তবে কিছুই বলে না। শুধু জুবায়েরের শরীরের নিচ থেকে তাকে টেনে বের করে আনার সময় ব্যাথায় নাকি কষ্টে চেঁচিয়ে উঠে একবার।

প্রীতিকে সামনের সিটে বসাবার সময় অন্তরার চোখ যায় ড্রাইভিং সিটে, দেখে অলি ভাই স্টিয়ারিং হুইলে মাথা দিয়ে পড়ে আছে। প্রচন্ড আঘাতে উনার মাথা প্রায় থ্যাতলে গেছে, রক্ত আর ঘিলু বেরিয়ে বীভৎস দেখাচ্ছে তার মৃত মুখটা। অন্তরা সে দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।

অনেক কষ্টে সিট টপকে অন্তরা আর রুবী চলে যায় সুরমার কাছে । হাজার চেষ্টা করেও তারা জুবায়েরের লাশটা পেছনের সিট থেকে সরাতে পারে না। ফলে পেছনের সিটে তাকে জুবায়েরের মৃত শরীরের উপর বসে থেকেই সুরমাকে পরীক্ষা করতে হয় অগত্যা। কীভাবে কি করবে জানেনা ওরা। সুরমার যা অবস্থা তাতে নিজ শক্তিতে সে কতটুকু পারবে কে জানে! রুবী সুরমার পেটের নিম্নাংশে মৃদু চাপ দিতে থাকে আর অন্তরা তার সাধ্যমত নিজের জ্ঞান দিয়ে চেষ্টা করতে থাকে।

সুরমার অবস্থা খুবই খারাপ! তবু সে অন্তরার হাত খামচে ধরে নিজের শরীরের যতটুকু অবশিষ্ট শক্তি আছে তাই দিয়েই চেষ্টা করতে থাকে… হাজার প্রতিকূল পরিবেশের সাথে লড়াই করে হলেও তাকে জিততে হবে, কেননা একজন মায়ের এতো সহজে হার মানতে নেই।

– পুশ সুরমা পুশ …

অন্তরা আশেপাশের সব কিছু ভুলে গিয়ে চিৎকার করে সুরমাকে চেষ্টা চালিয়ে যাবার সাহস যোগায়। তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে …

শেষ একটা জান্তব চিৎকার বেরিয়ে আসে সুরমার গলা থেকে। অন্তরা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার হাতের নবজাতকের দিকে। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে শেষ পর্যন্ত বাচ্চাটাকে বের করতে সক্ষম হয়েছে। আনন্দে উত্তেজনায় সে প্রায় ফিসফিস করে স্পন্দনকে বলে,
– আমরা পেরেছি স্পন্দন , আমরা পেরেছি!

কিন্তু উত্তরে স্পন্দনের কোন সাড়া না পেয়ে চমকে তাকায় অন্তরা। তাইতো, এত উত্তেজনার মাঝে সে স্পন্দনের কথা ভুলেই গিয়েছিল! তাকিয়ে দেখে স্পন্দন সিটে বসে ঝিমাচ্ছে।
একহাতে স্পন্দনের কাঁধ ধরে জোরে ঝাঁকুনি দেয় অন্তরা। স্পন্দন চোখ খুলতেই অন্তরা তাকে বাচ্চাটা দেখায়। স্পন্দনের পকেট নাইফ দিয়ে কোনভাবে মা ছেলের নাড়ির বন্ধন মুক্ত করে তারা। তারপর নিজের ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে বাচ্চাটাকে স্পন্দনের দিকে বাড়িয়ে ধরে। স্পন্দন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,

– আমি?

অন্তরা মাথা নেড়ে সায় জানায় যে তাকেই বাচ্চাটা ধরতে হবে। আসলে স্পন্দনকে ব্যস্ত রাখার জন্য এটা অন্তরার একটা কৌশল মাত্র। সদ্যপ্রসূত বাচ্চাটা হাত-পা ছুঁড়ে ইচ্ছেমত কাঁদছে, স্পন্দন তাকে সাবধান কোলে তুলে নেয়। স্পন্দন বুকে নিতেই কাঁদুনে বাচ্চাটা কেমন চুপ হয়ে যায় বুকের উষ্ণতায়।

অন্তরা রুবীর দিকে তাকিয়ে দেখে ও সুরমাকে পরীক্ষা করছে। সে অন্তরার দিকে ফিরে মাথা নেড়ে ইশারায় জানিয়ে দেয় সুরমা আর বেঁচে নেই। নিজের সমস্ত আত্মিক শক্তি দিয়ে বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে রেখে নিজে চলে গেছে সুরমা। জুবায়ের আর অলি ভাইয়ের লাশের সঙ্গে আরও একটা লাশ যুক্ত হওয়ায় ওদের মনটা বিষন্ন হয়ে ওঠে আবারো।

হঠাৎ স্পন্দনের বুক পকেটে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠে। স্পন্দন তখনও বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে তাই অন্তরা স্পন্দনের ফোনটা হাতে নিয়ে কলটা রিসিভ করে।

– হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন ? আমি এস আই হাসান বলছি।

– জ্বী শুনতে পাচ্ছি, বলুন?

– আমরা আপনার মোবাইল লোকেশনে চলে এসেছি , কিন্তু অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না বলে জায়গাটা ট্রেস করতে পারছি না। আপনারা প্লীজ কোনরকম আওয়াজ করে বা অন্য কোনভাবে আপনাদের অবস্থান জানাতে পারবেন আমাদের?

পুলিশ চলে এসেছে শুনে অন্তরার ভেতরটা আনন্দে নেচে ওঠে।
– আমি ঠিক বলতে পারছি না,তবে চেষ্টা করে দেখছি।

অন্তরা রুবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
– একটু দেখবি, গাড়ির হর্ণটা বাজে কিনা ?
তারপর স্পন্দনকে আনন্দে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আমরা বেঁচে গেছি স্পন্দন , সাহায্য চলে এসেছে।

কিন্তু অন্তরার উত্তেজনা বা আনন্দের এতটুকুও যেন স্পর্শ করতে পারে না স্পন্দনকে। সে বাচ্চাটাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে রেখে ক্লান্ত কন্ঠে বলে,
– খুব ঘুম পাচ্ছে অন্তু। বাচ্চাটাকে একটু ধরবা? ওরা আসার আগে আগে আমি না হয় এই ফাঁকে একটু ঘুমায় নেই।

অন্তরা বুঝতে পারে সুরমা যে মারা গেছে সেটা স্পন্দনকে না বললেও সে ঠিকই ব্যাপারটা টের পেয়েছে। সে স্পন্দনের কাছে মিনতি করে বলে,
– না স্পন্দন, এখন ঘুমানো যাবেনা। কোনভাবেই না! আর একটু অপেক্ষা করো লক্ষ্মীটি।

– কি ঝামেলায় পড়া গেলো বলতো দেখি ! সেই কখন থেকে ঘুমাতে চাইতেছি অথচ ঝামেলার কারণে একটু ঘুমাতেও পারতেছি না। এবার সব ঝামেলা চুকে গেলে সবার আগে একটা লম্বা ঘুম দেবো, কি বলো?

অন্তরা স্পন্দনের কথায় ফুঁপিয়ে ওঠে। নিজের উদগত অশ্রুকে অনেক কষ্টে সংবরণ করে স্পন্দনের রক্তমাখা ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
– অবশ্যই! বাচ্চাটাকে তুমি রাখবা, না আমাকে দিবা?

– না থাক, ঘুমাতে যখন পারতেছি না তখন থাকুক না হয় গোল্লাটা আমার কোলেই। দেখসো অন্তু, বাচ্চাটা কেমন বুকের সাথে মিশে আছে! কেমন যেনো বাবা বাবা ফিল হচ্ছে।
স্পন্দন ঘুমকাতুরে চোখে অস্পষ্টভাবে হাসে।
– মনে হচ্ছে নিজের বাচ্চা।

– আমাদেরই তো।

– ঠিক বলছো। ওর তো বাবা মা কেউ বেঁচে নেই। তাছাড়া ওরা পেলে বাচ্চাটাকে মেরেই ফেলবে। তারচেয়ে ও আমাদের সাথেই থাক। আজ থেকে তুমি ওর মা আর আমি ওর বাবা। ব্যাপারটা কিন্তু ভারী মজার হবে! ছোট্ট একটা নাদুস-নুদুস বাচ্চার দুইজন আনম্যারেড বাবা-মা, কি বলো?

অন্তরা বাচ্চাসহ স্পন্দনকে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে যেন ছেড়ে দিলেই ওরা দুজন অন্তরাকে ছেড়ে পালাবে।

এদিকে রুবী বহুকষ্টে হাঁচড়ে পাঁচড়ে সকলকে ডিঙিয়ে ড্রাইভিং সিটের কাছে যায়, তারপর অলি ভাইয়ের লাশটা সরিয়ে হর্নে চাপ দেয়। চারপাশের নিস্তব্ধতাকে ছিঁড়ে হর্ণটা তীব্র চিৎকার করে ওঠে । তাই শুনে পিছন থেকে ইশিতা তীব্র ব্যথার মাঝেও আনন্দে অদ্ভুত এক ধরনের হর্ষধ্বনি করে।

– দেখসো অন্তু, আমি বলসিলাম না সব ঠিক হয়ে যাবে ? দেখো, সব ঠিক হয়ে গেছে। রেস্কিউ টিম চলে আসছে, আবার সকালও হয়ে গেছে । চারিদিকে কত আলো।

অন্তরা ফুঁপিয়ে ওঠে, কারণ চারিদিকে এখনো রাতের ঘুটঘুটে কালো আধার। অন্তরা বেশ বুঝতে পারে স্পন্দনের হেলুসিনেশন হচ্ছে ….. আর তাই ও উল্টা পাল্টা বকছে…..
অন্তরা স্পন্দনকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে আর বলতে থাকে,
– প্লিজ, স্পন্দন প্লিজ! আর একটু অপেক্ষা করো…. আর একটু…! প্লিজ, স্টে উইথ মি… প্লিজ… প্লিজ!

***

অন্তরা পায়েসের বাটিটা টেবিলে রেখে সন্তুষ্টচিত্তে একটা লম্বা দম নেয়। আজকে বিকেলে স্পন্দনের সব বন্ধুরা খেতে আসবে ওদের বাসায়। তাই সেই সকাল থেকে যত্ন করে এটা সেটা বানাচ্ছে অন্তরা। অন্তরা টিপটপ করে সাজানো খাবার টেবিলের দিকে তাকিয়ে আনমনে হাসে, আর ঠিক তখনই হঠাৎ করে কি একটা উড়ে এসে পড়ে পায়েসের বাটিতে! মুহূর্তেই চারিদিকে পায়েস ছিটকে পড়ে সাজান টেবিলের যাচ্ছেতাই অবস্থা করে দেয়। অন্তরা অবাক হয়ে দেখে, একটা ক্রিকেট বল তার সাধের পায়েসে সাঁতার কাটছে। ব্যাপার দেখে রাগে অন্তরার ব্রহ্মতালু অব্দি জ্বলে ওঠে। সে রাগে গর্জে উঠে।

– স্পন্দন !!!! কতবার ? কতবার বলসি বাড়ীর সামনে না পিছনে গিয়ে ক্রিকেট খেলতে , কোন কথাই কানে যায় না !

অন্তরা রাগে গজরাতে গজরাতে সদর দরজার দিকে এগোয়,
দেখে ব্যাট হাতে স্পন্দন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কাঁচুমাচু মুখ করে ।
অন্তরা ওর কাছে গিয়ে আচ্ছা করে ওর কানটা মুচড়ে দেয়, তারপর ব্যাটটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলে,
– আজকে এটা আমি যদি না ভাঙছি!

রাগে অন্ধ হয়ে অন্তরা ব্যাটটা মাথার উপর তুলে আছড়ে ফেলবে কি ফেলবে না ভাবছে এমন সময় হঠাৎ তাকে অবাক করে দিয়ে স্পন্দন অন্তরাকে জড়িয়ে ধরে। তার সাত বছরের ছোট্ট শরীরটা মায়ের মুখ নাগাল পায় না। তাই মায়ের পেটের কাছটাতেই টপাটপ চুমু খায় কয়েকটা। আর অমনি অন্তরার সব রাগ যেনো এক ফুৎকারে পানি হয়ে যায়। সে ব্যাটটা নামিয়ে রেখে এক হাতে স্পন্দনের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,

– তোকে না আমি মাত্রই মারলাম,আর তুই কিনা আমাকে চুমু খাচ্ছিস!

– ভালোবাসি যে।

স্পন্দনের পাকা পাকা কথা শুনে অন্তরা হেসে বলে,
– মাইর দিলেও আদর দিস , এইটা আবার কেমন ভালোবাসা তোর?

– এইটা আমার অন্যরকম ভালোবাসা মাম্মা , তুমি বুঝবা না।

স্পন্দন তার ছোট হাতদুটো দিয়ে মাকে জাপটে ধরে।

অন্তরার বুকের ভেতরে চিনচিনে একটা ব্যাথা অনুভূত হয়। তার মনে পড়ে অনেকদিন আগে স্পন্দনও তাকে জড়িয়ে ধরে এই একই কথা বলেছিল…এভাবেই।

সেদিন যখন অনেক চেষ্টা চরিত্রর পর রেস্কিউ টিম ওদের উদ্ধার করে নিয়ে যায় অন্তরার তখন হুশ ছিল না। কে কি বলছে, কি জানতে চাইছে সবকিছুই কেমন যেন দুর্বোধ্য ভাষাহীন মনে হচ্ছিল তার কাছে। স্পন্দন ছাড়া পৃথিবীটা তার কাছে শূন্য মনে হচ্ছিল। খবর পেয়ে স্পন্দনের বাবা যখন হাসপাতালে ছুটে আসেন শুধুমাত্র তখনই তাকে দেখে অন্তরার মুখে ভাষা ফিরে আসে। সে স্পন্দনের বাবাকে জড়িয়ে ধরে মিনতি করে বলেছিল, সুরমার বাচ্চাটা যে বেঁচে আছে এ কথা যেন জানাজানি না হয়। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত স্পন্দন বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল, হতে চেয়েছিল তার বাবা। তাই ও চায়না বাচ্চাটার কোন ক্ষতি হোক, শুধু সারাজীবন তাকে বুকে আগলে রাখতে চায় মা হয়ে। স্পন্দনের বাবা প্রভাবশালী লোক, তিনি পুরো ব্যাপারটা কীভাবে সামলে ছিলেন জানেনা অন্তরা। শুধু জানে সেই থেকে বাচ্চাটা স্পন্দন নামে অন্তরার বুকে পালিত হচ্ছে স্পন্দন আর অন্তরার সন্তান পরিচয়ে।

স্পন্দন বলেছিল যতদিন অন্তরা থাকবে স্পন্দনও ততদিন বেঁচে থাকবে। স্পন্দন বেঁচে নেই, তবে সে তার কথা রেখেছে …সে মরেও বেঁচে আছে ছোট্ট স্পন্দনকে ঘিরে। সত্যিই, এটা স্পন্দনের বড্ড অন্যরকম ভালোবাসা বটে …..

অন্তরার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে , সে পরম মমতায় চুমু খায় ছোট্ট স্পন্দনের কপালে।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here