লুকোচুরি,পর্ব:১

“লুকোচুরি”
পর্ব- ১
(নূর নাফিসা)
.
.
পাশাপাশি দুইটা চারতলা বাসা। একশো সাতাশ নম্বর বাসার তৃতীয় তলা থেকে লুবনা এবং একশো আটাশ নম্বর বাসার তৃতীয় তলা থেকে ইয়াসমিন তুমুল ঝগড়া করছে সকাল থেকে। আর একশো সাতাশ নম্বর বাসার ছাদে বসে বসে তাদের ঝগড়া দেখছে রিজোয়ানা। প্রায় দেড় ঘন্টা যাবত এই রোদের মধ্যে বসে আছে সে। আর তাদের দুই মহিলার ঝগড়া চলছে প্রায় তিন ঘন্টা। কেউ কারো চেয়ে কম না। একটু পরপর বারান্দায় এসে জবাব দিয়ে কাজে হাত লাগায়, চুপচাপ অপর প্রান্তের কথা শুনে আবার বারান্দায় এসে কর্কশ গলায় জবাব দিয়ে যায়। জীবনের যত খোটা আছে, ঝগড়া লাগলে সব বেরিয়ে আসে। আর এমনিতে ছেলেমেয়েদের যতই দোষ থাকুক, ঝগড়াকালে নিজের ছেলেমেয়ের গুণের পাহাড়ের সন্ধান পাওয়া যায়। ফ্ল্যাটে থাকাকালীন মাকে চুপ করানোর চেষ্টায় কতক্ষণ টানাটানি করে ক্লান্ত হয়ে গেছে রিজোয়ানা। তাদের মুখের বুলেটে কানটা তব্ধ লেগে গেছে। তাই বিরক্ত হয়ে চলে এসেছে ছাদে। কখন থামবে, কখন থামবে সেই অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে প্রায় তিনঘণ্টা। অতঃপর যোহরের আজান পড়লে উক্ত দুই জননীকে থামতে দেখা গেলো। রিজোয়ানা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে বললো,
“আল্লাহ! তুমি রহম করলে। আগে জানলে তো সাউন্ড বক্সেই আজানের রেকর্ড ছেড়ে দিতাম। এই বুলেটের অত্যাচার থেকে তো অন্তত বাঁচতে পারতাম!”
অতঃপর প্লাস্টিকের টুল উঠিয়ে নিয়ে ফ্ল্যাটে চলে এলো। কিচেনের দিকে এগিয়ে গরম মেজাজে লুবনাকে কড়াইয়ে খুন্তি চালাতে দেখলো। হালকা কেশে টুলটা রেখে রিজোয়ানা বললো,
“হুহ্! অবশেষে বুলেট ফুরালো তাহলে?”
লুবনা খুন্তি দেখিয়ে বললো,
“আরেকবার ওই ছেলের সাথে কথা বলবি তো জিভ কেটে গলায় বেঁধে দিবো। আর ছাদে যাবি তো ঠ্যাং কেটে রোদে শুকাতে দিবো।”
“কি আশ্চর্য! তুমি ওই মহিলার সাথে ঝগড়া করবা আর অত্যাচার চালাবা আমার উপর! উনার কথায় আমাদের ছাদে আমি যেতে পারবো না এটা কোনো কথা?”
“নাহ! যাবি। একশো বার যাবি। আমার মেয়ে ছাদে যাবে তো তার বাপের কি!”
রিজোয়ানা বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে যেতে লাগলো,
“একশো বার গেলে তোমার মেয়ে এমনিতেই পঙ্গু হয়ে যাবে। তারচেয়ে কি ভালো নয়, দুই বারই যাই?”
লুবনা ধমকের সুরে বললো,
“খবরদার, ওই ছেলের সাথে যাতে কথা বলতে না দেখি। যোগাযোগ টোটালি অফ!”
রিজোয়ানা দ্রুত পা চালিয়ে রুমে চলে গেলো। জানালার পাশে এসে উঁকি দিয়ে ওপাশে ইয়াসমিনকে হাটা চলা করতে দেখা গেলো। তাকে দেখে যাতে আবার বুলেট না ছুড়তে পারে সেজন্য পর্দা টেনে দিলো রিজোয়ানা। চলে গেলো গোসল করতে। নামাজ পড়ে ভাত খেলো, অতঃপর মায়ের ভাত বেড়ে দিয়ে রুমের দিকে এগোতেই কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলে দেখলো লিসান এসেছে। রিজোয়ানা বললো,
“ভাইয়া, আজ এতো তারাতাড়ি চলে এলে যে?”
“কাজ নেই, তাই চলে এসেছি।”
“ভাগ্যিস, আরও আগে আসোনি!”
“কেন?”
“নাহ, এমনি।”
“খাবার দে তো। লাঞ্চ করিনি। ক্ষুধা লেগেছে।”
“কি অবস্থা! হাতমুখও ধুয়নি, খাবার চাইছে! অফিসে থাকতেই কল করতে, অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে যেতাম খাবার নিয়ে।”
লিসান এক গাল হেসে তার রুমে যেতে যেতে বললো,
“তুই যেই ঢিলা কোম্পানি, প্লেটে খাবার তুলতে তুলতে আমি গোসলও করে ফেলতে পারবো।”
“হু, তুমি তো রোবট। আমি যে মানুষ।”
লিসানের জন্য আরেক প্লেটে ভাত দিয়ে রিজোয়ানা চলে এলো রুমে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ইভানের নম্বর থেকে কোনো কল এসেছে কি-না। কিন্তু না, আসেনি। মহারাজ আজ অনেক ব্যস্ত। কোনো খবর নেই তার। সকালে দেখা পর্যন্ত করে যায়নি। সারাদিনে কল দেওয়ারও সময় হয়নি। রিজোয়ানা বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়লো।
ফ্রেন্ডদের সাথে নদীর তীরে ঘুরতে গেছে। নদীর দুকূল ধরে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি কাশবন। কাশফুল ছিড়ে কিছুক্ষণ একে অপরের মাথায় মারামারি করলো তারা। অতঃপর তীর ঘেষে অর্ধডুবন্ত এক ছোট নৌকা পেয়ে সেটাকে টেনে তুললো। পানি সেচে তারা একে একে উঠতে লাগলে দেখলো আবার ডুবে যাচ্ছে। তাই দুজন দুজন করে ঘুরার সিদ্ধান্ত নিলো। প্রথমেই উঠে বসলো রিজোয়ানা। দ্বিতীয় বার তার নেমে পড়ার সময় এলেও সে নামলো না। তৃতীয়বারও সে নামতে চাইছে না। অতঃপর সবাই ঝাক বেঁধে তাকে বকাঝকা করতে লাগলো। সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে সে দুহাতে কান চেপে ধরে রাখলো। পরক্ষণে ঢেউ উঠলো। প্রচন্ডভাবে আঘাত হানছে তীরে! নদীতে সাগরের ঢেউ! মুহুর্তেই বন্ধুবান্ধব সব উধাও! একি! সাগরের ঢেউ কি তাদের সবাইকে নিয়ে চলে গেলো! নদীরও বোধহয় সহ্য হচ্ছিলো না তাদের চেচামেচি। তাই অতিমাত্রায় রেগে সাগরের ঢেউ তুলে দিয়েছে। কিন্তু ঢেউ যে থামছেই না। রিজোয়ানা হেলছে, দুলছে কিন্তু নৌকা থেকে পড়ছে না। সাথে বাতাস বয়ে এনেছে মায়ের কণ্ঠধ্বনি,
“ওই, শয়তান! কিসের ঘুম ঘুমাস! ওঠ!”
পরক্ষণে চোখ খুলে বুঝতে পারলো, ঢেউটা নদীরও ছিলো না সাগরেরও ছিলো না। ঢেউটা ছিলো তার মায়ের ধাক্কাধাক্কির। রিজোয়ানা জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো দুপুরে ঘুমাচ্ছে। তাই ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“আসরের আজান পড়েছে?”
“না, তোর জন্য ইমাম অপেক্ষা করছে।”
“কে? ইভান?”
“ইমাম, ইমাম, ইমাম সাহেব! মাগরিবের আজান পড়ে যাচ্ছে, এতোক্ষণে জিজ্ঞেস করে আসরের আজান পড়েছে কি-না! এখন থেকে ডেকে যাচ্ছি! গাজা খেয়ে ঘুমায়!”
“ইশ! যদি খেতে পারতাম!”
“ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে সব দূর করে দিবো বাড়ি থেকে! বদের হাড্ডি কোথাকার! সারাদিন ঘরে বসে খাওয়া দাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তার!”
যা-ই হাই তুলতে যাচ্ছিলো, ঝাটাপেটার কথায় বাধাগ্রস্ত হলো। লুবনা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলে বললো,
“মা, তুমি দিনদিন ঝগড়ুটে হয়ে যাচ্ছো। ভীষণ ঝগড়ুটে। নিজের মেয়ের সাথেও ঝগড়া করো। এই দুঃখে দুঃখেই কেবল আমি দিন পাড় করছি।”
লুবনা আরও কি যেনো বিড়বিড় করছেন, যা কানে আসছে না রিজোয়ানার। সে হেলেদুলে বাথরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ওযু করার পর রুমে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো ইভানের রুমের লাইট অন করা আছে। তবে মানুষজন দেখা যাচ্ছে না ওপাশে। এপাশে তার রুমের বরাবর যে রুমটা সেটাতে ইভানের ছোট ভাইয়েরা থাকে। টিচার এসেছেন, পড়াচ্ছে তাদের। রিজোয়ানা নামাজ আদায় করে ইভানকে কল করলো। সাথে সাথেই রিসিভ হলো,
“হ্যালো?”
রিজোয়ানা সামান্য চেচানো কণ্ঠে বললো,
“ওই, সারাদিন তুমি কই থাকো?”
“অফিসে।”
“তোমার ফোন কই থাকে?”
“পকেটে।”
“আমি কই থাকি?”
“বাসায়।”
“ফাজলামো করো আমার সাথে?”
“কি আশ্চর্য! ফাজলামো করলাম কোথায়! তুমি প্রশ্ন করলে আর আমি উত্তর দিলাম।”
“আমি বাসায় থাকি এটা তোমার মাথায় থাকে, একটাবার ফোন দেওয়ার কথা মাথায় এলো না?”
“ব্যস্ত ছিলাম।”
“কি এমন ব্যস্ততা, হুম? কাজের ফাঁকে কি একটুও সময় হলো না একবার ফোন দেওয়ার?”
“নতুন নতুন অফিস জয়েন করেছি। এখনই যদি ফাঁকি দেওয়া শুরু করি, চাকরি থাকবে?”
“তোমাকে ফাঁকি দিতে বলছে কে? আজ সকালে যে তুমি আমার সাথে দেখাও করে যাওনি, একটা কল তো দিতে পারতে। এতোই যদি ব্যস্ততা থাকে, তো সকালে দেখা না করে চলে গেলে কেন?”
“তুমি ঘুমাচ্ছিলে, তাই দেখা করতে পারিনি।”
“একটা ডাক দিলেই তো হতো।”
“কিভাবে ডাকবো? আমার রুমের পাশে তো তোমার রুম নয়। এদিক থেকে ডাকলে আবার ভাড়াটিয়া এসে সাড়া দিবে।”
“অয়ন নিয়নের রুমে এসে তো ডাকতে পারতে!”
“তাতেও বোধহয় লাভ হতো না। তোমার দরজা জানালা সব লাগানো ছিলো, সাথে পর্দাও টানানো। তাছাড়া তুমি যেভাবে ঘুমাও, ফায়ারসার্ভিস এসেও ঘুম ভাঙাতে পারবে কি না সন্দেহ!”
“খবরদার, এখন আমার ঘুমকে দোষারোপ করবে না। নিজের দোষ স্বীকার করতে শেখো। এখন আমার সাথে দেখা করবা। আমি কিছু জানি না। বাসায় নেই নাকি?”
“হ্যাঁ, বাসায়ই। ছাদে এসো।”
“ছাদে আসতে পারবো না।”
“তাহলে দেখা করবো কিভাবে?”
“অয়ন নিয়নের রুমের বারান্দায় এসো।”
“তারা পড়ছে, ডিস্টার্ব হবে। মা দেখলে আবার আমার উপর সুনামি উঠবে।”
“আচ্ছা, ছাদে থাকো। আসছি।”
কল কেটে রিজোয়ানা বের হওয়ার জন্য রুমের বাইরে এসে দেখলো লিসান টিভি দেখছে। তার মা হেটে হেটে ছোলা খাচ্ছে। রিজোয়ানা চুপচাপ বেরিয়ে যেতে লাগলে লুবনা বললো,
“এই, কোথায় যাচ্ছিস?”
“হুম? আসছি একটু।”
“কোত্থেকে আসছিস?”
“এখানেই যাচ্ছি। পাশের ফ্লেটে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসবো।”
“এক মিনিটও না। ধেইধেই নাচানাচি বন্ধ কর। সন্ধ্যার পর কোথাও যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। অপ্রয়োজনে সারাদিন ঘরের বাইরে পা রাখাও নিষিদ্ধ।”
“যাবো আর আসবো।”
“না করেছি না! এদিকে আয়, নে ছোলা খা।”
“তুমিই খাও বেশি বেশি।”
রিজোয়ানা গোমড়ামুখু হয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। দরজার সামনে এসে থেমে গেলো এবং পিছু ফিরে লিসানের উদ্দেশ্যে বললো,
“ভাইয়া, তুমি বিয়ে করো না কেন?”
লিসান ব্রু কুচকে তাকালো তার দিকে। লুবনাও তার দিকে একই ভাবে তাকালে রিজোয়ানা হতাশা নিয়ে সামনে ফিরে আবার পা চালাতে চালাতে বিড়বিড় করে বললো,
“চুপিচুপি ঘর থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য হলেও একটা ভাবি যে আমার আর্জেন্ট দরকার।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here