লুকোচুরি,পর্ব:১৪+১৫

“লুকোচুরি”
পর্ব- ১৪
(নূর নাফিসা)
.
.
ভোরে ফজরের নামাজ পড়েই রিজোয়ানা ছাদে এসে হাটছে। আবছা আলোর এ শহর খুবই মায়াবী লাগছে। দিনের কিছু বিশেষ সময়ও সৃষ্টিকর্তাকে বেশ মনে করিয়ে দেয়। তার মধ্যে এই ভোর অন্যতম। মনটাকে স্বচ্ছ করতে যেন তার এক অসীম ক্ষমতা আছে। আর অনায়াসেই মনে করিয়ে দেয় এই ক্ষমতা তাকে সৃষ্টিকর্তা দিয়েছে। তখন খুব নিকটে অনুভব হয় সৃষ্টিকর্তাকে। এতো এতো অপরূপ সৃষ্টি মহান আল্লাহ কেবল মানুষের জন্যই সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আর মানুষ তার কত অপব্যবহারই না করে বেড়াচ্ছে। আল্লাহ তার বান্দাদের ভালোবাসলেই কি, বান্দা যে সেই ভালোবাসাকে গ্রহণ না করে পিছিয়ে আসছে! ভাবতেই বড়সড় নিশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। হাতে ফোন, ইভানের কল এলো,
“হ্যালো, যাবে না ছাদে?”
“হুম, ছাদেই আছি। এসো।”
“ছাদেই! কে কে?”
“আমি আর তোমার বউ।”
“ও আচ্ছা। বরের আগেই চলে গেছো?”
“বর নাকি লেট লতিফ।”
“অযৌক্তিক! সবসময় কিন্তু বরই আগে থাকে।”
“এইতো তার যথাযথ প্রমাণ।”
“আরে না, মসজিদ থেকে বেরিয়ে শরীফ চাচার সাথে দেখা হলো। হেটে হেটে একটু কথা বললাম। বেশিক্ষণ তো হয়ওনি। পাঁচসাত মিনিট হবে।”
“আমি এসেছি আরও পাঁচ মিনিট আগে।”
“তো আমাকে কল দিতে। আমি তো জানি তোমাকেই কল করে নিয়ে আসতে হবে।”
বলতে বলতে ছাদের দরজা খুললো ইভান। তাকে দেখতে পেয়ে রিজোয়ানা কল কেটে দিলো। দুহাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। ইভান মুচকি হেসে সালামের জবাব দিয়ে রেলিং টপকে এপাশে চলে এলো।
“গ্রামে যাচ্ছো কবে?”
“আগামীকাল।”
“ক’দিনের জন্য?”
“বলতে পারি না। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।”
“সারাজীবন থেকে যাওয়ার প্ল্যান আছে নাকি?”
“প্রয়োজনে যাবো থেকে।”
“হাবভাব তো ভালো ঠেকছে না! বিয়ে টিয়ে ঠিক হয়ে যায়নি তো!”
রিজোয়ানার চেহারায় অভিমান ফুটে উঠলো। সে জবাব না দিয়ে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ইভান জ্বিভ কেটে তার হাত ধরে টেনে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে বললো,
“ওকে, ওকে। আর বলবো না। এমনি মজা করছিলাম।”
“ছাড়ো! তোমার মজার উপর সর্দি ফেলি!”
“হা হা হা! আচ্ছা ফেলো। দাঁড়াও চুপ করে। সূর্যোদয় দেখবো দুজনে।”
“ছাড়ো বলছি!”
“উহুম।”
“পা মেরে দিবো এখন।”
“আহ! দাড়াও না একটু চুপ করে।”
আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে ইভান। রিজোয়ানা এবার রাগান্বিত কণ্ঠ ছেড়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“ছাড়ো, নয়তো সত্যিই চলে যাবো।”
ইভান এবার ছেড়ে দিয়ে মুখোমুখি হয়ে রেলিংয়ে হেলান দিলো এবং হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বললো,
“শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সৌভাগ্য হবে না আমার?”
“চলো, না করেছে কে?”
“যেতেও তো বলেনি কেউ।”
“বললেই কি যাবে?”
“একবার বলেই দেখতে।”
“যাবে না যে, সেটা ভালো করেই জানি। তাই বলিনি। এমনিতে গেলে বলতাম, ঈদে পরিবার ছেড়ে সেখানে যাবে এ আমি কোনোক্রমেই বিশ্বাস করিনা।”
ইভান এক গাল হেসে বললো,
“তোমাকে অন্যরকম লাগছে। ফুটফুটে চেহারায় মায়ার ভীড় জমেছে। একমুহূর্তে আলতো করে ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।”
বলতে বলতে মাথাটা ধীরে ধীরে এগিয়ে নিলো রিজোয়ানার দিকে। রিজোয়ানা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললো,
“এতো ইচ্ছে পূরণ হতে নেই। আমি তো চলে যাচ্ছি৷ আমার ঈদ সালামি কোথায়?”
“কাল না এতোকিছু পাঠালাম!”
“ওটা তো ঈদ গিফট। গিফট আর সালামি এক হলো নাকি! সালামি দাও।”
“এখন কিসের সালামি! ঈদের দিন না দিবো সালামি।”
“ঈদের দিন তো আমি থাকবো না। এডভান্সই দাও।”
“ঈদ করো আমার সাথে, তবে দিবো।”
“আমার পরিবার গ্রামে যাবে আর আমি তোমার সাথে ঈদ করবো? সেই ব্যবস্থা করেছো?”
“চলো করে দিচ্ছি ব্যবস্থা। তুমি চাইলে এখনই নিয়ে যাবো বাসায়।”
“জ্বি না। সেটা সম্ভব না। এভাবে যাবো না। এখন এতো কথা বলো না। সালামি দাও।”
“কি সালামি সালামি শুরু করেছো। একবারও তো জিজ্ঞেস করলে না আমি ঈদের শপিং করেছি কিনা!”
“তোমার শপিং করা লাগবে না। তুমি পুরাতনগুলোতেই ঈদ করো। পরিবারের কর্তাদের এতো নতুন নতুন লাগে না। দেখো না, আমার বাবাকে হাজার বার বলেও নিজের জন্য কিছু কিনতে রাজি করাতে পারি না। তাই ভাইয়া এখন জিজ্ঞাসাও করে না। নিজের পছন্দমতো কিনে এনে বাবার হাতে ধরিয়ে দেয়। ওইটা আর না পরে পারে না।”
“তোমার বাবা তো কিপটা।”
রিজোয়ানা তার হাতে মেরে বললো,
“তুমি ভালো কোনদিক দিয়ে? কখন থেকে সালামি চাইছি, এখনো সালামি পেলাম না!”
এবার সে নিজেই পকেট থেকে ওয়ালেট নেওয়ার জন্য টানাটানি করতে লাগলো। ইভান বাঁধা দিয়ে বললো,
“আরে আরে! হচ্ছে কি! ভোরবেলা ছিনতাই!”
“হ্যাঁ, ছিনতাই।”
জোরাজুরিতে রিজোয়ানার জয়। দুকদম পিছিয়ে গিয়ে ওয়ালেট ফাঁকা করে দেখলো কিছু টাকা আছে। সে হাসতে হাসতে বললো,
“যা আছে তাতেই হবে। কিছু হলেও তো পেলাম।”
এরপর ওয়ালেট মুঠোয় রেখেই কিছুক্ষণ গল্পসল্প করে চলে এলো। ঘরে এসে মনে হলো ওয়ালেট যে তার হাতে! কথার ছলে তো ভুলেই গিয়েছিলো ফিরিয়ে দেওয়ার কথা! ইভানও তো একবার মনে করলো না! সে দ্রুত বারান্দায় এসে দেখলো ইভানকে দেখা যায় কি না। তার দেখা না পেয়ে সে ফোন হাতে নিয়ে কল করতে যাচ্ছিলো এমনি অয়ন নিয়নের বারান্দার দরজা খুলে ইভান এলো। রিজোয়ানাকে তাকাতে দেখে বললো,
“সালামির সাথে কি আমার ওয়ালেটও রেখে দিবে? ওটা ফিরিয়ে দাও। ভিজিটিং কার্ড আছে।”
“আমিও এটার কথাই ভাবছিলাম। মাত্রই তোমাকে কল দিতে যাচ্ছিলাম।”
রিজোয়ানা গ্রিলের ফাঁকে এগিয়ে দিতে গেলে বললো,
“এদিক দিয়ে পারবে? নিচে এসো নাহয় ছাদে।”
“কোথাও যেতে পারবো না। এদিকেই নাও।”
ইভান হাত বাড়ালো রিজোয়ানাও হাত বাড়িয়ে দিলো। এক-দেড় ইঞ্চি শর্ট আছে। দুজনেই গ্রিল ঘেঁষে দাড়িয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলো। এবার হয়েই যেতো কিন্তু ইভান না ধরতেই রিজোয়ানা ছেড়ে দিয়েছে! দুজনেই হা হয়ে তাকিয়ে আছে হুট করেই তিন তলা থেকে ঝাপিয়ে পড়া ওয়ালেটের দিকে। পড়েছে তো পড়েছেই, তা-ও আবার নিচে সরু রাস্তাটায় বসে থাকা কুকুরের উপর! কুকুর ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে দূরে সরে গেলো। ইভান রেগেমেগে তাকালেও রিজোয়ানা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে! তার এতো হাসির কারণ কুকুরটা! সে হাসতে হাসতেই বললো,
“আমার কি দোষ! তোমার ওয়ালেট সুইসাইড করতে চেয়েছে। দাঁড়িয়ে আছো কেন এখনো? যাও নয়তো কুকুর মুখে নিয়ে দৌড় দিবে। তখন তোমার টাকা, ওয়ালেট, ভিজিটিং কার্ড সবই যাবে।”
“যা কাণ্ড ঘটাও তুমি!”
ইভান ছুটে চলে গেলো নিচে। রিজোয়ানা হাসি নিয়ন্ত্রণে আনতে আনতে এখানে দাঁড়িয়ে পাহাড়া দিতে লাগলো সে যেতে যেতে কেউ আবার ধরে কি না দেখার জন্য। যদিও এটা মূল রাস্তা নয়। অন্যসময় এদিকে বসবাসরত বাচ্চাকাচ্চারা কিংবা লোকজন আসাযাওয়া করে। রমজানের সকাল হওয়ায় এসময়টাতে মানুষের আনাগোনা নেই। ইভান নিচে গিয়ে কাগজের সাহায্যে ওয়ালেটটা ধরে ভেতরের জিনিসপত্র নিয়ে ওয়ালেট ময়লার ড্রেনে ফেলে দিলো। উপরের দিকে তাকালে রিজোয়ানা দুহাতে মুখ চেপে আবারও হেসে উঠলো। সারাদিনেও তার এই হাসি ফুরাবে কিনা সন্দেহ! শিহানের সাথেও তো ব্যাপারটা শেয়ার করা দরকার! ভাবতেই আবার হেসে উঠলো!

“লুকোচুরি”
পর্ব- ১৫
(নূর নাফিসা)
.
.
ঈদুল ফিতর ফুরালো, গ্রামের বাড়িতে বেড়ানো শেষ হলো এরপর আবারও পথঘাট পেরিয়ে ফিরে এলো নীড়ে, ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত দিনে। তৃতীয়দিন তারা বাড়ি ফিরেছে আর আজ ষষ্ঠ দিন। দুপুরে দারুণ একটা খবর পেয়েছে রিজোয়ানা যেটা ইভানকে জানানোর জন্য তার হার্টবিট অদ্ভুত ভাবে লাফালাফি করছে। আজ তার অফিসের হাফ ডে, নিশ্চয়ই আগে বাড়ি ফিরবে। কিন্তু অপেক্ষার সময়গুলো যেন কাটতেই চায় না। কতবার বারান্দায় উঁকি দিয়ে এলো, কোনো খবরই পাওয়া গেলো না। ফোন করেও জানাতে ইচ্ছে করছে না। সরাসরি জানাতে চায়। মাকে জানিয়েছে, বাবা ভাইকে জানাবে বাড়িতে এলে। হয়তো এতোটা খুশি হবে না, তবে নিষেধও করবে না তার ধারণা। কিন্তু ইভানের পারমিশনটা নেওয়ারও তো প্রয়োজন আছে।
এ পর্যন্ত বিশ বারের মতো বারান্দায় এসে অবশেষে ইভানের দেখা পাওয়া গেলো। কিন্তু তাকে এই অবস্থায় দেখবে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। সে তো জানে সারাদিন অফিসেই কাটছে সময়। এদিকে উনি তো খালি গায়ে নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে লম্বা করে হাই তুলছে! সে এদিকে উত্তেজনায় মরছে, আরেকদিকে উনি ঘুমিয়ে সময় কাটিয়েছে! রিজোয়ানা ব্রু কুচকে বললো,
“ঘুম থেকে উঠে এলে? অফিস যাওনি?”
ইভান পাশ ফিরে মুচকি হেসে বললো,
“তোমাকে না বলেই গেলাম সকালে! হাফ ডে তাই তাড়াতাড়ি ফিরেছি আজ। ভাবলাম একটু ঘুম দেই।”
আবারও হাই তুললো ইভান। রিজোয়ানা বললো,
“তো এখানে দাঁড়িয়ে বডি দেখাচ্ছো কাকে? সুমনের দাদির সাথে চলছে নাকি কিছু?”
“ছি! ছি! কি বলো! এ রুমটায় সুমনের একটা বড় বোন থাকলেও মেনে নিতাম। দাদির সাথে চলাচলি হলে দাদা কি ভাববেন!”
“দাদা তো তোমার জন্যই ছেড়ে চলে গেছেন।”
“ও আচ্ছা! জানতাম না তো। তাহলে তো লাইন ধরা যায়।”
“একটক নিউজ দেওয়ার জন্য ছটফট করছিলাম। দিবো না।”
“কি? আরে, রিজু!”
রিজোয়ানা হনহনিয়ে বারান্দা ছেড়ে চলে এলো রুমে। পরক্ষণে ভাবলো এখন রাগ করার সময় না। ব্যাপারটা তাকে জানাতে হবে। সে আবার বারান্দায় এসে ডাকলো,
“এই, শুনছো? চলে গেলে নাকি?”
ইভানও নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আবার বারান্দায় এসে বললো,
“রাগ শেষ?”
“আমার কথা শুনো। মনযোগ দিয়ে শুনবে তারপর বলবে।”
“হুম, বলো।”
“জানুয়ারিতে একটা জব এপ্লাই করেছিলাম। রোজার আগে ইন্টারভিউ নিলো। আজ দুপুরে মেসেজ এলো, যোগাযোগ করতে বলেছে। মানে জব কনফার্ম হতে চলেছে। শুধু তোমাকে না, আগে কাউকেই জানাইনি। এপ্লাই করলেই তো আর জব হয়ে যায় না। তাই ভেবেছিলাম হলে পরেই নাহয় জানাবো। এখন তুমি কি বলো?”
“কি জব?”
উত্তেজনায় ডিটেইলস না জানিয়েই মতামত জানতে চাওয়ায় রিজোয়ানা নিজের মাথা ঠুকে বললো,
“ওহ্! সরকারি না। প্রাইভেট হসপিটালে রিসিপশন সেকশনে। ছোটখাটো হসপিটাল, নতুন করেছে। অনলি ডে টাইম। ডে এন্ড নাইট টাইমে দুজন নিবে। আমি ডে টাইমে দিয়েছিলাম। বেতন স্কেল আলোচনা সাপেক্ষে পাঁচ থেকে আট হাজার পর্যন্ত। অবসরই তো আছি, তাই ভাবলাম সময় কাটবে। তাছাড়া গ্রাজুয়েশন তো কমপ্লিট হয়নি যে বড় কোনো পদে ট্রাই করবো। আপাতত…”
এমনি অয়ন নিয়নের রুম হতে বারান্দায় এলো ইয়াসমিন। রিজোয়ানা খেয়ালই করেনি ইয়াসমিন এই রুমে ছিলো! তার মুখোমুখি হতেই সে হকচকিয়ে গেলো এবং সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম, মামি।”
ইয়াসমিন বিড়বিড় করে সালামের জবাব দিয়ে বারান্দার গ্রিলে নেড়ে দেওয়া পাপোশগুলো নিতে লাগলো। অপর বারান্দায় থেকে ইভান তার মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে রিজোয়ানার উদ্দেশ্যে বললো,
“তোমার ভালো লাগলে জব করো। আমি নিষেধ করবো না। অযথা ঘরে বসে থেকে কি লাভ! তোমারও তো ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। তোমার সুবিধামত যেখানে ইচ্ছে করো। আমার আপত্তি নেই। আমার পারমিশন এবং সাপোর্ট সবসময়ই পাবে।”
ইভান কথা শেষ করে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো রুমে। ইয়াসমিনও নিজের মতো কাজ করে চলে গেলো রুমে। সবসময় লুকোচুরিতে অথচ আজ এভাবে ইয়াসমিনের সামনে পড়ে যাওয়ায় রিজোয়ানার বেশ অস্বস্তি লাগছে। আরেকজনের কথার ভঙ্গি দেখেই মনে হচ্ছিলো তার মাকে দেখে ইচ্ছে করে খোঁচা দিতে চেয়েছে কথার তালে। তাহলে তার সিরিয়াস মতামত কি, সেটা তো নিশ্চিত হতে পারলো না সে! ধ্যাৎ! কেন যে বলতে গেলো এখানে দাঁড়িয়ে! ফোনে বললেই পারতো! আর কে-ই বা জানতো উনি রুমে ছিলো, আর হুট করে চলে আসবে বারান্দায়! ইভানের মতামতে নিশ্চিত হতে রিজোয়ানা আবার কল করলো। ইভান কেটে দিলো! আবার ডায়াল করলো, রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না! এ আবার কোন ঢং! কয়েকবার চেষ্টা করে সে ফোন রেখে দিলো। মাথাটা আঁচড়ে যে-ই রুম থেকে বেরিয়ে যেতে লাগলো, এমনি ফোনটা বেজে উঠলো। ইভান কল করেছে। সে ফোন রিসিভ করেই বললো,
“কল রিসিভ করছিলে না কেন?”
“মা এসেছিলো রুমে। কথা বলে গেলো।”
“তুমি মামিকে শুনিয়ে শুনিয়ে এভাবে কথা না বললেও পারতে। বউয়ের জন্য মাকে খোঁচা দাও!”
ইভান বিষ্ময়করভাবে বললো,
“রিজু, আমার কথা শুনো আগে৷ মা তোমাকে চাকরি করতে নিষেধ করে গেলো।”
“কেন?”
“জানি না, তবে অনেক কারণই এখন আমার চোখের সামনে। মা শুধু বলে গেলো, এই চার-পাঁচ হাজার টাকায় অযথা চাকরি করার প্রয়োজন নেই। মোট কথা, চাকরি না করাই ভালো। আর যদি তোমার চাকরি করার প্রবল ইচ্ছা থাকে কিংবা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার কথা আসে, তাহলে যেন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরে ভালো কোনো পদে নিযুক্ত হও। টাইম পাস করার মতো কিংবা সংসার চালানোর উদ্দেশ্যে চাকরি করা মায়ের তরফ থেকে নিষিদ্ধ।”
“তাহলে করবো না? তুমি কি বলো?”
“আমি বলি কি, মাস শেষে মায়ের কাছ থেকে পাঁচ হাজার করে টাকা নিয়ে নিয়ো।”
“আমি সিরিয়াস একটা কথা বলছি আর তুমি ফাজলামো করছো! রাখো ফোন!”
ইভান হেসে বললো,
“আমি নিষেধ করছি না। আবার করতেও বলছি না। শ্বাশুড়ি মা নিষেধ করেছে এবার ভেবে দেখো তুমি কি করবে।”
“হ্যাঁ, মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ায়ই তোমার কাজ।”
“একদমই না। তোমাকে আমি মৃত্যুর পরেও ছাড়ছি না। পরকালে জমিয়ে সংসার করবো।”
রিজোয়ানা দাতে দাত চেপে বললো,
“আমি আমার কথা বলিনি। আমি ডিসিশনের কথা বলছি।”
“ও আচ্ছা, সে যাক যেদিকে ইচ্ছা। আল্লাহ হাফেজ।”
ইভান কল কেটে দিলো! রিজোয়ানা ব্রু কুচকে দাঁড়িয়ে রইলো। এতোটা হেয়ালিপনা তো সে কখনোই করে না। আজ কেন এমন করলো! তার কাছে একটা সলিউশন চাইলো অথচ কথায় যেন পাত্তায়ই দিলো না! উল্টো আরও মাথাটাকে হযবরল করে দিলো!
মনোভাব এমন হযবরল হয়ে যাওয়ায় বাবা ভাইকে এ ব্যাপারে আর জানালোই না। আগামীকাল শুক্রবার, তারা বাসায় থাকবে। পরে নাহয় ঠান্ডা মাথায় কথা বলবে। পরদিন সকাল দুপুর ব্যস্ততা, বিকেলে ঠান্ডা হাওয়া। বাবার দুপুরের দাওয়াত ছিলো, বিকেলে বাড়ি ফিরে তিনি সোফায় বসে সুপারি চিবাচ্ছেন। লিসান একটু আগে কোত্থেকে যেন এলো, রিজোয়ানার হাতে কোণ আইস্ক্রিম দিয়ে আবার পোশাক পাল্টে কোথায় যেন যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রিজোয়ানা আইস্ক্রিম খেতে খেতে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। লিসান বললো,
“কি? আমার রুমে এমন ঘুরঘুর করছিস কেন?”
“ফাগুন না আসতেই আগুন লেগে গেছে, তা-ই দেখছি ঘুরে ঘুরে!”
“মানে!”
“সত্যি করে বলোতো, চুপিচুপি বিয়ে করে বউ শ্বশুরবাড়িতে রেখে দাওনি তো? নাকি আলাদা বাসা নিয়ে নিয়েছো?”
“আযব ব্যাপার! তোর মাথা ঠিক আছে তো? জ্বরটর হয়নি তো?”
“জ্বর হলেই কখনো উল্টাপাল্টা বলেছি নাকি আমি?”
লিসান ড্রেসিং টেবিল থেকে লোশনের খালি প্যাকেটটা নিয়ে মাথা বরাবর মেরে বললো,
“তো এমন আবলতাবল বলছিস কেন? ওসব তো সিনেমার ঢং।”
রিজোয়ানা সরে গিয়ে বললো,
“যা-ই বলো, সেজেগুজে কার জন্য বের হচ্ছো বুঝি কিন্তু!”
বলেই দরজায় হেলান দিয়ে মুখ চেপে হাসতে লাগলো। লিসান বেরিয়ে যেতে যেতে তার মাথায় ঠুসি মেরে বললো,
“যা, সর!”
এরপর মাকে দেখে বললো,
“মা, তোমার মেয়েকে শাসন করো। যা তা বললে চড়ের উপর চড় খাবে বলে দিচ্ছি।”
লুবনা কিছুই বুঝতে না পেরে একবার মেয়ের দিকে আরেকবার ছেলের দিকে তাকালো। এদিকে লিসান বের হওয়ার জন্য দরজা খোলার আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো। আর পরপরই সে-ও দরজা খুলে দিলো। ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটলো, যেনো দরজা খোলার জন্যই সে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ওপাশে ইয়াসমিনকে দেখে লিসান অবাক হলো। ইয়াসমিন বললো,
“ভালো আছো?”
লিসান তার জবাব না দিয়ে সালাম দিয়ে বসলো। ইয়াসমিন সালামের জবাব দিতে দিতে ঘরে প্রবেশ করলো। বাকিরাও অবাক হয়েছে দেখে। কথা প্রথমে রিজোয়ানার বাবা-ই বললেন। তিনিও ভালোমন্দের জিজ্ঞাসা করে আলাপ করতে বসে গেলেন। সাথে এসেছে নিয়ন। রিজোয়ানা দরজার সামনেই দাঁড়ানো ছিলো। ইয়াসমিনকে সালাম দিয়ে সেখান থেকে লিসানের রুমের ভেতরে চলে গেলো। খাটে বসে ভাবতে লাগলো তিনি হঠাৎ কি মনে করে! গতকাল চাকরির ব্যাপারে শুনে নিষেধ করতে বাড়ি পর্যন্ত চলে এলেন?
লিসান বেরিয়ে গিয়েছিলো। নিচতলায়ও বোধহয় নামেনি, আবার ফিরে এসেছে। রুমে এসে রিজোয়ানাকে বসে বসে পা ঝুলাতে দেখে ফিসফিসিয়ে বললো,
“মামি হঠাৎ এখানে কি মনে করে?”
রিজোয়ানা ঠোঁট উল্টালে সে বললো,
“কি জানিস তুই!”
“আশ্চর্য! না জানলেও কি তোমার জন্য হ্যাঁ বলবো? তুমি না কোথাও যাচ্ছিলে, ফিরে এলে কেন?”
“একটু পর যাবো।”
“কেন?”
“টেনশন এসে গেছে মাথায়, টেনশনটাকে নামিয়ে তারপর যাবো। নয়তো ঘুরাফেরায় মন বসবে না।”
“ভাবি এতোক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে?”
লিসান আবারও মাথায় মেরে বসলো। রিজোয়ানা মাথায় ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,
“মাথায় মারবা না বলে দিচ্ছি৷ তাহলে তোমার সবগুলো জুতার বেল্ট কেটে দিবো।”
“সাহস থাকলে দে।”
“এতোই যখন মারবা, আইস্ক্রিম খায়িয়ে কি লাভ? যতটুকু না শক্তি পেয়েছি, তারচেয়ে বেশি তো হারিয়েই ফেলেছি!”
“তবুও মুখটা কেন তোর চুপ থাকে না?”
রিজোয়ানা ভেঙচি কেটে চুপ করে বসে রইলো। দুই ভাইবোন এখানে বসে বসে বড়দের কথা শুনছে। ইয়াসমিন বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করতে এসেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে রিজোয়ানাকে ঘরে তুলতে চান। কথা বার্তার মাধ্যমে রিজোয়ানার বাবা-মাও সম্মত হলেন। এক পর্যায়ে তারা তারিখও নির্ধারণ করে ফেললেন দু সপ্তাহ পর। সবটাই যেন রিজোয়ানার স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। কি থেকে কি হলো? হঠাৎ করেই সবই যেন পাল্টে গেলো। ঝগড়াবিবাদ সবই নিরবে মিটে গেলো। আপনের মর্যাদা তাহলে উভয়েই দিতে জানে, আপনকে আপন করে নিতে শুধু একটু সুযোগের অভাব থেকে যায়। বিকেলের পর থেকে রাত পর্যন্ত সময়টুকু স্বাপ্নিকভাবে কেটে গেলো। উনারা দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন, এরপর সন্ধ্যায় কয়েক মিনিটের জন্য ব্রেক হলো। লুবনা তাদের উদ্দেশ্যে রান্নাবান্না বসিয়ে দিলেন। সন্ধ্যার পর ইভান এলো। এখন শিহান বাদে সবাই এবাড়িতে। ইয়াসমিন নিজ হাতে রিং পড়ালেন। রিজোয়ানার নতুন পোশাক পরারও কোনো প্রয়োজন মনে করেননি। ঘরের মেয়ে ঘরোয়া সাজেই বসে গেছে তাদের সামনে। তার মুখে কোনো কথা নেই। লিসানেরও ঘুরতে যাওয়া হলো না আর। ইভানের স্বাভাবিক হাসি মাখা মুখটাই রিজোয়ানা দেখছিলো বারবার। তার সাথে দুটো কথা বলার সুযোগও হয়নি। অবশ্য নিজেই সুযোগ পেতে চায়নি কারণ ইভান স্বাভাবিক থাকলেও তার খুবই অস্বাভাবিক লাগছিলো সব। খাওয়াদাওয়ার পর তারা যাওয়ার পূর্বে অন্যরা যখন কথা বলছিলো, ইভান তার রুমে এসেছিলো। দুহাতে রিজোয়ানার মুখখানা ধরে মিষ্টি হেসে বলেছিলো,
“গতকাল থেকে কারণটা সন্দেহ হয়ে মাথায় চেপে বসেছিলো। আজ তার মুক্তি মিললো। মা খুব ভালো সারপ্রাইজ দিতে জানে, তাই না? আসি, আমন্ত্রণ রইলো বউ সেজে আমার ঘরে যাওয়ার।”
বিপরীতে লজ্জিত হাসি ছাড়া কোনো প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করতে পারলো না রিজোয়ানা। বেশ কিচ্ছুক্ষণ একা থেকে যখন লজ্জা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো, মূল আনন্দটা তখন ধরা দিলো। স্বাপ্নিক ন্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ভেবে ভেবে খুশি খুশি অনুভূত হচ্ছে। অতি খুশিতে রিজোয়ানা এবার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ফেললো, “শ্বশুর বাড়ি জিন্দাবাদ…🥳”
আর সেই স্ট্যাটাসে সর্বপ্রথম হা হা রিয়েক্ট দিলো ইভান! সে এক্টিভ ছিলো রিজোয়ানা খেয়ালই করেনি। তার রিয়েক্ট দেখে রিজোয়ানা ফোন ফেলে হাসতে হাসতে খাটে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। কারণটা হাসির না হলেও আজ তার খুব হাসি পাচ্ছে। এ বোধহয় সর্বোচ্চ পর্যায়ে মন ভালো থাকার বহিঃপ্রকাশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here