লুকোচুরি,পর্ব:১৭

“লুকোচুরি”
পর্ব- ১৭
(নূর নাফিসা)
.
.
শুক্রবার বিয়ের প্রোগ্রাম হলে আজ হলুদের প্রোগ্রাম হওয়ার কথা। কিন্তু এসবই নাকি বিয়ের সময় গায়ে হলুদ টলুদ মেখে আগেই হয়ে গেছে তাই এখন পুনরায় কোনো প্রোগ্রামের আয়োজন করলো না পরিবার। বউ ঘরে তুলছে, সেই সুবাদে আত্মীয়দের দাওয়াত করে দুই পরিবার একত্রে শুধুমাত্র একটা প্রোগ্রাম করছে। অর্থাৎ জামাই ভাত (ওয়েডিং প্রোগ্রাম) বলুক আর বৌভাত (রিসিপশন প্রোগ্রাম) বলুক একই দিনে একই আয়োজনে শেষ হয়ে যাচ্ছে সব। যার ফলে রিজোয়ানার কাছে পুরো পৃথিবীটাকেই আজ কিপ্টে কিপ্টে মনে হচ্ছে! কৃপণতায় ভরে গেছে দুনিয়া। এইটুকু করারই কি দরকার ছিলো? বাসা তো কাছেই। যেতে আসতে মিনিটের ব্যাপার। মেয়ের পরিবার মেয়েকে নিয়ে নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়াতো, ছেলের পরিবার ছেলেকে নিয়ে নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়াতো। ছেলে এগিয়ে এসে মেয়ের হাত ধরে বর্ডার ক্রস করতো। ছেলের মা বরন করে দুয়ারের ভেতরে ঠেলে দিতো। ব্যাস! বউ ঘরে উঠে গেলো। কারোই অতিরিক্ত কোনো খরচের প্রয়োজনই হলো না!
এই সন্ধ্যায় রুমের দরজা লাগিয়ে খাটের কোণে গোমড়ামুখু হয়ে বসে আছে রিজোয়ানা। চাচাতো ভাইবোনগুলো লিসানের রুমে গানবাজনা চালিয়ে সুরে উড়াচ্ছে বাড়িঘর! নানাবাড়ির আত্মীয়গুলো দুইবাড়িতেই আসাযাওয়া করছে। একটু পরপর একএকজন এসে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে, ডাকছে রিজোয়ানাকে। বারবারই গলা চেচিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে সবাইকে। অসহ্য লাগছে তার সব! একটু পরেই আবার শিহানের গলা। কিছুক্ষণ আগেও এসে দরজা ধাক্কিয়ে ডেকে গেছে ছেলেটা। এখন আবার ডাকছে! রিজোয়ানা বললো,
“শিহান, ডেকো না তো। যাও তোমরা তোমরা মজা করো। আমি বাইরে আসবো না।”
“বাইরে আসতে হবে না, ঘরে থেকেই শুনো। এই যে, আমি বারান্দা থেকে ডাকছি।”
রিজোয়ানা বিছানা ছেড়ে বারান্দার দরজার সামনে এসে দেখলো শিহান অয়ন নিয়নের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দরজার হাতল ধরে সে বললো,
“ও, আবার এই দরজা লাগানো বাকি! দাড়াও, এক্ষুনি লাগিয়ে দিচ্ছি। ওকে, বায়। গুড নাইট।”
ধপাস করে এ দরজাও লাগিয়ে আবার খাটে এসে বসে রইলো। ওদিকে শিহানের হাসিতে ফেটে পড়া গলা শুনা যাচ্ছে,
“তোমার বউ পুরো পাগল হয়ে গেছে।”
“সর তুই। যা। রিজু? এই রিজু?”
এবার ইভান ডাকছে। রিজোয়ানা এখানে থেকেই চেচিয়ে সাড়া দিলো,
“কি?”
“শুনো না একটু…”
রিজোয়ানা খাটের এপাশে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে বললো,
“কি শুনবো?”
“বারান্দায় এসো।”
“পারবো না। এখানে থেকেই শুনছি। বলো কি বলবে?”
“মেহেদি পড়নি?”
“না।”
“কেন?”
“তোমার শখ লেগেছে তুমি পড়ো। আমার এতো শখ জাগেনি।”
“ও আচ্ছা। প্রোগ্রামটা কেমন পানসে পানসে হয়ে গেছে, না?”
“আবার কথা বলো তুমি!”
“আমার কি করার। যা করার বড়রা করেছে। আমার বলা তো আমি বলেছিলামই।”
“কি দরকার ছিলো এসবই করার? এসে এমনিতেই নিয়ে যেতে। আমার বাবামা অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত দিয়ে আসতো, বাকি অর্ধেক রাস্তা তোমরা নিয়ে যেতে। ব্যাস! চলে যেতাম তোমার ঘরে।”
“ইশ! আইডিয়াটা আগে দিলেও তো প্রস্তাব রাখতে পারতাম! এখন কি করে তা চেঞ্জ করবো! আচ্ছা, যা হওয়ার হয়েছে। ছাদে চলো। আমরা দুজন মিলে প্রোগ্রাম করি৷ সবাই বাদ। শুধু তুমি আর আমি।”
“আমিও বাদ। শুধু তুমি আর তুমি।”
“এই শুনো! তা কি করে হয়! তোমার বরের মাথায় একটা প্ল্যান আছে।”
“তোমার কোনো প্ল্যান আমি শুনবো না।”
“আহা! আরে শুনো তো। ভালো না লাগলে রিজেক্ট করো। আগে শুনো। লুকোচুরি তো শেষ হতে চলেছে। চলো, শেষ বারের মতো তাকে আরেকটা চান্স দেই।”
বিষয়টা একটু ইন্টারেস্টিং ঠেকলো রিজোয়ানার কাছে। তাই মনযোগী হয়ে তাকিয়ে রইলো তার কথা শোনার জন্য। বউ পোষ মেনেছে তাই ইভান মুচকি হেসে বললো,
“চলো, পালিয়ে যাই বাসা থেকে। হারিয়ে যাই অজানায়। এসব ছেড়ে কিছুক্ষণের জন্য নিরিবিলিতে কোথাও সময় কাটাই দুজন মিলে। বোরিং লাগছে আমার৷ মন ভালো করি নাহয় লুকোচুরি খেলে?”
রিজোয়ানা শান্ত গলায় বললো,
“কোথায় যাবো?”
“হুম… বাইরে কোথাও! প্রকৃতির সংস্পর্শে খোলা আকাশের নিচে।”
“ছাদে যেতে পারবো না। সবগুলো এখন পিছু পিছু চলে যাবে।”
“ওকে, ডিরেক্ট নিচে চলে এসো।”
বিনা ভাবনায় রিজোয়ানা হনহনিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে। লুবনা বললো,
“কোথায় যাচ্ছিস আবার!”
“মা, কোনো প্রশ্ন করবে না। আমার মেজাজ এমনিতেই খারাপ করে দিয়েছো, প্রশ্ন করে করে আর খারাপ করো না। তোমাদের কাজ তোমরা করো।”
চাচাতো বোন এসে টানলো, তারা নাচগান করছে সেখানে যোগ দেওয়ার জন্য। রিজোয়ানা ছাড়া পেতে, “আসছি একটু পরে।” বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেলো। নিচে এসে দেখলো ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে ইভান। সাদা পাঞ্জাবিতে অন্যরকম সুন্দর লাগছে তাকে। তার পোশাকের সাথে ম্যাচ হয়েছে কি না তা দেখতে নিজের পোশাকের দিকে তাকালো সে। খারাপ না, তার পরনে বাসন্তী রঙের সুতি থ্রিপিচ আছে। তাই রিলেক্স হয়ে আবার তাকালো ইভানের দিকে। ইভান মুচকি হেসে এগিয়ে এসে তার হাতটা ধরে সামনে পা বাড়িয়ে বললো,
“মনটা কি খুব বেশিই খারাপ?”
তালে তাল মিলিয়ে হাটতে হাটতে রিজোয়ানা বললো,
“না। কিছুটা। তুমি একটু আগে কি পরে দাঁড়িয়ে ছিলে?”
“কেন, দেখোনি?”
“ওভাবে খেয়াল করিনি। তবে পাঞ্জাবি পরে ছিলে না, শিওর।”
“সেন্টু গেঞ্জি পরনে ছিলো। হলুদের রাতে লুকোচুরি খেলবো, ভাবলাম টিশার্ট বাদ দিয়ে পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে যাই।”
রিজোয়ানা মুচকি হেসে সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সুন্দর লাগছে।”
“ওহ! রিয়েলি!”
“হুম।”
রিজোয়ানাদের সীমানা পেরিয়ে ইভানদের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে লাগলে শিহানকে দেখা গেলো। মাত্রই নেমে এসেছে উপর থেকে। তাদের দেখে থেমে গিয়ে দুহাত ভাজ করে গেইটে হেলান দিয়ে বললো,
“বাহ! এতো সেজেগুজে কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আসবো নাকি সাথে?”
ইভান চোখ পাকিয়ে তাকালো তার দিকে। রিজোয়ানা ইভানের সাথে সামনে হাটতে হাটতে হেসে বললো,
“যাও, ছেলে! নিজের বউ খুঁজো গিয়ে আগে। তারপর এসো।”
“হুহ্! যাও, যাবো না। আরও কখনো বলো, শিহান চলো আমাদের সাথে! তখন আমারও ভাব দেখে নিয়ো।”
“দেখবো না।”
তারা এগিয়ে গেলো সামনে। শিহান ভেঙচি কেটে রিজোয়ানাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। রিজোয়ানা হাটতে হাটতে বললো,
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
“এইতো, সামনে। দূর অজানায়।”
“সকালের আগে ফিরতে পারবো তো?”
ইভান তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,
“না ফিরলে কি হবে? বর তো তোমার সাথেই যাচ্ছে। মেহমান আসবে, খাবে, চলে যাবে। আমাদের সাথে তো আর তাদের বিশেষ কাজ বাকি নেই। যে চেনার চিনবে, যার না চেনা সে অচেনাতেই থাকবে। আমরা আছি তো পাশাপাশি।”
“ইডিয়ট! ঘন্টা পাড় হতে দাও, মামী যদি কল না করেছে!”
“বলে এসেছি, দুই ঘন্টায় যেন আমাকে স্মরণও না করে।”
“তাহলে লুকোচুরি কিভাবে হলো?”
“তোমার সাথে বের হচ্ছি তা তো বলিনি। কি খাবে?”
“মালাইবরফ।”
“মালাই তো দেখা যাচ্ছে না। অন্যকিছু নেই? নাকি রেস্টুরেন্টে যাবে?”
“উহুম, সামনে যাও দেখি। পাবো হয়তো।”
একটু এগিয়ে যেতেই তারা মালাইবরফ পেয়ে গেছে। তবে বেশি খেতে দেয়নি ইভান। সন্ধ্যায় বরফ খেয়ে খেয়ে না আবার গলার সমস্যা করে বসে! তাই বাকিটুকু সময় হাটতে হাটতে ঝালমুড়ি এবং ছোলাতেই চালিয়ে নিলো। কিছুদূর গিয়ে একটা বাড়ির সামনে থামলো ইভান। বাড়িটা তিন রাস্তার মোড়ে। বাড়ির সাথেই ঘেঁষে তোলা আছে এক ফটোস্ট্যাট দোকান। দোকানের চারপাশ পাকা হলেও চালা টিনের। এই বাড়ি এবং দোকানটা ইভানের বন্ধুর বাবার। এখন তার বন্ধুই বসে আছে দোকানে। ইভান দেখেছে তাকে, ফোনে কথা বলছে সে। বাড়ির বাউন্ডারির দেয়াল ঘেঁষে পড়ে থাকা চারটা ইটের কণা তুলে নিলো ইভান। রিজোয়ানা বললো,
“এগুলো দিয়ে কি করবে?”
“ইট নিক্ষেপ খেলবো।”
কথার পরপরই ইভান দুইটা ইট ছুঁড়ে মারলো টিনের চালায়। রিজোয়ানা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার আর সময় পেলো না। ইভান আবারও বাকি দুটো কণা ছুড়তেই দোকানদারের আগে বাড়ির দারোয়ান চেচিয়ে উঠে দৌড়ে গেইটের বাইরে এসে বললো,
“অই, কেডা রে!”
ইভান রিজোয়ানার হাত ধরে ভেতরের রাস্তার দিকে ঢুকে পড়ে বললো,
“দৌড়াও!”
রিজোয়ানাও বুঝে আর না বুঝে দৌড় দিলো তার সাথে। দৌড়ে সাত-আট কদম এগিয়ে থেমে আবার স্বাভাবিকভাবে হাটতে হাটতে দুজনেই হাসতে লাগলো। ইভান পেছনে ফিরে দেখলো দারোয়ান এবং তার বন্ধু, দুজনেই মোড় পর্যন্ত এসেছে। তার বন্ধু হয়তো ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চিনতে পেরেছে তাকে তাই আবার দাড়োয়ানকে টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে।
“অযথা ইটা কেন মারলে?”
“এখানে এলে এটা আমাদের বন্ধুদের নিত্যকার অভ্যাস।”
“যেদিন বেঁধে ধোলাই করবে, সেদিন ভালো লাগবে।”
“বাঁধলেও ছাড়া পেয়ে যাবো। বন্ধুর বাপের দোকান তো।”
“বন্ধু যদি বাঁচানোর জন্য না থাকে তখন?”
“বন্ধু না থাকলে তো ইটাও মারি না তখন!”
“ও, আচ্ছা। এই ব্যাপার!”
কথা বলতে বলতে তারাও তাদের পথে হাটতে লাগলো। সাথে সাথেই ফোনটা বেজে উঠলো। ইভান রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো,
“তুই আমার বাড়ির সামনে এসেছিলি?”
“কই না তো! তোর বাড়ির পেছন দিয়ে হাটছি।”
“আমার বাপের দোকানটাকে বুঝি শেষ করে দিবি, না?”
“না তো, দোকানের চালাটা গেলেই হলো। এরপর দোকানের ছাদ দিবি তাহলে আর দিবো না, প্রমিজ।”
লাউড স্পিকারে রিজোয়ানা সবই শুনছে। ইভানের করা প্রত্যুত্তর শুনে নিঃশব্দে হেসে ঘুষি দিলো তার হাতে। ওদিকে ইভানের বন্ধু বলছে,
“বেয়াদব! কাল বউ ঘরে তুলবি, তো এখন কোন মেয়ের হাত ধরে রাস্তায় হাটছিস? বাসায় জানে?”
“জানে না, তবে মেয়েকে চিনে।”
“আযব! কয়টা মেয়ের জীবন তুই নষ্ট করবি এভাবে!”
“আজই তো শেষ, বল? সবাইকে সময় দিয়ে কাল থেকে বউ নিয়ে সংসার করবো।”
রিজোয়ানা এবার আরও দুইটা ঘুষি মারলো। ইভান সরে গিয়ে বললো,
“আরে, আস্তে!”
এরপর আবার তার বন্ধুর উদ্দেশ্যে বললো,
“ওই, তুই ফোন রাখ। বউ নিয়ে একটু হাওয়া-বাতাস খেতে এসেছি, তোর জ্বালায় শান্তি হচ্ছে না।”
“ভাবি! মানে, রিজোয়ানা? বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিস অথচ বাসায় নিয়ে আসবি না!”
“তুইই আসিস আমার বাসায়।”
এখানেই কথা শেষ করে ইভান নিজেই কল কেটে দিলো। প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় হেটে হেটে বাইরে কাটানোর পর রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরলো তারা। রিকশা থেকে নেমে রিজোয়ানাকে বললো,
“আচ্ছা, যাও তাহলে। মন ভালো হয়েছে?”
“মোটা লাঠি নিয়ে দারোয়ানের দৌড়ানিটা জোস ছিলো।”
কথার পরপর খিলখিলিয়ে হেসে বাড়িতে প্রবেশ করলো সে। ইভান মুচকি হেসে রিকশাভাড়া দিতে লাগলো। ফ্ল্যাটে এসে আর কাজিনদের নাচগানে যোগ দেওয়া হলো না। ফুরফুরে মনে সে বিরিয়ানি খেতে বসে গেছে। তারপর হাতে মেহেদি লাগিয়ে ঘুমাতে চলে গেছে। মেহেদি লাগানোর সময়ই কাজিনদের সাথে চললো যতটুক আড্ডা।
কমিউনিটি সেন্টারে প্রোগ্রাম শেষে সেখান থেকেই মেয়ে বিদায় হলো। মনের আনন্দে পার্লারে সাজা, সেন্টারে উপস্থিত হওয়া, দুজনের একত্রে ফটোশুট সবই হাসিখুশিতে সম্পন্ন হলো। কিন্তু বিদায়ের সময় যখনই রিজোয়ানার বাবা আহসান হাবীব রিজোয়ানার হাত ইভানের হাতে তুলে দিয়ে কিছু কথা বললেন তখনই হঠাৎ করে মন ভেঙে কান্না আসতে লাগলো। বাবা হাত ছেড়ে দিতেই রিজোয়ানার কান্না আর বাধা মানলো না! সারাদিন আনন্দের পর এমন একটা অবস্থা কেউই প্রত্যাশা করেনি রিজোয়ানার কাছে। এরকম কিছু যে ঘটতে পারে তার কোনো আভাসই পাওয়া যায়নি। সবাই অবাক হয়েছে এবং অনেকেই তার কান্না দেখে কেঁদে দিয়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে এলে তার কান্না কিছুটা কমেছে। কিন্তু থেমে যায়নি। বাড়িতে এসেও কাঁদছেই। শিহান গাড়ি থেকে টিস্যু বক্স তুলে নিয়ে হাটছে। একদিকে বরন করছে, আরেকদিকে সে কাঁদছে, অন্যদিকে ইভান শিহানের কাছ থেকে টিস্যু নিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে। ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেও কাঁদছে, ইভান শিহানকে ডেকে আবার টিস্যু নিয়ে এগিয়ে দিচ্ছে। একটা ফেলতেই সে শিহানের উদ্দেশ্যে গলা ছাড়ে,
“শিহান, টিস্যু দে…”
বারবারই এমন করার ফলে রিজোয়ানা যখন বুঝতে পারলো তার কান্না দেখে দুই ভাই টিস্যু দেওয়ার নাম করে ঠাট্টা করছে, তখন থেকে আর টিস্যু হাতে নেয় না রিজোয়ানা। ফুপিয়ে কাঁদতে থাকলেও রেগেও আছে তাদের প্রতি। তাদের দিকে আর তাকাচ্ছেই না। রিজোয়ানা টিস্যু নিচ্ছে না বলে ইভানই এসেছিলো চোখের পানি মুছে দিতে। তাদের ফাজলামো বুঝতে পেরে অবশেষে ইভানের খালামনি ধমক দিয়ে সেখান থেকে বিদায় করলো তাকে। কথাবার্তার মাধ্যমে রিজোয়ানাকে পুরোপুরি শান্ত করা হলো। আহসান হাবীব ফ্ল্যাটে এসে দেখা করে গেছেন।
রাত গভীর হয়ে এসেছে। হালকা খাওয়াদাওয়ার পর ইভানের রুমে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাজটা একবার দেখে নিলো রিজোয়ানা। সাজ তেমনভাবে নষ্ট না হলেও কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। একে তো মুখের হাসিভাবটা বিলীন, অন্যথায় কান্নার ফলে মেকাপের ঝলকানিটা হারিয়ে গেছে। ইভান রুমে এসেই মুখ বাকিয়ে হাসলো এবং কান্না ভঙ্গিমায় বললো,
“শিহা…ন, টিস্যু দে…”
রাগে রিজোয়ানা আবারও কেঁদে উঠে বললো,
“আমি কালকেই বাপের বাড়ি চলে যাবো। থাকবো না তো আমি এখানে।”
“বাপরে! ঘরে না আসতেই চলে যাওয়ার হুমকি! তুমি জানো, পুরো একটা বক্স টিস্যু লেগে গেছে তোমার চোখের পানি আর নাকের পানি মুছতে! আরও লাগবে?”
এগিয়ে এসে কথাটা বলেই ড্রেসিং টেবিলের কর্ণার থেকে রুমে থাকা আধব্যবহৃত টিস্যু বক্সটা তুলে রিজোয়ানার সামনে ধরলো। রিজোয়ানা কান্নার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বললো,
“আমি এক্ষুনি চলে যাবো। আর এক মুহূর্তও থাকবো না এখানে!”
ইভান জ্বিভ কেটে দরজা খোলার আগেই তাকে আটকে ধরলো। রিজোয়ানা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলে ইভান টিস্যু বক্স ফ্লোরে ফেলে দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“এতো আহ্লাদের সংসার, এতো তাড়াতাড়ি শখ মিটে গেলো!”
“তোমার মতো ইডিয়টের সাথে সংসার করে কে!”
ইভান হেসে নাকে নাক ঘেঁষে বললো,
“এই যে, তুমি করবে। আমাদের কতো প্রচেষ্টার সাধনা, সাজিয়ে গুছিয়ে তুলবো দুজনা। এতো সুন্দর সজ্জিত ঘর, পছন্দ হয়নি বুঝি?”
ইভান গালে আলতো ছুঁয়ে দিলে কেঁপে উঠলো রিজোয়ানা। মুহুর্তেই রাগ মুছে লজ্জা ফুটে উঠলো চেহারায়। ইভান দেখছে তাকে, সে দৃষ্টি নামিয়ে রেখেছে নিচের দিকে। বাহুডোর থেকে মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টায় বললো,
“সরো, চেঞ্জ করবো ফ্রেশ হবো। এসব আর ভালো লাগছে না। চোখ কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে।”
“সে তো দেখতেই পারছি। কিন্তু চেঞ্জ তো চলবে না। এইটুকু সময়ের জন্য এতো দামে শাড়ি কিনেছি নাকি! কিছু তো উশুল উঠতেই হবে। এরপর পরবে কি পরবে না তার ঠিক নেই।”
“পরবো।”
“সে নাহয় পরেই দেখা যাবে। আজকেরটা আজ পরিপূর্ণ থাকুক।”
আজকের সকালটা খুব মিষ্টি। মিষ্টি সকালের উষ্ণতায় ধোঁয়া উঠা দুকাপ চা নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো রিজোয়ানা। যদিও ইচ্ছে ছিলো ইভানদের বাড়িতে প্রথম সকালেই ইভানের আবদারটা পূরণ করবে। কিন্তু সংকোচের কারণে তা সম্ভব হলো না। মামার বাড়ি হলেও তার অবস্থান ছিলো সম্পূর্ণ অচেনা নতুন বউদের মতোই। কেননা সেবাড়িতে তার তেমন আসাযাওয়া ছিলো না যে, শুরুতেই নিঃসংকোচে যা ইচ্ছে করতে পারবে। তাই আজ তৃতীয়দিন অর্থাৎ দ্বিতীয় সকালে নিজের বাড়িতে এসে সেই ইচ্ছে পূরণ হলো। রিসিপশনের প্রোগ্রাম আলাদাভাবে না হলেও নিয়মনীতিগুলো ঠিকভাবেই চলছে। দ্বিতীয়দিন ঘরোয়া আয়োজনের মাধ্যমে আবার রিজোয়ানাদের বাড়িতে পাঠিয়েছে রিজোয়ানা ও ইভানকে। আজকের রাতটা এখানে থেকেছে। আর এখন সকাল, ইভান বুকে ভর করে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রিজোয়ানা সবসময় ঘুম থেকে উঠে সবার আগে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। কিন্তু ইভানের ঘুমে সমস্যা হবে তাই আজ সরায়নি। ফজরের সময় নামাজ পড়ে সে আবার ঘুমিয়েছে। আটটার আগে ডাকতে নিষেধ করেছে। আটটা বাজতে চলেছে তাই রিজোয়ানা চা নিয়ে হাজির। মাথার পাশে বসে নিশ্চুপে চুলগুলোতে হাত বুলাচ্ছে। ডাকছে না, কারণ সে জানে তার ঘুম এতোটা গভীর নয়। এতে যদি কাজ না হয়, তবে ডেকে তুলবে। কিন্তু এতেই কাজ হয়ে গেছে। মাথায় হাত বুলানোর কারণে ইভান নেড়েচেড়ে উঠতেই রিজোয়ানা বললো,
“এই, চা কিন্তু ঠান্ডা হয়ে গেলো।”
ইভান চোখ কুচকে একটুখানি তাকাতেই আবার বললো,
“তোমার ধোঁয়া উঠা আবদার, সকাল সকাল কড়া রঙ চা। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে যে…”
ইভান এবার বুঝতে পেরে মুচকি হেসে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“ধোঁয়া উঠা আবদার!”
রিজোয়ানা চোখের পলক ফেলে মুচকি হাসলো। ইভান আড়মোড়া ভেঙে বললো,
“সুইট মর্নিং।”
“সুইটো টু। ওঠো।”
অবশেষে কাছাকাছি এসে, জানালার ধারে পাশাপাশি বসে উপভোগ্য সকালে কড়া রঙ চা উপভোগ এবং গল্পেসল্পে জমেছে নবদম্পতি। শত স্বপ্ন, শত পরিকল্পনা যে এখনো রয়েছে বাকি।

(তবে লুকোচুরির এখানেই সমাপ্তি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here