তুমি কোন কাননের ফুল, পর্ব:১

ক্লাস টেইনের অর্ধ-বার্ষিক পরিক্ষার কিছুদিন আগে থেকে আমার মনে সূক্ষ্ম ভয় ঢুকাতেই আবির্ভাব হলো দস্যি ছেলেটার।
একদিন কোচিং শেষে বাড়ি ফেরার পথে সে দূর থেকে ডাকলো,
“এই ফুলটুসি?”
ডাকটা কানে আসলেও বুঝতে পারলাম না যে আমাকে ডাকছে। আমি আর তানিশা আমাদের মতোই হাঁটতে লাগলাম। সে আবার ডাকলো। তানিশা ফিসফিসিয়ে বলল,
“দোস্ত পোলাটা মনেহয় তোকে ডাকে।”
আমি একবার তার দিকে তাকালাম। একদমই অচেনা। অবাক হয়ে বললাম,
“আশ্চর্য! আমাকে ডাকবে ক্যান? আমার নাম কি ফুলটুসি নাকি? উনি তো কোন ফুলটুসিকে ডাকছে।”
তানিশা মুখে হাত চেপে হেসে বলল,
“মনেহয় তোরেই ঢং করে ফুলটুসি বলতেছে। সামথিং সামথিং…!” বলেই চোখ মারলো। ভীষণ বিরক্ত হলাম মেয়েটার উপর। রাগ দেখিয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই সে এসে হাজির হলো। আমাদের পথের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। অচেনা একটা ছেলের এহেন কর্মকান্ডে আমি একটু অস্বস্তিতে পড়লাম।
এলোমেলো চুলের শ্যামবর্ণের একটা ছেলে। টি-শার্ট এর উপর চেকপ্রিন্টের একটা শার্ট। হাতটা কনুই অব্দি গোটানো। আগাগোড়া অগোছালো একটা ছেলে।
আমরা অস্বস্তিতে পড়লেও সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
“এই যে ফুলটুসি? কেমন আছো? কাল আসোনি কেন?”
আমার ঠিক কি বলা উচিত ঠিক ভেবে পেলাম না। মনেমনে ভাবলাম, সে হয়তো অন্য কারোর সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলছে। তা না হলে চেনা নাই জানা নাই সে আমাকে এসব প্রশ্ন কেন করবে? আমি বললাম,
“আপনি বোধহয় ভুল করছেন ভাইয়া। অন্যকারো সাথে গুলিয়ে ফেলছেন হয়তো। আমার নাম ফুলটুসি না।”
উনি হো হো করে হেসে উঠলেন। যেন আমি ভারি মজার কথা বলেছি! একটু রাগ হলো তার হাসি দেখে। আমার বিরক্তি কিংবা রাগ কিছুই সে পাত্তা দিলো না।
সদ্য তারুন্যে পা দেয়া বিরক্তিকর ছেলেটা আমার একটু কাছে ঝুঁকে বলল,
“কাল থেকে কপালে একটা কালো ফোঁটা দিয়ে বের হবা। নাহলে এমন ভুল অনেকেই করে বসবে, বুঝেছো ফুলটুসি? সামনে না তোমার এক্সাম? গ্যাপ দিবা না মোটেও, ঠিক আছে?”
এমনিতে ইনট্রোভার্ট হলেও রাগ হলে ফটাফট কথা শুনিয়ে দিতে পারি। তাকেও ছেড়ে দিলাম না। ফুঁসে উঠে বললাম,
“আশ্চর্য! আমি গ্যাঁপ দিলে আপনার কি? আপনি কি আমার গার্জিয়ান? চেনা নাই, জানা নাই, আসছে টিচার গিরি দেখাতে! বখাটে!”
ছেলেটা আরো এক দফা হাসলো। অনেকটা নিচু স্বরে বললো,
“বাহ! বাচ্চা ফুলের অনেক রাগ দেখি! আই লাভ রাগী ফুল!”
বখাটে তকমা পাওয়ার প্রথম ধাপ সে ততক্ষণে ক্রস করে ফেলেছিলো।

সেই ছোট থেকেই আমার ধারনা, যেই ছেলেরা মেয়েদের পিছু পিছু ঘোরে, তারা বখাটে। ভালো ছেলেরা কখনোই কাউকে বিরক্ত করে না, মেয়েদের পিছে ঘোরে না।
আমার চিন্তা আরো খানিকটা শক্তপোক্ত করতেই বোধহয় ছেলেটার আবির্ভাব ঘটে। বিশ-বাইশ পেরোনো আওলা-ঝাউলা সেই ছেলেটাকে মারাক্তক অপছন্দ করে ফেললাম শুরুতেই। প্রথম দেখায় ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসা বলে কিছু আছে কিনা জানি না। কিন্তু প্রথম দেখায় অ-ভালো লাগা বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা সে!

তানিশাকে টেনে চটজলদি একটা রিকশায় উঠে পড়লাম। উপরে উপরে রাগ দেখালেও, হাত পা কাঁপাকাঁপি টাইপ ভয় পেলাম। ছোট মনটাতে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেলো, “তবে কি এই বখাটে ছেলে আমার মুখে এসিড মারবে? নাকি কিডন্যাপ করবে? আচ্ছা? বাংলাদেশে কি বখাটের উৎপাত বেড়ে গিয়েছে? আল্লাহ বাঁচাও!”
আরো কতশত ভয় যে তাকে ঘিরে শুরু হলো তার কোনো ইয়াত্তা নেই। কনজারভেটিভ ফ্যামিলি হওয়ার সুবাদে ভালোই কড়া শাসনে রাখতো। সেই ছোট থেকেই আমাকে এবং আমার সকল বোনদের বোঝানো হতো, ‘মামুনি? এমন কিছু কখনোই করবা না, যাতে পরিবার ছোট হয়। মনে রাখবা, তোমার পরিবারের একটা আলাদা সম্মান আছে সমাজে।’
আমি বরাবর-ই বাবা-মায়ের বাধ্য মেয়ে। ইন্ট্রোভার্ট হওয়ার ফলে তাদের বানী মানতে খুব একটা কষ্ট হয়নি। তানিশা ব্যাতিত তেমন কোনো ফ্রেন্ডও ছিলো না। গার্লস স্কুল হওয়ার ফলে ছেলেদের সাথে সখ্যতা গড়ার কোনো রকম সুযোগ কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই ছিলো না।
এই সহজ-সরল জঞ্জালহীন ছোট্ট মনটাতে ভয়ের রেশ ঢুকালো ছেলেটা।
ভয়ে ভয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করতে লাগলাম। যেখানে আগে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম, সেখানে আমি রিকশা দিয়ে যাওয়া আসা শুরু করলাম। তানিশা ভয় পেত না। ও বলতো,
“এত ভয় পাচ্ছিস কেন? ছেলেটা তো জ্বালাচ্ছে না, শুধু দূর থেকে তাকিয়ে থাকে আর একটু একটু হাসে। মাঝেমধ্যে বাইক নিয়ে রিকশার পিছু নেয় আর ফুলটুসি বলে ডাকে। ক্ষতি তো করছে না। দেখে তো বখাটে মনে হয় না দোস্ত। হাসিটা কি কিউট দেখছিস? আহা!”
তানিশার মুখে ওই বিরক্তিকর ছেলেটার সম্পর্কে সু-বাক্য শুনে রীতিমতো অবাক হলাম। ক্ষোভ প্রকাশ করলাম। ইয়াক-টিয়াক করে চোখমুখ কুঁচকালাম। বললাম,
“কি জঘন্য তোর চয়েস রে! এই বখাটের জঘন্য হাসি দেখলে আমার কি ইচ্ছে হয় জানিস? ইচ্ছে হয়, হাতুড়ি দিয়ে বারি মেরে ভ্যাম্পেয়ারের মতো গ্যাঁজ দাঁত গুলো ভেঙে দেই। ইশ, তোর চোখ পুরাই নষ্ট রে। জলদি ডক্টর দেখা দোস্ত।”

ও আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করতো আমি ওকে যতটা খারাপ ভাবছি ততোটাও খারাপ সে না।
বখাটে ছেলেরা পথ আটকে নানান ভাবে টিজ করে। মাঝে-মধ্যে ওরনা-টরনা ধরে টানাটানি করে, দেখিস না টিভিতে? ও কি তেমন কিছু করে?
আমিও ও’কে পাল্টা যুক্তি দিতাম। বুঝাতাম,
‘বখাটেরা আপডেট হয়েছে। দেশ ডিজিটাল হয়েছে বখাটেরা কি ব্যাকডেটেড থাকবে? তারা আর আগের মতো ওরনা ধরে টানাটানি করে না। দুর থেকে দাঁড়িয়ে মাঝে-মধ্যে ফুলটুসি টুলটুসি ডাকে।’
ভালো ছেলেদের সঙ্গা দিতাম। নানা যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতাম, ভালো ছেলেরা কি এমন হয়?
কোনো ভালো ছেলে, দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসবে কেন? ফুলটুসি মুলটুসি ডাকবে কেন? তাছাড়া ভালো ছেলেরা কখনো এত কম বয়সে বাইক চালায়? টিভিতে দেখিস না? মা-বাবাকে ব্লাকমেইল করে বকাটে ছেলেগুলা কিভাবে বাইক কিনে দেয়ার জন্য ফোর্স করে! এ ও নিশ্চই তেমন কিছু করেছে। দেখেই বোঝা যায়, অসভ্য ছেলে একটা!
রাগে কিড়মিড় করে বলা কথাগুলো শুনে
তানিশা হাসতো। কেন হাসতো কে জানে! মাঝে-মধ্যে মেয়েটার উপর ও রাগ লাগতো।আমার ফ্রেন্ড হয়ে বখাটে ছেলেটা সাপোর্ট ক্যান করবে?
অর্ধ-বার্ষিক পরিক্ষার সময়টাতে সে কম জ্বালাতো। হুট করে বাইক চালিয়ে কই থেকে জানি আসতো। কিছুক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে থেকে বিচ্ছিরি হাসিটা দিয়ে আবার চলে যেত। মনে মনে ভাবতাম, এইটাই বোধহয় ডিজিটাল বখাটেদের জ্বালানোর স্টাইল!
শেষ পরিক্ষা দিয়ে আমি তো মহা খুশি। এক সপ্তাহ বন্ধ থাকবে। অন্তত কয়েকটা দিন তো শান্তিতে থাকতে পারবো।
পরিক্ষা শেষে স্কুল থেকে বের হয়ে সেদিন তাকে দেখতে পাই নি। আমার খুশির মাত্রা আরো বেড়ে গেলো। তানিশাকে বললাম,
“আজকে আমার খুশির দিন বুঝলি?”
রিকশায় উঠতে উঠতে তানিশা বলল,
“পাগলের সুখ মনে মনে!”
আফসোস সুখটা বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না।
রিকশা যখন ছেড়ে দিবে ঠিক তখনই পেছন থেকে ননস্টপ ডাকতে লাগলেন,
“এই সুন্দর ফুল? ফুলটুসি? ওই ফুলের রানী?”

আগেই বলেছি আমি ভীষণ কনজারভেটিভ পরিবারের মেয়ে। একবার যদি আমার পরিবার টের পায় তাদের মেয়ের পিছে কোনো ছেলে ঘুরছে, তাহলে আমার যতটুকু স্বাধীনতা ছিলো সব শেষ। তার চাইতে বড় কথা তারা যদি আমায় খারাপ ভাবে? আশেপাশে আমার পরিবারের কেউ যদি তার এমন ডাকাডাকি শুনতে পায় তাহলেই আমি শেষ! আমি ভয়ে অস্থির হয়ে গেলাম। ভয়ে ভয়ে রিকশার মাঝের ফাঁক দিয়ে তাকে দেখে আরো একটা ধাক্কা খেলাম। মাথায় ব্যান্ডেজ করা। হাতের কব্জি থেকে শুরু করে কনুই অব্দি ব্যান্ডেজ করা। চোখমুখ ফুলে আছে। মনে হলো মাত্রই এক্সিডেন্ট করে ব্যান্ডেজ করে চলে এসেছে। কিন্তু তার মুখে হাসি। দুই কিনারের গেঁজ দাঁত বেরিয়ে এলো। তবে সেই প্রথম তার প্রতি আমার একটুখানি সহানুভূতি হলো। তানিশা আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,
“কিরে দোস্ত? এক্সিডেন্ট-ফেক্সিডেন্ট করলো নাকি?”
মনেমনে মায়া হলেও উপরে সেটা প্রকাশ করলাম না। কপাল কুঁচকে বললাম,
“আমি কি জানি? পাগল-ছাগল যা কিছু করতে পারে!”
ছেলেটা রিকশার পেছন থেকে বাইকটা নিয়ে আমার কিনারে এসে থামালো। পঁচা পঁচা হাসি মুখ করে বলল,
“কেমন আছো ফুল?”
আমি কিছুই বললাম না। কপাল কুঁচকে সামনে ফিরে বসলাম। তানিশা তাকে জিজ্ঞেস করলো,
“আল্লাহ, ভাইয়া? এক্সিডেন্ট করেছেন নাকি?”
তিনি বললেন,
“ইয়ে মানে, আমার এই বাচ্চা বাইক আমাকে ফেলে দিয়েছে। ফুলটুসির কথা ওকে একটু বেশি বেশি বলি দেখে রাগ হয়েছে হয়তো!”
তানিশা মুখ চেপে হাসলো। আমি যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে বসে রইলাম।
তার দিকে তাকাতেই বলল,
“আজ বেশি জ্বালাবো না, সত্যি। একটা জিনিস দিতে এসেছি। দিবো?”
রাস্তাঘাটে বেশিক্ষণ এভাবে রিকশা থামিয়ে কথা বলাটা বিপদজনক ভেবে রুক্ষ কন্ঠে বলাম,
“জলদি দিন।”
“চিঠি-ফিটি লিখতে পারি না, বুঝছো রাগী ফুল? একটা উপন্যাসের বই থেকে কিছু লাইন কপি মাইরা লিখে দিয়েছি। লাস্টে দিয়ে ইট্টু কষ্টে-মষ্টে নিজ থেকে লিখছি। হাইসো না কেমন?” বলেই আমার কোলের উপর রাখা ব্যাগের উপর একটা কাগজ রাখলো।
আমি কাগজ টা নিতে না নিতেই সে বাইক ঘুরিয়ে চলে গেলো। আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে ই হয়তো একমাত্র অসহ্যকর প্রেমিক যে কিনা কপি করে চিঠি লিখে, সেটা আবার গর্ব করে বলে! আমার মনে সূক্ষ্ম একটা প্রশ্ন উঁকি দিলো, ‘সে কি পাগল?’
একটা বখাটে, অসভ্য আর পাগল চলে যাচ্ছিলো আর আমি আহাম্মকের মতো তাকিয়ে ছিলাম। মানুষ এমন বেশরম হয়?
তানিশা ফিক করে হেসে ফেললো। আমার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছিলো আর হাসছিলো। হাসতে হাসতেই বলল,
“দোস্ত? তোর নাম তো গিনেজ বুকে উঠা দরকার। তুই-ই বোধহয় একমাত্র আজব প্রেমপত্রের উত্তরাধিকারী। যার প্রেমপত্রের একপাশে উপন্যাসের কপি অন্যপাশে কবিরাজদের বিজ্ঞাপন। পুরাই জোশ। হা হা হা!”
আমি কপাল কুঁচকে কাগজটা নিলাম। উল্টেপাল্টে দেখে প্রচন্ড রাগ হলো। ইচ্ছে হচ্ছিল ছেলেটার ব্যান্ডেজ করা মাথাটাতে একটা ঘুষি মেরে আসি। অসভ্য ছেলে! রাস্তা থেকে বিজ্ঞাপনের কাগজ টোকায়ে প্রেমপত্র লিখে গর্বের সহিত দিতে এসেছে! বাসায় কি কাগজ কলম ছিলো না? বেয়াদপ!
আমার ফুলেফেঁপে ওঠা রাগে আরেকটু ঘি ঢালতেই কিছুদূর গিয়ে বিরক্তিকর ছেলেটা আবার ফেরত এলো। গলা খ্যাঁকারি দিয়ে লাজুক স্বরে বললো,
“ইয়ে মানে, ফুলটুসি? আরেকটা জিনিস দিতে ভুলে গিয়েছি। রাগ করো না কেমন?
আমার এক বন্ধু বলছিলো, মেয়েদের নাকি গান শুনাইলে তারা তাড়াতাড়ি পটে যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমার ভয়েস মারাক্তক খারাপ। উল্টো রিয়েকশন হয়ে যেতে পারে। তাই রিস্ক নিলাম না। কিন্তু পটাইতে তো হবেই। তাই একটা গান লিখে এনেছি।” বলেই আরেকটা কাগজ আমার কোলে দিলো। যাওয়ার আগে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,
“পটে যেও প্লিজ! এই সুন্দর ফুলটা আমার চাই-ই চাই।”

সে চলে যেতেই তানিশা আকাশ কাঁপানো হাসিতে ফেঁটে পড়লো।
ওর থেকে চোখ সরিয়ে কাগজ খুলে দেখলাম সেখানে রবীন্দ্রনাথের সুন্দর একটা গান লেখা।
‘তুমি কোন কাননের ফুল,
কোন গগনের তারা!
তোমায় কোথায় দেখেছি
যেন কোন স্বপনের পারা!’

…..(চলবে)

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#সূচনা_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here