তুমি কোন কাননের ফুল, পর্ব:২

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#দ্বিতিয়_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

পরিক্ষা শেষ হওয়ার পর দুদিন ছেলেটার সাথে দেখা হয়নি। আমার একটা স্বভাব হচ্ছে, যাদের আমি অপছন্দ করি তারা যতই দূরে থাকে ততোই আমার শান্তি। তখনও মোটামুটি শান্তিতেই ছিলাম। তানিশার বাসা আমাদের বাসার কাছেই ছিলো। দিনের বেশিরভাগ সময় আমরা একসাথে কাটাতাম। বেয়াদপ ছেলেটা যবে থেকে ফুলটুসি বলে ডাকা শুরু করেছে তবে থেকে তানিশাও ফুলটুসি ডাকে। আর আমার শরীর রাগে কটমটিয়ে উঠে। তানিশা বলতো, ফুলটুসি ডাকটা খুব সুন্দর। তোর নাম নয়নতারা না হয়ে ফুলটুসি হলে কিন্তু মন্দ হতো না। বলেই হো হো করে হেসে ফেলতো।
আমার রুমের বারান্দা থেকে রাস্তা স্পষ্ট দেখা যায়। সন্ধ্যের পর বেশখানিকটা সময় আমার বারান্দাতেই কেটে যায়। সেদিনও সন্ধ্যার পর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। যখন চলে আসবো ঠিক তখন একটা কাগজ এসে পড়লো বারান্দায়। আমি কাগজটা নিয়ে রাস্তায় তাকালাম কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না। কাউকে না দেখতে পেয়ে কাগজটা খুললাম। সেখানে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা ছিলো,
“এই ফুলটুসি? রাতের আর খানিকটা সময় কি নয়নতারা ফুলটা ফুটে থাকতে পারে না? রোজ এত জলদি সে আড়ালে চলে যায় কেন বলতে পারো? সারাদিন না দেখতে পাওয়ার তৃষ্ণা এই একটুখানি দেখাতে কি মিটে, বলো? এই সুন্দর ফুলটাকে কি ভীষণ ভালোবাসি জানো মেয়ে?”
এই ছোট্ট চিরকুটটাতে আমার ছোট মনটা ডুবে গেলো। বারবার পড়লাম। আমার নামটা আমার কাছে এর আগে কখনই এতটা সুন্দর লাগে নাই।
আমি আবার রাস্তায় তাকালাম। প্যান্টের দুই পকেটে দুই হাত গুঁজে একটা পাগলাটে ছেলে চলে যাচ্ছিল আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। সে আর পেছন ফিরে তাকালো না। তবে আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখলাম। ভীষণ অপছন্দ করা ছেলেটার জন্য হুট করেই একটুখানি মুগ্ধতার রেশ ভর করলো।

তানিশাকে যখন বললাম, মেয়েটা খিলখিল করে হাসি শুরু করলো। আমি বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, হাসছিস কেন?
ও হেসে হেসেই উত্তর দিলো,
“দোস্ত আগের চিঠিটার মতো এবারের চিরকুট টার অপর পাশে কবিরাজের বিজ্ঞাপন-টিজ্ঞাপন আছে নাকি দেখ তো। আই থিংক ওই অপর পাশের কবিরাজ বেটারে দিয়াই যাদুমন্ত্র করিয়েছে। তার এফেক্টেই পটে যাচ্ছিস, হা হা হা!”
এবার আমিও হেসে ফেললাম। কই যেন শুনেছিলাম ‘পাগলাটে প্রেমিক গুলো প্রেমিক হিসেবে পারফেক্ট।’ আমার দেখার খুব ইচ্ছে হলো এই ছেলে আর কি কি পাগলামি করতে পারে। যেই ভাবনা সেই কাজ। এর পর দুদিন আমি বারান্দায় গেলাম না। কিন্তু লুকিয়ে গিয়ে তার ফেলা আজব চিরকুট গুলো ঠিক কুড়িয়ে আনতাম। পাগল পাগল লেখার পাগলাটে অনুভূতি। শেষের চিরকুট টা পড়ে খুব হেসেছিলাম। বাচ্চা বাচ্চা কথা।
“এই ফুলটুসি, জানো? আজ দুদিন আমার বাগানে ‘নয়নতারা’ ফোঁটেনি! রোজ কত যত্ন করি, আদর করি, ভালোবাসি! তবুও ফুলটা আসে না আমার বাগানে। কেমন যেন দুঃখ দুঃখ হচ্ছে। আসবা একটু? প্লিজ?”
আমি বারান্দায় যাইনি ঠিক-ই তবে আড়াল থেকে দেখেছি। সে যখন উসখুস করছিলো আমি তখন মুখ চেপে হেসেছি। শুধু একটা কাগজে এইটুকু লিখেছিলাম যে,
“নয়নতারা সব বাগানে ফোঁটে না। আর পাগল মালিদের বাগানে তো কখনই না।”
আমার ফেলা চিরকুটটা সে পড়ছিল আর হাসছিলো। এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল। আমি আড়াল থেকেই দেখেছিলাম। সেই প্রথম তার ওই বিচ্ছিরি হাসিটা একটু একটু ভালো লেগেছিলো। তানিশাকে ইয়াক-টিয়াক করে যতটা খারাপ বলেছি ততোটা খারাপ না।
সেই সাথে মনে একটা প্রশ্ন ও জাগলো, আমার নাম যে ‘নয়নতারা’ সে জানলো কি করে?
পঞ্চম দিন সবচাইতে অবিশ্বাস্য কান্ডটা ঘটিয়েছিলো। সকাল বেলা তখনও আমি ঘুম থেকে উঠিনি। ঘুম ভাঙলো আব্বুর কন্ঠে। জোরে জোরে ডাকতে লাগলেন,
“নয়নতারা? আম্মাজান? এদিকে আসো তো।”
আব্বু ডেকেছে তবুও আমি শুয়ে থাকবো সেটা অসম্ভব। আমি আধো আধো ঘুম চোখেই ড্রয়িংরুমে গেলাম। আব্বুর সাথে তাকে দেখে চোখ কচলালাম। তারপর ও যখন তাকে দেখলাম, আমার কথা বন্ধ হয়ে গেলো। হার্টবিট বেড়ে গেলো।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো আজ বোধহয় সব বলেই দিবে এই ছেলে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে খুব স্বাভাবিকভাবেই আব্বু বলল,
“আম্মাজান? ঘুম হয়েছে?”
আড়চোখে ছেলেটাকে একনজর দেখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
“আরজুকে চিনিস?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“কোন আরজু?”
সে পাশ থেকে আব্বুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“চিনে না আঙ্কেল। ফুলটু…না মানে ও তো আমাকে কখনও দেখেইনি। দেখলেও তাকায়-ই নাই। তবে আমি চিনি।”
আব্বু আগ্রহ নিয়ে বললেন,
“আম্মাজান? আরজু ভীষণ ব্রিলিয়েন্ট একটা ছেলে। নটরডেম থেকে মারাত্মক ভালো রেজাল্ট নিয়ে এইচএসসি দিয়ে বেড়িয়েছে। ফিজিক্স, ক্যামেস্ট্রি, ম্যাথে তোমার কোনো প্রবলেম থাকলে ওর থেকে হেল্প নিতে পারো। কি বলো, বাবা?”
সে এমন ভাবে সম্মতি জানালো যে তার মতো নম্রভদ্র ছেলে আর দ্বিতীয়টি নেই! কিন্তু এই পাগল ছেলেটার সাথে ব্রিলিয়েন্ট শব্দটা ঠিক মিলাতে পারলাম না। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আচ্ছা আঙ্কেল আমি তবে আজ সন্ধ্যায় এসে একবার নয়নতারার ম্যাথের প্রবলেম গুলো দেখে যাবো।”
আমি আতংক চেপে রাখতে পারলাম না। সাথে সাথে বলে উঠলাম,
“না, না, আমার ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথে কোনো প্রবলেম নাই। আপনার আসতে হবে না।”
আমার আব্বুর জন্য আমার চাওয়াটা টিকলো না। বলল,
“তুমি জানো তোমার কোথায় প্রবলেম? সামনেই এক্সাম এখন ফাঁকিবাজি করলে তো চলবে না আম্মাজান। ও একটু গার্ড দিলে তোমার রেজাল্ট ভালো হবে। তুমি এসো বাবা।”

কি ভয়ংকর শয়তানি বুদ্ধি থাকলে একটা ছেলে আমার আব্বুকে এত জলদি ইমপ্রেস করে ফেলতে পারে তা ভেবে শিওরে উঠলাম। কি সাংঘাতিক! এই ছেলে কি আমাকেও পটিয়ে ফেলছে নাকি? নিজের মন নিয়ে নিজেই সংশয়ে পরে গেলাম। বার কয়েক বিড়বিড় করলাম,
“নয়ন রে? ভুলেও এই পাগল’টাতে পটবি না। বি কেয়ারফুল মেয়ে, বি কেয়ারফুল!”

সে যাওয়ার সময় যখন দরজা আটকাতে আসলাম, তখন সে আব্বুর আড়ালেই ফিসফিসিয়ে বলল,
“সকাল বেলার ঘুম ঘুম নয়নতারা ভীষণ মিষ্টি! আরো একবার ভয়ানক প্রেমে পড়ে গেলাম। পড়ে গিয়ে বেশ কয়েকটা হাড়-টারও ভেঙে গিয়েছে। কেমন যেন ব্যাথা ব্যাথা করছে। তোমার কাছে কি কিছু মেডিসিন হবে? নয়নতারা মেডিসিন?”
.
সেদিন সন্ধ্যে সে আসে নি। আমি যে কি খুশি হয়েছিলাম। যে আব্বুকে পটিয়ে বাসা অব্দি চলে আসতে পারে সে যা কিছু করতে পারে। তবে ততদিনে এইটুকু বুঝে গিয়েছিলাম, এই ছেলে আর যাই করুক, যতই বখাটে-টখাটে হোক সে একটু একটু ভালোও। আমার খুশিটা একদিনও টিকলো না ঠিকঠাক। পরদিনই সে বাধ্য ছেলের মতো হাজির হয়ে গেলো। আব্বু এসে আমার রুমে দিয়ে গেলো। আমি একটু ভয়-ই পেলাম। আমতা আমতা করে বললাম, আব্বু? তানিশাকে ডেকে আনি? দুজনকেই পড়াক উনি?
আব্বু বলল, “আজ তুমি একাই পড়। কাল থেকে নাহয় তানিশাকেও ডেকে নিও।”
আমি আৎকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, “উনি রোজ পড়াবে নাকি আব্বু?”
বলেই তার দিকে তাকালাম, সে শুধু হাসলো।
সেদিন সে একটাও বাড়তি কথা বলেনি। ম্যাথ করিয়েছে, ফিজিক্স বুঝিয়েছে। একটা অগোছালো ছেলে যে পড়াশোনায় এতটা গোছালো আমি বুঝতেই পারিনি। পড়ানো শেষ করে যাওয়ার আগে শুধু বলেছিলো,
“তুমি আমাকে যতটা খারাপ ভাবো, আমি ততোটা খারাপ না। এতদিন যা করেছি সব দুষ্টামি করে করেছি। ভীষণ চুপচাপ মেয়েটার একটু কটকট কথা শোনার জন্য করেছি। তোমাকে হার্ট করার জন্য করিনি।
আমাকে ভয় পেও না প্লিজ। ছোট্ট একটা বাচ্চা ফুল আমাকে ভয় পাচ্ছে, ব্যাপারটা উইয়ার্ড না?”

আমি আর সেদিন কিছু বলিনি। বলিনি বলাটা ঠিক হবে না। বলা বাহুল্য বলার সুযোগ পাইনি। হনহন করে চলে গেলো সে।

এরপর স্কুল খুললো। স্কুল খোলার পর দশদিন কেটে গেলো কিন্তু তার দেখা নেই। হুট করেই যেন উধাও হয়ে গেলো। স্কুলে আসে না, বাসায় আসেনা, বারান্দাতেও আসে না।
আমার উসখুস দেখে তানিশা বলেছিলো,
“দোস্ত? একটা কাজ করে দেখতে পারিস।”
আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
“কি কাজ?”
“তোর চিরকুটের অপর পাশের বিজ্ঞাপনে কবিরাজদের নাম্বার আছে না? সেখানে ফোন দিয়ে বল, ও কবিরাজ মশাই? যাদু ও তন্ত্রমন্ত্রের মাধ্যমে আমার হারানো পাগল প্রেমিক কে ফিরিয়ে দিন তো! আমি তাকে ভীষণ মিস করছি।”
ওর এই কথা শুনে ওকে বেশ কিছু কিল ঘুষি মারলেও ভেতর ভেতর সত্যি সত্যিই কাজটা করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো।
ভয়ানক বিরক্তিকর ছেলেটাকে মিস করতে লাগলাম। তার আজব আজব কান্ডগুলো মিস করতে লাগলাম। সবচাইতে বেশি মিস করছিলাম তার বলা অদ্ভুত সুন্দর সম্বোধন গুলো। কই হারালো ছেলেটা? কেন হারালো?
……….(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here