তুমি কোন কাননের ফুল, পর্ব:৩

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#তৃতীয়_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

সে যেমন হারিয়ে গেলো আমিও তেমন ভুলে গেলাম। যেইটুকুনু অনুভূতি জন্মেছিল ওইটুকুও ভুলে যেতে বসলাম। একটা ছেলে আসলো কয়েকদিন খুব জ্বালালো, পরের কিছুদিন একটু একটু মুগ্ধ করলো তারপর ঠুস করে হারিয়ে গেলো। আমিও তাকে খোঁজার চেষ্টা করিনি। এর মাঝে এক্সামেরও চাপ বেড়ে গেলো। মনে রাখার আর কোনো অবকাশও রইলো না।
তানিশাকেও শেয়ার করা বন্ধ করে দিলাম। ওকে যদি একটু দুঃখি দুঃখি মুখ করে বলতাম,
“যাহ, ছেলেটাকে বেশি বকা দিয়ে ফেলেছি মনেহয়। কষ্ট পেয়েছে রে!”
মেয়েটা তখন এমন মুখ করতো যেন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। আমার থেকেও দিগুন দুঃখি দুঃখি ভাব করে বলতো,
“আহ-হারেএএ! অনেক কষ্টের প্রেম কাহিনী। মহা কষ্ট! কষ্টের কোনো সীমানা নাই। কেঁদে কেটে দুনিয়া ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে রে! আয় একটু কাঁদি।” বলে আকাশ কাঁপানো হাসিতে ফেটে পরতো। অসহায় আমি ঠিক করে নিলাম এই বিচ্ছিরি মেয়েটাকে আর কিচ্ছুটি বলবো না।
কাটা গায়ে নুনের ছিটা মারার মতো একদিন এসে বলল,
“দোস্ত? আই উইশ, আরজু ভাইয়ার মতো আমারও একটা পাগল প্রেমিক হোক। একটু দোয়া-টোয়া করে দে তো।”
দোয়ার বদলে দুইটা থপ্পড় দিয়েছিলাম ফাজিল’টাকে।

আমি যখন তাকে বেমালুম ভুলে যেতে বসেছিলাম ঠিক তখনই সে আবার নতুন করে উদয় হলো। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের পাশের ফ্লাটে নতুন ফ্যামিলি উঠেছে। আম্মু বলল, চল ঘুরে আসি। আলাপ হয়ে আসি। আমি যেতে চাইলাম না। আমার এই সব কিছুতে ‘না, না’ স্বভাবে আম্মু প্রচুর বিরক্ত। তার ভাষ্যমতে যারা মানুষের সাথে কম মিশে তারা অসামাজিক, অভদ্র। আর আমি নাকি এই অসামাজিক, অভদ্রতার চরম পর্যায়ে পৌছে গিয়েছি। এক পর্যায়ে বকাযকা দিয়েই নিয়ে গেলো আমাকে। কিন্তু আমার জানাই ছিলো সেখানে কত বড় সারপ্রাইজ ছিলো। আম্মু যখন আন্টির সাথে কথা বলছিলো আমি তখন তাদের রুম ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। একটা রুমের সামনে যেতেই একটা পাখি ডেকে উঠলো, ‘নয়নতারা, নয়নতারা’ ‘ফুল, সুন্দর ফুল’। নিজের নাম শুনে চমকালাম, থমকালাম। আমি আগ্রহ দমিয়ে রাখতে না পেরে পর্দাটা হালকা ফাঁক করে তাকালাম। সেই পুরোনো পরিচিত একটা মহাবিরক্তিকর ছেলে। চুলগুলো এলোমেলো, গায়ে গেঞ্জি, পরনে ত্রি-কোয়াটার প্যান্ট, গলায় তোয়ালে, হাতে তুথপেস্ট লাগানো ব্রাশ। সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। বারোটা বাজে কোনো ভালো ছেলে ঘুম থেকে উঠে? ইশশ, একটু ডিসিপ্লিন নেই ছেলেটার। এত দেরী করে ঘুম থেকে উঠেও তার কোনো ভাবান্তর নেই। খুব আয়েশ করে যত্নসহকারে পাখিটার সাথে কথা বলছে। হাতের মুঠোয় রাখা ব্রাশ নেড়ে নেড়েই গল্প করছে। কতদিন পর দেখলাম তাকে! ভালো লাগলো কিনা জানি না তবে আগ্রহভরে তাকালাম। কিছুদিন আগেও আগেও যার প্রতিটা কাজে বিরক্ত হতাম, এখন তার সব কিছুতেই একটু একটু মুগ্ধ হলাম। পাশের দরজাটায় হাত রাখতে গিয়ে একটা লেখায় চোখ আটকালো। দরজার সাথে লাগানো বড় একটা রঙিন কাগজে লেখা “এখানে নয়নতারা ফুলের মালিক থাকে।”
আমি ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম কাগজটার দিকে।
পাখিটা আবার ডেকে উঠলে, নয়ন-তা-রা, নয়ন-তা-রা! ফুল, ফুল!
আমার ভালো লাগলো। একটু না, অনেক বেশি ভালো লাগলো। এই পাগল পাগল মানুষগুলো বোধহয় খুব তাড়াতাড়ি মানুষ আকৃষ্ঠ করে ফেলতে পারে। আমিও এই পাগলের পাগল পাগল কাজগুলোর প্রেমে পড়ে গেলাম ঠুস করেই। কি ভয়ংকর ব্যাপার ভাবতে পারেন?
সে পাখিটাকে আদর করতে করতে বলল,”শোন বাবু? তোকে ফুলটুসি ডাকটা শিখাবো না। এটা একান্তই আমার ডাক। ফুলটাও আমার, ফুলকে ভালোবেসে ডাকা ডাকটাও আমার। তুই একটা কাজ করিস তো। মেয়েটাকে দেখলে জিজ্ঞেস করিস, সে কোন কাননের ফুল? এত সুন্দর কেন ফুলটা? এই তুই রবীন্দ্রনাথে এই গানটা পারিস তো? আচ্ছা না পারলে সমস্যা নেই, আমি শিখিয়ে দিবো। তুই সুইট করে ফুলটুসিকে শুনিয়ে দিবি, ওকে?”
আমি নিজের অজান্তেই ফিক করে হেসে ফেললাম। প্রায় সাথে সাথেই মুখ চেপে ধরলাম কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। সে ফিরে তাকাতেই ছুটে চলে আসলাম। অন্যকারো রুমে লুকিয়ে লুকিয়ে তার কার্জকলাপ দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়ার মতো বিড়াম্বনা আর নেই। হতে পারে না! এরপর টানা তিনদিন আমি রুম থেকেই বের হইনি। সে আসলেও নিজের রুমে দরজা আটকে বসে ছিলাম। আব্বু ডেকেছে তবুও আমি না শোনার ভান ধরে বসে ছিলাম। পরে অবশ্য শুনেছিলাম এই গুনধর ছেলেটাকে আব্বুই ফ্লাট খালি হওয়ার ব্যাপারটা অবগত করেছে! দূরে থাকলে পালিয়ে বেড়ানো যায়। কাছে থাকলে এভাবে আর কতদিন ঈ বা আড়ালে থাকা যায়?
বারবার মনে হচ্ছিল, ইশশ কি লজ্জার কাজ করে ফেলেছি! এভাবে ধরা পড়ে যাওয়াটা মোটেও ঠিক হয়নি।
আপ্রাণ চেষ্টা করেও তার থেকে বেশিদিন লুকিয়ে কাটাতে পারলাম না।
সেদিন বিকেলে ছাদে উঠে হাঁটছিলাম আর গুনগুন করে গাইছিলাম,
“অলির ও কথা শুনে বকুল হাসে
কই তাহার মতো তুমি
আমার কথা শুনে
হাসো না তো!
ধরার ও ধুলিতে যে ফাগুল আসে
কই তাহার মত তুমি
আমার কাছে কভু
আসো না তো!”
আমার এই কলিটা শেষ হতে না হতেই পেছন থেকে মৃদু কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,
“আকাশ পাড়ে ঐ অনেক দূরে
যেমন করে মেঘ
যায় গো উড়ে!
যেমন করে সে হাওয়ায় ভাসে
কই তাহার মত তুমি,
আমার স্বপ্নে কভু
আসো না তো!”
আমি হকচকিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। আকাশ থেকে টুপ করে পড়লে যেমন অনুভূতি হওয়ার কথা ঠিক তেমন অনুভূতিটাই হলো আমার। ইচ্ছে হলো ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ি। পরক্ষণে ভাবলাম, এই পাগলের জন্য লাফিয়ে পরে ঠুস করে মরে যাওয়াটা ঠিক হবে না। তার চাইতে বরং ছুটে পালাই। হায় আফসোস! ছুটে পালাতে লাগলে সে হাত টেনে দাঁড় করালো। হাত ছুটানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেও বিশেষ লাভ হলো না। সে আমার দিকে অপলক চেয়ে থেকে গাইলো,
“যেমন করে নীরে একটি পাখি
সাথীরে,
কাছে তার নেয় গো ডাকি,
যেমন করে সে ভালোবাসে
কই তাহার মত তুমি আমায় কভু
ভালোবাসো না তো!!”
গালে আঙুল ছুঁয়িয়ে তার সেই পঁচা হাসি হেসে গাইলো,
“অলির কথা শুনে বকুল হাসে
কই তাহার মত তুমি
আমার কথা শুনে
হাসো না তো!”
গান শেষে সে হাসলো। আগের মত এক হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি রীতিমতো ভয় পাচ্ছি। পাশের জবা গাছ থেকে একটা জবা ফুল ছিড়ে আমার লম্বা বেনীটাতে গুঁজে দিতে দিতে প্রশ্ন ছুড়লো,
“পুচকে রাগী ফুল? ভয় পাচ্ছো? আমায় এত ভয় পাও কেন ফুলটুসি? আমি কি বেশি পঁচা? শোন মেয়ে? আমাকে একটা হেল্প করতে পারবা? করতেই হবে।”
এক নাগারে একের পর এক প্রশ্ন করে গেলো ছেলেটা আর অস্বস্তিতে ডুবে মারা যাচ্ছিলাম আমি। তাকে ঘিরে একটু একটু পছন্দ তৈরি হয়েছিলো বলেই হয়তো এই অস্বস্তি! থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলাম, কি হেল্প?
“গান শিখাবা? কি সুন্দর গাও! আমাকে আর আমার বাচ্চা পাখিটাকে শিখাবা?”
আমার ভয় উড়ে গেলো। হেসে দিয়ে বললাম,
“আমি কোনো পাগলকে গান শিখাই না। তবে পাখিটাকে শিখাতে পারি। চলবে?”
সেও হেসে দিলো। হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
“চলবে না, দৌঁড়াবে। হা হা হা।”
হুট করে হাসি থামিয়ে একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
“এই ফুলটুসি? তোমার না সামনে পরিক্ষা? এই সময়ে ছাদে কি করো, হুম?”
আমার কপাল কুঁচকে এলো। নিজের ফর্মে ফিরে গিয়ে দাম্ভিকতা নিয়ে বললাম,
“শোনেন? আমার যখন ইচ্ছে, ছাদে আসবো, গান গাইবো, যা খুশি করবো। আপনার কি হু? বখাটে একটা!”
সে হেসে দিয়ে বলল,
“দ্যাট’স লাইক মাই রাগি ফুল! আমার ফুলটুসি!”
আমি হনহনিয়ে চলে এলাম। কিছুদূর এসে মনে হলো আরো কিছু কঠিন কঠিন কথা শুনাতে হবে তাকে! ফিরে গিয়ে বললাম,
“এই যে শোনেন? আমাকে ফুলটুসি ফুলটুসি করেন কেন হ্যাঁ? এটা আমার নাম না। আমার সুন্দর একটা নাম আছে। এসব ফুলটুসি মুলটুসি বলবেন না, বলে দিলাম।”
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে চলে আসলাম। সে পেছন থেকে চিল্লায়ে চিল্লায়ে বলল,
“এই মেয়ে? বেশি রেগে গিয়েছো? ওহ শিট! আজ তো আমার বাগানের নয়নতারা ফুলটাতে পানি দেই নি! এই ফুলটুসি? তাই বলে এত্ত রেগে গিয়েছো? এই শেষ বিকেলের ফুল? শোনো…!
…….(চলবে)

(গল্পটা পঁচা হচ্ছে, না?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here