লুকোচুরি,পর্ব:১৩

“লুকোচুরি”
পর্ব- ১৩
(নূর নাফিসা)
.
.
প্রতিবছরই ঈদ উদযাপন করতে গ্রামে যায় রিজোয়ানার পরিবার। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। ঈদের দু-এক দিন আগে পথেঘাটে ভীড় থাকে প্রচুর। তাই সবসময়ই তারা চার-পাঁচ দিন আগে যায়। আসেও একটু দেরি করেই। একুশ রমজানে ঈদ শপিং শেষ। এবার পঁচিশ রমজানে তারা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ তেইশ রমজান। ব্যস্ত বিকেলে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ডেলিভারম্যান। হাতে একটা প্যাকেট। লুবনা দরজার সামনে এসে দাঁড়ালে লোকটা রিজোয়ানার খোঁজ করলো। লুবনা সেখান থেকেই রিজোয়ানাকে ডাকলে সে কাজ ছেড়ে বিরক্তি নিয়ে উপস্থিত হলো। প্যাকেট এগিয়ে দিতেই লোকের প্রতি প্রশ্ন জুড়ে দিলো,
“এইটা কি?”
“গিফট ম্যাম। আপনার নামে এসেছে।”
“কে পাঠালো?”
“নাম ঠিকানা তো আনপাবলিশড!”
“আনপাবলিশড! আচ্ছা, কি আছে এতে?”
“ম্যাম, সেটা আমি কি করে বলবো। আমরা তো প্যাকেট …”
“ওহ্! স্যরি। আমিই কি বলে যাচ্ছি। আচ্ছা, দিন।”
রিজোয়ানা প্যাকেট হাতে নিতেই লুবনা খপ করে প্যাকেট কেড়ে নিয়ে আবার লোকটার হাতে ধরিয়ে দিলো এবং রিজোয়ানার উদ্দেশ্যে বললো,
“নাম ঠিকানা আনপাবলিশড, তুই কেন নিবি এটা?”
“আশ্চর্য! আমার নামে এসেছে তো।”
“তোর নামে এসেছে তো কি হয়েছে? কে না কে কি না কি পাঠিয়েছে, না জেনে একটা নিলেই হলো! এই, আপনি যান তো। যারটা তার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসুন।”
রিজোয়ানা এবং ডেলিভারম্যান দুজনেই হকচকিয়ে গেল। লুবনা লোকটাকে জিজ্ঞেস করলো,
“রোযা রেখেছেন? তাহলে ইফতার করে যান। কিন্তু এই প্যাকেট ফিরিয়ে দিবেন।”
রিজোয়ানা আবার প্যাকেট নিয়ে বললো,
“আহ, মা! কেন অযথা উনাকে হয়রানি করছো! কেউ গিফট পাঠিয়েছে সেটা ফিরিয়ে দেওয়া শোভা পায়? খুলে দেখলেই তো হিন্টস পাওয়া যাবে। নাকি?”
“এই, খুলবি মানে কি? অহেতুক অচেনা লোকের গিফট নেওয়ারই কোনো মানে হয়না। খুলে দেখার মানে কি! ভেতরে হিন্টস দিবে আর বাইরে নাম বসাতে পারবে না! ফিরিয়ে দে বলছি।”
রিজোয়ানা রিসিভ করে লোকটাকে পাঠিয়ে দিলো এবং সোফার দিকে যেতে যেতে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
“তুমি যে কি কাণ্ড করো না! ফ্রেন্ডসরা সারপ্রাইজও দিতে পারবে না তোমার যন্ত্রণায়! এতো চিন্তা করো না। বোমা টোমা নেই। উড়াবে না তোমার বাপের সম্পদ আর আমার বাপের বাড়ি। প্যাকেটের ভেতরটা নরম।”
“চিন্তা করো না, বোমা টোমা নেই! তা না থাকলেই কি! তোর যে কতটা লোভ আছে, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তোর লোভের চেয়ে বড় বোমা আর কি হতে পারে! যেই গিফট পেয়েছে, সেই হাতছাড়া করতে রাজি না! এটা নিয়ে এখন বসছিস কেন? কাজ নেই?”
“আরে বসছি না, রেখে আসছি।”
রিজোয়ানা প্যাকেটটা সোফায় রাখতে গিয়েও রাখলো না। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে নিজের রুমেই রেখে এলো। পরিচয় লুকিয়ে কেউ তাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছে। বাবা ভাইয়ার হাতে পড়ে গেলে তো আর সারপ্রাইজটা মনমতো পাওয়া হবে না! তাই এই ব্যবস্থা।
বাকিটা সময় কাজ করতে করতে শুধু ভাবতেই লাগলো, কে গিফট পাঠালো আর কি ই বা পাঠালো! ইফতারের পরে সে রুমে এসে প্যাকেট খুলে দেখলো সম্পূর্ণ সাদা রঙের একটা জর্জেট গাউন সেট! গাউনে বসানো স্টোনগুলো লাইটের আলোয় চিকচিক করছে। মুহুর্তেই মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠলো। এতো ভালো লাগছে দেখতে এবং অনুভব করতে! লাইটের আলোতেই কতটা চাকচিক্যময় দেখাচ্ছে, রোদের আলোয় না জানি কত সুন্দর দেখায়! ভাবতে পারছে না রিজোয়ানা। মনের মধ্যে চরম উত্তেজনা কাজ করছে। কি গিফট, তা তো দেখা হয়ে গেলো। কিন্তু গিফটদাতাকে তো এখনো জানা হলো না। সে গাউনের সাথে ছোট আরেকটা প্যাকেট দেখলো। সেই প্যাকেট খুলে দেখলো এখানে এক জোড়া জুতো! জুতো জোড়ার রঙ এবং তার উপর নকশার স্টোন সম্পূর্ণ গোল্ডেন কালার! এ-ও ঝিকিমিকি করছে। জুতোর প্যাকেটের ভেতরও আরও ছোট একটা প্যাকেট! সেটা খুলে দেখলো স্টোন বসানো গোল্ডেন কালারের এক জোড়া কানের দুল! গিফটদাতার কোনো পরিচয় নেই প্যাকেটের ভেতরে। গাউন দেখার পর পর্যন্তও সন্দেহ করছিলো তার ফ্রেন্ডদের মধ্যে কেউ হবে। কিন্তু পরপর তার সাথে জুতো ও দুল দেখে একজনকেই সন্দেহ হচ্ছে। যদিও নিশ্চিত হতে পারছে না। কেননা সেই একজন গিফট পাঠালে কুরিয়ারে কেন পাঠাবে! সে তো হাতে হাতেই দিতে পারতো!
রিজোয়ানা বারান্দায় এসে দেখলো ইভানের রুমের লাইট অফ। তাহলে কি ইভান এখনো বাড়ি ফিরেনি? সে তো ইফতারের আগেই অফিস থেকে ফিরে। হয়তো কোথাও গিয়েছে তাই বাসায় নেই। রিজোয়ানা কল করলে রিং হয়ে কেটে গেলো। ফোন কি সাইলেন্ট মুডে নাকি বুঝতে পারলো না। কয়েক সেকেন্ড পাড় হতেই ইভান অনলাইনে কল করলো। সে অনলাইনে আছে, তার মানে কি সে বাসায়ই! ভাবতে ভাবতে রিজোয়ানা রিসিভ করেই বললো,
“তুমি বাসায়!”
“কেন?”
“না, বাইরে থাকলে তো অনলাইনে পাওয়া যায় না। তাই…”
“হুম, বাসাতেই আছি।”
“বারান্দার লাইট অফ যে?”
“জ্বালাইনি?”
“তুমি জানো না সেটা?”
“রুমে বেশিক্ষণ থাকিনি তো। ভুলে গেছি।”
“তাহলে কোথায় আছো?”
“এইযে, ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছি।”
“পাশে কে?”
“সবাই।”
“সবাই বলতে?”
“সবাই বলতে, সবাই।”
“মামিও?”
“হ্যাঁ।”
“মামির সামনে বসে তুমি কথা বলছো!”
“এতো জিজ্ঞাসা না করে কি বলবে বলো?”
“একটু সরে আসো সেখান থেকে।”
“ওকে, বলতে থাকো।”
“গুড্ডু সুড্ডুর টিচার আসেনি যে আজ?”
“ঈদের ছুটি দিয়েছে।”
“ওহ্! একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিলো।”
“হুম?”
ওদিকে ইভানের বারান্দার লাইট জ্বলে উঠতে দেখা গেলো। রিজোয়ানা বুঝতে পারলো ইভান ড্রয়িংরুম ছেড়ে নিজের রুমে চলে এসেছে কিন্তু বারান্দায় আসেনি। সে বলতে লাগলো,
“তুমি কিছু পাঠিয়েছো?”
“কাকে?”
“তোমার বউকে।”
“কি পাঠাবো?”
“পাঠাওনি কিছু?”
“বউকে পাঠালে বউ জানবে না?”
“হুম, সেটাই তো। আচ্ছা, কিছু না। রাখি।”
“রাখবে মানে! এজন্য তুমি আমাকে ড্রয়িংরুম থেকে উঠিয়ে এনেছো? তা-ও আবার কিসব জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছো যার কোনো কূল কিনারা নেই!”
“উহ! টিভিতে কি এমন গিলছিলে যে তুলে আনায় অপরাধ হয়ে গেছে আমার!”
“কত সুন্দর নাটক দেখছিলাম, মনযোগটাই তো নষ্ট করে দিলে।”
“বাব্বাহ! কি এমন নাটক যে মা ছেলে একত্রে বসে দেখতে শুরু করেছো?”
“কি যেনো নাম, খেয়াল করিনি।”
“মনযোগ দিয়ে নাটক দেখছো, অথচ নামই জানো না!”
“বাংলাদেশি নাটক। ভীষণ সুন্দর। গুড্ডু সুড্ডু সহ বসে পড়েছে নাটক দেখতে। বুঝো এবার।”
“হয়েছে, হয়েছে। নাটকের নাম বলতে পারে না, আবার গুন গাইতে আসে। যাও গিয়ে নাটক দেখো। মনযোগ নষ্ট করার জন্য স্যরি।”
রিজোয়ানা কল কেটে দেওয়ার পূর্বেই ইভান মুচকি হেসে খুবই শান্ত গলায় বললো,
“গিফট পছন্দ হয়েছে?”
“কিহ! তার মানে তুমি পাঠয়েছো! এতোক্ষণ কি ভাবটাই না নিলে, যেন কিছুই জানো না!”
“তুমি তো আর ধরতে পারলে না। কতটুকু ভালোবাসো এটাই তার প্রমাণ।”
“ইশ! আমি ধরতে পেরেছি বলেই এগুলো দেখার পরপরই সোজা তোমাকে কল করেছি।”
“তার মানে কি বুঝাতে চাইছো? খুব বেশি ভালোবাসো?”
“মোটেও না। একদমই না। কখনোই না।”
ইভান হেসে বললো,
“আচ্ছা, পছন্দ হয়েছে?”
“ভী…ষণ! তোমার প্রিয় রঙ তো আকাশী৷ তাহলে সাদা সিলেক্ট করলে কি মনে করে?”
“আমার ভালোবাসা যে পবিত্র। সাদা পবিত্রতার রঙ। আর কি কারণ, তোমার প্রয়োজন?”
রিজোয়ানা মিষ্টি কণ্ঠে বললো,
“আর কিছু না। অযথা কুরিয়ারে পাঠানোর কি প্রয়োজন ছিলো? নিজ হাতেই তো দিতে পারতে।”
“ওইযে, তোমাকে কনফিউশানে ফেলতে পারলাম।”
“পাজি বর!”
“হা হা হা…ভোরে ছাদে এসো।”
“এই ড্রেস পড়ে?”
“নাহ! এটা ঈদ গিফট। এমনি এসো। ক’দিন যাবত একসাথে সময় কাটানো হয়না। ভোরের কোমলতায় একটু সময় কাটাবো তাই এসো।”
“ওকে।”
“ওকে, রাখি।”
“শুনো, থাক কিছু না।”
“কিছু না? আমি তো জানি অনেক কিছুই।”
“অনেক কিছুই কি?
“আমার তো মনে হলো এটা বলতে চেয়েছো…শুনো, ভালোবাসি। তাহলে কি, কিছুনা মানে ভালোবাসি?”
“হুহ্! মোটেও না।”
কল কেটে রিজোয়ানা হাসলো। ফোন রেখে জামা জুতো গুছিয়ে রাখছিলো। এমনি টুংটাং আওয়াজ হলো ফোনে। ইভান টেক্সট করেছে, নাটকের নাম “কিপ্টে”। তারমানে এখন সে টিভির সামনে গিয়ে আগে নাটকের নাম দেখেছে আর তাকে জানিয়ে দিয়েছে! তা ভেবে হাসলো আর মনে মনে বললো,
“একেবারে এটিএম শামসুজ্জামানের সহোদর তুমি। যদিও কিপ্টামি করো না, তবুও তুমি আমার কিপ্টে, কিপ্টে, কিপ্টে!”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here