#অন্যরকম_ভালোবাসা
#আফসানানীতু
#পর্ব_৮
শারমিন সুলতানা ছেলের ঘরে ঢুকেই বিরক্তিতে নাক কুঁচকে ফেললেন। ঘরের কি যে অবস্থা করে রেখেছে ছেলেটা! এমনিতে উনার পরিষ্কারের বাতিক আছে অথচ ছেলেটার সাথে পেরে ওঠেন না একদম। তিনি কোমরে আঁচল বেঁধে ঘর গোছাতে লেগে গেলেন। এমন সময় খাটের উপরে ফেলে রাখা স্পন্দনের মোবাইলটা বেজে উঠলো রিমঝিম করে। স্পন্দনকে দেবেন বলে ফোনটা হাতে নিয়েই চোখ আটকে গেলো স্ক্রিনে। একটা মিষ্টি মুখ ভেসে উঠছে কলের সাথে সাথে , বোধ হয় কলার প্রোফাইল সেট করা। শারমিন এতই মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন যে দেখতে দেখতে আঙ্গুল লেগে কলটা কেটে গেলো।
এই যাহ্! কি হল এটা ? থাক, আবার কল দেবে হয়তো। উনি ফোনটা স্পন্দনের পড়ার টেবিলের উপর রাখতে রাখতে ভাবলেন “কে মেয়েটা ? কি মিষ্টি দেখতে !” তিনি তার ছেলের সব বন্ধুদেরই কম বেশি চেনেন, তবে এই মেয়েটাকে আগে কখনো দেখেননি তিনি। পড়ার টেবিলটা গোছাতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়লো একটা পেন্সিল স্কেচের উপর। একটা মেয়ে শিউলী তলায় হাঁটু মুড়ে বসে হাঁটুতে থুতনি রেখে আনমনে হাসছে। মেয়েটার বিছানো আঁচলে এত্ত এত্ত শিউলী ফুল! স্কেচের মেয়েটাকে দেখেই চিনতে পারলেন শারমিন, একটু আগে যেই মেয়েটা কল করেছিল এ সেই মেয়েটাই।
স্পন্দন শাওয়ার নিয়ে রুমে ঢুকে দেখে ওর মা ওর টেবিল গোছাচ্ছে।
-আম্মা, আমাকে টাইটলি কড়া একটা কফি বানায় দিতে পারবা?
কথা বলতে বলতেই তার চোখ আটকে যায় মায়ের হাতে ধরা তার পেন্সিল স্কেচটার দিকে।
-কেরে মেয়েটা ? ভারী মিষ্টি তো দেখতে!
-কেউ না , এম্নি এম্নিই মন থেকে আঁকা আম্মা!
-ইহ্ , বললেই হল! একটু আগে মেয়েটা কল করেছিল তোকে, তুই দিন দিন যা মিথ্যুক হচ্ছিস বাবু!
– আম্মা, তুমি বোধ হয় আগের জন্মে শার্লক হোমসের নাতনী ছিলা, ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই ডেস্ক, মোবাইল সব চেক দিয়া ফেলসো! বাকী আছে কী, ফেসবুক আই ডি দেবো? সেইটাও চেক দিয়া দেখো কি অবস্থা।
– শোন, আমার সাথে চালাকি কম করবি। আর চেক দিয়েছি কে বলল তোকে? গুছাতে এসেছিলাম , ঘরটা তো একেবারে গরুর ঘর বানায় রাখিস ,খবিশ ছেলে কোথাকার! কথা ঘুরাবিনা একদম ! বল, বল মেয়েটা কে ?
স্পন্দন এবার ধরা পড়ে যাওয়ায় মুচকি হেসে মায়ের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সে তার মাকে পেছন থেকে আদর করে জড়িয়ে ধরে, তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
-তোমার ছেলের বৌ।
***
– অন্তু ফোন দিসিলা?
– হুম ,তুমি তো পিক করলে না তাই ভাবলাম ব্যস্ত।
-আরে আমি না, আম্মা। দেখতে দেখতে নাকি আঙ্গুল লেগে কেটে গেছে।
– ওমা, আন্টি দেখেছে !!
– হুম , শুধু কল না…সেদিন শাহজাদপুরে তোমার যে স্কেচটা করেছিলাম সেটাও দেখেছে। পুরাই বোল্ড, বুঝসো ?
– ইস্ , এখন কি হবে ? আন্টি কি খুব রাগ হয়েছে ?
– আরে,ব্যাপার না ! বরং ভালই হইছে, দেখে ফেলছে। নইলে তোমার আমার ব্যাপারটা কীভাবে বলতাম তাই নিয়ে ভেজালে ছিলাম। আর এত চিন্তার কিছু নাই…আমার আম্মা খুবই লক্ষী মেয়ে, বুঝসো ? তোমার মত হালুম পার্টি না।
-আচ্ছা, তো আমি হালুম !
– তো, নয়তো কি! কথায় কথায় যেইভাবে হুঙ্কার দেও !!
– থাক তাইলে হুঙ্কার শুনতে হবে না ফোন রাখলাম টা টা।
– ওরেহ , রাগ কর কেনো ? শোন, তুমি রাগী ঠিক আছে কিন্তু তোমার ভিতরটা কিন্তু নরম আর হেব্বি মিষ্টি, একদম নারকেল !
– পামও মারতে পারো না! জিএফরে কেউ নারকেল বলে ?
– জিএফরে বলে না তবে বৌরে বলে। শোন, কালকে তোমাকে খুব সুন্দর একটা গ্রামে নিয়ে যাবো , রেডী থেকো।
***
মুশফিক সাহেব তখন থেকে বিরক্ত মুখে চুপচাপ বসে আছেন। মাঝে মাঝে স্ত্রী সাবিনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাচ্ছেন। সেই কখন থেকে সাবিনা ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদেই চলেছেন। শেষে বিরক্তি আর চাপতে না পেরে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন,
– কি যন্ত্রণা ! আর কত কাঁদবা ? পুরা টেঙ্কি কি আজই খালি করতে হবে নাকি?
– কাঁদবো না তো কি করবো শুনি? সব তোমার দোষ! এত করে বললাম, ওরা যখন বলছে আসো মেয়ের এনগেজমেন্টটা অন্তত করে রাখি। না, মেয়েটাকে একটু সময় দাও… সময় দাও করতে করতে শেষ! এখন হলো তো সর্বনাশ?
– তোমার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমার মেয়ে ওই ছেলেটার সাথে ভেগে গেছে। আরে সময় কি আমি সাধে দিতে বলেছি? চোখ দুটো তো হাতে নিয়ে ঘোর, তাই বোধহয় দেখতেও পাওনা মেয়েটা স্বপ্নকে দেখলে কেমন কুঁকড়ে যায় । তাই বলেছিলাম ওকে আর একটু সময় দাও। আর সেই কখন থেকে কি সর্বনাশ সর্বনাশ করতেসো ! একটু থামবে প্লীজ। তোমার না সবটাতেই একটু বেশি রকমের বাড়াবাড়ি না করলে ভালো লাগে না।
ঘটনার আকস্মিকতায় মুশফিক সাহেব নিজেও চমকে গেছেন। তিনি দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পারছেন না। অন্তরা খুব বুঝদার মেয়ে। উনি উনার মেয়েকে কখনোই কোনো ব্যাপারে বাধা দেননি। অন্তরা কখনো পা পিছলে এমন কোন ভুল করবে না যার জন্য তাকে পস্তাতে হবে এমন বিশ্বাসই ছিলো উনার, তবে কি উনি ভুল করলেন ? তবে স্বপ্ন ছেলেটার কথাও পুরোপুরি বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। ছেলেটাকে উনার নিজেরও খুব একটা পছন্দ নয়। ছেলেটার মধ্যে মেকিভাব বেশি। তিনি যুক্তিবাদী মানুষ, যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিচার করতে ভালোবাসেন। তার মনে হলো, ছেলেটা যদি সত্যিই অন্তরাকে ভালোবাসত তবে এসব সাবিনাকে না জানিয়ে সরাসরি অন্তরার সঙ্গে কথা বলতো। মুশফিক সাহেব ঠিক করলেন উনি নিজে স্পন্দন ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজ নেবেন। তাছাড়া অন্তরার সাথেও এ ব্যাপারে কথা বলা জরুরী। কোন কিছু না জেনে স্বপ্নের কাছ থেকে শোনা কথায় বিশ্বাস করে উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষপাতী নন মুশফিক সাহেব।
***
– আহ্ স্পন্দন একটু আস্তে হাঁটো! আমি তো আর তোমার মত ঢ্যাংগা না।
স্পন্দন অন্তরাকে নিয়ে খুব সুন্দর একটা গ্রামে এসেছে আজ। গ্রামটার নামটাও খুব সুন্দর, শ্রী নগর।
– অন্তু, একটা জিনিস দেখবে ?
– কী?
– উহু এভাবে না, আগে চোখ বন্ধ করো।
– কোন আজাইরা দুষ্টামি করবেনা তো? দেখো, এটা কিন্তু একে গ্রাম তার উপর খোলা মাঠ।
– পৃথিবীতে মনে হয় তুমিই একমাত্র বউ যে অকারণে স্বামীকে চরিত্রহীন ভাবে।
স্পন্দন বেচারা মুখ করে বলে।
– তুমি না একটা ঢঙ্গী পুরুষ, এত ঢং করতে পারো!
অন্তরা হেসে চোখ বন্ধ করলো।
– তোমার স্যান্ডেল জোড়া হাতে নেও , ওখানে খালি পায়ে যেতে হবে।
– উফ্ ,স্পন্দন তুমি বড্ড জ্বালাও!
অন্তরা তার স্যান্ডেলজোড়া হাতে নিয়ে চোখ বুঁজে আর স্পন্দন ওর চোখ পেছন থেকে হাত দিয়ে ঢেকে দেয়। তারপর আরেক হাতে অন্তরাকে ধরে সামনে এগোয়।
অন্তরা সাবধানে ছোট ছোট পা ফেলে সামনে এগোয়।
– আর কতদূর স্পন্দন ?
– আর একটু … এইতো,চলে এসেছি। হুম , এইখানে দাঁড়াও। এইবার বল , কিছু ফিল করলা ?
অন্তরার চোখ বন্ধ তবে মনে হল পায়ের নিচে কেমন যেন কাদা কাদা।
– এমা ছিঃ , তুমি কি আমাকে কাদার মধ্যে আনসো ? কেমন ভিজা থিক থিকা লাগে !
– ধুর, তুমি না সবসময় সন্দেহ কর ! শোন, আমি তোমার চোখ ছেড়ে দিতেসি তবে না বললে তাকাবা না কিন্তু প্লীজ।
– আচ্ছা, তাকাবো না যাও। কিন্তু স্পন্দন, কেমন যেন একটা গন্ধ আসছে বাজে!
-আহ্ , এখনি তো দেখতে পাবা। এত কথা কিসের ?
– ওকে ।
এবার স্পন্দন অন্তরার চোখ ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।
– হুম , এইবার চোখ খোলো।
অন্তরা ধীরে ধীরে চোখ খুললো , কিন্তু চোখ খুলেই ঘটনা দেখে ওর পুরো শরীর গুলিয়ে উঠলো।
– এমা ছিঃ !
বলেই ও এক লাফে সরে গেলো। অন্তরার পুরো পা গোবরে মাখামাখি। মাঠের ঘাসে পা ঘষে সেগুলো মোছার অনর্থক চেষ্টা করে অন্তরা।
– এম্নে হবে না কন্যা, পা ধুতে হবে অবশ্যই।
অন্তরা তাকিয়ে দেখে স্পন্দন দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসছে। রাগে অন্তরা ওর হাতের স্যান্ডেল জোড়া ছুঁড়ে মারে স্পন্দনের দিকে।
– তুমি না আসলে একটা ফালতু ছেলে! এইভাবে কেউ কাউরে গোবরে এনে দাঁড় করায়?
স্পন্দন অবশ্য এমন ঘটনার জন্য আগে থেকেই তৈরী ছিল, তাই অন্তরা তার দিকে সেন্ডেল ছুড়ে মারতেই সে চট করে সরে যায়। লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় অন্তরা এবার দৌড়ে আসে ওকে খামচে দেবে বলে। কিন্তু কাছে আসতেই স্পন্দন খপ করে ওর হাতটা ধরে হ্যাচকা টানে ওকে বুকের মধ্যে নিয়ে নেয়। অন্তরা প্রথমে হকচকিয়ে যায় তারপর নিজেকে হঠাৎ স্পন্দনের বাহুডোরে পেয়ে কেঁপে ওঠে। ওর সারা শরীরে শিরশিরে একটা ভালো লাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। সে নিজেকে স্পন্দনের বুকে সমর্পণ করে দিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলে,
-তুমি খুব খারাপ একটা ছেলে!
– আমি আর কি খারাপ , তুমি তো আমার চাইতে আরো বেশি খারাপ ! নইলে জামাইরে কেউ জুতা মারে?
– মারলাম কই ?
স্পন্দনের বুকের উষ্ণতায় অন্তরার চোখ বুঁজে আসে।
– ওই হল ! মারা আর ঢিল দেয়া একই ব্যাপার। লাগতো যদি? জানো, জামাইরে মারলে আল্লাহ্ নারাজ হয় , শুধুমাত্র এই কারণে তুমি হাবিয়া দোযখে যেতে পারো।
স্পন্দন অন্তরাকে আরো কাছে টেনে ওর চুলে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ নেয়….
– তো এতই যদি পাপ হয়েছে তো শাস্তি দাও, আদর দিতে কে বলসে।
অন্তরা ঠোঁট ফুলিয়ে বলে। স্পন্দন তার দু’হাতের আজলা দিয়ে অন্তরার মুখটা একটু উঁচু করে ধরে ওর অভিমানী ঠোঁট দুটোর দখল নিয়ে নেয় আলতো করে। অন্তরার মনে হল, একটা আগুনের গোলা ওর ঠোঁট স্পর্শ করে ওর সমস্ত সত্তাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। অজানা এক উষ্ণ অম্ল মধুর আবেগে অন্তরা কেঁপে ওঠে।
এভাবে কতটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল ওরা জানেনা, সময় যেনো ওদের দুজনের জন্যই থমকে গেছে। লোকলজ্জা আর পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাইতে দুজনার কাছে দুজনার উপস্থিতি যেন সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। সম্পূর্ণ অপরিচিত দুজন নারী পুরুষ যেন একটি পবিত্র সুতোয় নিজেদের বেঁধে নিতে আজ বদ্ধপরিকর।
অন্তরা স্পন্দনের বুকে মাথা রেখে আদুরে আবেগে বলে,
-বৌ ভুল করলে কি সবসময় এইভাবে আদর দিবা ?
-হুম ,সবসময় ….. ভালোবাসি যে ….
-ভালোবাসলে কি কেউ ভুল করলে শাস্তি দেয় না ?
– খুব দেয়। কিন্তু আমি দেবো না।
অন্তরা দুষ্টু হেসে বলে,
– বাবা! এইটা তোমার কেমন ভালোবাসা মশাই?
স্পন্দন অন্তরাকে আরো নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে,
– এইটা আমার অন্যরকম ভালোবাসা …..
চলবে …….