অন্যরকম ভালোবাসা, পর্ব:৭

#অন্যরকম_ভালোবাসা

#আফসানানীতু

#পর্ব_৭

ফার্ম হাউসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। তাই দেখে স্পন্দন আনন্দে বাচ্চা ছেলের মত চিৎকার করে বলে ওঠে,

-ওফ আল্লাহ্ ! এইটাই চাইছিলাম ।

বাইকের হর্ন শুনে অল্পবয়সী একটা ছেলে এসে ফার্ম হাউসের মেইন গেট খুলে দেয়। ভেতরে ঢুকতেই অন্তরার চোখ জুড়িয়ে যায়!

বিশাল বড় ফার্ম হাউসটার একপাশে লম্বা করে মুরগী আর গরুর জন্য শেড করা , অন্যপাশে গোলাপ , রজনীগন্ধা আর জার্বালার শেড। সারি সারি ফুলের শেডের মাঝে ছবির মত গোছানো সুন্দর একটা একতলা কটেজ। তাই দেখে অন্তরা মনে মনে বেশ কয়েকবার বলে ওঠে , কি সুন্দর , কি সুন্দর !

স্পন্দন বাইক চালানো বন্ধ করেনি এখনো ,শুধু স্পিড কমিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে যাচ্ছে যাতে অন্তরা চারপাশটা ভালোমতো দেখতে পায়।

– পুকুরটা একদম ফার্মের শেষ মাথায়। দেখলে তোমার মাথা নষ্ট হয়ে যাবে অন্তরা!

– মাথা নষ্টের আরো বাকি আছে নাকি এখনো ?এতোটুকু দেখেই তো আমি মুগ্ধ!

স্পন্দন যেখানে বাইক থামালো , সেখানে নেমে অন্তরা রীতিমত স্তব্ধ হয়ে গেলো। ওর মনে হলো ও যেনো একলাফে বাস্তব থেকে কোনো রূপকথার রাজ্যে চলে এসেছে।

শ্বেত শুভ্র শান বাঁধানো পুকুরটার চারপাশে নানারকম ফুল আর ফলের গাছ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। আর পুকুরটা ভর্তি ঝাঁকে ঝাঁকে নীল রঙের শাপলা! একসঙ্গে এত এত শাপলা অন্তরা আগে কখনো দেখেনি ,সেখানে নীল রঙের শাপলা তো বলা যায় প্রত্যাশার চাইতে বেশি কিছু পাওয়া! রং বেরঙের ছোট ছোট শত শত ফড়িং শাপলা ফুলের উপর ছুটোছুটি করছে আর ঝিরঝিরে বৃষ্টি পুকুরের পানিতে ক্ষণে ক্ষণে এঁকে চলেছে নতুন নতুন আলপনা!

চোখে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে অন্তরা সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে পড়ে।

– কি …বলছিলাম না মাথা নষ্ট হয়ে যাবে , হইলো?

– সত্যি স্পন্দন, আমি ভাবতেও পারি নাই এত সুন্দর কিছু দেখতে পাব !! তুমি এখানে প্রায়ই আসো ?

– নাহ্ , প্রায়ই না তবে মাঝে মাঝে আসি। তবে আমি মনে মনে অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম যে আমার বৌকে অতি অবশ্যই এক বৃষ্টির দিনে এখানে নিয়ে আসবো । তারপর দুইজনে পুকুরপাড়ে বসে বৃষ্টি দেখবো একসাথে। অবশ্য ভাবি নাই ,এত তাড়াতাড়ি আমার ইচ্ছাটা পূরণ হয়ে যাবে। দেখছো, আমি আল্লাহর কত পেয়ারের বান্দা ?

কথা বলতে বলতে স্পন্দন অন্তরার পাশে এসে বসে।

– চা খাবে বিল্লু ?

– পেলে মন্দ হত না , কিন্তু এখানে চা পাবে কোথায়?

অন্তরার প্রশ্ন শুনে স্পন্দন রহস্যময় হাসি হেসে বলে,
– একটাবার আলাদীনের মত উইশ করেই দেখো প্রিন্সেস, আমি প্রদীপের দৈত্যের মতো সঙ্গে সঙ্গে যদি সেটা পূরণ না করছি তো আমার নাম অন্তরার স্পন্দন না।

অন্তরা দেখে স্পন্দন ওর হাতের ব্যাকপ্যাক খুলে একটা ফ্লাস্ক আর দুটো ওয়ান টাইম ইউজ গ্লাস বের করলো।

– বাহ্ ! তুমি তো দেখি সঙ্গে করে পুরো সংসার নিয়ে আসছো!

– দেখছো, আমি কেমন ইন্টেলেকচুয়াল বয়! আর তুমি তো আমারে খালি বার বার বুদ্ধু ভেবে রিজেক্ট করে দাও। নাও ধরো।

অন্তরা স্পন্দনের বাড়িয়ে দেয়া চায়ের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলে,

– নাহ্ এইবার তোমাকে একশোতে একশো দেয়া যায় কিন্তু।

– হুহ , মোটে! ম্যাডাম… আমি সাথে করে ছাতাও এনেছি ,লাগলে বলো। বৃষ্টিতে ভিজলে আবার কোনো সমস্যা হবে নাতো তোমার?

-না না , কক্ষনো না! ছাতা বের করবে না খবরদার! এভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে আমার বেশ লাগছে! আর মোটে তো এইটুকু ঝিরঝিরে বৃষ্টি …তাতে ভিজলে কি আর এমন হবে! আমি এত পুতুপুতু মেয়ে না বুঝসো ?

– না , আমি ভাবলাম যদি বৃষ্টির পানিতে মেকআপ ধুয়ে গিয়ে তোমাকে হঠাৎ পেত্নী পেত্নী লাগে!

স্পন্দন দুষ্ট হেসে বলতেই অন্তরা চা রেখে ওকে মারতে যায়। স্পন্দন যেনো রেডীই ছিলো , সে অমনি খপ করে অন্তরার হাতটা ধরে ফেলে। তারপর অন্তরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই টুপ করে ওর নরম গালে একটা চুমু দিয়ে বসে। ঘটনার আকস্মিকতায় অন্তরা এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়ে যে কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে যায়। তারপর ঝটপট নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ পাকিয়ে জানতে চায়,

– এটা কী হল ?

স্পন্দন মুচকি হেসে বলে,
– বারে, এত সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে আসলাম তো এমন দু’একটা পুরস্কার তো আমার প্রাপ্য অধিকার।

অন্তরা লজ্জা পেয়ে প্রতিবাদ করতেও ভুলে যায়, স্পন্দনের ছোঁয়ায় ওর শরীরের সর্বত্র একটা ভালো লাগার মিষ্টি অনুভূতি পাড় ভাঙ্গা ঢেউএর মত আছড়ে পড়ে।

স্পন্দন তাকিয়ে তাকিয়ে অন্তরার লজ্জা রাঙ্গা মুখটা দেখে। কি ভীষণ সুন্দর লাগছে অন্তরাকে! স্পন্দনের ইচ্ছে হয় ওকে জড়িয়ে ধরে ওর নরম ঠোঁটে খানিকক্ষণের জন্য হারিয়ে যেতে। কিন্তু পরক্ষণেই ইচ্ছেটাকে বাতিল করে দেয় স্পন্দন, নাহ্ …প্রথম দিনেই একটু বেশী বেশী হয়ে যায় ব্যাপারটা! তাছাড়া অন্তরার রেগে যাবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেই রাগী মেয়েরে বাবা! তবে অন্তরাকে আরেকটা চুমু খাবার লোভ সামলাতে পারে না স্পন্দন, টুপ করে ওর অন্য গালে আরো একটা চুমু দিয়ে বসে।

অন্তরা চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই স্পন্দন অন্তরার থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে বলে,

– ভবিষ্যতে আরো কত সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখাবো তোমাকে, তাই আগেভাগে অগ্রীম নিয়ে রাখলাম আর কি!

বলেই মাথা নীচু করে হাসতে থাকে স্পন্দন, ঠিক যেভাবে কলেজে ওর পিছু নেবার সময় হাসত। অন্তরার রাগ হওয়া উচিত কিন্তু কেন যেন তার রাগ আসে না বরং স্পন্দনের এই ছেলেমানুষি ভরা দুষ্টুমি ভালো লাগে… অল্প অল্প লজ্জাও লাগে! অন্তরা প্রথম প্রেমের সুখানুভূতিতে লজ্জায় লাল-নীল হয়ে মনে মনে ভেবে পায়না, কীভাবে সে এই ডানপিটে ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেলো !!

***

স্বপ্ন আর ইলাহী সাহেব ম্যাংগো কেফেতে মুখোমুখি বসে আছে। স্বপ্ন অদম্য রাগে তার হাতের টিসু পেপারটা কুটিকুটি করে ছিঁড়ছে আর বারংবার সামনে ফেলে রাখা ছবিগুলোর দিকে এমনভাবে অগ্নি দৃষ্টি মেলে দেখছে যেন সম্ভব হলে সে চোখের আগুন দিয়ে সেগুলো পুড়িয়ে ছারখার করে দিত। ইলাহী সাহেবের তাতে কিছু এসে যায় না , তিনি নির্বিকার চিত্তে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন। ক্লায়েন্টদের এমন ব্যবহার উনার কাছে নতুন কিছু নয়। তবে তিনি খানিকটা বিরক্ত, স্বপ্ন অযথাই তার সময়গুলো নষ্ট করছে। একবার তার প্রাপ্য পারিশ্রমিকটা দিয়ে দিলেই সে চলে যায়, তারপর দেখুকনা ভদ্রলোক ছবিগুলো যত খুশি উল্টে পাল্টে। একটা ব্যাপার তার মাথায় আসছে না, স্বপ্ন ছবিগুলো দেখে এত রিয়্যাক্ট করছে কেন? মেয়েটা যে তার বৌ না সেটা স্পষ্ট। তাছাড়া আজকাল বৌরাই স্বামী ফেলে অন্যকারো সাথে ঘুরলে স্বামীদের কিছু আসে যায় না আর এতো বান্ধবী মাত্র!

ইলাহী সাহেব স্বপ্নর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য শার্টের হাতা উঠিয়ে নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখেন। তবে তাতে বিশেষ কোনো লাভ হয় না, স্বপ্নের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। সে ইলাহী সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে জানতে চায়,

-আপনি শিওর অন্তরা এই ছেলেটার সাথে প্রেম করছে ?

– দেখে তো তাই মনে হয়। ম্যাডাম উনার সাথে অন্তরঙ্গভাবে বাইকে চড়ে ঘুরে বেড়ান, হাত ধরাধরি করে খেতে যান। এতে দুজনের মাঝের সম্পর্কটা স্পষ্ট।

ইলাহি সাহেবের কথায় স্বপ্নের মুখটা রাগে লাল হয়ে ওঠে , তাই দেখে ইলাহি সাহেব মনে মনে একটা বিকৃত আনন্দ অনুভব করেন। পকেট গরম এসব বোকা ক্লায়েন্টদের এমন ছোট ছোট অপারগতাগুলো তাকে সবসময়ই আনন্দ দেয়।

– ছেলেটার ডিটেইল এনেছেন?

– ছবির সাথের খামটায় সব পাবেন।

– আপনি বলছেন ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ঘরে বসে আছে , কিছুই করে না ?

– জ্বী না , সারাদিন কেবল আড্ডা আর বাইকবাজি। এক কথায় পুরদস্তুর ভবঘুরে!

স্বপ্ন আর কিছুই বলে না , পকেট থেকে টাকা ভরা একটা খাম বের করে ইলাহী সাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরে। খামটা পকেটে ভরে উঠে দাঁড়ায় ইলাহী সাহেব।

– আপনার কাজ করতে পেরে ভালো লাগলো, ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে আবার ডাকবেন।

চওড়া আন্তরিক হাসির সঙ্গে পেশাগত মুখস্ত বুলিটা আওরে আর দাঁড়ায় না ইলাহী সাহেব, এমনিতেই উনার অনেক সময় নষ্ট করেছে লোকটা।

ইলাহী সাহেব চলে গেলেও স্বপ্ন বসে রইলো, ওর ভেতরে একটা অন্ধ রাগ মাথা কুটে মরছে। ছেলেবেলা থেকেই অন্তরা আর ওদের দুই পরিবারে নিত্য মেলামেশা। ওর মা আর অন্তরার মা দুজন বাল্যবন্ধু। ছোটবেলা থেকেই ওর অন্তরাকে ভালো লাগে! বেশ শান্ত শিষ্ট আর চুপচাপ মেয়ে অন্তরা। ঠিক যখন থেকে সে প্রেম কি সেটা বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই ওকে ভালোবাসে স্বপ্ন। আর ওর ভালোবাসার এই চারাগাছে অহর্নিশ পানি ঢেলেছেন ওর মা আর সাবিনা আন্টি।

আগে অন্তরা ওর সাথে গল্প করতো, খেলতো। ওদের বাসায় সারাদিনের জন্য বেড়াতেও আসতো। তারপর বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরা আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিলো, ওকে দেখলে আর আগের মত হেসে হেসে কথা বলে না বরং কেমন এড়িয়ে চলতে শুরু করে। তখন থেকেই স্বপ্নের সন্দেহের শুরু। ওর সন্দেহ অমূলক কিনা সেটা কিভাবে যাচাই করবে তাই নিয়ে আলাপকালে ওর এক বন্ধু ওকে এই প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফার্মের হদিস দেয়। টাকা স্বপ্নর জন্য কোনো ব্যপার না, তাই আইডিয়াটা সানন্দে লুফে নেয় ও।

ইলাহী সাহেব তার হয়ে অন্তরার পিছু নেয় , আর তার ফল আজকে সামনে। রাগে ফুঁসে ওঠে স্বপ্ন। অন্তরা ওকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে ভালোবাসে… এর চেয়েও যেই ব্যাপারটা তাকে বেশি যাতনা দিচ্ছে সেটা হল, ওর মত এমন একজন যোগ্য ডাক্তার ছেলেকে ফেলে ও কিনা প্রেম করছে একটা ভেগাবন্ডের সাথে !! অথচ শুধুমাত্র অন্তরার জন্য স্বপ্ন ডাক্তারি পাশ করে এখনো দেশেই পড়ে আছে। ভেবেছিলো অন্তরার ইন্টার্ণশিপ শেষ হলে ওকে বিয়ে করে দুজন একসাথে বাইরে পড়তে যাবে। সব যখন ঠিকঠাক তখন সামান্য একটা হাভাতে ছেলের কাছে হেরে যাবে ও !!! কখনো না ….স্বপ্ন এটা হতে দিতে পারে না।

স্বপ্ন ঠিক করে আজই এই ছবি আর ছেলের ডিটেইল সে অন্তরার মা সাবিনা আন্টিকে দেখাবে। তারপর আন্টিকে যথাসাধ্য বোঝাতে চেষ্টা করবে যে অন্তরা কত বড় ভুল করতে যাচ্ছে! আন্টিকে বোঝাতে হবে অন্তরা ছেলেমানুষ তাই বোঝে না , তবে এভাবে ওর ভুলটা আর বাড়তে দেয়া যাবে না কিছুতেই। ইন্টার্ণশিপ বিয়ের পরেও করা যাবে, তাই দেরী হবার আগেই স্বপ্ন অন্তরাকে বিয়ে করতে চায়।

টাকার দম্ভ আর অহমিকায় অন্ধ স্বপ্নের কাছে তার ভালোবাসার মানুষের চাওয়ার চাইতে নিজের জয়টাই বেশি মানে রাখে। তাই আর দেরী না করে ছবিগুলো আর খামটা পকেটে পুরে উঠে দাঁড়ায় স্বপ্ন।

চলবে …..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here