অপেক্ষারা পর্ব -৪১

#অপেক্ষারা
৪১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

উত্তাল হওয়া বইছে ধরণীর বুকে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে চারিদিকে। বৃষ্টিধারা এবং হওয়া যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে, কে কার থেকে ঝড়ো গতিতে ছড়িয়ে যেতে পারে। এমন আবহাওয়ায় কেউ রাস্তায় দাঁড়ালে তার উড়ে যাওয়ার ক্ষীণ সম্ভবনাও থাকে।

চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘড়ির দিকে তাকালো নাজ। প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। সায়েম তো প্রতিদিন সাতটার মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসে। তবে আজ এত দেরি করছে কেন? তাও আবার এই ঝড়-বাদলের দিনে?

মোবাইলে হাতে কল লিস্ট থেকে সায়েমের নম্বরটা বের করলো নাজ। ডায়াল করতে গিয়েও করলো না। এই মুহূর্তে সে নির্ঘাত ড্রাইভ করছে। ফোন করে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হয়তো ঠিক হবে না। তবে সায়েম বেচারা এত সহজে পার পাচ্ছে না। একবার আসুক, আজ তার খবর আছে!

কয়েক মিনিটের মধ্যেই কলিংবেলের আওয়াজে নাজের সাত-পাঁচ ভাবনায় ছেদ পড়ল। ছুটে গিয়ে দরজা খুলেই কঠিন গলায় কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক তখনি বিস্ময়ে খাবি খেল। কাকভেজা হয়ে আছে সায়েম। তার হালকা নীল রঙের শার্টটা ভিজে গায়ের সঙ্গে সেঁটে আছে। ব্লেজারটা কাঁধে ঝুলছে, তবে সেটাও চুপচুপে ভিজা। তার চোখের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো বেয়ে টুপটাপ করে জল গড়িয়ে পরছে।

নাজ হতভম্ব হয়ে বলল, “একি? এভাবে ভিজলেন করে?”

সায়েম শান্ত গলায় বলল, “বৃষ্টি হলে মানুষ ভিজবে না?”

নাজ সন্দিহান গলায় বলল, “ইচ্ছে করে ভেজার মানুষ তো আপনি না। ঘটনা কী?”

“শুধু জেরাই করবে না-কি ঢুকতেও দেবে?”

নাজ দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াতেই সায়েম ভেতরে প্রবেশ করলো। নাজের চোখেমুখে এখনো প্রশ্নেরা উঁকি দিচ্ছে। তবে উঁকি দেওয়া সেই প্রশ্নগুলোকে আপাতত চাপা দিয়ে নাজ সায়েমের পিছু পিছু ঘরের ভেতরে চলে এলো। ছেলেটাকে একপ্রকার জোর করেই বসিয়ে দিলো ডাইনিংয়ের চেয়ারে। এক দৌড়ে ঘর থেকে শুকনো টাওয়েল এনে, সায়েমের সামনে দাড়িয়ে অতি যত্নে মুছে দিচ্ছে তার মাথা।

মাথা মুছতে মুছতেই নাজ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “ইশ! কী অবস্থা করেছেন নিজের?”

সায়েম তার প্রতিউত্তরে কিছুই বলল না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিজের কপাল গিয়ে ঠেকলো নাজের পেটে। ছেলেটার ভিজে চুল আর শার্টের প্রভাবেই নিমিষেই ভিজে গেল নাজের জামা। তবুও কোনো প্রতিবাদ করতে পারলো না। আচমকা প্রিয় মানুষটার এমন আদুরে কান্ডে হিমবাহের ন্যায় জমে দাঁড়িয়ে রইল।

সায়েম কোমল গলায় বলল, “কেন ভিজেছি জানো?”

নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “কেন?”

“এই মুহূর্তটার জন্যে। তুমি ব্যস্ত হয়ে আমার চুলগুলো মুছিয়ে দেবে, আর আমি সেই সুযোগে আদর কুড়াবো।”

কিছুই বলার ক্ষমতা অবশিষ্ট রইল না নাজের মাঝে। নীরবে নিভৃতে মাথা মুছিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। জীবনে যতই ঝড়-ঝাণ্ডা, বিপত্তি আসুক – গাঢ় শ্বাস নিয়ে সবকিছু সহ্য করে যেতে হয়। জীবনে চলার পথে যে যতটা যন্ত্রণা সহ্য করে সামনে এগিয়ে যায়, সে ততটাই সুখের সান্নিধ্য লাভ করেনি।

মাঝে মধ্যে ওই যন্ত্রণাময় দিনগুলোর কথা মনে করে নিজের ওপরেই গর্ব হয় নাজের। নাজ তখন ভেঙে পড়েনি, পরাজয় স্বীকার করেনি বাস্তবতার কাছে। নিজেকে শক্ত হাতে সামলেছে, এগিয়ে নিয়ে গেছে। তারই ফলস্বরূপ প্রকৃতি হয়তো তাকে উপহার দিয়েছে আজকের এই মুগ্ধতা, সুখময়তা।

যন্ত্রণার দিনগুলোতেও তাই ধৈর্য ধরে রাখতে হয়। প্রকৃতি নিঃসন্দেহে প্রতিটি মানুষের জন্যে ভালো কিছু লুকিয়ে রাখে ভবিষ্যতের আড়ালে।

বাঙালিদের মতো আবেগপ্রবণ জাতি খুব সম্ভবত এই বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। কনকনে শীতে গরম গরম পিঠা, নববর্ষে পান্তা-ইলিশ, ঈদে সেমাই – সবকিছুর সঙ্গেই এদের আবেগ জড়িত। বৃষ্টির সঙ্গে বাঙ্গালীর আবেগজড়িত খাবারটি হলো খিচুড়ি।

নাজ ব্যস্ত ভঙ্গিতে রান্নাঘরে খিচুড়ি রাঁধছে। এই জিনিস এর আগেও বেশ কয়েকবার সে রেঁধেছে। সেজন্যে আজ আর খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। হুট করে সায়েম এলো রান্নাঘরে।

পেছন থেকে নাজকে জড়িয়ে ধরে কৃত্রিম অভিমান নিয়ে বলল, “আমার বউটা এত আনরোমান্টিক কেন?”

ছেলেটার এমন আকস্মিক কান্ডে হকচকিয়ে গেলেও নাজ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “মানে?”

“মানে এই রোমান্টিক ওয়েদারে কোথায় আমার বউটা আমার সঙ্গে রোমান্স করবে। তা না করে রান্নাঘরে খুন্তি নাড়ছে। হাউ বোরিং!”

নাজ লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে বলল, “দিন দিন এত অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন আপনি!”

“এই অসভ্যতার কী করলাম? আমার বিয়ে করা বউয়ের সঙ্গে একটু রোমান্স করতে চেয়েছি। এটা কী খুব দোষের?”

“হ্যাঁ অনেক দোষের। এখন গিয়ে রেস্ট নিন, আমি রান্নাটা শেষ করি।”

“আমি হেল্প করি তোমাকে?”

“একদম না। নিজে সবকিছু চেপে রাখেন বলে ভেবেছেন আমি কিছুই বুঝি না? বৃষ্টির পানি মাথার পড়লেই তো আপনার মাথা ধরে। এখনও নিশ্চয়ই তাই হয়েছে!”

কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে রইল সায়েম। আসলেই তো, সেই তখন থেকে মাথাটা ঝিমঝিম করে। ছেলেটা চিরকালই চাপা স্বভাবের। ভেতরে ভেতরে প্রবল ঝর বয়ে গেলেও সামনে থাকা মানুষটাকে তা বুঝতে দেবে না। অথচ নাজ ঠিকই বুঝে ফেলল কী করে?

নাজ আবারও বলল, “আপনি ঘরে গিয়ে রেস্ট নিন আমি আদা চা করে আনছি।”

মানুষ ভালোবাসলে হয়তো মনের সকল অব্যক্ত কথাগুলোও বুঝে ফেলতে পারে। সেই তখন থেকেই আদা চা খেতে ইচ্ছা করছিল সায়েমের। মেয়েটা বুঝে ফেলল কী করে?

খাবার টেবিলে বসে সায়েম শান্ত গলায় বলল, “নাজ, আমাদের ফ্ল্যাট কিন্তু প্রায় রেডি। দুইমাস পরেই আমরা উঠছি।”

নাজ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “সে কী? এখনই?”

“এখনই মানে? বুকিং তো কত আগেই করে রেখেছিলাম। তোমার মনে নেই?”

“আছে। কিন্তু…”

“কিন্তু?”

নাজ ইতস্তত করে বলল, “সবে সংসারটাকে নিজের মতো করে দেখতে শুরু করলাম। আর এখনই এ বাড়িতে ছেড়ে যেতে হবে?”

সায়েম আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “সংসার তো তোমারই থাকবে নাজ। বাড়িটা শুধু পাল্টে যাবে।”

এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা শুনতেই বুকটা কেমন যেন হুহু করে উঠলো। বিয়ের পর সায়েমের সঙ্গে ঠিক এখানেই এসে উঠেছিল নাজ। তার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-যন্ত্রণা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সকল অনুভূতিগুলোর সাক্ষী হয়ে আছে এই বাড়ির দেয়ালগুলো।

নাজের শুকনো মুখটা দেখে সায়েম বলল, “তুমি ব্যাপারটা পজিটিভলি দেখ নাজ! মেয়েদের তো সারাজীবনের শখ থাকে বিয়ের পর নিজ হাতে সংসার সাজাবে। তুমি তো সে সুযোগ পাওনি। বিয়ের পরই তোমাকে নিয়ে এলাম আমার আগে থেকে সাজানো বাসাটায়। কিন্তু এবার তো সুযোগটা পাচ্ছ। নিজের মনের মতো করে ঘর সাজাবে।”

সঙ্গে সঙ্গে নাজের ঠোঁটজুড়ে প্রশস্ত এক হাসি ফুটে উঠলো। এই ছেলেটা আসলেই জাদু জানে। জাদুর মতো করে মুহূর্তেই ভালো করে তুলতে পারে নাজের মনটা।

নাজ উৎফুল্ল গলায় বলল, “তাই তো! শুনুন ওই বাসায় কিন্তু টিভি বসার ঘরে থাকবে না, বেডরুমে থাকবে। আমি টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়বো, তারপর আপনি টিভি বন্ধ করে দেবেন। আর ফ্রিজটা কিন্তু ডাইনিংয়ে থাকবে না, রান্নাঘরে থাকবে। রান্নার সময় বারবার ডাইনিংয়ে ফ্রিজের কাছে আসতে যা বিরক্ত লাগে।”

সায়েম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাজের দিকে। তার চোখদুটো চকচক করে উঠেছে। একরাশ স্বপ্ন মুহূর্তেই এসে জমেছে ওই চোখদুটোতে। নাজ যখন কোমরে ওড়না বেঁধে রান্না করে, ঘর গোছায়, সংসারের বড় কোনো সিদ্বান্ত একা হাতে নেয় তখন মনে হয় মেয়েটা যেন এক লাফে অনেক বড় হয়ে গেছে। আবার পরমুহূর্তেই তার বাচ্চামি কান্ডগুলো মনে করিয়ে দেয়, মেয়েটা কখনোই বড় হবে না!

নাজের অসংখ্য বদভ্যাসের মধ্যে একটি হলো রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া। এতে অবশ্য বেচারির কোনো দোষ নেই, ঘুম ভেঙে গেলে তারই বা কী করার থাকে। প্রায় প্রতিরাতেই ঘুম ভেঙে কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে, পরমুহূর্তেই আবার তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।

কেবলই নাজের ঘুম ভেঙেছে। ঘুমজড়ানো চোখে চারিদিকে তাকাতেই হঠাৎ খেয়াল হলো, পাশে সায়েম নেই। বিছানায় হাতড়ে আরও ভালো করে নিশ্চিত হলো নাজ। ব্যাপার কী? ছেলেটাকেও কি তার মতো ঘুম ভেঙে যাওয়া রোগে ধরলো।

নাজ সাবধানে উঠে বসলো। বসার ঘরের বাতি জ্বলছে। সেদিকেই পা বাড়ালো মেয়েটা।
বসার ঘরের মৃদু আলোয় সোফার ওপরে চোখদুটো বুজে বসে রয়েছে সায়েম। ডান হাতের দুটো কপালে চেপে ধরে রেখেছে।

নাজ আঁতকে উঠে বলল, “আপনি এখানে?”

হঠাৎ নাজের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকালো সায়েম। তার চোখদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।

তবুও নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “ঘুম আসছিল না নাজ। তুমি আবার উঠতে গেলে কেন?”

প্রশ্নটাকে রীতিমত উপেক্ষা করে নাজ বলল, “ঠিক আছেন আপনি?”

“হ্যাঁ ঠিক…”

সায়েম কথাটা শেষ করবার আগেই নাজ তার কপালে হাত ছুঁইয়ে বলল, “কী সর্বনাশ! এত জ্বর আসলো কখন?”

“কোথায়? জ্বর আসেনি তো?”

“কেন মিথ্যা বলছেন? আপনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে!”

সায়েম প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার জন্যে বলল, “তোমার হাতই ঠান্ডা নাজ। চলো শুয়ে পড়ি।”

“আবারও মিথ্যা বলেছেন? আমাকে ডেকে একবার বললে কী হতো?”

সায়েম চুপ করে রইল।

নাজ বলল, “মাথা ব্যাথা করছে আপনার?”

“কিছুটা, ঠিক হয়ে যাবে।”

“চলুন আমার সঙ্গে।”

সায়েম কথা না বাড়িয়ে বাধ্য ছেলের মতো নাজের সঙ্গে ঘরে ফিরে এলো। বিছানার পাশেই ছোট সাইড টেবিলের ড্রয়ারে সবসময় একটা ওষুধের বাক্স থাকে। নাজ সেটা বের করে প্যারাসিটামিল খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেল। সায়েম অবাক চোখে দেখছে তার কর্মকান্ড। মেয়েটার চোখে তার জন্যে দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের ছড়াছড়ি। নাজ দুইটি প্যারাসিটামিল আর পানির গ্লাস সায়েমের দিকে এগিয়ে দিল।

“নাজ, ডক্টরের ইনস্টাকশন ছাড়া নিজে থেকে এতগুলো ওষুধ খাওয়া কিন্তু ঠিক নয়।”

নাজ ভ্রু কুঁচকে ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “চুপ! একটাও কথা বলবেন না আপনি আমার সঙ্গে। কী মনে করেছেন? সবকিছু চেপে রাখবেন অথচ কেউ কিছু বুঝতে পারবে না? এমন কেন আপনি?”

সায়েম কিছুই বলল না। মনে মনে বউয়ের শাসন উপভোগ করে আবারও বাধ্য ছেলের মতো ওষুধ দুটো গিলে ফেলল।

নাজ ধমকের সুরে বলল, “কে বলেছিল ওভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে? উফ আপনাকে নিয়ে আর পারি না।”

সায়েম শান্ত ভঙ্গিতে নাজের কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলল, “কাম ডাউন নাজ। কোথায় আমার টেক কেয়ার করবে, উল্টো আমকেই বকছো!”

নাজ কী বলবে বুঝতে পারলো না। নিঃশব্দে মনের অজান্তেই তার হাতটা চলে গেল সায়েমের কপালে। অতি যত্নে প্রিয় মানুষটার মাথায় ম্যাসাজ করে দিচ্ছে নাজ। তার এতটুকু স্পর্শেই যেন সকল যন্ত্রণা দূর হয়ে প্রশান্তির হওয়া বয়ে গেল শরীর জুড়ে। সায়েম চোখদুটো বুজে সেই প্রশান্তিকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল।

প্রায় অনেকটা সময় সায়েম টের পেল মেয়েটা টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে। চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেল নাজের চোখভর্তি জল।

সায়েম ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে বসে বলল, “এই নাজ? কাঁদছো কেন?”

নাজ চুপ করে রইল। যদিও চোখের জল আড়াল করার কোনো প্রচেষ্টা তার মধ্যে দেখা গেল না।

সায়েম তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে কোমল স্বরে বলল, “এতটুকু জ্বর তো মানুষের প্রায়ই হয়। তাই বলে এভাবে কাঁদতে হয় না-কি?”

নাজ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “আপনি অনেক খারাপ! সব সময় নিজেকে আড়াল করে রাখতে হবে কেন?”

“কোথায় আড়াল করে রাখলাম?”

“নয়তো কী? নিজের সমস্যার কথাগুলো মুখ ফুটে কাউকে বলবেন না! কাউকে আপন মনে করবেন না! কেন? আমাকে ডেকে একবার বললে কী হতো? আমাকে আজও আপন ভাবতে পারলেন না আপনি।”

“তোমার তাই মনে হয়?”

“অবশ্যই। আপন মনে করলে একটাবার আমাকে ডেকে তুলতে বলতেন আমার মাথা ব্যাথা করছে, মাথা টিপে দাও। তা বলবেন কেন? সবকিছুতেই আপনার ফর্মালিটি!”

“তুমি ভুল বুঝছো নাজ। আমি তো একটুপরে নিজেই ওষুধ খেয়ে নিতাম। শুধু শুধু তোমার কষ্ট হতো তাই ডাকিনি। ”

“কষ্ট হতো মানে? আমার যদি মাঝরাতে এভাবে জ্বর আসতো আমি তো আপনাকে টেনে তুলতাম। আসল কথা হলো আপনি আমাকে বাইরের কেউ মনে করেন।”

“অন্তরের অন্তঃস্থলে যার বসবাস, তাকে বাইরের কেউ মনে করবো কী করে?”

নাজ চুপ করে রইল। ইচ্ছা করছে সায়েমের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতে, তর্ক করে তাকে হারিয়ে দিতে। তবে তার এই কথাটার পর তর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যুক্তি খুঁজে পেল না নাজ। চুপচাপ গুটিশুটি মেরে পড়ে রইল তার বুকে।

সায়েম বলল, “আচ্ছা, এখন থেকে আর কোনো ফর্মালিটি করবো না। মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলবো মাথা টিপে দিতে, কয়েকদিন পর যখন তোমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে তখন ক্লাসের মাঝখানে ফোন করে বলবো অফিসে গিয়ে কফি বানিয়ে দিতে। এবার তো একটু হাসো!”

চোখভর্তি চোখ নিয়েই ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটিয়ে তুললো নাজ। ভাগ্যিস এই মানুষটা এসেছিল তার জীবনে। নাহলে জীবনের সেরা এই অনুভূতিগুলোর স্বাদ কোনো কালেই পাওয়া হতো না।

প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে আল্যার্মের কর্কশ শব্দেই ঘুম ভাঙ্গে। আল্যার্মের শব্দ কানে আসতেই আর দেরি করে না সায়েম, এক লাফেই উঠে বসে। তবে আজ ঘটলো ব্যতিক্রম ঘটনা। মহা বিরক্তিকর সেই শব্দ ছাড়াই জেগে উঠলো সায়েম। আজ ঘুমটা বেশ ভালো হয়েছে, শরীরটা কেমন ফুরফুরে লাগছে। মাথার ব্যাথাটা এখনো না থাকলেও জ্বর আছে সামান্য। এমন সামান্য জ্বরকে চিরকালই উপেক্ষা করে এসেছে সায়েম।

চোখ মেলে তাকাতেই আবছা দৃষ্টিতে সায়েম দেখতে পেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত নাজ। তার পরনে সায়েমেরই একটা সবুজ রঙের টিশার্ট। দৃশ্যটার এক ঝলক দেখতেই ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস ফুটে উঠলো।

প্রিয় মানুষটার চোখদুটো তার দিকে আটকে আছে বুঝতে পেরে নাজ মিষ্টি গলায় বলল, “গুড মর্নিং।”

সায়েম ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল, “গুড মর্নিং নাজ। তোমাকে আজ এর সুন্দর লাগছে কেন?”

খানিকটা লজ্জা পেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে নাজ দুষ্টুমিমাখা কণ্ঠে বলল, “আমাকে সবসময়ই সুন্দর লাগে। আপনি আজ প্রথম খেয়াল করলেন।”

হঠাৎই সায়েমের চোখ গিয়ে পড়লো দেয়াল ঘড়িটায়। সঙ্গে সঙ্গে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো।

“ওহ মাই গড! দশটা বেজে গেছে?”

নাজ যথেষ্ট স্বাভাবিক গলায় বলল, “না, দশটা ছয় বাজছে।”

“কী সাংঘাতিক! আমার অ্যালার্ম বাজলো না কেন?”

“ওহ! ওটা আমিই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অ্যালার্ম বাজলে আপনার ঘুমটাই ভেঙে যেত।”

“বন্ধ করে রেখেছিলে কেন? কতোটা লেট হয়ে গেল আমার! যেখানে কোনো এমপ্লয়ি লেট করে আসলে আমি ধমক দিই, সেখানেই নিজেরই এতটা লেট হয়ে গেল।”

নাজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আজ আপনাকে অফিসে যেতে হবে না। আপনার ম্যানেজার আজকের দিনটা সামলে নেবেন।”

“মনে?”

“আমি আজ সকাল সকাল আপনার ফোন থেকে ম্যানেজারকে মেইল করে জানিয়ে দিয়েছি যে আপনার বউয়ের হাত ভেঙ্গে গেছে। তাই আজ আপনি অফিসে যেতে পারবেন না।”

সায়েম বিছানায় হাতড়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো মেয়েটা সত্যি সত্যিই ম্যানেজারকে মেইল করেছে। ম্যানেজার মেইলে রিপ্লাই করে বলে দিয়েছে, সায়েমকে কোনো চিন্তা না করতে। আজকের দিনটা সে সামলে নিতে পারবে। সায়েম হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নাজের দিকে। মেয়েটা তো সাংঘাতিক!

নাজ সায়মের কাছে এসে তার হাত থেকে ফন্ট কেড়ে নিয়ে বলল, “আজ সারাদিন রেস্ট করবেন। এত কাজ করে কী হবে?”

সায়েম কিছু বলল না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নাজের দিকে।

“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

“ভাবছি, সত্যি সত্যিই তোমার হাতটা ভেঙে দিই।”

নাজ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। এই মানুষকে বিশ্বাস নেই। সত্যি সত্যি তার হাতটা ভেঙে ফেলতে পারে।
সায়েম বিছানা থেকে উঠে এক পা দু পা করে এগিয়ে আসছে নাজের দিকে। নাজও প্রায় একই ভঙ্গিতে পিছিয়ে যাচ্ছে। সায়েমের চোখেমুখে দুষ্টুমির ছড়াছড়ি। নাজ বুঝতে পারছে তার সঙ্গে অনর্থ কিছু ঘটতে চলছে। অবস্থা বেশ সুবিধার না দেখে নাজ ছুটে পালালো।

ছুটতে ছুটতেই উঁচু গলায় বলল, “সরি সরি! আর এমন হবে না!”

সায়েমও তার পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে বলল, “এবার আর আপনার সরিতে কোনো কাজ হচ্ছে না ম্যাডাম।”

আর কতই বা ছোটা যায়? একটা সময় নাজ আটকা পড়ে গেল প্রিয় মানুষটার আড়ষ্ট হাতের বাঁধনে। সায়েম শক্ত করে নাজের কোমর জড়িয়ে রেখে নিজের খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছে তাকে। যেন এতটুকুও ছেড়ে দিলে মেয়েটা তলিয়ে যাবে। সায়েম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাজের দিকে। তার অস্বাভাবিক নিঃশ্বাসগুলো একেক করে আছড়ে পড়ছে নাজের চোখেমুখে।

নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “ছাড়ুন।”

“উহুঁ!”

নাজ মিনতির স্বরে বলল, “প্লিজ! আর কখনো এমন করবো না। এবারের মতো ছেড়ে দিন প্লিজ।”

“তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার লাভ কী?”

“ধরে রেখেই বা লাভ কী হচ্ছে?”

“সেটা তুমি বুঝতে পারলে তো হয়েই যেত।”

নাজ লজ্জায় লাল হয়ে বলল, “আপনি ছাড়ুন তো আমাকে।”

সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “আগে তুমি ডাকো, তারপর ছাড়বো।”

নাজ আঁতকে উঠে বলল, “আমি পারবো না।”

“তাহলে আমি ছাড়বোও না।”

নাজ টের পেল মানুষটা একটু একটু করে অগ্রসর হচ্ছে তার দিকে। এই মুহূর্তে তুমি না ডাকলে সর্বনাশের আর বাকি থাকবে না।

নাজ উপায়ন্তর না পেয়ে বলল, “আচ্ছা তুমি! আমি কিন্তু ডেকেছি, এবার আপনি ছাড়ুন।”

সায়েম নাজকে আরও একটু শক্ত করে জড়িয়ে বলল, “এটা তুমি ডাকা হলো? ঠিক করে ডাকো না হলে আজ তোমার খবর আছে।”

নাজ চোখমুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে রইল। তার হাত-পা ক্রমেই অবশ হয়ে আসছে। মানুষটা মাঝে মাঝে এমন কান্ড করে, ইচ্ছা হয় মাটির তিন ফুট গভীরে ঢুকে পড়তে।

অবশেষে উপায়ন্তর না পেয়ে নাজ অস্ফুটস্বরে বলল, “ছাড়ো।”

(চলবে)

[প্রিয় পাঠকমহল, আপনারা হয়তো আমার ওপর অনেক রেগে আছেন। রেগে থাকতেই স্বাভাবিক, আপনাদের প্রিয় নাজ আর সায়েমকে টানা কয়েকদিন নিজের কাছেই বন্দী করে রেখেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার সত্যিই কিছু করার ছিল না। গত রবিবার এবং সোমবার ছিল টানা পরীক্ষা। মঙ্গলবার আমাদের স্কুল থেকে শিক্ষাসফরে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই দিন বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। এতই টায়ার্ড ছিলাম যে বাসায় ফিরেই ঘুমিয়ে পড়ি। বুধবার কোনো কাজ ছিলাম না, কিন্তু জার্নির কারণে টায়ার্ডনেস তার ওপরে আবার বৃহস্পতিবারের পরীক্ষার প্রিপারেশন। সবকিছু মিলিয়ে এই সপ্তাহটা ছিল বিভীষিকার মতো। আজকে মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই এই পর্বটা লিখে শেষ করি। আমি জানি এতদিন পর পর্ব দিলে পড়ার আগ্রহটাই হারিয়ে যায়, লিখতে গিয়ে আমারও কেমন জানি লাগছিলো। তাও এই গল্পটা আমার মনের অনেক কাছের। সেই অক্টোবর থেকে লেখা শুরু করছি, এখনো লিখে যাচ্ছি। আগামী দিনে আরও ব্যস্ত হয়ে পড়বো, যেহেতু সামনেই এসএসসি। তাই যত তাড়াতাড়ি পারি গল্পটা শেষ করবো ইনশাল্লাহ। তবে চিন্তা করবেন না, গল্পে এতটুকুও তাড়াহুড়া থাকবে না। সকলের জন্য অবিরাম ভালোবাসা রইল ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here