#গল্পঃঅপেক্ষার_শেষ_প্রহর
#পর্বঃ২
#লেখনিতেঃহৃদিতা_ইসলাম_কথা
গোধুলির আলো আধারের খেলা করা দেখছি।গোধূলি এমন একটা সময় যখন আলো আর আধার এক সাথে আসে।আলো আধারের মিলনেই গোধূলির উৎপত্তি। এই সময়টা আমার কাছে বেশ লাগে।প্রতিদিন এই সময়টা উপভোগ করা আমার ডেইলি রুটিনের মধ্যেই পড়ে। তবে আজ কেনো জানি না উপভোগ করতে পারছি না।মনের মধ্যে অজানা কষ্টেরা বাধা বাধছে। কফিতে চুমুক দিচ্ছি আর ভেবে চলেছি আজকের সকালের কথা।
————————————————————
ক্যাফেতে যাওয়ার পর আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলাম মাথা নিচু করে। আমার পাশেই বাচ্চাটা আর সামনে সেই প্রিয় মুখটি। আমাদের দুজনের জন্য কফি আর ফারানের জন্য পেস্ট্রি অর্ডার করলেন।উনি অবশ্য অন্য কিছুর জন্য জোর করেছিলেন কিন্তু আমি দেই নি।আসলে পালিয়ে আসতে চেয়ে ছিলাম কিন্ত পারিনি।এভাবে চলে আসলে কি ভাবতেন উনি।অনেক কিছু জানার ও ছিল।তাই এক বুক সাহস সন্ঞ্চার করে বসে ছিলাম।উনার সামনে থাকাটা আমার জন্য কতটা কষ্টকর তা শুধু আমিই জানি।কাউকে বোঝানো যাবে না।হঠাৎ উনার কথায় ধ্যান ভাঙলো আমার।
—“এতদিন পর এইভাবে এখানে আপনার সাথে দেখা হবে ভাবতে পারিনি।তা এতদিন কোথায় ছিলেন?হঠাৎ করেই নড়াইল থেকে চলে এলেন। কেউ কিছু জানে না আপনি কোথায় গেছেন? আপনার তো আরো কিছুদিন থাকার কথা ছিল তাই না?”
উনার কথায় বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হলো।সেই পুরনো স্মৃতি। যা থেকে পালিয়ে বাঁচতে আমার এই খানে আসা।সবার থেকে দুরে শুধুমাত্র প্রকৃতির কাছে নিজের কষ্টগুলোকে উজার করে দিতেই এখানে আসা।কি বলবো উনাকে? কেনো এসেছি এখানে? যে কারন সে নিজেই কারন জিজ্ঞেস করছে।কি অদ্ভুত তাই না।উনার সামনে কিছু বলতেও গলা কাপছে। মিথ্যে বলার অভ্যাসটা আমার নেই।যেই মেয়ে কিনা দিন হাজারটা বাদরামি করে একশ একটা মিথ্যে বলতো তার আজ বুক কাপছে। আসলে জীবনটাই পালটে গেছে আর তার সাথে পালটে গেছি আমি।আগের সেই চাঞ্চল্যকর কথা যে আর আমি নেই।তাই আমতা
আমতা করে বললাম,
—“আ..আসলে হুট করে তো আসিনি।দ.. দরকার ছিল তাই এসেছি।”
—“ওহ আই সি।কিন্তু বাড়ি ফিরে আর কারো সাথে যোগাযোগ করেন নি কেন? আই মিন টু সে আপনার আর কেয়ার তো একসাথে ঢাকায় এডমিশন নেওয়ার কথা ছিল।তো আপনি ঢাকা ছেড়ে এখানে কিভাবে?এই পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার জানা মতে আপনাদের কোন পরিচিত বা আত্নীয় নেই তাই না।”
—“জীবনে চলার পথে মোড় কখন ঘুড়ে যায় কেউ বলতে পারে না।আমারও তাই হয়েছে। জীবনের মোড় ঘুড়ে গেছে আর তা এই পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে ঠেকেছে।আর আমি তো বরাবরই প্রকৃতি প্রেমি তাই প্রকৃতির সন্নিকটে চলে আসি।যার থেকে দুরে থাকতে প্রকৃতির কাছে আজ সেই অজানা অচেনা মরিচাধরা অতীত আমার সামনে চলে এসেছে।যা থেকে পালিয়ে বাঁচতে এত দুর আসা আজ সে নিজে আমায় খুজে নিয়েছে।”
—“বিয়ে করেন নি?না মানে আসলে তখন বললেন মিসেস না মিস ই ঠিকাছে তাই আরকি।”
থমকে গেলাম আমি। উনার এই একটা প্রশ্নই যথেষ্ট ছিলো আমাকে থমকে দেয়ার জন্য। আমার ভিতরটাকে এলোমেলো করার জন্য। মনে হচ্ছিল বুকের ভেতরে জলোচ্ছ্বাস চলছে।যা সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।আমার আকড়ে ধরার মত কিছু অবশিষ্ট নেই। কিন্তু এ জলোচ্ছ্বাস শুধু আমায় দুঃখের জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।মনে মনে বললাম,যাকে ভলোবাসলাম সে তো অন্য কাউকে নিয়ে সুখের ঘর বেধেছে। আমি তো পারলাম না অন্য কাউকে এই মনে জায়গা দিতে।কি করে দিব?যে মনে ঘরে সবটা জায়গা জুড়ে রয়েছে আমার প্রিয়র অস্তিত্ব সেখানে তো অন্য কারো বসবাস সম্ভব না।যার মন প্রান আত্মা জুড়ে শুধু একজনের রাজত্ব সেখানে অন্য কাউকে ঠাই কিভাবে দিবে।কাউকে মিথ্যে ভালোবাসার মায়াজালে বাধতে চাই নি তাই চেষ্টাও করিনি।বাবা মা ভাইয়া অবশ্য খুব করে চেয়েছিলেন কিন্তু আমার জেদের কাছে হার মানেন তারা।কি আর করবে তারা জানেন তো তাদের মেয়ে কতটা জেদি।একমাত্র আদরের মেয়ে কিনা তাই শত কষ্ট পরেও মেয়ের মুখ পানে চেয়ে আর কিছুই করতে পারেন নি।আমার জেদ হার মেনে যায়। আমাকে বেশ অনেকক্ষণ চুপ থাকতে দেখে উনি গলা খাকারি দিলেন
—“না বিয়ে করিনি। “কাঠ কাঠ গলায় স্পষ্ট জবাবে তিনি খানিকটা বিচলিত হলেন। পাল্টা প্রশ্ন করলেন,
—“কেনো বিয়ে করেন নি?কাউকে ভালোবাসেন তার অপেক্ষা করছেন?”
তাচ্ছিল্যে হাসলাম আমি আর ভাবছি ভালোবাসা হ্যাঁ ভালোবেসেছিলাম প্রেমেও পড়েছিলাম।কিন্তু মানুষটি যে আমার ছিল না। সে তো অন্য কারো ছিল।অন্য কারো অধিকার ছিল তারউপর।আমি বা আমার অনুভূতি তার কাছে কোন মুল্যই ছিল না।সে তো অন্য কারো মোহে অন্য কারো প্রেমে মাতোয়ারা ছিল।তাই তো এত নিখুঁতভাবে ভালোবাসার পরও আজ আমি একা।একাকিত্ব আজ আমার একমাত্র সঙ্গী।
—“প্রয়োজন পড়েনি তাই। যারা প্রকৃতির প্রেমে পড়ে তাদের জীবনে আর অন্য কারো প্রয়োজন পড়ে না।তাই আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়।”
—“হুম আপনিই ভালো করেছেন বুদ্ধিমানের কাজ করছেন।প্রেম ভালোবাসা এসবের মুল্য নেই আজ পৃথিবীতে। সব নিছকই খেলা।নিছকই অভিনয়। যারা অভিনয় করতে পারে তারা ভালোই থাকে।”
উনার কথাগুলো কেমন জড়তা ছিল।আটকে আটকে আসছিলো।মুখটা মলিন হয়ে উঠেছিল।উনার এমন চাহনি দেখে বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হলো।বেশ কষ্ট হচ্ছে মায়া হচ্ছে। যে মানুষটাকে এত ভালোবাসি তার কষ্টে কতটা কষ্ট আর যন্ত্রণা অনুভব হয় শুদুমাত্র সেই জানে যে ভালোবেসেছে। মনে হচ্ছিল কথাগুলো বেশ কষ্ট থেকেই বললেন।কিন্তু উনার আবার কিসের কষ্ট?স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখের সংসার করছে। আমি এবার প্রশ্ন করলাম,
—“তা আপনি এখানো কিভাবে? নড়াইল থেকে এখানে আসার কারন কোন কাজ ছিল?”
—“হ্যাঁ, কাজই বটে। কাজের জন্যই এখানে আসা।আমার ব্যাংক থেকে এখানে ট্রান্সফার করা হয়েছে। তাই এখানে আসা।আপনার মত এই প্রকৃতি ও এখন আমার নিবাস।এখানে সব ব্রাঞ্চের দায়িত্ব আমার উপর।কালই এসেছি এখানে। তাই আজ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতেই আসা।ভাবতে পারিনি এখানে এসে আপনাকে পাবো।অনেকটা বদলে গেছেন আপনি।আগের মত সেই বাচ্চা বাচ্চা চাঞ্চল্যকর স্বভাব নেই।অনেক ম্যাচিওর হয়ে গেছেন।কত বদলে গেছেন। ”
—“বদলাতে তো হবেই কারন সবকিছুই পরিবর্তনশীল।তাই সময়ের সাথে সাথে মানুষকেও পরিবর্তন হতে হয়।”
—“তা বললেন না তো এখানে কিভাবে? আর আপনি কি এখন এখানেই থাকেন?”
—“ওই যে বললাম,প্রকৃতির প্রেম এখানে এনেছে।ঢাকা এডমিশন নেওয়ার ই কথা ছিল।ঢাকার মত কোলাহল পূর্ণ স্থানের এখানকার পরিবেশ মন কেড়ে নেয়।তাই হুট করেই ডিসিশন চেঞ্চ করে ফেলি।তারপর এখানেই এডমিশন নিয়ে নেই।এখন এখানেই থাকি ফিরে যেতে ইচ্ছে করেনি।তাই এখানেই একটা স্কুলে জব করি।”
—“ওহ।তা এতদিন কারো সাথে যোগাযোগ রাখেননি কেনো?”
যোগাযোগ না রাখার যে কারন সেই যোগাযোগ না করার কারন জানতে চাইছে।নিজেকে ধাতস্থ করে বললাম,
—“এমনি।লেখাপড়ার চাপ থাকায় হয়ে উঠেনি। বাই দা বাবুর আম্মু কোথায়? মানে আপনার স্ত্রী উনাকে তো দেখছি না।”
আমার এহেন প্রশ্নে উনার মুখ আষাঢ়ের কালো মেঘে ঢেকে গেল।তাতে আমি খানিকটা অবাকই হই।কেননা এর আগে সে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়েছিল।এবার ফারানকে জিজ্ঞেস করি,
—“তোমার নাম কি বাবা?তোমার আম্মু কই?একা একা কি করছিলে তখন আর কিভাবে হারিয়ে গেলে?”
আমার প্রশ্ন শুনে ফয়সাল কিছু বলবে তার আগেই ফারান একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলা শুরু করলো।
—“আমার নাম ফারান আহমেদ শুভ।আম্মু তো নাই মামুনি।”
ওর কথায় আমি বেশ চমকে যাই।আম্মু নাই মানে কি?কি হইছে ওর আম্মুর।উনার কি কিছু হয়েছে নাকি।হয়তে, তাই স্রোত বারবার আমাকে এই বিষয়টা নিয়ে ইগনোর করছিলেন। ইশশ কতটা কষ্ট পেলেন উনি কতটা আঘাত পেয়েছেন।আমার জন্য সবটা আমার জন্য। কি দরকার ছিল উনাকে একথা জিজ্ঞেস করার।নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। লজ্জিত লাগছিল কেন উনাকে এই প্রশ্ন করলাম।কষ্টগুলো ঝড়ে পড়তে চাইছে। নিজের প্রিয়। মানুষটি যখন নিজেরই ভুলে কষ্ট পায়।তখন বুক ফেটে কান্না আসে।আমারও তাই হচ্ছে। এখন এখান থেকে আমি পালাতেই হবে।নাহলে পারবো না আর নিজেকে ধরে রাখতে।আমাকে বেশ চিন্তিত দেখে উনি বললেন,
—“আসলে……
উনাকে বলতে না দিয়ে আমি ঝট করে উঠে দাড়ালাম আর বললাম,
—“আমার একটা জরুরি কাজ আছে।আমি আজ আসি।”
বলেই ফারানকে চুমু দিলাম।তারপর গাল ছুয়ে আদর করে বললাম,
—” তুমি খুব মিষ্টি একটা ছেলে।একা একা কোথায় যাবা না বাবাকে ছেড়ে নাহলে হারিয়ে যাবা।বাবার সব কথা শুনবে আর ভালো ছেলে হয়ে থাকবে কেমন”
আমার কথা শুনে ও আমাকে বললো,
—“তুমি চিন্তা করো না মামুনি। আমি বাবাইয়ের সব কথা শুনবো।তুমি রাগ করেছো তোমায় মামনি বলেছি বলে।”আমি মিষ্টি হাসি দিয়ে বললাম,
—“না বাবা একদমই রাগ করিনি।আজ আসি ভালো থেকো।ভালো থাকবেন।”
বলেই ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলাম।আড়ালে চশমার নিচে চোখের জলটুকু মুছে নিলাম।অবাধ্য অশ্রুকনাগুলো যেনো বাধা মানছিলনা। অনেক কষ্ট হয়েছে তাদের বাধ্য করতে।এতদিন এই অবাধ্য অশ্রু অবাধ্য অনুভুতিগুলোকে বাধ্য করে নিজের অধীনে রাখতে পারলেও আজ আর সম্ভব হলো না।আবার পালিয়ে যেতে হবে বহুদুরে।বাঁচতে হলে আমাকে পালাতেই হবে।আজ এই শহরে তার আগমন ঘটেছে। এই শহরে আমার প্রযোজনীয়তা ও ফুরিয়েছে।
______________________________
কাঁদতে কাঁদতে বাসায় চলে এলাম।দুঘন্টা শাওয়ারের নিচে বসে অশ্রু বিসর্জন করলাম।আর বারবার প্রশ্ন করলাম আমার জীবনটা এমন কেনো হলো? এতো এলোমেলো কেনো? এত জটিলতা কেনো??
#চলবে….
🌼