অপেক্ষার শেষ প্রহর পর্ব -০৩

#অপেক্ষার_শেষ_প্রহর
#পর্বঃ৩
#লেখনীতেঃহৃদিতা_ইসলাম_কথা

দুই ক্লাস শেষে অফিস রুমে নিজের ডেস্কে বসে আছি।একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে চাকরি করি আমি। প্রথম টা পঞ্চম শ্রেনির আর দ্বিতীয় টা চতুর্থ শ্রেনীর ক্লাস করে বেরিয়ে আসছি।হটাৎ করেই অতীতের সোনালী দিনগুলো মনে পড়ে গেল।অতীতের স্মৃতিচারন করছি।কত অমায়িক ছিলো সেই দিনগুলো।কতটা হাসি খুশিতে পরিপূর্ন আর আজ সব এলোমেলো।

সেদিন ছিল আমার এইচএসসি এক্সামের পরেরদিন।গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আমি,বাইরের আম্মুর চেচামেচি শোনা গেলেও চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না।তাই আরেক কানে বালিশ চাপা দিয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে আছি।উঠবো না মনে উঠবোই না।এতদিন এই এক্সাম নামক পেরায় লাইফটা আমার বাঁশপাতা করে ছাড়ছে এখন কি একটু শান্তির ঘুমও ঘুমাতে পারবো না।এমনিতেও আমি আব্বু ছাড়া আর কারো কথা শুনি না। কারন আব্বুকে আমি খুব ভালোবাসি।আমার আব্বু কায়সার তালুকদার।তিনি একজন ব্যবসায়ী। আমার আম্মু শারমিন বেগম। তিনি একজন গৃহিণী। আমার ভাই শাহাদ তালুকদার।আর আমি আমার আব্বুর একমাত্র আদরের প্রিন্সেস হৃদিতা ইসলাম কথা। আব্বু আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে ভাইয়ার থেকে। হয়তো তাই তার নামের সাথে সাদৃশ্য রেখেই আমার নাম রাখা।যাই হোক আমার দাদা কবির তালুকদার। তিনি আমাদের এলাকার একজন নামি দামি ব্যক্তি ছিলেন।এলাকার চেয়ারম্যান হওয়ার দারুন তার এলাকায় বেশ দাপট ছিল।সেই সুবাদে বাবারও আছে। আমি আমার দাদুকে ছাড়া আর কাউকে তেমন ভয় পেতাম না।আমার মায়ের ভাষ্যমতে,এর কারন হলো সবাই আমাকে আদরে আদরে বাদর করে ফেলেছে।ছোট চাচ্চু কিরন তালুকদার। আর কাকিমা আসমা তালুকদার।আর তাদের ছেলে আরিফ আর মেয়ে কেয়া।কেয়া আমার কাজিন + কলিজার ফ্রেন্ড। চাচ্চুকে চাকরির দরুন নড়াইলে ট্রান্সফার হতে হয়। বিধায় তার সাথে কেয়াও চলে আসে। উচ্চ মাধ্যমিক আর দুজনের এক সাথে শেষ করা হয় না।কাজেই দুজন দুদিকে ছিটকে যাই।কিন্তু তবও আমাদের যোগাযোগ হতো রোজ কথা বলতাম। এত দুরে থেকেও এতটুকু দুরত্ব আসেনি আমাদের মাঝে। এবার এক্সাম শেষে নড়াইল বেড়াতে যাবো সেজন্য আজ শপিং এ যাবো কেনাকাটা করতে। তাই মা ওমন করে চেচাচ্ছে।কিন্তু আমি তো আমি আমার সাধের গুম নষ্ট করবো না মানে করবো না।কিছুক্ষন পর চেচামেচি বন্ধ হয়ে গেল। আহা!এবার একটু শান্তিতে নিদ্রা যাপন করতে পারবো।আচমকাই মুখে ঠান্ডা পানির সংস্পর্শ পেতেই ধরফরিয়ে উঠে যাই আমি।তাকিয়ে দেখি ভাইয়া তার ৩২ কপাটি দাঁত বের করে হাসছে।শরীরে কাপনি দিয়ে রাগ বেড়ে চলেছে আমার।হারামিটা আমার সাধের ঘুমটা মাটি করে দিল।

–হুলো বেড়াল আমি কি করেছি যে তুই আমার সাধের ঘুমের বারোটা বাজালি?আজ তোর একদিন কি আমার যতদিন লাগে বলেই দৌড়ে যাচ্ছি ওর পিছন পিছন।নাগাল না পা দিয়ে লেঙ মেরে ফেলে দিলাম।ও ধপাস করে পড়লো,মনে মনে বলছি বেশ হয়েছে আরো দে আমার মুখে পানি।হুহ।বলেই একটা ডেম কেয়ার ভাব নিয়ে সোফায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম।এবার আম্মু কিচেন রুম থেকে তেড়ে এলো।

–কি হলো শাহাদ তুই পড়ে গেলি কিভাবে?

–আম্মু তোমার এই পাজি মেয়ে আমাকে ফেলে দিছে।

কথাটা বলতেই আম্মু আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি তাক করলো। আমার ভাবান্তর নেই।আমি উল্টো ভাইয়াকে মুখ ভেংচি কেটে বসে রইলাম।এবার আম্মু তেজি গলায় বললেন,

–তুই দিনদিন এতো বেয়াদব হচ্ছিস কেনো বলতে পারবি আমায়?আর ও তোর কত বড়, তোর বড় ভাই তাকে তুই এভাবে ফেলি দিলি।এতো অসভ্য কেনো তুই কথা? আমাদের মা ছেলের হাড় মাংস না জ্বালিয়ে খেলে তোর আর তোর বাবার শান্তি নেই বুঝি তাই না।কোনো ফেললি আমার ছেলেটাকে ওমন করে কতটা লেগেছে ওর দেখেছিস?

–তোমার আদরের ছেলের গুনগান করা বন্ধ করো। কত বড় আমার থেকে মাত্র চার বছরের হুহ।আর তোমার ছেলে কি করেছে জানো। আমার সাধের গুমে পানি ঢেলে দিয়েছে। হুহ।বলেই মুখ ভেংচি কেটে আগের ন্যায় পা তুলে বাবু হয়ে বসে রইলাম।

–তো কি করবো?তোর পুজো করবো। আম্মু যে সেই কখন থেকে তোকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকছে তা কি তোর কানে যায়না।আবার বালিশ চাপা দিয়ে ঘাপটি মেরে শুয়ে ছিলি।

–তো আমি বলেছি আম্মুকে গলা ফাটিয়ে ডাকতে,সবে কাল এক্সাম শেষ হলো এখন একটু ঘুমোবো না আমি।তাতেই তোর সইছে না ভাইয়া।আমার জাত শত্রু তুই ভাইয়া। কোথায় বড় ভাই হয়ে বোনকে আগলে রাখবি তা না আমার হাড় গোড় জ্বালিয়ে খাস তুই হুলো বিড়াল একটা।

মা আমাদের ঝগড়া দেখে কিছু না বলেই কিচেনে চলে গেল।জানে এ নতুন কিছু না। আমাদের দুই ভাই বোনের টম এন্ড জেরি সারাদিন চলতেই থাকে।পিঠাপিঠি ভাই বোন হলে যা হয় আরকি।কিন্তু দিনশেষে সেই আমার কিছু হলে বাবার মত ভাইয়া ও অস্থির হয়ে পড়ে। আসলে আমাদের দুভাইবোনের ঝগড়াই আমাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ভাইয়া কখনো ঝগড়ায় আমার সাথে পেরে ওঠে না।এবার ভাইয়া সোফায় বসে বলে উঠলো,

–ওই জেরি যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে শপিং এ যেতে হবে তো।কাল তো আবার নড়াইল নিয়ে যাবো তোকে,তোর নাকি কিসের শপিং করতে হবে।

আমার মনে পড়ে গেল, যে আজ শপিং এ যাওয়ার কথা যা একেবারে ভুলেই গেছিলাম আমি।তাই ভাইয়া আমায় ওভাবে তুলেছে।আড়চোখে দেখেও নিলাম ভাইয়ার হাত সামান্য ছড়ে গেছে কনুইয়ের দিকে।ইশশ তখন ওভাবে লেঙ না মারলেও পারতাম।তবে আমার জন্য ভাইয়া কখনো ব্যাথা পেলে তা প্রকাশ করে না।আমি চুপচাপ আমার রুমে গিয়ে রেডি হয়ে হাতে একটা ক্রিম নিয়ে ফিরে এলাম তারপর ভাইয়ার হাতে লাগিয়ে দিলাম। আঘাত যেভাবেই পাক ভাইয়া সবসময় ঔষধ আমিই লাগিয়ে দেই।ভাইয়ার হাতে ঔষধ লাগানো হলে ও এবার আমার চুল ধরে টেনে ধরলো,

–আহহ ভাইয়া লাগছে ছাড়।আমি কিন্তু আব্বুকে বলে দিব তুই আমাকে মেরেছিস।

ভাইয়ের মুখ তৎক্ষনাৎ হা হয়ে গেল।আমার চুল ছেড়ে অবাক হয়ে রইলো।আমি চুল ঠিক করে একটা ভেংচি কাটলাম।এটা আমার জন্মগত স্বভাব কথায় কথায় ভেংচি কাটা।এবার ভাইয়া আমাকে বলল,

–আমি তোকে কখন মারলাম? তুই না আমাকে ফেলে দিলি।আমি একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বললাম,

আমি যা বলবো আব্বু তো তাই বিশ্বাস করবে।বলেই একটা ইনোসেন্ট হাসি দিলাম।ভাইয়া রাগী চোখে তাকালো। তারপর বললো,

–চল আগে শপিংটা করে আসি।

তারপর দুজনে বেরিয়ে পরলাম শপিং করতে।খুব শপিং করলাম।ভাইয়ের জন্য ও অনেক কিছু নিয়েছি,অবশ্য ভাইয়া মানা করেছিল কিন্তু আমি শুনিনি।কারন ভাইয়ের জন্য কিছু পছন্দ হলে সেটা আমি না নিয়ে ছাড়ি না।দু’ভাইবোন শপিং করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলাম তারপর ফ্রেস হয়ে দুপুরের লান্চ করলাম।বাবাও আমাদের সাথে ছিল।বেশি প্রয়োজন না হলে বাবা বাড়ির বাইরে খাবার খায় না।ডাইনিং এ অনেক কথাবার্তা আর হৈ হুল্লোড় করেই খাবার শেষ করলাম।নড়াইল যাওয়া নিয়ে ও অনেক কথা হলো।আব্বু বলে দিয়েছে ওখানে গিয়ে একা কোথাও না যেতে গেলে আরিফ ভাইকে সাথে করে নিতে।আর আম্মু বলছে কাকিমাকে যেনো বেশি বিরক্ত না করি।কারন তারা আমাকে কেয়ার থেকে বেশি ভালোবাসে যেমনটা মা আমার থেকে কেয়াকে বেশি ভালোবাসে তেমনই।

যাইহোক হাসি খুশি পরিবার আমাদের।কখনো দুঃখের রেশটুকু ও ছিলো না আমাদের।আর আমার তো আরো আগেই না জন্মের পর শুধু দাদার মৃত্যুতে কেঁদেছিলাম।তাছাড়া আর একদিনও কেউ আমার চোখের জল ঝড়তে দেয় নি।সেই আমি আজ সাত বছর ধরে প্রতিনিয়ত চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছি সবার অগোচরে।তাদের কাছে থাকলে না কাঁদতে পারতাম আর না নিজেকে সামলে নিতে পারতাম।তারা আমার এমন কষ্ট দেখলে আমার থেকেও হাজর গুন বেশি কষ্ট পেত।তাই তাদের ছেড়ে এত দুরে বসবাস আমার। বাবা ভাই তো আমার চোখের জল সহ্য করতে পারে না।আর তাদের অগোচরে আমি ভালোবাসার জন্য গুমরে গুমরে মরছি।

ইদানীং বাবারও নাকি মনটা খারাপ থাকে আর মায়ের ও। কেয়ার সাথে কথা হলে ও বলে আমাকে ফিরে যেতে কিন্তু আমি পারি না।কেয়া আর শাহাদ ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে আরও তিনবছর আগে কিন্তু ওদের এখনো কোনো সন্তান নেই।অনেকদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি এখানে আসার পর শুধু ভাইয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম কিন্তু সেখানে সবার সাথে হাসিখুশি থাকার অভিনয় করতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো।তাই বেশি দেরি না করে আবর নিজের গন্তব্যে ফিরে আসি।বিয়েতে অনেকে অনেক কথা বলাবলি করছিলো,যে মেয়েকে কেনো এখনো বিয়ে দিচ্ছে না।কিন্তু আমার পরিবার তা খুব সুন্দর ভাবে এড়িয়ে গেছে।কারনটা ছিলো আমার পড়াশোনা।আমি বলেছিলাম যে আমি আমার পড়াশোনায় কোনো ব্যাঘাত চাই না।। পড়ে অবশ্য অনার্স শেষ হওয়ার পর মা বাবা বিয়ের কথা বলতেই তাদের এড়িয়ে যেতাম।কেননা তা ইহ জীবনে আমার জন্য অসম্ভব তাই সবসময় বিষয় টাকে এড়িয়ে যেতাম।বাবা – মা জানে আমার জেদ আর রাগ সম্পর্কে যখন যা বলি তাই করি।আর স্রোতের ভালোবাসা তো আমাকে রীতিমতো পাগল করে ফেলছে তাই তখন নিজের কথার নড়চড় কখনোই হতো না।

#চলবে….

🌼

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here