অপেক্ষিত প্রহর পর্ব -১০

#অপেক্ষিত_প্রহর
#আফসানা_মিমি
|১০ম পর্ব |

গোধূলি লগনে বসিয়া দু’জনে,
কইবো কথা গোপনে গোপনে।
বাঁধিবো রক্তজবা তোমার সোনালি কেশবে,
ওহে মোর প্রিয়লতা; বসবে কি আমার সংলগ্নে!
অগোছালো হয়ে আছি তোমার নিরবে,
আসক্ত হতে চাই তোমার অন্তরের গহ্বরে।

ইফাজের মাতাল কন্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলাম। বর্তমানে আমি দরজার সাথে মিশে দাঁড়িয়ে আছি আর ইফাজ আমার সামনে। ইফাজের বলা দুই লাইনের কবিতা শুনে মাথা নিচু করে ছিলাম এতক্ষণ। আস্তে আস্তে মাথা তুলে ইফাজের পানে দৃষ্টিপাত করতেই একজোড়া মাতাল নেত্রদ্বয় দেখতে পেলাম; সাথে সাথে নিজের দৃষ্টি নত করে ফেললাম। ইফাজের দৃষ্টির সাথে দৃষ্টিপাত করা আমার পক্ষে সম্ভব না। ঐ নেত্র পল্লবে তাকালে আমি ঘায়েল হয়ে যাবো, মুখ ফসকে নিজের মনের কথা এমনিতেই বলে দিবো।

– আমার অবর্তমানে আমার ঘরে প্রবেশ করেছিল কে?

ইফাজের কথা শুনে চট করে ইফাজের পানে তাকালাম। ইফাজ ভ্রু যুগল কুঁচকে আমার পানেই তাকিয়ে আছেন। এখন আমি কি বলি! সত্যি বললে তো ইফাজ জেনে যাবে যে আমি জেনে গিয়েছি ইফাজ-ই ইফু। না না সত্যি বলা যাবে না! ইফুকে আরো শায়েস্তা করতে হবে। কি বলি, কি বলি! হ্যাঁ পেয়েছি। ইফাজের দিকে মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে বললাম,

– আরে আপনি চলে যাবার পর হেনা আর রাজ এসেছিলো বাড়িতে। আমি ওদেরকে আমার ঘরে বসিয়ে লাউ গাছ থেকে লাউ আনতে গিয়েছিলাম। তারপর জানেন কি হয়েছে! আমি এসে দেখি হেনা আর রাজ দোতালায় উঠে প্রেম মানে গল্প করছে। হয়তো তারা আপনার কোন জিনিস উলট-পালট করে রেখেছে। আমি কিন্তু কিছু করিনি। আমি তো সারাদিন ঘরে বসে কাটিয়েছি একা একা। কলেজেও যাইনি।

– হয়েছে হয়েছে, থাক আর কোনো বাহানা দিতে হবে না। এবার বলো আজকে চলে এসেছ কেন?

ইফাজের কথা শুনে গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল আমার। আমি না এই লোকটার সাথে রাগ করে এখানে চলে এসেছি! এই লোকটা এখানে চলে এসেছে এই কথা মাথায় আসতেই ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে নিলাম ইফাজকে। রেগে ইফাজের দিকে আঙ্গুল তুলে বলতে শুরু করলাম,

– এই যে বদ শিল্পী, একদম আমার কাছে ঘেঁষতে চেষ্টা করবেন না। আপনার এমন ভোলাভালা কবিতা, গান শুনে আমি একদম আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে যাব না। দূরে সরে যান আমার কাছ থেকে! আর এখানে কেন এসেছেন? আপনি যে এখানে এসেছেন নানুমনি আপনাকে দেখেছে? ইয়া আল্লাহ! আপনাকে আর আমাকে এভাবে একা ঘরে একটা ছেলে মেয়ে! ইশ কি বলছি আমি! আপনি এক্ষুনি আমার ঘর থেকে বের হন। শুধু ঘর থেকে না এই বাসা থেকে বের হয়ে যান। আচ্ছা আপনি কি করে আসলেন? এ রাস্তা দিয়ে তো কোন গাড়ি ঢুকানো যায় না।আপনি কি হেঁটে এসেছেন? নাকি কোন উড়োজাহাজে উড়ে চলে এসেছেন এখানে?

ইফাজ আমার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে আমার পানে তাকিয়ে রইলেন।

– এতগুলো প্রশ্নের উত্তর আমি কীভাবে দেই?

– এতকিছু মানে! আমি কিছুই জানি না। আপনি এখান থেকে যান। আপনাকে জাস্ট আমার সহ্য হচ্ছে না।
ইফাজ আমার কথা শুনে আমার কাছে আগাতে আগাতে বলল,

– কালকের রাতের কথা ভুলে গিয়েছো বুঝি! আবার মনে করিয়ে দিব, আবার কি কাছে আসবো?

– এই না, একদম না! আপনি একটা বদ শিল্পী। আপনি শুধু আমার কাছে আসার বাহানা খোঁজেন। আপনি থাকুন এখানে আমি চলে যাচ্ছি।

ইফাজকে আর কিছু বলতে না দিয়ে দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলাম। বারান্দায় পারভীন খালা কি যেন চিন্তা করছে। খালার কাচে যেতেই পারভীন খালা আমাকে দেখে খানিকটা ফিসফিস করে আমার উদ্দেশ্যে বললেন,

– হ্যাঁ রে আহিবা! তোর বাপ মা যে তোকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে আমাদের একবার খবর দিতে পারলি না! আমরা গরিব হতে পারি এজন্য কি তোকে কিছুই দিতাম না! তোর বাপ মা এমন কাজ করতে পারলো? বলি আপার সাথে তো আমার গতকাল কথা হয়েছে, কই তোদের বিয়ে নিয়ে তো কিছুই বলল না।

খালামনির কথা শুনে আমার চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম। আমি খালামনির কথা বুঝতে না পেরে খালমনিকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম,

– কি বলছো খালামনি, আমার বিয়ে মানে! মাথা ঠিক আছে তোমার?

– আমার মাথা ঠিক আছে। বল তোর মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে গিয়েছে। এতক্ষণ ঘরে কার সাথে ছিলি ভুলে গিয়েছিস? এই কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভুলে গেলি!
বলছি শহরের নামকরা শিল্পীর সাথে তোর বিয়ে হয়েছে। আমাদের জানাস নি কেন? কিছুক্ষণ আগে মা আমাকে বলল শহরের নামকরা শিল্পীর সাথে তোর বিয়ে হয়েছে। তুই নাকি রাগ করে বাসা থেকে চলে এসেছিস। সত্যিই কি ইফাজ তোর বর হয়?

এতোক্ষণে বুঝতে পারলাম আসল কাহিনী কি। তার মানে ওই বদ শিল্পীটা এখানে এসে নানুমনিকে সব বলে দিয়েছে। নানুমনির কথা মনে হতেই খালামণিকে ভীত কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন করলাম,

– তুমি কীভাবে জানলে? নানুমনি বলেছে? নানুমনি কি জানে এই বদ শিল্পীর কথা?

– আমি তো মার কাছ থেকে শুনলাম। তোর বর শিল্পী নাকি এসে সরাসরি নানু মাকে সালাম করল, তারপর খুব সুন্দর কন্ঠে বলল যে, “আমি তোমার নাত জামাই, দোয়া করে দাও আমাকে। আমার বউটা রাগ করে এখানে চলে এসেছে। রাগ ভাঙাতে এসেছি।

– ইয়া আল্লাহ! কি বলো এসব? এখন আমি নানুমনির সামনে যাবো কীভাবে? নানুমনি আমাকে কি ভাববে?

– এত ভাবা ভাবির কিছু নাই। আমার কিন্তু ছেলেটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে তোর সাথে অনেক সুন্দর মানিয়েছে। আর তাছাড়া মায়েরও অনেক পছন্দ হয়েছে যতটুকু বুঝলাম। কিন্তু তোর উপর আর আপা দুলাভাই এর উপর রাগ করে আছে। এখন তোরাই জানিস কি করবি। আমি বাবু এইসবের ভিতর নাই। যায় আমি সন্ধার বাতি দিয়ে আসি আমার ঘরে।

—————-
খাবারের টেবিলের পিনপতন নীরবতা। ইফাজকে রুই মাছের মাথা খেতে দেয়া হয়েছে। ইফাজও রুই মাছের মাথাটা কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে। এমন ভাবে খাচ্ছে যেন আস্ত একটা রাক্ষস। আর এদিকে আমি নানুমনির সামনের কিছুই খেতে পারছি না। নানুমনি ভালোর ভালো, খারাপের খারাপ। একবার যদি রাগ হয় তাহলে সেটা ভাঙতে দিন দুনিয়া এক হয়ে যায়। নানুমনির পাশে বসে খেতে আরও বেশি ভয় করছে। খাবারের পাত্রে আমার হাত নড়াচড়া দেখে নানুমনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

– কি ব্যাপার আহিবা, খাচ্ছিস না কেন? এখনো কি ছোট আছিস যে, তোকে আমি এখন ভাত মেখে খাইয়ে দিব? আমি এত পারব না বাপু। তোরা তো বড় হয়ে গিয়েছিস। একা একা সব করতে পারিস। বিয়ে-শাদী ঝগড়াঝাটি সব একা একা করতে পারিস। আবার বাড়ি থেকে একা বের হয়েও আসতে পারিস। কিন্তু খাবার খাইয়ে দেবার বেলায় আমি থাকব কেন? পারব না আমি।

এই যা! যে রাগের ভয় করেছিলাম সেটাই হলো। নানুমনি রাগ এখন সপ্তম আকাশে। এদিকে নানুমনির মনের কথা শুনে আড়চোখে তাকালাম ইফাজের পানে। ইফাজ মাছের মাথার কাঁটা বেছে যাচ্ছেন একনাগারে।

– আহ মা থামো তো এবার! খাবারের সময় এত কথা বলতে নেই। আয় তো আমার মনি টা, আমি তোকে খাইয়ে দেই! সে ছোটবেলায় তোকে খাইয়ে দিতাম এখন বড় হয়ে গিয়েছিস তবুও হাতে নাড়াচাড়া করছিস খাবার প্লেটে; আয়।

খালামণি কথায় অনেক খুশি হলাম। আহা কতদিন পর খালামণির হাতে খেতে পারব! ভাতের প্লেট নিয়ে খালামণি পাশে বসব এমন সময় ইফাজ ভারী কন্ঠস্বরে বললেন,

– খালামনির কাছে যাওয়ার দরকার নেই। আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি।

ইয়া আল্লাহ! এই ছেলের কি লজ্জা শরম বলতে কিছুই নেই? নানুমনি আমাদের সামনে, আর এই বদ শিল্পীটা বলছে আমাকে খাইয়ে দিবে! ভীত চোখে নানুমনির দিকে তাকালাম। নানুমনি খাওয়া রেখে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন তো একবার ইফাজের দিকে তাকাচ্ছেন।

নানুমনির এভাবে তাকানো দেখে ইফাজ ফিক করে হেসে বললেন,

– ওল্ড ডার্লিং, এতো রাগ করছ কেন? তোমার নাতনিকে যে আমি এত ভালবাসি তা কি তোমার সহ্য হচ্ছে না? নাকি বুড়োর কথা মনে পড়েছে? যাও তো, হিংসুটে বুড়ি! একদম নজর দিবে না আমাদের দিকে।
যোয়ান বয়সে গিয়ে দেখো কত খাইয়ে দিয়েছে বুড়ো তোমাকে! এখন এসেছে আমাদের রাগ দেখাতে। আচ্ছা নানুমনি ! নানাভাই কি অনেক রোমান্টিক ছিল! নাকি তোমার মত পাংসুটে ছিল?

ইয়া আল্লাহ, ইয়া আল্লাহ! এই ছেলে বলে কি? নানুমনিকে ইফাজ এভাবে কথা বলছে? নানুমণি তো আজকে এই বদ শিল্পীকে আস্ত গিলে খাবে। নানুমনি এগন কী বলবে তা ভেবেই তো আমি ভয় পাচ্ছি।
কিন্তু নানুমণি আমাকে অবাক করে দিয়ে ইফাজের উদ্দেশ্যে বললেন,

– তোর নানাভাই তোর মত ভীতু ছিল নাকি! তোর নানা ভাইয়ের বুকের পাঠা ছিল অনেক। তাইতো গ্রামের শত শত মানুষের সামনে আমাকে বিয়ে করার সাহস করেছিল।
তোর মত ভীতুর ডিম নাকি যে লুকিয়ে বিয়ে করবে?

নানুমনির এহেন কথাশুনে বিষম খেলাম। কাশতে কাশতে চোখ দিয়ে পানি আসার উপক্রম। ইফাজ তাড়াতাড়ি নিজের খাবার রেখে পানি ভর্তি গ্লাস এগিয়ে দেন আমার দিকে। নিজের হাতে পানি পান করিয়ে দেয় আমাকে। ইফাজ নানুমনির কথার প্রত্তুত্তরে বললেন,

– দিলে তো হিংসুটে বুড়ি, উল্টা পাল্টা কথা বলে আমার বউকে বিষম খাইয়ে! আমার সাহস আছে বুঝলে তাই তো চুপ করে আছি। তোমার নাতনির যেন পড়াশোনায় আমার জন্য কোন ব্যাঘাত না আসে এর জন্য চুপ করে আছি। সময় হোক ঢাক-ঢোল বাজিয়ে সাত গ্রাম এক করে তোমার নাতনিকে ঘরে তুলে নিয়ে যাব। আর তুমি কিভাবে জানলে আমি একা বিয়ে করেছি?

– তোদের বিয়ের কথা না আমি জানি না পারভীন! আহিবার বাবা-মাও জানে না তা বুঝতে পেরেছি। নাহলে আমি এমন মেয়েকে পেটে ধরিনি যে কিনা আমাকে না জানিয়ে আমার নাতনির বিয়ে দিয়ে দিবে।

– তার মানে বলতে চাচ্ছো, তুমি মেনে নিয়েছে আমাদের?

ইফাজের কথায় নানুমনি কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিল,

– তোর চেহারা সুরত দেখে তো মাশাল্লাহ মনে হচ্ছে। কিন্তু শুনেছি শহরের শিল্পীরা খারাপ হয়। তোর কয়েকটা পরীক্ষা দিতে হবে। পরীক্ষার যদি পাস করিস তাহলে আমার নাতনি তোর আর যদি ফেল করিস তাহলে ” যা বাছা! তুই তোর পথ ধর গিয়ে।”

– আচ্ছা আমি রাজি।

নানুমনি আর ইফাজের কথোপকথন শুনে আমার খাওয়ার ইচ্ছেই মরে গেল। কি শুরু করেছে এরা! আমি এখানে এসেছিলাম ইফাজকে শায়েস্তা করতে কিন্তু এখন দেখি এখানে পরীক্ষা দেয়ার কথা আলোচনা হচ্ছে।

এখন নিজেকে নিজেই বলতে ইচ্ছে করছে,

” কপাল খারাপ তোর মাইয়া,
করবি এবার কি!
নানী-নাতি এক হয়েছে,
এটাই বেশি।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here