অপেক্ষিত প্রহর পর্ব -১১

#অপেক্ষিত_প্রহর
#আফসানা_মিমি
|১১তম পর্ব |

নিশাচর রজনীতে যেন দুজন মানুষ নিশাচর প্রাণীর ন্যায় বসে আছি একে অপরের দিকে তাকিয়ে। পূর্ণিমার চাঁদখানা পূর্ণ হয়ে স্থির হয়ে বসে আছে মাথার উপরে।
দীঘির পানিগুলো স্চ্ছ হয়ে আছে। বহমান বাতাস পানির মধ্যে থেমে থেমে ঢেউ তরঙ্গের সৃষ্টি করছে। পানির মধ্যে স্পষ্ট পদ্মফুল জোড়া সেই ঢেউয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে দুলছে সমানতালে।

নানুমনির দেয়া পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য জোড় করে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে, এটা ইফাজের বাণী।
খাবারের টেবিলে বিশাল আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, আগামীকাল থেকে ইফাজের পরীক্ষা দেয়া শুরু হবে। ইফাজ নানুমনির মুখশ্রীতে এই কথা শোনার পর পরই আমাকে এই পুকুর পাড়ে নিয়ে আসেন। অবশ্য নিয়ে আসার আগে আমাকে শাড়ি পরিয়ে আনতে ভুলেন নি। আমাকে এখানে বসিয়ে রেখে কোথায় যেন চলে গেলেন ইফাজ।
ইফাজ চলে যেতেই পুকুরের পানির দিকে দৃষ্টিপাত করি। পুকুরের পদ্ম গুলো যেন আমাকে ডেকে যাচ্ছে। দিনরাত, শীত ভুলে পুকুর পাড়ে চলে গেলাম পদ্মগুলো তুলে আনবো এই ভেবে।
পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছি। কনকনে শীতের মধ্যে পুকুরে ভেজার মজাই আলাদা। আরেক কদম আগালে পুকুরের মধ্যে আমার পা ডুবে যাবে।
আমার আগানোর মাঝেই কানে গিটারের প্রতিধ্বনির আওয়াজ আমার কানে আসে। গিটারের তালে কেউ গেয়ে যাচ্ছে,

তোমারে দেখিলো পরানও ভরিয়া
আসমান জমিন দরিয়া
তোমারে দেখিলো পরানও ভরিয়া
আসমান জমিন দরিয়া
চলিতে চলিতে থামিয়ো
দেখিবো তোমারে আমিও
ওহ, রুপে দিলা তুমি পাগল করিয়া

ও কাজলটা মাখিতে, ডাগরও আঁখিতে
নজর পড়িলে কী হবে?
ও প্রেমেতে পড়িবে, মরনে মরিবেএ
দেখিয়ো তুমি তবু নীরবে
চোখেরো পলকে, পলকে
রুপেরো ঝলকে, ঝলকে
আমি যে ডুবে রই সেই প্রেমে পড়িয়া
ওহ, রুপে দিলা তুমি পাগল করিয়া।

একজন জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী এমনি এমনি হওয়া যায় না। খানের মাধুর্যতাই বলে দিবে সে বিশেষ কোন শিল্পী। পুকুরে নেমে পদ্মফুল আমার তুলে আনা আর হলো না। পুকুরের সিড়িতে বসে নেত্র পল্লব বন্ধ করে মিষ্টি কন্ঠস্বরে গান শুনতে লাগলাম।
দুই মিনিট হয়েছে গানটা শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, গানটা এখনও আমার কানে বাজছে।
কারোর নিশ্বাস নাকে এসে বাড়ি খেতেই নেত্র পল্লব ধীরে ধীরে খুলে ফেললাম।

আমার চোখের সামনে ডজন খানেক কদমফুল। কদমফুল পেয়ে মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। ছোটবেলা থেকেই এই কদমফুল আমার দুর্বলতা। কদমফুল পেয়ে আমি আনন্দিত হলাম। ইফুর হাত থেকে কদমফুল নিয়ে মন ভরে ঘ্রাণ শুঁকলাম। ইফাজের পানে তাকাতেই নজরে এলো, ইফাজ মাতাল দৃষ্টিতে আমার পানে তাকিয়ে আছে। ইফাজ এবার আমার সম্মুখে আরো একগুচ্ছ কদমফুল এগিয়ে দিয়ে বলল,

” প্রিয়লতা, আমার হিবারাণী! চিনেছো কি আমায়? তোমার সেই ছোট বেলার খেলার সাথী। যার সাথে শৈশবের হাজারো স্মৃতির জড়িয়ে আছে! মনে পড়ে হিবারাণী, কদমফুলের আবদারের সেই বিরল কাহিনী! মনে আছে কি তোমার, ইফুর পাগলামি। শেষ বেলায় বলা সেই মনঃক্ষুন্ন কাহিনী! আমি কিন্তু কিছু ভুলিনি। ভুলিনি আমার সেই ছোট্ট হিবারাণীকে। যার হাসিতে চারপাশ মুখরিত হয়ে যেত, যার আলতা পায়ের নূপুরের প্রতিধ্বনি শুনে মন শান্ত হয়ে যেত, যার চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজ না শুনলে ঘুমই আসতো না। আমি ভালোবাসি সেই হিবারাণীকে ছোটবেলার মত। আর এখন, এমন এক প্রিয়লতাকে ভালোবাসি! যার বিরল হাসিতে প্রতিবারই মরতে রাজি আছি। যার মিষ্টি হাসিতে প্রতিবারই ঘায়েল হতে প্রস্তুত আমি। ভালোবাসি আমায সেই শৈশবের খেলার সাথীকে, ভালোবাসি আমার বউকে, ভালোবাসি আমার হিবারাণীকে।
চলো না হেঁটে চলি একসাথে! আজীবনের জন্য একে অপরের হাতে হাত রেখে? রাজি তুমি হিবারাণী?”

ইফাজের প্রত্যেকটা কথা শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি। হিচকি তুলে কান্না করে যাচ্ছি অনবরত। ইফাজের হাত থেকে দ্বিতীয় গুচ্ছ কদমফুল নিয়ে নিলাম।
– আপনি খুব নির্দয় শিল্পী সাহেব। মন বলতে কিছুই নেই আপনার। আমি আপনার বিরহের দহনে এতদিন পুড়ে ছাই হয়েছি, কিন্তু আপনি! আপনি একটিবারের জন্য মুখ তুলে তাকাননি। এই হাতে হাত রাখেন নি। আমি অভিমান করেছি ইফু। খুব অভিমান।

পুকুরের পাড়ের বসার জন্য ইট পাটকেল দ্বারা একটি বসার স্থান তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বসে অনবরত কান্না করে যাচ্ছি। আমার সামনে ইফাজ দুই হাঁটু গেড়ে বসে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। রাগে, অভিমানে, কষ্টে ছোটবেলার ন্যায় ইফাজের মাথার চুল ধরে টানছি আর কান্না করছি।

কিছু দিবসের পূর্বে যতই আমি ইফাজের আসল পরিচয়ে অবগত হয়েছি কিন্তু তারপরেও আমার মনে সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো; ইফু এসে সরাসরি আমাকে বলবে, হিবারাণী চলো না একসাথে মিশি।” কিন্তু তা আর করল কোথায় ইফাজ! ইফাজ আমাকে ঠিকই চিনে নিয়েছে, মন ভরে শত আলাপনও করতে পেরেছে। হাজারো ঝগড়া-বিবাদ করে আমাকে রাগিয়েছে। ইফাজ তো তখন অবগত ছিলো যে আমিই তার হিবারাণী! নাহ, এমন পঁচা স্বামীকে আমার চাই না, আমার তো সেই ছোট্ট ইফুকে চাই।

– এই বদ শিল্পী উঠুন বলছি,উঠুন আমার কোল থেকে। আপনার সাথে আমার কথা নেই।

ইফাজ মাথা তুলে করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

– এতটাও নির্দয় হয়ো না বউ! আমি আর পারছি না তুমিহীনা থাকতে।

ইফাজের করুন কন্ঠস্বরে আর কঠোর হতে পারলাম না। ইফাজের সামনাসামনি বসে পড়লাম। হাতের কদমফুল গুচ্ছ গুলো দুইহাতের মুঠোয় নিয়ে জড়িয়ে ধরলাম আমার ইফুকে। ইফাজ হয়তো ভাবতে পারেনি আমি এখন এমন কান্ড করব। ইফাজও পরম যত্নে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

————–

– আপনি শিওর আপনি এই কাজ করতে পারবেন?

– করতে পারব কি হিবারাণী, করে দেখাবো। তুমি শুধু আমার ওল্ড ডার্লিংকে এখানে নিয়ে আসো।

– ইফাজ, আমার জামাই! দেখো, এখন আর তুমি আগের মত নেই। এখন তুমি বড়ো হয়ে গিয়েছ। এসব কাজ করতে পারবে না। আগে না হয় ছোট ছিলে! সব কৃষকদের দেখাদেখি ধান কাঁটতে! কিন্তু এখন তো তাও পারবে না। আর তুমি এখন শহরের নামকরা শিল্পী। এখন যদি এসব করতে যাও তো লোকে কি বলবে?

– আহ্ আমার বউ, চিন্তা করিও না। এটা তো কিছুই না তোমার বরের জন্য। তুমি এক কাজ করো, সেই আগের সাজে সজ্জিত হয়ে আসো আর নানুমনিকে নিয়ে আসো।
– উহু, সাজবো না আমি।

নানুমনির বাসায় আজকে ইফাজের দ্বিতীয় দিন সাথে আমারও। নানুমনি গতকাল রাতে আমাদের দুজনকে পুকুর পাড় থেকে কানে ধরে টেনে বাসায় নিয়ে আসেন। বাসায় এনে একগাদা বকাঝকা করেন আমাদের। কোথায় চেয়েছিলাম! আমি আর ইফু আজকে চন্দ্র বিলাস করব কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। দুইজনকে কানে ধরে টেনে বাসায় নিয়ে আসেন নানুমনি। বাসায় এনে আমাকে নিজের সাথে নিয়ে চলে যান আর ইফাজকে আমার জন্য নির্ধারিত করে রাখা ঘরে থাকতে বলেন। এদিকে ইফাজের চেহারা তখন দেখার মত ছিল। বেচারা বিরক্তি মাখা চোখে আমার পানে তাকিয়ে ছিলো।

আজ সকালে নানুমনি কড়া নির্দেশ দেয় ধান কাঁটতে হবে ইফাজকে। যদি না পারে তাহলে আমাকে ইফাজের সাথে ফেরত পাঠাবে না। নানুমনির একটা কথায় ইফাজ রাজি হয়ে যায়। নানুমনির উদ্দেশ্যে তখন বলে,

– আরে ওল্ড ডার্লিং, এটা তো আমার জন্য কিছুই না। তুমি শুধু তাকিয়ে দেখবে, আর আমি! আমার হাতের কামাল দেখাবো।

বর্তমানে ধান কাঁটার স্থানে আসলাম। শাড়ি পরিধান করে মাথায় ঘোমটা টেনে নানুমনির পাশের চেয়ারে বসলাম। আমার আগে এখানে নানুমণি এসে উপস্থিত হয়েছেন। নানুমনির পাশে আকবর মামা ছাতা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে নানুমনির মাথায় ছায়া দিচ্ছেন। আমাকে দেখে নানুমনি প্রশস্ত হেসে বললেন,

– বাহ আমার বুড়িটাকে তো একদম বউ বউ লাগছে! মাশাআল্লাহ, আমার পাশে বসে থাক তো দেখি! আজ দেখবো, তোর এই শহরের বর কি কি কাজ করতে পারে।

নানুমনির কথা শুনে আকবর মামা বলে উঠলেন,

– আম্মা! শুধু শুধু শহরের শিল্পীটারে এত কষ্ট দিতাসেন। শিল্পী মানুষ এসবে অভ্যস্ত আছে নাকি? শিল্পী সাহেবের কাম তো শিল্পকলা ঢোল তবলা বাজানো। এক হাতে ধান আর অন্য হাতে কাঁচি তোলার সময় আছে নাকি তাঁর?

– আরে আকবর! আমার নাত জামাইকে পরীক্ষা করার দুঃসাহস আমার নেই। আমি শুধুই ব্যাটাকে একটু বাজিয়ে দেখতে চাই।

নানুমনির কথা শুনে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালাম। নানুমনি আমার মত ইফাজকে শায়েস্তা করছে। যাই হোক আমার তো এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে।
আকবর মামা আর কিছু বললেন না। আমাদের তিনজনের দৃষ্টি স্থাপন করলাম ধান ক্ষেতে দণ্ডায়মান ইফাজের দিকে।

মাথায় মাথাল বেঁধে ছোটবেলার মতো কোমরে গামছা পেঁচিয়ে ইফাজ ধান কাঁটার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ধান ক্ষেতে নামার আগে আমার দিকে তাকাতে ভুলেনি ইফাজ। আমার পানে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে নেমে পরলো ক্ষেতের মধ্যে।

সকল কৃষকদের সাথে মিলে হেসে খেলে ধান কাঁটছে ইফাজ সেই ছোটবেলার মতো। ধান কাঁটার মধ্যে গান ধরল ইফাজ।

ধান কাটার বিরতি এখন। ইফাজের ধান ক্ষেতে অটল থাকা দেখে নানুমনির মাথায় হাত। আজ যে তাঁর নাত জামাই বাজিতে নানুমনিকে হারাবে তা বুঝে গিয়েছে নানুমনি। প্রেশার বেড়েছে এই অজুহাত দেখিয়ে নানুমণি চলে গেলেন ভেতরে।

নানুমনি চলে যেতেই আমি সেই ছোটবেলার মতো লম্বা আঁচল জমিনে ছড়িয়ে, মাথায় গামছা মোড়ানো খাবার নিয়ে, পায়ে আলতা নূপুর পরে হেলে দুলে এগিয়ে যাচ্ছি। উদ্দেশ্যে ধান ক্ষেতের ইফাজের কাছে। যেখানে ইফাজ বর্তমানে হাত মুখ ধুচ্ছে পানির মেশিন থেকে। মুখে দুই-তিনবার পানির ঝাপটা দেওয়ার পর ইফাজ আমার উপস্থিতি অনুভব করল। আমার পানে তাকাতেই ইফাজের চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। ইফাজ হয়তো ভাবতে পারেনি আমাকে আবারো সেই একি সাজে সজ্জিত দেখবে। ইফাজের চাহুনি দেখে লাজুক হাসি উপহার দিলাম। ইফাজকে টেনে নিয়ে আসলাম ছায়াদার এক গাছের নিচে। সেখানে বসিয়ে নিজেই আঁচলখানা দিয়ে আলতো করে মুখখানা মুছে দিলাম। ইফাজ শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে আমার কান্ড-কারখানা দেখছে। আমার এহেন কান্ডে মুচকি হেসে বলল,

– সেই ছোটবেলা বর বউ খেলতাম। তুমি আমার জন্য এভাবে খাবার নিয়ে আসতে বুড়ি মার কাছে কিছু বন্ধক রেখে। তা আজকে কার কাছে কি বন্ধক রেখে খাবার নিয়ে এসেছো?

ইফাজের কথায় মুচকি হেসে বললাম,

– আপনার সেই ছোট্ট হিবারাণী এখন বড়ো হয়ে গিয়েছে। এখন সে নিজে রান্না করে নিয়ে আসতে পারে বরের জন্য। আজকে আপনার জন্য আপনারই হিবারাণী নিজের হাতে রান্না করে নিয়ে এসেছে। খেয়ে দেখুন তো কেমন হয়েছে?

ইফাজ মুচকি হেসে খাবারের পাত্র থেকে খাবার খাওয়া আরম্ভ করল।
ইফাজ খাচ্ছে আর আমি তৃপ্তি সহকারে দেখছি। এটাই কি সুখ! এখানেই কি সকল বিষাদের অবসান ঘটবে! নাকি কোন ঝড় তুফান এসে এই সুখকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিবে।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here