অপেক্ষিত প্রহর পর্ব -১২

#অপেক্ষিত_প্রহর
#আফসানা_মিমি
|১২তম পর্ব |

শীতের রাতে যেন শীতটাও কাবু করে ফেলে একজন মানুষকে। শীতের মৌসুমে শীত থেকে বাঁচার জন্য ভারী বস্ত্র পরিধান করে। শীতের মৌসুমে গাড়ি চলাচল করা মানে আপনি আর আপনার মধ্যে নেই জমে বরফ হয়ে যাবেন। আমার এখন কিছুটা কাঁপাকাপি অবস্থা। শা শা করে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে ইফাজ। গাড়ি ছাড়া যে শিল্পী সাহেব অচল তা অনেক আগ থেকেই আমি জানি। নানুবাড়িতে যাওয়ার পূর্বে এক বাজার পড়ে সেখানের কোন এক দোকানে ভাড়া দিয়ে গাড়ি রেখে এসেছিল। আজ আসার সময় নিয়ে আসেন।
নানুমনির পরীক্ষায় জয়ী হবার পর আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করেননি ইফাজ। বিকেলেই আমাকে তাড়া দিয়ে উঠেন তৈরি হওয়ার জন্য। সন্ধ্যার আগেই নানুমনির কাছ থেকে ইফাজ আমাকে নিয়ে বের যান। বাজার পর্যন্ত আকবর মামা ভ্যানে চড়িয়ে এগিয়ে দিয়ে যান। ইফাজ নানুমনির থেকে বিদায় নেয়ার সময় নানুমনিকে সালাম দিয়ে বলেন,

– দোয়া করবেন নানুমনি আমাদের জন্য। আমি আপনার এই নাতনিতে খুব ভালোবাসি। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আপনার নাতনিকে আগলে রাখার দায়িত্ব নিলাম।
ইফাজের কথায় নানুমনি আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না নিবারনের চেষ্টা করেন। নানুমনির কান্নামাখা মুখ দেখে বিদায় বেলা ভালো লাগছিল না তখন, কিন্তু ইফাজের কথায় খারাপ লাগাকে ভালোলাগায় রূপান্তরিত করে দেয়। ইফাজ আসার সময় চিল্লিয়ে নানুমনির উদ্দেশ্যে বলল,

– এই যে আমার ওল্ড ডার্লিং, খুব ধুমধাম করে কিন্তু তোমার নাতনিকে আবার বিয়ে করব। তুমি চাইলে একটা চান্স পেতে পারো! আমাদের বিয়ের একমাস আগে তোমাকে সেখানে দেখতে চাই। খেয়ে শরীরে বল তৈরি করো বুঝলে!

কান্নার মাঝেও নানুমনি তখন হেসেছিল।
– এই যে আমার স্বপ্নের রাণী, চোখজোড়া খুলুন! আমরা যে আমাদের কাঙ্খিত স্থানে চলে এসেছি।

এই কনকনে শীতের মধ্যে মাত্র আঁখিজোড়ায় ঘুম এসে ভর করল আর এমনিই বদ শিল্পীটার ডাক। চোখ খুলে ইফাজকে খুব কাছেই দেখতে পেলাম। আমার চেহারার পানে তাকিয়ে কি যে খুঁজে চলছে।

– কি দেখছেন?

ইফাজ কিছুক্ষণ ভেবে উওর দিলো,

– তোমার চেহারায় কিসের যেন একটা কমতি আছে!

ইফাজের কথায় ফিক করি হেসে দিলাম। ইফাজের নাক টেনে হেসে বললাম,

– আমি আমার মত, আমাকে আল্লাহ এই চেহারায় সৃষ্টি করেছেন। ত্রুটি তো থাকতেই পারে। একজন মানুষের তো আর পাঁচ দিকে পাওয়া যায় না তাই না?

– আমি সেটা বলিনি হিবারাণী, আমি বলেছি তোমার মধ্যে একটা জিনিসের কমতি আছে। সেই জিনিস টা পূরণ করলেই তুমি আমার এই ইফাজের বউয়ের মত লাগবে।

ইফাজের কথায় আয়নায় নিজের মুখশ্রী দেখতে লাগলাম। সবদিক দিয়েই তো ঠিক আছে। কমতিটা কীসের তাহলে?
আমার ভাবনার মাঝেই ইফাজের ঠান্ডা হাতে আমার নাকে নাকফুল পড়িয়ে দিলেন। আমার কপালে অধর ছুঁয়ে বললেন,

– মাশাআল্লাহ, আমার হিবারাণী। এবার পরিপূর্ণ লাগছে আমার বউকে।

– ইফাজের কথায় লাজুক হাসলাম। প্রসঙ্গ এড়াতে জিজ্ঞেস করলাম,

– আমরা কি বাসায় চলে এসেছি?

– না আমার প্রিয়লতা, বাসায় যেতে আরো এক ঘন্টা সময় লাগবে। আমরা এখন কিছুক্ষণ প্রেম করব, তারপর খাওয়া-দাওয়া করব, তারপর বাসায় চলে যাব।

ইফাজের এমন বাচ্চামো কথায় কিছুটা রাগান্বিত কন্ঠস্বরে বললাম,

– এটা কেমন কথা ইফু! বাসায় কেউ জানে না যে আমরা বিবাহিত। আর তার মধ্যে এখন রাত হয়ে গিয়েছে। এখানে আপনি খাবার পাবেন কোথায়? আর প্রেম করব মানে! আমি আপনার সাথে এক মিনিটও থাকবো না। বদ শিল্পী কোথাকার, শুধু মাথার মধ্যে উল্টাপাল্টা চিন্তা নিয়ে ঘুরেন আপনি!

আমার কথায় ইফাজ শব্দ হাসলেন। আমাকে টেনে গাড়ির দরজা খুলে আবারো গাড়ির পিছনের সিটে নিয়ে বসালেন। তারপর আমার কোলে মাথা রেখে আবেগের সহিত বলে উঠলেন,

– হাবারাণী! মাথার চুলগুলো একটু টেনে দাও তো! আস্তে আস্তে টানবে বুঝলে! তোমার নরম তুলতুলে হাত দিয়ে। তোমার তো আবার অভ্যাস রাগ হলে বা অভিমান হলে আমার চুল ধরে টানাটানি করা। আমি আজ একটু ঘুমাব তোমার কোলে। গতকাল রাতে একটা সুযোগ ছিল আমার কিন্তু আমার ওল্ড ডার্লিং সে সুযোগটা কেড়ে নিল। কিন্তু আজ আর কোন ছাড়াছাড়ি নেই। বাসায় গেলে তো তোমার ধারে কাছে ঘেষতে পারব না। তাই এখানে একটু প্রেম আলাপ করে যাই। স্মৃতি হয়ে থাকবে তোমার আমার আজকের এই প্রেম আলাপ।

———–

অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে যেন অন্য কোন জগতে চলে গিয়েছিলাম। আমার জীবনটা সত্যিই আঁধারময়। আমার জীবনে আলো নেই। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে জীবন পার করলাম। জানি ভবিষ্যতেও আরো করব।

আহিবা দু তলায় কি করছিস তুই? আবারো সেই নেমকহারামির জন্য কাঁদছিস? আমাদের মত গ্রামের সহজ সরল মানুষদের ধোঁকা দিয়ে গিয়ে দেখ সে দিব্যি সুখে আছে। এখন হয়তো বিয়ে করে বাচ্চার বাপ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তোর দিকে তাকিয়ে দেখ! তুই সেই খারাপ লোকটার জন্য এখনও অপেক্ষা করছিস। আর কত, আর কত বছর এভাবে থাকবি আহিবা? আমার বয়স হয়ে গিয়েছে। আমি আর পারছি না তোকে এভাবে দেখত। আহিবা মা আমার! তুই রাজি হয়ে যা। তোর বাবা একটা ভালো সমন্ধ নিয়ে য়ে এসেছে তোর জন্য। রাজি হয়ে যা মা! তোর এই অপেক্ষার প্রহর গুনতে দেখে আমার আর ভাল লাগছে না।

মায়ের কথাগুলো শুনে কিছু বললাম না। এটা মায়ের প্রতি দিনের কথা। দু’তলার ইফাজের এই ঘরটা আগের মতই রয়েছে। কিছুই পরিবর্তন করতে দেইনি আমি। ইফাজ চলে যাওয়ার সময় একটা সুতো পর্যন্ত নিয়ে যায়নি এখান থেকে। এখানে আমি বেশিরভাগ সময় থাকি। মন খারাপ হলে ইফাজেরর ব্যবহৃত বস্ত্রের ঘ্রাণ নেই, আর ভাবতে থাকি, আমার ইফু আশেপাশেই আছে। মাঝে মাঝে গান গাই বাদ্যযন্ত্র দিয়ে আবার মাঝে মাঝে বুকফাটা আর্তনাদ দিয়ে চিৎকার করে কান্না করতে থাকি। শত অভিমান অভিযোগ করে বসি ইফাজের কাছে,

– কেন ইফু! কেন আমাকে এভাবে একা ফেলে চলে গেলে তুমি! এই তোমার প্রতিশ্রুতি! তোমার ওয়াদা! সব ভুল ছিল। সব মিথ্যা ছিল। তুমি একটা মিথ্যাবাদী। আমাকে হাজারো স্বপ্ন দেখিয়ে দূরে চলে গিয়েছো। কোনদিনও ক্ষমা করব না তোমাকে।

– আহিবা খেতে আসো মা! খাবার টেবিলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
বাবার ডাকে নিচে চলে আসি খাওয়ার জন্য। বাবার সামনে বসে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ বাবা আমার হাত ধরে খাবার খাওয়া আটকে দিলেন। নিজেই ভাতের লোকমা বানিয়ে আমার মুখে পুরে দিতে দিতে বললেন,
– তুমি এখন অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছো। ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছো। আজ আমি তোমার কাছে কিছু চাইবো। আশা করি ফিরিয়ে দিবে না।

বাবার কথায় ভীতি দৃষ্টি প্রতিস্থাপন করলাম।

_ তোমার সব কথা শুনতে, মানতে রাজি আমি। কিন্তু আমার একটা অনুরোধ আছে। ইফাজকে ভুলতে বলিও না বাবা। দোহাই লাগে তোমার।

আমার কথা শুনে বাবা লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। পুনরায় ভাতের লোকমা আমার মুখে পুরে দিতে দিতে বললেন,

তুমি যখন ছোট ছিলে তখন ইফু সাথে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে। প্রথমে ব্যাপারটা আমি আর ইফাজের বাবা স্বাভাবিকভাবে নিলেও পরবর্তীতে আমরা ভালো করে দৃষ্টিপাত করি তোমাদের সম্পর্কে। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা আমি আর ইফাজের বাবা মিলে কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করার পর অবাক হয়ে যাই যে, তোমরা একে অপরের ছাড়া অচল ছিলে। তখনই তোমাদের মধ্যে আমি আমরা দৃঢ় বিশ্বাস দেখতে পেয়েছিলাম। আর দেখতে পেয়েছিলাম তোমার প্রতি ইফাজের ভালোলাগা, ভালোবাসা, যত্ন সবকিছু। তখনই আমি আর ইফাজের বাবা মিলে সিদ্ধান্ত নেই; বড়ো হলে তোমাদের দুজনকে বিয়ে দিবো। কিন্তু তার আগেই ইফুর পরিবার চলে গেল গ্রাম থেকে। কোন একটা কারণে।

বাবার কথার মাঝেই বাবাকে প্রশ্ন করলাম,

– আমি এখন পর্যন্ত জানতে পারলাম না বাবা, সে ছোটবেলায় ইফাজরা হুট করে গ্রাম ছাড়া কারণটা কি? আমি কি এখন বড়ো হইনি? আমাকে কি এখন বলা যাবে না?

– কেন বলা যাবে না! অবশ্যই বলা যাবে। তুমি আর এখন ছোট না অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছ। তোমাকে এখন সব কথাই বলতে পারব আমি।

বাবা একটু থেমে আবার বলা শুরু করলেন সেই ছোটবেলার ঘটনা,

– তুমি তখন ইফাজের সাথে খেলছি বুড়ো আর বুড়ি মার বাড়িতে। এদিকে ইফাজের বাবা আর আমি মাঠে কাজ করছিলাম। আমাদের কাজ করার মাঝেই রহিমার মা দৌঁড়ে এসে আমাদের উদ্দেশ্যে বলে,

– ইফুর বাবা! আরে ও ইফুর বাবা। আপনারা কই? এদিকে তো সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে! ইফুর ভা তো স
ঘরের ভিতর পর পুরুষ নিয়ে ঢুকেছে। এখনতো গ্রামের সবাই এক হয়ে গিয়েছে ইফুদের বাড়িতে।

সেদিন রহিমার মার কথা শুনে লাঙ্গল মাথার মাঠে ফেলে দৌঁড়ে চলে গিয়েছিলাম ইফাজের বাসায়। সেখানে যাওয়ার পর দৃশ্যমান হলো গ্রামের পঞ্চায়েতেরা উপস্থিত হয়েছেন সেখানে।

ইফাজের মায়ের দূর সম্পর্কের মামাতো ভাই এসেছিল বাড়িতে। আর তার সাথে ইফাজের মায়ের অবৈধ সম্পর্ক হয়। আর তা অনেক জনেই দেখে ফেলে দিনের কারণে। সেদিন তাৎক্ষণিক পঞ্চায়েতের রায় হয় যে ইফাজদের গ্রাম ত্যাগ করতে হবে আজীবনের জন্য। কখনো এখানে প্রবেশ করতে পারবে না।

গ্রামের পঞ্চায়েতের অনেক বুঝানোর পরও তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। সেদিন গ্রাম ছেড়ে পাড়ি জমান শহরের উদ্দেশ্যে।

– কিন্তু ইফাজ আমাকে বলেছিল যে, এটা তার সৎ মা। তাহলে শুধু সৎ মাকে গ্রাম ত্যাগ করতে বলতো! ইফাজ আর ইফাজের বাবাকে কেন বলল?

– ইফাজ ছিলো মায়ের ভক্ত। মাকে ছাড়া একরাত থাকলে অসুস্থ হয়ে যেত। এজন্য ইফুর বাবা বলিন যদি তার স্ত্রীকে যেতে হয় তাহলে পরিবারসহ যাবে। ইফাজের বাবা ভেবেছিলেন ভুল তো মানুষ একবার করে, বারবার না। এজন্য তিনি তার স্ত্রীকে আরেকটি সুযোগ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে সুযোগ দেওয়াতে তাদের গ্রাম ত্যাগ করতে হয়।

বাবার কথা শেষ হতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। কেন এত নিয়ম? কেন এত আইন? যে আইন আমাদের দুজনকে দূরে সরিয়ে রেখেছে! আমি মানি না আইন, ভঙ্গ করে ফেলব এই নিয়ম, কান্না কিছুটা থামিয়ে বাবার উদ্দেশ্যে বললাম,

– এবার কি হয়েছিল বাবা? এবার কেন ইফাজ আমার থেকে দূরে সরে গেল? এখানে আমাদের তো কোন দোষ ছিল না, কেন এমন হলো?

– এইবারের কথা আলাদা আহিবা! ইফাজ নিজে চায়নি তোকে সাথে রাখতে, তাই তোর এই দুর্দশা।

– কিন্তু আমি তো ইফাজকে ছাড়া ভালো নেই বাবা! যতই হোক, তিন কবুল বলে তার সাথে বিবাহ নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম। এ পবিত্র সম্পর্ক কীভাবে আমিও অস্বীকার করি? আমি পারব না বাবা ইফাজকে ছাড়া অন্য কাউকে স্বামী হিসেবে মানতে পারব না।

আমার কান্না মাখা চেহারা দেখে বাবা কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন। তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

– শহরে যাবি মা! ইফাজকে খুঁজতে? চল না এবার ঘরে বসে অপেক্ষার প্রহর না গুনে তোর প্রিয়জনের নিকটে অপেক্ষার প্রহর গুনবি?

বাবার কথায় প্রচন্ড অবাক হলাম।আবেগে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,

– সত্যিই বাবা, নিয়ে যাবে আমাকে? আমি তোমার কাছে আর জীবনে কিছুই চাইবো না বাবা। শুধু একবার আমার ইফাজের কাছে নিয়ে যাও! শুধু একবার বাবা।

চলবে চলবে….!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here