অপেক্ষিত প্রহর পর্ব -১৩

#অপেক্ষিত_প্রহর
#আফসানা_মিমি
|১৩তম পর্ব |

ভোর সকালে রেল স্টেশনে তেমন মানুষজনের আনাগোনা নেই। কয়েকজন ফেরিওয়ালাকে দেখা যাচ্ছে স্টেশনের বসার জন্য পেতে রাখা চেয়ারে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। বাবার হাত ধরে ছোট বাচ্চাদের মত এদিক সেদিক নজর ঘুরিয়ে পর্যবক্ষেণ করছি আমি। আমাদের মত এত সকালে দু’জন দম্পত্তিকে দেখলাম যারা হয়তো নতুন বিবাহ করেছে আর কোথাও ঘুরতে যাচ্ছে। দম্পত্তির মধ্যে ছেলেটা একটু পর পর কি যেন বলছে তাঁর বধূকে, প্রত্যুওরে বধূ শুধু মুচকি হাসি উপহার দিচ্ছে। নব দম্পতিদের দেখে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলাম। আজ যদি ভাগ্য আমাদের ঠিক থাকতো তাহলে আমরাও সুখী দম্পত্তি হতাম। কিন্তু আমার এই পুরা কপালে সুখ নেই।

– আম্মা, চলো ট্রেন এসে গিয়েছে।
বাবার কথায় ভাবনার জগত থেকে বের হয়ে আসলাম। বাবার হাত ধরে ট্রেনে উঠে বসলাম। এই প্রথম আমার ট্রেন ভ্রমণ। ট্রেন করে এক অচেনা শহরে যাচ্ছি আপনজনের খোঁজে। জানি না সেখানকার মানুষজন কেমন। আমি কি ঠিকঠাক সেখানে পৌঁছাতে পারব? ইফাজ কি আমায় মেনে নিবে? যদি মেনে না নেয়! যদি তাঁরভালোবাসার মানুষটিকে অস্বীকার করে! যদি বলে যে, তোমাকে আমি চিনি না, আর চিনলেও মেনে নিবো না? নাহ্ এমন করবে না আমার ইফাজ আমার সাথে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ইমাকে দেখা মাত্রই ইফাজ দৌঁড়ে চলে আসবে আমার কাছে। এসে বলবে, “এই হিবারিণী, এত দেরি করলে কেন আসতে? তোমার মত দেড়টা বছর অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। চলো না অদূরে কোথাও চলে যাই! যেথায় থাকবে না কোন আইন, কোন সংশয়।”

– আহিবা মা, চা পান করবি?

ট্রেনে চড়ে আবারও ইফাজের ভাবনায় বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম। বাবার ডাকে হুঁশ আসে।

– বাবা! তুমি কি ইফাজের বাড়ির ঠিকানা জানো?
আমার কথার প্রত্যুওরে বাবা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন,
– হ্যাঁ, চিনি। ইফাজ একবার আমাকে বলেছিলো।

বাবার সাথে আর কোন কথা বললাম না। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে মিনিট পাঁচেক হলো। কিছুক্ষণ আগেই ট্রেন থামতেই জনমানবশূন্য এলাকা যেন মানুষের গমগম। কোথায় থেকে যেন একে একে পুরুষ মহিলারা চলে আসেন হাতে পানি,জুসের বোতল নিয়ে। ট্রেন ছাড়তেই তাঁদের কাজ শেষ এবং তাঁরাও যে,যার কাজে চলে গিয়েছে। ট্রেন ছাড়তেই জানালা দিয়ে পেছনে স্টেশনে তাকালাম। ছোট- বড়ো বাচ্চারা, মহিলারা পরিত্যক্ত বোতল, কাগজগুলো কুড়িয়ে যাচ্ছে।
ট্রেন দ্রুত গতিতে চলছে। ট্রেনের গতির সাথে সবকিছু উল্টো মনে হচ্ছে। ইফাজের কথা খুব মনে পড়ছে। আমাদের গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে ট্রেনের লাইন আছে। যখন ট্রেন যায় তখন বাচ্চারা দৌঁড়ে এসে ট্রেনের ঝকঝক আওয়াজ শুনতে আসে। আমি আর ইফাজও চলে গিয়েছিলাম সেই রেল লাইনে। ইফাজের কথা মনে আসতেই ডুব দিলাম সেই দেড় বছর আগের দিনে,

শেষরাতে আমার দরজায় কড়াঘাতে ঘুম ছুটে গেল। ভয়ে শীতের মধ্যেও তরতর করে ঘামছি।আজকাল গ্রামে চোরের চলাচল হচ্ছে বেশি, যদি জানালার অপর প্রান্তে চোর হয়? আমাকে যদি এসে অপহরণ করে নিয়ে যায়?
আমার ভাবনার মাঝে আবারও জানালায় আওয়াজ হলো। কেউ যেন ফিসফিসি করে বলছে,

– এই হিবারানী, ট্রেন দেখতে যাবে? আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো বউ?

ইফাজের কথা শুনে তড়িৎ গতিতে ঘরের জানালা খুলে দিলাম। কনকনে শীতে চাদর মোড়ানো ইফাজকে দেখে ভড়কে গেলাম। চিন্তিত কণ্ঠস্বরে ইফাজের উদ্দেশ্য বললাম,

– আপনি ঠিক আছেন তো? বাসায় চোর ডাকাত কি আক্রমণ করেছে? আমাকে কি এখন অপহরণ করে নিয়ে চলে যাবে? এই আপনি আমাকে বাঁচাবেন না! আপনি এভাবে চোরের মত এসেছেন কেন? আমরা কি এখন পালাবো? আপনার সাথে কি আমাকে শহরে নিয়ে যাবেন?

আমার কথা শুনেই ইফাজ কপাল চাপড়াল। আমার উদ্দেশ্যে শক্ত কন্ঠস্বরে বলল,

– আগে নিজের দিকে তাকাও,গায়ে ওড়না পরে আসো।

ইফাজের কথা শোনে তড়িৎ গতিতে নিজের দিকে তাকালাম। তাড়াহুড়োর জন্য দৌঁড়ে উড়না ফেলে চলে এসেছিলাম। গায়ে ওড়না জড়িয়ে আবারও জানালার পাশে ইফাজের এসে বললাম,

– বদ শিল্পীর সাথে সাথে আপনার নজরও বদ তা আপনি জানেন? এভাবে কেউ কাউকে বলে নাকি?

– তো কিভাবে বলব ম্যাডাম? যতই হোক আমি তো আপনার স্বামী। নজর তো একটু এদিক সেদিক যাবেই।

– হয়েছে আপনার! আর এসব কথা বলতে হবে না। এবার বলুন, এই রাতে কেন এসেছেন এখানে? কোনো মতলব নিয়ে আসেনি তো!

– একটা মাইর দেবো পঁচা মেয়ে! সারাক্ষণ শুধু আমাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা চিন্তা ভাবনা। বলছি যে এখন সাড়ে তিনটা বাজে, চারটার ট্রেন দেখবে আমার সাথে? শীতের সকালের ট্রেন দেখার মজাই আলাদা। চলো না! ছোটবেলার মতো সেই জায়গায় গিয়ে ট্রেন দেখে আসি!

ইফাজেরর কথা শুনে আমি এত খুশি হলাম যে খুশিতে চিল্লায় উঠলাম,

– সত্যিই ইফু! আমাকে সেখানে নিয়ে যাবেন? আহ আমার যে কি যে আনন্দ লাগছে!

– আস্তেআমার হিরারাণী! শ্বশুর-শাশুড়ির যদি শুনে ফেলে তাহলে তোমারও যাওয়া হবেনা সাথে আমারও।

– আচ্ছা, আমি বাড়ি থেকে বের হচ্ছি। আপনি ঐ কাঁঠাল গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ান।

সদর দরজা খুবই আস্তে করে খুলে বেরিয়ে পড়লাম। ইফাজের হাতে হাত রেখে চললাম ট্রেন দেখবো বলে।

যথাস্থানে এসে আমি আর ইফাজ বসে পড়লাম। ইফাজ আর আমি এক চাদরের নিচে বসে আছি। ইফাজ আমাকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। একে তো কনকনে শীত আমার এখন একদম কাপাকাপির মত অবস্থা! আর ইফাজ সে তো দিব্যি ঠিক আছে। যেন তার শরীরে শীত ছুঁয়েই দিচ্ছে না।

– এই ইফু, শীত করে না?

– কাছে যদি এমন সুন্দরী বউ থাকে! তাহলে কার শীত করবে বলো!

– আবারো পঁচা কথা বলছেন? আমি কিন্তু এবার চলে যাবো।

– কোথায় যাবে সুন্দরী! যেখানেই যাও ইফাজের কাছে তোমার চলে আসতে হবে। যদি কখনো ইফাজ তোমাকে ছেড়ে চলে যায় তোমারই আসতে হবে ইফাজকে খুঁজতে।

– আপনি চলে যাবেন কেন? আপনি কখনো আমাকে ছেড়ে চলে যাবেন না। আমার দীর্ঘ বিশ্বাস, আপনি সবসময় আমাকে এভাবে আগলে রাখবে।

– আমি আমার প্রিয়লতাকে এভাবেই সব সময় আগলে রাখবো। আর অনেক ভালোবাসবো।

ঝকঝক করে ট্রেন চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল। আমি আর ইফাজ আজ সেই ছোটবেলার মতো একদম শেষ প্রান্তে যতটুক পর্যন্ত ট্রেন দেখা যায় ততটুকু পর্যন্তই তাকিয়েছিলাম। ট্রেন চলে যেতেই ইফাজ আমাকে বলল,

– খেজুরের রস খাবে?

– হ্যাঁ খাবো। বুড়োর গাছ থেকে কিন্তু খাওয়াতে হবে!

– কিন্তু বুড়ো তো এখন জীবিত নেই। গাছে রস বাঁধে কে,

– আরে লিলি বুড়িমা আছে না! লোকদের দিয়ে বাঁধায় চলুন আমার সাথে, আজ লিলি বুড়ি মার অন্য ধ্বংস করতে যাব।

—————

অতীতের কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছিলাম নিজেই জানি না। বাবার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে আমার।

– বাবা এসে পড়েছি কি আমরা?

– না মা! এখনো আসিনি। চলো ষ্টেশনে চশে এসেছি। এখান থেকে বাস করে আমরা ইফাজের বাড়ির কাছে চলে যাবো।

ব্যাগ পত্র নিয়ে বাবার পিছুপিছু ট্রেন থেকে নামলাম। শহরে পা রাখতেই লম্বা নিঃশ্বাস নিলাম। এখানে আমার ইফাজের অবস্থান। এখানেই আমি আমার ইফাজকে পাবো। এই শহরেই আমার ঠিকানা হবে কোন এক সময়। বাবার সাথে হালকা পাতলা কিছু নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম ইফাজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

——-
এদিকে ইফাজ অন্ধকার একটি রুমে হাঁটুর উপর মুখ গুঁজে চুপ করে বসে আছে। বাইরে থেকে সৎ মা কি যেন বলে যাচ্ছে কিন্তু তা ইফাজের কানে প্রবেশ করছে না। ইফাজ চিন্তা তার হিবারাণীর কথা,

– কীভাবে পারলাম আমি! আমার হিবারাণীকে এভাবে একা ফেলে চলে আসতে! দেড় বৎসর হিবারাণীর কাছ থেকে এতটা দূরে চলে আসলাম। যাদের জন্য হিবারাঢীকে ফেলে চলে এসেছিলাম, আজ তাদের দিকে তাকাতেই ঘেন্না হয়। ভাবতেও লজ্জা লাগে যে তার পিতা-মাতা।

বিড়বিড় করে বলছে ইফাজ

– কোথায় গেলে পাবো আমার হিবারাণীকে! কোথায় পাবো আমার হিবারাণী স্পর্শ! কীভাবে মিটাবো হিবারাণীকে দেখার তৃষ্ণা! আমি কি আদৌ পারব হিফারাঢীর কাছে পৌঁছাতে? হে আল্লাহ! কোন একটা পথ দেখিয়ে দাও যেন হিবারাণী আমার কাছে চলে আসে, বা আমি যেন হিবারাণীর কাছে চলে যেতে পারি!

– এই ইফাজ বের হো রুম থেকে! কানিজ এসেছে তোর সাথে দেখা করতে! আজ তোর কোন বাহানা আমি শুনবো না। কানিজকে নিয়ে শপিং করতে নিয়ে যেতে হবে। মেয়েটা তুই বলতে পাগল। আর তুই কিনা সেই গাইয়া মেয়েটার জন্য কানিজকে পাত্তা দিচ্ছিস না! বের হো ঘর থেকে। তুই যদি এখন রুম থেকে বের না হোস তাহলে কিন্তু তোর বাবা,,,,,

ইফাজ তার সৎ মাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বের হয়ে আসে রুম থেকে, একদম পরিপাটি হয়ে। ইফাজ জানে ইফাজের মা খুবই ভয়ঙ্কর মহিলা। যে না কি তাঁর স্বামীকে খুন করার জন্য চেষ্টা করতে পারে সেই মহিলা সবকিছু করতে পারে। ইফাজ চায়না বাবার আর কোন ক্ষতি হোক।

ইফাজের সৎ মা বা কানিজকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। এদিকে কানিজ ইফাজের পাছনে ঠকঠক করে ইফাজ ইফাজ বলতে বলতে বের হয় বাড়ি থেকে।

বিকেল চারটা বাজে। আমি আর বাবা এইমাত্র বিশাল বড় একটা অট্টালিকার সামনে এসে দাঁড়ালাম। রিকশা ভাড়া মিটিয়ে বাবা আমার হাত ধরে এগিয়ে গেলেন সে বাড়ির দিকে। বাড়ির গেটের কাছে আসতেই দারোয়ান আমাদের পথ অবরোধ করে দাঁড়ায়,

– কে আপনারা? কাকে চান?
দারোয়ান চাচার কথা শুনে বাবা মুচকি হেসে বললেন,

আমি ইসহাক আহিবার বাবা। আপনার মালিক কে কষ্ট করে একটু খবর দিবেন যে তার পুরনো বন্ধু ইসহাক এবং তার মেয়ে দেখা করতে এসেছেন?

বাবার কথা শেষ হতেই দারোয়ান চাচা আনন্দিত বোধ করেন। আমাদের উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করেন,

– আপনি সেই ইসহাক। আর তুমি কি আহিবা! আমাদের ছোট বাবুর বউ? আপনি জানেন চাচা বড়ো বাবু তো সবসময় আপনার গল্প করতেন আর বলতেন যে আমি আহিবাকে আমার ব্যাটার বউ করব। আর ছোট বাবু তো আমার সাথে কত গল্প করেছেন! তুমি আর ইফাজ ছোটবেলায় কি করতে সবকিছু বলতো আমার সাথে।
এসো এসো তোমরা ভেতরে আসো তোমাদের ক্ষেত্রে কোন অনুমতির দরকার নেই।

দারোয়ান চাচার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। প্রথম ধাপেই যে এমন একটা ধাক্কা খাব তা ভাবতে পারিনি। তার মানে ইফাজকে আমি এখানেই পাবো। ইফাজের কথা স্মরণ হতেই আমার হৃদপিণ্ড জোরে জোরে আওয়াজ করতে লাগলো। কতকাল পর ইফাজকে দেখতে পাবো আজ! আমাকে দেখে কেমন করবে ইফাজ? অবাক হয়ে থমকে দাঁড়াবে! নাকি দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে,
ভালোবাসি আমার প্রিয়লতা, খুব বেশি ভালোবাসি।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here