অপ্রিয় প্রেয়সীর ভালোবাসা পর্ব -০৫

#অপ্রিয়_প্রেয়সীর_ভালোবাসা –[৫]
#মুনিয়া_মিরাতুল_নিহা
____________________

বাষ্পরাশিরা অন্তরিক্ষ জুড়ে আনাগোনা করছে কিয়ৎক্ষন যাবত! যেনো দৃষ্টির পলক ফেললেই ঝুমঝুমিয়ে মেঘ কনা বৃষ্টিতে রুপান্তরিত হয়ে ধরনীতে আছড়ে পড়বে! ঝিড়িঝিড়ি হাওয়ার বেগ বাড়ছে প্রবলভাবে।গাছের পাতাগুলো প্রচন্ড বাতাসের কারনে মৃদু কেঁপে ওঠছে! খোলা বাতাসে নিজের আপনমনে উড়ে চলেছে কেশগুলো। স্নিগ্ধ শান্ত কোমল প্রকৃতি যেনো গুরু গম্ভীর ভাবে সেজে নিয়েছে নিজেকে। কালো রঙের আধারে আবৃত করে রেখেছো গোটা অন্তরিক্ষ! আকাশ জুড়ে বাষ্পরাশি আর বি’দ্যুৎ চমকানোর আওয়াজে খোলা গগনের নিচে থাকাটা নিজেদেরকে নিরাপদ বলে মনে করলো না। হাঁটা ধরলো আশ্রয়স্থলে কিন্তু দূর দূরান্ত অব্দি কেবল গ্রামের আঁকাবাকা রাস্তা আর সামনে ফসলের ক্ষেতই কেবল ধরা দিলো দৃষ্টিতে! বাধ্য হয়ে গাছের নিচে আশ্রয় নিবে হাঁটা ধরলো! কিন্তু গুরু গম্ভীর প্রকৃতিও যেনো বলে দিচ্ছে আজ দু’জন ব্যাক্তিতে তাদের সঙ্গে বৃষ্টির সাজে সাজতে হবে। ঝুমঝুমিয়ে শুরু হয়ে গেলো বৃষ্টি। হিম শীতল হয়ে গেলো সারা সর্বাঙ্গ! আচমকাই বৃষ্টির ফোটার হিমশীতল স্পর্শ কাপুনি ধরিয়ে দিলো গায়ে। কাক ভেজা হয়ে গেলো তানহা আর আয়মান। বে’কুবের মতনই সেই অর্ধ রাস্তাই দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগলো দু’জনে। বৃষ্টির একেক টা ফোটা শরীরে পড়তেই অদ্ভুত শিহরন বয়ে যায় যেনো। আয়মান বৃষ্টিতে ভেজা পছন্দ করে না বিধায় সে পৌঁছে গেলো সেই গাছের নিচে।

সেইখান থেকেই দেখতে লাগলো তানহাকে যে এখনো সেই রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজের হাত দু’টো খোলা প্রকৃতিতে ছেড়ে দিয়ে নিজের আপনমনে বৃষ্টি বিলাশ করে চলেছে। অন্য কেউ যে তার দিকে তাকিয়ে আছে সেদিকে বোধহয় কোনোরূপ উৎকন্ঠা নেই তার! আয়মান বিমোহিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার প্রেয়সীর দিকে! উঁহু প্রেয়সীও নয় ঠিক সে হচ্ছে #অপ্রিয়_প্রেয়সী! যেই প্রেয়সী প্রিয় হতে গিয়েও সময়ের ব্যাবধানে আজকে #অপ্রিয়_প্রেয়সী হয়ে গিয়েছে।
আয়মানের সজল দৃষ্টি গিয়ে নিক্ষেপ হলো রাস্তার ওদিক থেকে কয়েকটি মধ্যবয়স্ক লোকের দিকে। বোধহয় ক্ষেতেই কাজ করছিলো হঠাৎ বৃষ্টি আসায় নীড়ে ফিরছে! আর সেই একই রাস্তায় তানহাও চুপচাপ ভাবে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিকে সাদরে নিজের গায়ে মেখে নিচ্ছে, তার পিছনে যে মানুষ আসছে সেই খেয়াল বোধহয় নেই তার। আয়মান তানহার দিকে চোখ বোলালো এই কাক ভেজা শরীরে অন্য কোনো পুরুষ যে তানহার দিকে বেশ ভালো নজরে তাকাবে সেটা নিশ্চয়ই না? তৎক্ষনাৎ কাল বিলম্ব না করে রাস্তার পাশ থেকে তানহার হাত ধরে টে’নে নিয়ে সেই গাছের নিচে গিয়ে হেঁচকা টা’নে তানহাকে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে নিলো!
লোকগুলো আঁড়চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে নিজেদের গন্তব্য চলে গেলো। আয়মানের বুকের মধ্যে মিশে আছে তানহা! এতোটা কাছের প্রথম স্পর্শ তানহাকে। এক অদ্ভুত অনূভুতির সম্মুখীন হচ্ছে তানহা আয়মানের স্পর্শ পেয়ে। মনে হচ্ছে এই খানেই স্তব্ধ হউক সময় কেটে যাক বেলা!
লোকগুলো চলে যেতেই তানহাকে নিজের বুক থেকে সড়ালো।

-‘ স্যরি। ওই লোকগুলোকে তুমি দেখতে পাওনি আর এই ভেজা অবস্থায় দেখলে নিশ্চয়ই তোমার দিকে খুব ভালো ভাবে তাকাতো না বলো? ‘

মনের মধ্যে দু’ষ্টু বুদ্ধির উদয় হলো। উনাকে জ্বা’লা’তে পাল্টা প্রশ্র করলাম।

-‘ আমার দিকে তাকালে আপনার কি? আমি তো আর আপনার প্রেয়সী না বলুন?’

-‘ প্রেয়সী নয়! তুমি আমার #অপ্রিয়_প্রেয়সী। যে প্রেয়সী প্রিয় হতে গিয়েও অপ্রিয় হয়ে গেছে!’

আয়মানের কথা কর্নকুহুরে বিচরন করা মাত্রই ঠোঁটের কোনে লেগে থাকা মুচকি হাসি আমার নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো! তৎক্ষনাৎ অনুশোচনায় দগ্ধ হতে লাগলাম। সত্যিই তো আমি তো উনার #অপ্রিয়_প্রেয়সীই বটে! প্রিয় ছিলাম যেটা নিজের হাতেই নষ্ট করেছি আমি।

-‘ পাঁচ মিনিট ওয়েট করো। এই গাছের নিচেই থাকবে ভুলেও রাস্তায় আসবে না।’

আয়মান আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে রাস্তায় ছুট লাগালো! আমি বুঝতে পারলাম না এইভাবে বৃষ্টির ভেতর দিয়ে উনার ছুটার কারন। দৃষ্টিখানি বড়ো করে দেখলাম উনি দৌড়ে গিয়ে কোথায় যাচ্ছে? গাছপালার ভিড়ে আর বোধগম্য হলো না উনি ঠিক কোথায় গেলো? তবে বড়ো রাস্তার দিকেই এগোলেন। বৃষ্টি ঝুমঝুমিয়ে পড়ছে বিধায় লোকজন কেউ বাহিরে নেই একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে নতুবা লোকজন আমাকে এই ভেজা অবস্থায় দেখলে সেটা ভালো হতো না। আমার এই সাত পাঁচ ভাবার মধ্যে দিয়েই আয়মান এসে হাজির হলো আমার সামনে!
হাঁপাতে লাগলো। বোঝাই যাচ্ছে এই বৃষ্টির মধ্যে গ্রামের পিছলা রাস্তায় দৌড়েছেন সেটা ঠিক কতোটা কষ্টকর!

-‘ এই আপনার কি নিজের জন্য কোনো যত্ন নেই নাকি? এই বৃষ্টির ভেতর আপনি যে দৌড় লাগালেন যদি পিছলে পড়ে যেতেন?’

-‘ পড়তাম না বড়ো রাস্তার দিকে বেশি পিছলা নেই। এই নাও এটা পড়ে নাও শরীর যে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। এভাবে এতোখানি রাস্তা পার করে বাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়। ‘

এতোক্ষণ খেয়াল না করলেও এবার বেশ ভালো করেই দেখলাম উনার হাথে একটা পলিথিন আছে।

-‘ এই পলিথিনে করে কি এনেছেন? আর কি পড়বো আমি? আমি তো জামাকাপড় পড়েই আছি। আর আপনি কোথায় গেলেন?’

-‘ উফফ! বা’জে ব’কা বন্ধ করবে তুমি! হ্যাঁ তুমি জামাকাপড় পড়েছো তো সাদা থ্রিপিসের ভেতর যে লাল আছে সেটা তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে নাকি! বৃষ্টিতে ভিজে তো শরীরে জামাকাপড় একেবারে লেপ্টে আছে! তাই তোমার লাল, সাদা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। আর কোনো প্রশ্ন?

আয়মানের কথা শেষ হতেই লজ্জায় মনে হচ্ছে “হে মাটি তুমি ফাঁক হও তো আমি পা’তালে চলে যাই”🙂
ভাবা যায় এতোটা লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে আমাকে? এখন মনে হচ্ছে কোন দুঃখে বৃষ্টিতে ভিজতে গেলাম! আর আমারই বা কি দোষ এই বৃষ্টিই তো হুড়মুড়িয়ে চলে আসলো। এবার বেশ ভালো ভাবেই বুঝছি আয়মান কেনো ওই লোকগুলোকে দেখে আমাকে ওভাবে ধরেছিলেন।

-‘ লজ্জাবতী লতা না হয়ে লজ্জা নিবারন করে এই প্যাকেট টা হাতে নাও। ওই দোকান থেকে কষ্টে একটা বোরখা আর হিজাব এনেছি তোমার জন্য। ‘

উনার কথা শেষ হতে না দিয়ে আমি পাল্টা কথা বললাম।

-‘ আমাকে বলে যেতেই পারতেন। আমি তো আপনার জন্য চিন্তা করছিলাম নাকি বলুন? ‘

-‘ অতো চিন্তা করতে হবে না। আমার উল্টোদিক ফিরে বোরখাটা পড়ে নাও বৃষ্টি কমে আসছে বাড়িতে যেতে হবে।’

উনার কথা মতন বোরখাটা পড়ে নিলাম হিজাবটাও পড়ে নিলাম বেশ বড়ো করে। কাপড়গুলো ভেজা কিন্তু বোরখাটা ভারী হওয়ায় তেমন একটা বোঝা যাচ্ছে না তার উপর হিজাব তো পড়েইছি। এবার হাঁটা ধরলাম বাড়ির উদ্দেশ্য, কিছুদূর এগিয়ে অটোতে ওঠলাম।
_______________________

আমি শুকনো জামা পড়েছি কিন্তু আয়মান সেই ভেজা শার্ট আর প্যান্ট পড়েই ছিলো যার দরুন বেচারা সন্ধ্যা থেকে রুমে এসে ঠান্ডায় হাঁ’চি দিচ্ছে বারবার! রাত্রে খাবার খেয়েই উনি রুমে এসে শুয়ে পড়েছেন তড়িঘড়ি করে বোধহয় শরীরটা ভালো যাচ্ছে না! দোষ তো আমরই আমি উনাকে ঘুরতে নিয়ে গেছিলাম, কিন্তু এখন এগুলো ভাবলে চলবে না উনার খেয়াল রাখতে হবে।

-‘ ওষুধগুলো খেয়ে নিন আশা করি আপনার ঠান্ডাটা একটু কমবে। ‘

-‘ আচ্ছা তানহা মিরা তো তোমার নিজের আপন ছোটো বোন ওর নির্জনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো তিন বছর আর তুমি কিচ্ছু টের পাও নি একবারো?’

-‘ টের পায়নি বললে ভুল হবে। ও বলেছিলো সঠিক সময় আসলে বলবে কিন্তু ও যে এরকম একটা কান্ড করবে কে জানতো বলুন?’

-‘ ওর কান্ডের ফলেই আমরা আজ এখানে। নিয়তির খেলা দেখলে? যে তুমি আমাকে চাইতে না, আমাকে দেখে বিরক্ত হতে, দূরে ধুরে থাকতে সেই আমার সঙ্গেই এখন তোমাকে থাকতে হবে তা-ও কিনা সারাজীবন যদি তুমি চাও? ‘

-‘ হ্যাঁ আমি চাই থাকতে! বিয়েটা ছেলেখেলা নয় যে খেলা খেলবো। পবিত্র বন্ধনে যখন আবদ্ধ হয়েছি তখন সেটার মর্যাদা আমি রাখবো।’

আয়মানে দৃষ্টি তুখোড় হলো। তার অবচেতন মন কেবল একই প্রশ্ন বেজে চলেছে তাদের অতীত কি সুখে থাকতে দিবে আদৌ কাউকে? নাকি অতীতের ছাপ বর্তমানেও পড়বে? ভাবতে লাগলো সেই কালো অতীত যেখানে তাদের দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেছিলো।

#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here