অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো পর্ব-১১+১২

#অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো
#পর্ব-১১
দুজনের সম্পর্ক এভাবেই চলছিল। কখনো ঝগড়া শুরু হতে হতে থেমে যায় আবার কখনো বা ভালো কথা বলতে বলতে ঝগড়া লেগে যায়। দুজন দুজন কে একটু একটু করে চিনতে লাগলো। শিশির পড়াশোনা ছাড়া বাকী সব কিছুতেই ভালো। চমৎকার গিটার বাজায়। গানের গলা দুর্দান্ত না হলেও যা গায় শুনতে ভালোই লাগে। চমৎকার বিরিয়ানি বানাতেও পারে। বিন্তী বিরিয়ানি খেয়ে বলেছিল,

“যেকোনো মেয়েই এই বিরিয়ানি খেয়ে পটে যাবে শিশির। ”

শিশির ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“তারমানে তুমি পটে গেছো? ”

“তুমি কী আমাকে পটাতে চাইছ?”

“একদম না। তুমি বললে যেকোনো মেয়ে! তাই জিজ্ঞেস করলাম। ”

বিন্তী হাসলো। যতটা খারাপ ও শিশির কে ভেবেছে ততটা খারাপ ও না। রাতে দুজন এক বিছানায় ঘুমালেও শিশির কখনো ওর লিমিট ক্রস করেনি। বড় বিছানা হবার দরুন দুজন দুই প্রান্তে ঘুমালেও শিশির কখনো কোনো ছুতোয়ও ওর কাছে আসার চেষ্টা করে নি। রাত জাগার অভ্যাস থাকলেও বিন্তী ঘুমিয়ে থাকলে কখনো ও’কে ডিসটার্ব করে নি। এমনকি গোসলের সময় বেশী সময় ধরে বিন্তী ওয়াশরুমে থাকলেও কিছু বলে নি। খিটিমিটি যা লাগে সেটা অন্য বিষয়ে। একটা সময় পর বিন্তীর মনে হলো ও হয়তো সব কিছুতে বেশী রিয়েক্ট করে ফেলে বলেই ঝগড়া লেগে যায়।

***
শিশিরেরও মনে হলো বিন্তী মেয়েটা খুব একটা খারাপ না। ভীষণ ই বুদ্ধিমতি মেয়ে। একটু জেদি আর মুখ বেশী চলে এই যা দোষ। বাড়িতে সবার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে অল্পতেই। বিন্তীও ওর পরিবারের মানুষগুলোর মতোই মিশুক। মাঝেমধ্যে ও বাড়িতে দেরি করে ফিরলে বিন্তী জেগে থাকে। ঠান্ডা খাবার টা গরম করে দেয়। খাওয়ার সময় বসেও থাকে। এটুকু ও’কে যে কেউ করতে বলেছে এমন না, তবুও করে। শিশির প্রথম প্রথম ভাব করতো যে ও বিরক্ত হচ্ছে কিন্তু মনে মনে ঠিক ই ভালো লাগতো। এই একই ব্যাপার বাড়ির অন্যদের ক্ষেত্রেও। তুষার, শিশিরের বাবা তাদের জন্যও করে। শিশিরের ভালো লাগে। বিন্তীর সঙ্গে ঝগড়াঝাটির পরিমাণও এখন কম। মেয়েটা’কে এমনিতে দেখলে বোঝা যায় না মনের মধ্যে কী চলছে কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হয় ওর অনেক কষ্ট।

একদিন বারান্দায় বসে সবাই আড্ডা মারছিলো। তুষার, বিন্তী, মা আর ও। শিশির তখন গিটার বাজিয়ে দুটো গান গেয়েছিল। সেই রাতে বিন্তী শিশির কে বলল,

“শিশির তুমি খুব ভালো গান গাও।”

“থ্যাংক ইউ। আমাকে কেউ কোনো ব্যপারে ভালো বললে আমি খুব খুশি হই। মিথ্যে করে বললেও খুশি হই। ”

বিন্তী হেসে বলল,

“মিথ্যে করে বলছি না। ”

“তোমার কথা বলছি না। অন্যদের কথা বলছি। পড়াশোনায় ডাব্বা মারতাম তো তাই সবাই বলতো অকর্মার ঢেকি। দুই একটা ব্যাপারে কেউ ভালো বললে আনন্দ পাই। ”

বিন্তী উদাস গলায় বলল,

“জানো শিশির, একটা সময় পর আমারও পড়াশোনা ভাল্লাগতো না। বছরের পর বছর ফার্স্ট, সেকেন্ড হওয়া কেমন যেন ডালভাতের মতো লাগতো। মনে হতো একই জিনিস আর কতোই বা ভালো লাগে!”

“তারপর? ”

“ভালো না লাগলেও করতে হয়। নিজের জন্য না হলেও অন্যদের জন্য করতে হয়। বাবা, মা আশা নিয়ে থাকেন!”

“আমি আবার অতো ভালো হতে পারব না। আমি নিজের থিউরিতে বিশ্বাসী। একটা জীবন আমার। যা ভালো লাগবে করব, না লাগলে করব না। কারোর জন্য কোনো কিছু সেক্রিফাইজ করতে পারব না। ”

বিন্তী হেসে ফেলল শিশিরের বলার ধরন দেখে। বলল,

“লাইফে ওরকম সিচুয়েশন আসে নি তো তাই অমন বলছ। ”

“সিচুয়েশন এলেও পারব না। ”

“ধরো তুমি কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসলে। সে যদি তোমাকে পাল্টাতে চায়। তাহলেও নিজেকে পাল্টাবে না। ”

শিশির খানিকক্ষন ভেবে বলল,

“সত্যিকারের ভালোবাসার মধ্যে পাল্টাপাল্টি ব্যাপার টা কেন থাকবে! আমি যেমন সেটা জেনে কেউ যদি আমাকে ভালোবাসে তাহলে সেটাই তো সত্যিকারের ভালোবাসা হওয়া উচিত। মিথ্যেকারের ভালোবাসায় পাল্টাপাল্টি ব্যাপার টা থাকে। ”

বিন্তী হেসে বলল, দারুণ একটা কথা বললে। আসলেই তো, সত্যিকারের ভালোবাসা তো স্বার্থহীনই হওয়া উচিত।

শিশির হঠাৎ প্রশ্ন করলো,

“তুমি কী তোমার প্রেমিক কে সত্যিকারের ভালোবাসতে?”

বিন্তী একটু অপ্রস্তুত হলো। শিশির সেটা খেয়াল করে বলল,

“সরি। আমার এই প্রশ্ন টা করা উচিত হয় নি। ”

“ইটস ওকে। আমি আসলে বুঝতে পারি না। আদৌ ভালোবাসা ব্যাপার টা ছিলো কী না সেটাও বুঝতে পারি না। ”

“তোমার কী তার কথা মনে পড়ে?”

বিন্তী শিশিরের চোখের দিকে তাকালো। শিশির চেষ্টা করলো চোখের ভাষা পড়বার। বিন্তী মৃদু হেসে বলল,

“যদি বলি মনে পড়ে না তাহলে সেটা মিথ্যে বলা হবে। আর যদি বলি সারাক্ষন মনে করে চোখের জলে নাকের জলে করি তাহলে সেটাও মিথ্যে হবে। ”

শিশির হেসে ফেলল। বিন্তীও হাসলো। কেন যেন বিন্তীর সেই হাসিতে শিশির চাপা একটা কষ্ট দেখলো।

***
কিছুদিন পরের ঘটনা। শিশিরের বন্ধুর বোনের বিয়েতে শিশির আর তুষার গেল। পুরান ঢাকার তিনদিন ব্যাপী বিয়ের আয়োজন তাই ওরা আগেভাগেই গেল। শিরিন বলেছিল বিন্তীকে নিয়ে যেতে। বিন্তী রাজী হয় নি। রাজী না হওয়ায় শিশির অবশ্য খুশি হলো। বন্ধুরা কম বেশী ওর বিয়ের ব্যাপার টা জানে। বিন্তীর সঙ্গে আলাপ করার জন্য সবাই মুখিয়ে থাকলেও শিশির একটু এড়িয়ে যায়। তার অবশ্য অন্য কারণ আছে। বন্ধুমহলে শিশির অপদার্থ হিসেবে বেশী পরিচিত। সেখানে বিন্তীকে দেখলে সবার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে। এই ভয়েও শিশির কাউকে আনতে চায় না।

শিশিরের বন্ধুর বিয়েতে বিশাল আয়োজন। শুধু গায়ে হলুদেই শ’তিনেক লোক এলো। বড় রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার দাবার আনানো হলো। জম্পেশ আয়োজন। গায়ে হলুদের পরদিন হলো সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। সেখানে টাকার শ্রাদ্ধ করা হলো। বেশী টাকা থাকলে যা হয় আর কী! পুরো পরিবার মেয়ের বিয়েতে হইহই করে নাচতে লাগলো। কেউ বাদ গেল না। শিশির, তুষার দুজনেই খুব আনন্দে কাটাতে লাগলো। বিয়ের দিন কনে হাজার হাজার টাকা দিয়ে সেজেগুজে, লাখ লাখ টাকার গয়নাগাটি পরে কমিউনিটি সেন্টারে পৌছানোর পর খবর এলো যে বর এক্সিডেন্ট করেছে। খুব খারাপ অবস্থা, আইসিও তে আছে। আলো ঝলমলে আনন্দের বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এলো। যে মেয়েটা কাল মেহেদী পরে হইহই করে সবার সঙ্গে নেচেছিল সেই মেয়েটার মুখে এখন শোকের ছায়া। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে একমাত্র মেয়ের বিয়ের আয়োজন করেছিল সেই আয়োজনে ভাটা পড়ে গেল এক মুহুর্তে। শিশিরের বন্ধুর মা’কে দেখে ওর বিন্তীর মায়ের মুখ টা মনে পড়ে গেল। বিয়ের দিনে সেই মহিলাও অসুস্থ ছিলো। দুটো ঘটনা আলাদা হলেও কোথাও গিয়ে যেন একই।

সারাদিন শিশির এসব ভাবলো। মেয়েটার বিয়ে আর হয় নি। আইসিও তে বর মারা গেছে। তখন মাঝরাত। শিশির ওর বন্ধুর সঙ্গে ছিলো। বাইরে আসতেই বন্ধুটি ও’কে জড়িয়ে ধরে বলল,

“আমার বোন টার অবস্থা দেখ শিশির। গায়ে একটা অপয়া তকমা লাগলো। ”

বন্ধুর সেই কষ্টকে ছাপিয়ে গেল বিন্তীর সেদিনের ঘটনা। দুটো ঘটনা আলাদা তবুও কতো মিল! শিশির সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় এলোমেলো কিছুক্ষণ হাটলো। হেটে ক্লান্ত হয়ে ফুটপাতে বসে পড়লো। পকেট থেকে মোবাইল টা বের করে বিন্তীকে ফোন করলো। এই তিন দিনে বিন্তীর সঙ্গে একবারও কথা হয় নি। বিন্তী ফোন টা তুলল না। শিশির আরও দু’বার ফোন করে বাদ দিলো। বিন্তী হয়তো ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমিয়েছে।

শিশির ফোন টা হাতে নিয়ে বিন্তীর বাবাকে ফোন করলো। এতো রাতে শিশিরের ফোন পেয়ে বিন্তীর বাবা অবাক হলো। আতঙ্কিত গলায় বলল,

“কী হয়েছে বাবা? বিন্তীর কিছু হয়েছে?”

“বিন্তী খুব ভালো আছে। ও ঘুমাচ্ছে। আপনি একটু মা’কে ফোন টা দিবেন?”

ভদ্রলোক হকচকিয়ে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,

“একটু অপেক্ষা করো। ”

বিন্তীর মা আরও দ্বিগুন আতঙ্কিত গলায় বলল,

“বাবা সব ঠিক আছে তো?”

শিশির খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বলল,

“মা আপনি বিন্তীকে নিয়ে টেনশন করে একদম শরীর খারাপ করবেন না। বিন্তী খুব ভালো থাকবে। ওর কোনো অসুবিধা হবে না। ”

ফোনের ওপাশে পিনপতন নীরবতা। বিন্তীর মা নিশ্চয়ই খুব বিস্মিত হয়েছেন। শিশির বলল,

“আপনি বলেছিলেন না, বিন্তীকে দেখতে! আমি দেখব। আপনি চিন্তা করবেন না। ”
#অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো
#পর্ব-১২
শিশির বাড়ি ফিরে এলো সেই রাতেই। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত চেহারা দেখে বিন্তী বলল,

“তোমার কী হইছে?”

শিশির সেকথার জবাব না দিয়ে বলল,

“তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন?”

বিন্তী ভারী অবাক হলো। শিশির কেমন অন্যরকম গলায় কথায় বলছে। বিন্তী বলল,

“আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম। ফোন সাইলেন্ট ছিলো। কী হইছে শিশির?”

“যার বিয়েতে গিয়েছিলাম তার বিয়েটা হয় নি বিন্তী। ”

বিন্তী অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো, কেন?

শিশির সব টা খুলে বলল। বিন্তী মন খারাপ করা গলায় বলল,

“এটাই ভাগ্য শিশির। তুমি সেদিন বলেছিলে না যে কাল কী হবে আমরা কেউ জানিনা! ব্যাপার টা তাই। ”

শিশির উদাস গলায় বলল, কী সুন্দর হাসিখুশি বাড়িটা এক মুহুর্তেই কেমন হয়ে গেল! মেয়েটা কতো স্বপ্ন দেখেছিল!”

“বিয়ে নিয়ে সবার স্বপ্নই রঙিন থাকে। দুর্ভাগাদের স্বপ্নগুলো সাদাকালো হয়ে যায়। ”

শিশির গভীর চোখে তাকালো বিন্তীর দিকে। বিন্তী মৃদু হেসে বলল,

“আমি আমার কথা বলছি না। ”

শিশির গভীর গলায় বলল,

“আমি আজ সারাদিন তোমার কথা ভেবেছি। ”

বিন্তী হাসলো। বলল,

“তোমার ঘুম দরকার শিশির। একটু ঘুমিয়ে নাও। ”

“আজ আমার আর ঘুম হবে না। ”

বিন্তী শিশিরের কাছে গিয়ে মাথাটা নিজের কোলে টেনে শুইয়ে দিয়ে বলল,

“আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ”

শিশির বিনাবাক্য শুয়ে রইলো। বিন্তী চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। শিশির চোখ বন্ধ করলো। কিছু সময় চুপ করে থেকে বিন্তী বলল,

“জীবন কারোর জন্য থেমে থাকে না শিশির। যে মেয়েটার জন্য তুমি কষ্ট পাচ্ছো ওর জীবনও থেমে থাকবে না। কিছু দিন কষ্ট পেলেও এরপর স্বাভাবিক হয়ে যাবে। বাধ্য হয়েই স্বাভাবিক হবে। এটাই সময়ের নিয়ম। সময় সব ক্ষত ভুলিয়ে দেয়। ক্ষতের দাগ টা হয়তো থেকে যায় কিন্তু ব্যথা টা একসময় না একসময় মুছে যাবেই। কষ্ট পেও না। ”

শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“আমি আজ তোমার কষ্টটা বুঝতে পেরেছি বিন্তী। বিয়ে নিয়ে তোমাকে যা তা বলেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।”

“আমার কোনো কষ্ট নেই শিশির। ওই যে বললাম জীবন থেমে থাকে না। সাব্বিরের সঙ্গে বিয়ে ভেঙে তোমার সঙ্গে বিয়ে না হলেও আমার জীবন কিন্তু চলতো। অন্যরকম হতো। এগুলো ভেবে লাভ নেই। ”

শিশিরের খুব হালকা লাগছে। মনের অজান্তে বিন্তী ওর ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে। আজকের ঘটনায় ওর বার বার মনে হয়েছে বিন্তীর কাছে গেলে ওর দমবন্ধ করা অনুভূতি আর থাকবে না। বিন্তী ম্যাজিক করে সব ঝামেলা মিটিয়ে দিবে। যেমন করে ঝুম্পার ঝামেলা মিটিয়েছে।

বাকী রাতটুকু শিশির ওইভাবেই ঘুমিয়ে কাটালো। বিন্তীও ওভাবে বসে রইলো। সকাল হবার পর বিন্তী উঠলো। বারান্দায় কিছু সময় এমনিই বসে রইলো। তারপর উঠে গিয়ে ডায়েরিটা হাতে নিলো।

সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লিখলো,

“তোমার বাবা ঠিক বলেছে শিশির। বাইরে তুমি যেমন ই হও, তোমার মন টা খুব ভালো। জীবন আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে জানিনা, তবে আমি চাইবো এক জীবনে তুমি এমনই থাকো। ”

***
শিশিরের খুব জ্বর কয়েকদিন ধরে। বিন্তী সারাক্ষণ ই ওর সঙ্গে লেগে আছে। এমনকি মাঝরাতেও শিশিরের ঘুম ভাঙলে দেখে বিন্তী জেগে আছে। অসুখের সময় শিশিরের মা’কে লাগে। কিন্তু এবার শিরিন বাড়িতে নেই। গ্রামের বাড়িতে ওদের এক আত্মীয় মারা গেছে তাই সেখানে যেতে হয়েছে। বিন্তী সুন্দরভাবে সব টা সামলে নিচ্ছে। এমনকি শিশিরের জন্য আলাদা করে রান্নাও করছে।

বাড়িতে তুষারও নেই। ইউনিভার্সিটি থেকে ক্যাম্পে গেছে। তাই না চাইতেও দুজনের সময় কাটছে এক সঙ্গে।

তিন, চারদিন পর শিশির একটু সুস্থ হলো। দুপুরের দিকে জ্বর টা পুরোপুরি নেমে গেছে। বিন্তীকে জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি খেয়েছো?”

“না। কেন?”

“তুমি না খেয়ে বসে আছ কেন?”

“একা একা খেতে ভালো লাগে না তাই বসিনি খেতে৷ পরে খেয়ে নেব। ”

শিশির এক প্রকার জোর করে বিন্তীকে খেতে বসালো। নিজ হাতে প্লেটে খাবার তুলে দিলো। শিশিরের পাগলামি বিন্তীরও ভালোই লাগলো। খেতে খেতে বলল,

“তুমি তো কেয়ারিং হাজবেন্ডের ভূমিকা পালন করছ!”

শিশির বলল,

“তুমিও তো এই ক’দিন খুব কেয়ারিং বউ হয়ে ছিলে। ”

“আমি এমনিই কেয়ারিং। তোমার ঘরদোর, জামাকাপড় কিন্তু গুছিয়ে রাখি। কিন্তু তুমি কেমন যেন পাল্টে গেছো। ”

শিশির কিছু বলল না। পাল্টে গেছে সেটা শিশির নিজেও জানে। কেন পাল্টেছে সেটা জানেনা।

বিন্তী হঠাৎ বলল, তুমি কী আমার প্রেমে পড়েছো বিন্তী?

শিশিরের মুখের রঙ টা পাল্টে গেল। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

“টিপিক্যাল মেয়েদের মতো কথা বোলো না। ”

“টিপিক্যাল মেয়েরা কী বলে?”

“যাদের প্রফাইল পিকে লাভ রিয়েক্ট দিলে ভাবে ছেলেরা প্রেমের জন্য মরে যাচ্ছে। তাদের মতো কথা বলছ তুমি।”

বিন্তী হেসে ফেলল। বলল,

“তোমাকে রাগাতে কিন্তু আমার খুব ভালো লাগে। ”

শিশির কপট রাগ নিয়ে বসে রইলো। মনে হাজারো দ্বিধা, দ্বন্দ্ব। কেন যেন নিজের গলার টোন নিজেরই অচেনা লাগছে। বিন্তী যখন জিজ্ঞেস করলো প্রেমে পড়েছে কী না তখন না বলতে গিয়েও থেমে গেল।

***
শিরিন ফিরলো আরও কয়েকদিন পর। সঙ্গে একজন আপদ নিয়ে ফিরলো। শিশিরের বড় খালা ফিরোজাকে। এই খালাকে শিশির মোটেও পছন্দ করে না। ভদ্রমহিলা এসে এমন ভাব করেন যে শিশিরদের দুই ভাইকে সে খুব ভালোবাসে। কিন্তু শিশিরের কাছে মনে হয় সবটাই মেকি। উনি একেক সময় আসেন আর ইনিয়ে বিনিয়ে নানান সমস্যার কথা তুলে শিশিরের বাবার কাছে টাকা চান। সেই কারনেও শিশিরের অপছন্দ। শিশিরের বিয়ের খবর শুনে এসেছেন এবার।

আসার পর পরই বিন্তীকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলল। এমনকি তার মুখের অভিব্যক্তি দেখেও বোঝা গেল বিন্তীকে তার পছন্দ হয় নি। সন্ধ্যাবেলা শিরিন কে চা বানাতে দেখে বলল,

“তুই এসব ক্যান করিস। ওই মেয়েরে দিয়া করা। ”

শিরিন বলল, এসব তো আমিই করি। ও’কে দিয়ে করাব কেন! এইটুক কাজ আমিই করি।

“ক্যান করবি। পোলার বউ পায়ের উপর পা তুলে বইসা খাইব আর তুই বান্দিগিরি করবি এইটা কোনো কথা! ”

শিরিন বোনের কথায় পাত্তা দিলো না। দিন দুয়েক যেতে না যেতেই ভদ্রমহিলা বিন্তীর সবকিছুতে ভুল খুঁজতে লাগলেন। শিশির সব টা খেয়াল করলো। বিন্তীর উপর খুব রাগও হলো। এমনিতে ফটর ফটর করতে পারে অথচ ওনাকে কিছু বলছেই না।

একদিন বিকেলে বিন্তী জানালো যে ওর মাথা ব্যথা করছে। সারা বিকেল তাই ঘুমিয়ে কাটালো। সন্ধেবেলা চা খেতেও এলো না। ভদ্রমহিলা তখন রসিয়ে রসিয়ে বলতে শুরু করলেন।

“সবই ভান। আমরা প্যাটে পোলাপান নিয়া ধান সেদ্ধও করছি। আর এরা একটু মাথা ব্যথা নিয়া যা করে! ”

কেউ কোনো কথা বলল না। শিশির মায়ের দিকে তাকালো। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চা খেতে ব্যস্ত।

ভদ্রমহিলা আবারও বললেন,

“নবাবের বেটির এখনই এই দশা। এরপর তো পায়ের উপর পা তুলে খাবে। ”

শিরিন বলল, থামো আপা। বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে এতোকিছু কেন বলছ!”

“দেখলাম তো এই কয়দিন। খালি খায় আর ঘুমায়। কোনো কাজের না। ”

শিরিন বলল, আমার ঘরের সব কাজ তো বুয়াই করে। ও কেন করতে যাবে?

“হ। তোগো বাসায় এইজন্য আসতে মন চায় না। বুয়ার রান্না খাওয়া লাগে। এইসব বেডিরা ডান হাত, বাম হাত মিলায়ে রান্ধে। আর এই মাইয়া তো বেয়াদব। খালা শাশুড়ী আসছে তারে কিছু রাইন্ধা পর্যন্ত খাওয়াইলো না! বাপ মায়ে এই শিক্ষা দিছে! লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুই শিখায় নাই!”

শিরিন কিছু বলার আগেই শিশির ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটালো। শিশির বলল,

“আপনার মরা বাপ মা আপনাকে কী শিক্ষা দিছে? কয়দিন পর পর আমার বাবার কাছে হাত পাতার?”

ঘরের মধ্যে যেন বোমা বিস্ফোরণ ঘটলো। শিরিন বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। শিশিরের চোখে আগুন জ্বলছে। খালা ভদ্রমহিলা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। শিশির আবারও বলল,

“আমাদের বুয়া ডান হাত, বাম হাতে রাঁধে তো তা আপনার খাওয়ার কী দরকার? আপনি আসেন ক্যান খাইতে?”

ভদ্রমহিলা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, তুই কী কইলি?

শিরিন বলল,

“এই শিশির থাম। ”

শিশির আবারও বলল,

“বিন্তীর বাবা মা ভালো শিক্ষা দিছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। তবে আপনার শিক্ষায় সন্দেহ আছে। ”

ভদ্রমহিলা রাগে কিছু বলতেও পারছে না। শিশির এতোকিছু বলবে সেটা স্বপ্নেও ভাবে নি।

শিরিন বলল, শিশির এবার থাপ্পড় খাবি।

“আরে তুমি থামো। এই মহিলা প্রত্যেকবার আসে আর আমাদের জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। শেভিং ক্রিম, পারফিউম, প্যান্ট, শার্ট সব। এগুলো নেয় ঠিক আছে। গতবার তো আমার আন্ডারওয়্যারও নিয়ে গেছে। এ আসছে আরেকজন কে শিক্ষার বানী শোনাতে। ”

ভদ্রমহিলার চোয়াল ঝুলে পড়লো। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রাগে ফোস ফোস করতে লাগলো।

চলবে….

)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here