অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো পর্ব-১৫+১৬

#অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো
#পর্ব-১৫
বিন্তী যে বন্ধুর সঙ্গে থেকে গেছে ওর নাম রুচি। রুচি ওর খুব কাছের বন্ধু না। হলে একই রুমে এক সঙ্গে থেকেছে। দূরের বন্ধু যেমন বলা যায় না, তেমনি কাছেরও বলা যায় না। রুচি বিন্তীকে আন্তরিকতা দেখিয়ে রেখেছে। বিন্তীরও ভালো লেগেছে। রুচির এখনো বিয়ে হয় নি। একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছে কিছুদিন আগে। সারাদিন অনেক ভালো ভালো কথা বললেও বাসায় ফিরে বিন্তীকে জিজ্ঞেস করলো,

“তুই কী ভাবলি? চাকরি বাকরি করবি?”

বিন্তী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

“বিসিএসের চেষ্টা করব ভাবছি। ”

“আরেহ ধুর! ওসব হবে না। শুধু শুধু সময় নষ্ট। ”

“অনেকের ই তো হচ্ছে। ”

“যাদের হচ্ছে তারা লেগে থাকে দিন রাত। তোর তো বিয়ে হয়েছে। ঘরদোর সামলে এতো সময় দিতে পারবি তো?”

বিন্তী স্বাভাবিক গলায় বলল,

“আমাকে কোনো কাজ করতে হয় না। সারাদিন শুয়ে বসেই থাকি। ”

রুচি এরপর সেই অপ্রিয় প্রশ্ন টা করে ফেলল। বলল,

“সাব্বিরের সঙ্গে বিয়েটা ভাঙলো কেন রে?”

বিন্তী স্বাভাবিক গলায় বলল,

“শেষ মুহুর্তে কিছু ঝামেলা হয়েছিল তাই। ”

“এতো বছর প্রেম টা করে লাভ টা কী হলো বল তো? বিয়ে তো হলো না। ”

বিন্তী কিছু বলল না। হঠাৎ করেই পরিবেশ টা অসহ্য লাগছে। রুচির আন্তরিকতা দেখে ওর সঙ্গে থাকতে এসেছিল। এখন মনে হচ্ছে না আসাই ভালো ছিলো। রুচি এসব ব্যাপার জানার জন্যই হয়তো ও’কে এতো খাতির যত্ন করে এনেছে।

রুচি আবারও প্রশ্ন করলো,

“তোর হাজবেন্ড কেমন? ”

“ভালো। ”

“কী করে?”

বিন্তী অতি সন্তঃর্পনে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,

“এখনো কিছু করে না। বাবার বিজনেস আছে। সেটা দেখবে মনে হয়। ”

রুচি হেসে ফেলল। বিন্তী সেটা দেখেও চুপ করে রইলো। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো না হাসির কারন।

রুচি বলল,

“সরি সরি। আসলে একটা ব্যাপার মনে পড়ে গেল। আমার এক পরিচিত আত্মীয়ের একবার বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল। ছেলে কিছু করে না কিন্তু ছেলের দুলাভাইর বিরাট ব্যবসা। সেই কথা মনে পড়ে গেল। ”

বিন্তীও মৃদু হাসলো। এই মুহুর্তে ওর শিশির কে মনে পড়ছে। শিশির কে যদি ফোন করে বলে আমাকে নিয়ে যাও তাহলে কী নিতে আসবে! মনে হয় না। একশ টা খারাপ কথা শুনিয়ে ফোন রেখে দেবে। আরাম আয়েশের ঘুম ছেড়ে আসবে না।

রুচি আবারও বলল,

“তোর হাজবেন্ড তোকে ভালোবাসে?”

বিন্তী আনমনে বলল,

“হু। ”

“এই যুগে এমনও হয়। একটা মানুষ কে চিনিনা জানিনা অথচ বিয়ে করে শুয়ে পড়লাম! ছিঃ!”

বিন্তী ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত সাড়ে দশ টা। এখন বেরিয়ে গেলে পৌছুতে দুই তিন ঘন্টা লেগে যাবে। এতো বড় রিস্ক নেয়া যায় না। বিন্তীর রাগ লাগছে না। কিন্তু খুব ঘেন্না হচ্ছে। কিন্তু রুচিকে কোনো জবাবও দিতে পারছে না। মাঝে মধ্যে পরিস্থিতি এমন হয় যে সামনের মানুষ টা’কে চড় মারতে ইচ্ছে হলেও হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়।

বিন্তী ফোন দেখছে। শিশিরের নাম্বারে ডায়াল করেও কেটে দিলো। রুচি দেখলো বিন্তী চুপ করে আছে। তাই আর ঘাটালো না।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর শিশির ফোন করলো। বিন্তী ফোন ধরতেই গমগমে গলায় বলল,

“আমি বাইরে আছি। এক্ষুনি নিচে এসো। নাহলে পুলিশ দিয়ে ধরে নিয়ে যাব। ”

বিন্তী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিঃশব্দে হাসলো। তারপর বলল,

“পুলিশ আনতে হবে না আসছি। ”

রুচি পাশেই বসা ছিলো। শুনতে পেয়ে বলল,

“কী হয়েছে? ”

“শিশির আসছে। আমাকে নিতে।”

“তোর হাজবেন্ড? কেন?”

বিন্তী জবাব না দিয়ে নিচে চলে গেল।

শিশির দাঁড়িয়ে আছে চোখ, মুখ শক্ত করে। বিন্তী এসে দাঁড়াতেই বলল,

“এক্ষুনি আমার সঙ্গে যাবে। নাহলে আমি কিন্তু তোমার বাবাকে ফোন করে বলব। ”

বিন্তীর আজ আর একটুও রাগ হলো না। শিশির যা বলে বলুক, ও কিছু বলবে না।

বিন্তী বলল,

“আচ্ছা। আমি একটু আমার বন্ধুকে বলে আসি। ”

শিশির হ্যাঁ, না কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইলো। বিন্তী উপরে উঠে গেল। রুচি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিল। বিন্তী উপরে আসতেই রুচি বলল,

“একি ভাইয়াকে ভেতরে আসতে বললি না? ”

“না। তোকে একটা কথা বলার জন্য এসেছি। ”

“কী?”

“আমি আর শিশির একদিন তোদের বাড়ি যাব। গিয়ে তোর মা’কে জিজ্ঞেস করবো যে তারও তো এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিল। তার একটুও লজ্জা লেগেছিল কী না!”

রুচি হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। বিন্তী দুই সিড়ি নেমে আবারও ফিরে এসে বলল,

“ভালোবাসার নমুনা দেখলি তো!”

রুচি মাথানিচু করে ফেলল।

***
সারা পথ শিশির মেজাজ দেখালো। একটু পর পর বলতে লাগলো,

“এতো লোভ তোমার। ভালো, মন্দ খাবারের আশায় থেকে গেলে!”

বিন্তী বলল,

“তোমার তাই মনে হয়?”

“হ্যাঁ। ”

“তাহলে তাই। ”

“এক থাপ্পড় মেরে তোমার মুখ ভেঙে দেয়া দরকার। ”

“কে মারবে তুমি?”

“না। তোমার বাবাকে দিয়ে মারা দরকার। আমি আজকের ঘটনা তোমার বাবাকে বলে দেব। ”

“আচ্ছা বলে দিও।”

শিশির বিড়বিড় করে বলল, কতো বড় সাহস! বাড়ির বাইরে থাকবে।

“শিশির ও আমার বন্ধু। ”

“সে যাই হোক। মেয়েরা কোথাও নিরাপদ না। তোমার ওই বন্ধুও তো একা থাকে। তাছাড়া বিয়ের আগের ব্যাপার আলাদা। এখন যদি তোমার কোনো বিপদ হয়!”

এই দুটো বাক্য বিন্তীর এতো ভালো লাগলো। ‘যদি তোমার কোনো বিপদ হয়’! বিপদের আশঙ্কা করে শিশির এতো দূর ছুটে এসেছে। কে হয় এই ছেলেটা! বিয়ে নামের এক বন্ধনে দুজন কে জোর করে আটকে দেয়া হয়েছে। সেই বন্ধনের এতো জোর!

বিন্তী আড়চোখে শিশিরের থমথমে মুখ টা দেখলো। শিশির একবারও ওর দিকে তাকাচ্ছে না। বাকী পথটুকু এমন ই কাটলো।

***
বাড়ি ফিরে দেখলো শিরিন আর তুষার বসে আছে। শিশির সবার দিকে একটা রাগী দৃষ্টি দিয়ে ঘরে চলে গেল। শিরিন বলল,

“পাগল টা শেষমেস তোমাকে নিয়ে ফিরলো।”

বিন্তী হাসলো। তুষার বলল,

“যাক বাবা আমি বাঁচলাম। আমাকে যেভাবে দেখছিল তাতে মনে হয়েছে গুলি করে মেরে ফেলবে। ”

শিরিন বলল, খাওয়া না হলে খেয়ে নাও। আর ওই পাগল টা’কেও খেতে দিও। তোমার শ্বশুর কে জানিয়ে আসি। সে বারবার জিজ্ঞেস করছিল।

বিন্তী আচ্ছা বলে চলে গেল। শিরিনের আজ খুব খুশি লাগছে। নিজের ছেলের পাগলামীতেই খুশি লাগছে। বিন্তীর সঙ্গে রসিকতার সম্পর্ক হলে বলতো, বিন্তী তোমার স্বামী তোমাকে ছাড়া একটা রাতও থাকতে পারবে না তাই নিয়ে এলো।

কিন্তু শাশুড়ী হবার কারণে রসিকতা করতে পারলো না।

***
বিন্তী ঘরে এসে দেখলো শিশির লাইট অফ করে শুয়ে পড়েছে। ডেকে বলল,

“খেতে আসো। ”

শিশির কঠিন গলায় বলল,

“না। ”

বিন্তী বলল, আমিও না খেয়ে আছি শিশির।

“হুহ! দুপুরে যা গিলেছো তাতে দুইদিন না খেলেও চলবে। ”

“তুমি এতো রেগে আছ কেন? তোমাকে নিয়ে যাই নি তাই?”

“এই তুমি যাও তো। ”

“তুমি খেতে চলো। ”

“না।”

“আচ্ছা কথা দিচ্ছি এরপর তোমাকে নিয়ে যাব। এবং কোথাও গেলে বলেও যাব। তুমি যেমন স্বামী চরিত্রে ভালো অভিনয় করছ তেমন আমিও করব। ”

শিশির রেগেমেগে উঠে গেল।

***
বিন্তী ঘুমানোর আগে ডায়েরিটা হাতে নিলো। মাঝখানে অনেক দিন লেখা হয় নি। আজ আবারও লিখছে।

“শিশির ছেলেটা পাল্টে যাচ্ছে একটু একটু করে। ওর রাগের মধ্যে আগের মতো ঝাঝ নেই। শিশির কী নিজে জানে যে ও একটু একটু করে পাল্টে যাচ্ছে! নাকি সবটাই আমার মনের ভুল। আমাকে নিয়ে খালার সঙ্গে ঝগড়া, আজকের রাগ সবটা কী এমনিই! নাকি অন্যকিছু। ”

পরের পৃষ্ঠায় বিন্তী লিখলো,

সব মেয়েরাই সঙ্গীর ভেতরে বাবার ছায়া খুঁজে বেড়ায় অবচেতন মনে। বাবার মতো করে খেয়াল রাখুক, ভাবুক তেমন চায়। আজকের শিশিরের মধ্যেও কেন যেন বাবার ছায়া খুঁজে পাওয়া গেল। হঠাৎ হয়ে যাওয়া সম্পর্কে এমন আশা কখনো করিনি তবুও যেটুকু পেয়েছি তাতেই আমি খুশি শিশির। আজকের ঘটনা আমার অনেক দিন মনে থাকবে।
#অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো
#পর্ব-১৬
বিন্তী যেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করলো শিশিরের সঙ্গে আর ঝগড়া করবে না, সেদিন থেকে ঝগড়ার পরিমাণ বেড়ে গেছে। ঝগড়ার কোনো মাথা মুন্ডু নেই। যাকে বলে অকারণ ঝগড়া। শীতের শেষে একবার বিন্তীর বাবা এলেন। শিশির এবার খুব খুশি হলো। হাসিমুখে স্বতস্ফুর্ত ভাবে অনেক গল্পগুজব করলো। কিন্তু যখনই সে বিন্তীকে বাড়ি নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিলো তখনই ঝামেলা লেগে গেল। শিশির গম্ভীর গলায় বলল,

“আপনি বিন্তীকে নিয়ে যেতে এসেছেন?”

বিন্তীর বাবা বললেন, হ্যাঁ। ও কয়েকটা দিন গিয়ে থাকুক। তারপর তুমি গিয়ে নিয়ে আসবে।

“দুদিন থাকবে ঠিক আছে। আমিও সঙ্গে যেতে পারি। আমার কোনো সমস্যা নেই।”

বিন্তীর বাবা আমতা আমতা করে বলল,

“দুদিন না বাবা। দিন পনেরো থাকবে।”

শিশির চোখ কপালে তুলে বলল, দিন পনেরো কে আপনি বলছেন কয়েকটা দিন!

বিন্তী পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। বিন্তীর বাবা মেয়ের দিকে তাকালেন। বিন্তী বলল,

“আমি চাচী কে জিজ্ঞেস করে নেই। চাচী পারমিশন দিলে যাব। ”

শিশির কটমট চোখে তাকালো।

শিরিনের কাছে পারমিশন চাইতেই দিয়ে দিলো। বলল,

“হ্যাঁ থেকে এসো কয়েকটা দিন। তোমার মায়েরও তো ইচ্ছে করে মেয়েকে কয়েকটা দিন কাছে রাখতে। ”

শাশুড়ীর অনুমতি পেয়ে বিন্তী গোছগাছ শুরু করলো। শিশির ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকে গেল। বলল,

“তুমি তার মানে সত্যিই যাচ্ছো?”

বিন্তী ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল,

“হ্যাঁ! কেন মিথ্যে মিথ্যে যাবার কথা ছিলো? ”

শিশির গম্ভীর গলায় বলল,

“তুমি যাচ্ছো অথচ একবারও আমার মতামত নিলে না?”

“তোমার মতামত কেন নিতে হবে শিশির?”

“কারন আমি তোমার স্বামী। ”

“আচ্ছা। ”

“আচ্ছা মানে কী? আমাকে মানুষ মনে হয় না?”

“হ্যাঁ হয়। আমি তো তোমাকে লুকিয়ে যাচ্ছি না। তোমার সামনেই যাচ্ছি। ”

“না তুমি যাবে না। ”

“যাব। সপ্তাহ খানিক পর তুমিও যেও।”

“জীবনেও যাব না আমি। ”

“আচ্ছা। না গেলে নাই। কিন্তু আমি যাব। ”

“তুমি কিন্তু খুব অসভ্য। তোমার বাবা বসে আছেন। তাকে বলব যে তুমি একটা বেয়াদব। ”

“আচ্ছা যাও বলে এসো। তাতে আমারই লাভ। আমি বাড়িতে বেশী দিন থাকতে পারব। ”

“মানে?”

“মানে বাবা ভাববে যে তুমি আমাকে একদম সহ্য করতে পারো না। তাই তারা আর পাঠাতে নাও চাইতে পারে।”

শিশিরের চোয়াল শক্ত হলো। বিন্তীর খুব মজা লাগছে। ও মিটিমিটি হাসছে। শিশির আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি তার মানে যাবেই?”

“হ্যাঁ। ”

শিশির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে দড়াম করে দরজা লাগিয়ে গেল।
বিন্তী হেসে ফেলল। ও চলে গেলে শিশিরের কী! ঝগড়া করার মানুষ পাবে না তাই! নাকি অন্যকিছু!

***
শিশির রান্নাঘরে এসে মায়ের উপর খুব হম্বিতম্বি করলো। বলল,

“তুমি যেতে দিতে রাজী হলে কেন?”

শিরিন অবাক গলায় বলল,

“ও বাপের বাড়ি যেতে চাইলে আমি আটকাবো?”

“তুমি যেতে দেবার কে? বিয়ে কী তোমার সঙ্গে হয়েছিল?”

শিরিনও ক্ষেপে গেল। বলল,

“আমি যেতে দেয়ার কেউ না হলে ও কেন এসেছিল আমাকে জিজ্ঞেস করতে। তোর কাছে কেন যায় নি?”

“তুমিই একটা ভয়ংকর মহিলা। ”

শিরিন অবাক গলায় বলল, তোর বউ বাপের বাড়ি যাচ্ছে তারজন্য আমি ভয়ংকর মহিলা! ”

“হ্যাঁ। তুমি চাও না ও এই বাড়ি থাকুক। ”

শিরিন বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো।
রাগী গলায় বলল,

“আমার সঙ্গে উল্টাপাল্টা কথা বলবি না শিশির। খুন্তি দিয়ে মেরে পিঠ লাল করে দেব। ”

“এতো গায়ের জোরের বড়াই করছো, তাহলে বিন্তীর একটা ঠ্যাং ভেঙে দিতে পারো না!”

“বিন্তীর ঠ্যাং কেন ভাঙব? তোর মুখ ভাঙা দরকার। এমন ভাবে ভাঙা দরকার যেন দুই মাসেও আর কথা বলতে না পারিস। ”

বিন্তী এসে বলল,

“শিশির এসব কী হচ্ছে। ”

শিরিন বিন্তীকে দেখে বলল,

“তোমার সঙ্গে এই ঝামেলা টা’কেও নিয়ে যাও। এটার ভ্যজর ভ্যজর আমি আর নিতে পারি না। ”

শিশির রাগী গলায় বলল,

“আমি জীবনেও যাব না। ও মরে ভুত হয়ে থাকলেও যাব না। ”

বিন্তী হেসে বলল,

“মরে ভুত হয়ে তোমার কাছেই আসব। তোমার ঘাড়ে এসে চাপবো। ”

“তুমি জাহান্নামে যাও। ”

শিশির আবারও ঝড়ের গতিতে চলে গেল। শিশির চলে যেতেই শিরিন আর বিন্তী হেসে ফেলল। শিরিন বলল,

“বুঝতে পারছ তো?”

বিন্তী হাসতে লাগলো। শিরিন বলল,

“বেশী দিন থাকার দরকার নেই বিন্তী। আমার দিক টাও একটু দেখো। বয়স হচ্ছে তো। ”

বিন্তী হেসে ফেলল আবারও। শিরিনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

“আমারও তোমাকে ছেড়ে বেশীদিন থাকতে ভালো লাগবে না চাচী। ”

“এসব চাচী ডাকা কবে বন্ধ হবে? আমার ছেলে না জানি কবে আবার এই নিয়ে ঝগড়া শুরু করে। বলবে বিন্তীকে ওর চাচাতো বোন বানাচ্ছি আবার। ”

বিন্তী শব্দ করে হেসে ফেলল।

***
যাবার সময় শিশির বিন্তীকে বলল,

“আর ফেরার দরকার নেই। এক বছর থেকে আসুন। আপনার মায়ের ইচ্ছা পূরণ হোক। পনেরো দিনে তো আর মন ভরবে না তার। ”

বিন্তী নির্লিপ্ত গলায় বলল,

“আগেই বলতে পারতে। সব গুছিয়ে নেই। ঠিক আছে সমস্যা নাই। তুষার কে বলব সব যেন দিয়ে আসে। ”

শিশিরের ইচ্ছে করছে দেয়ালে ঠুকে নিজের মাথা ফাটিয়ে ফেলতে। এই মেয়ের মনে কোনো দয়ামায়া নেই! যেখানে এক বেলা ও মেয়েটাকে না দেখতে পেয়ে ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছিলো। সেখানে পনেরো দিন! এক্ষুনি একটা ভয়াবহ বন্যা হতো! ঢাকা, শহর ডুবে যেত। একটা গাড়িও না চলতো। তাহলে যাওয়া ছুটে যেত ফাজিলটার। শিশির রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়েগুলোর বাপের বাড়ি থাকার কী দরকার!

বিন্তীর চোখ হাসি হাসি কিন্তু মুখ টা গম্ভীর। বলল,

“আমি না থাকলেই তো তোমার সুবিধা। হাত, পা ছোড়াছুড়ি করে ঘুমাতে পারবে। একটা ফাজিল মেয়েকে সহ্য করতে হবে না। ”

“হ্যাঁ যান আপনি। ”

“হঠাৎ এতো সম্মান? আপনি আজ্ঞে করছ যে!”

“তাহলে কী করব। আপনি তো মহামান্য ব্যক্তি। স্বামীকে কোনো গুরুত্ব দেন না। ”

বিন্তী আফসোসের সুরে বলল,

“তোমার কপাল খারাপ। একটা বাধ্য মেয়ে কপালে জুটলো না!”

“এরপর যে মেয়েকে বিয়ে করব, প্রথম দিন ই তার জিভ কেটে দেব। যেন টকাস টকাস করে কথা না বলতে পারে। ”

“বেস্ট অব লাক শিশির। আমাকে অবশ্যই দাওয়াত করবে। আমি দুই পিস রোস্ট খাব। ”

শিশির মনে মনে বলল, ফাজিল ছেমড়ি তোকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলা উচিত। এবার বাড়ি থেকে আয় তোর এক ঠ্যাং ভেঙে ঝুলিয়ে রাখব। বাপের বাড়ি, মায়ের বাড়ি কোথাও যেতে পারবি না।

বিন্তী শিশির কে ওভাবে রেখেই চলে গেল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও শিশির বিন্তীর বাবাকে বিদায় দিতে এলো। তখন শুনলো বিন্তী তুষার কে বলছে,

“তোমাকে খুব মিস করব।”

তুষারও বলছে,

“আমিও ভাবী। নতুন সেমিস্টার শুরু না হলে আমিও যেতাম। ”

শিশির রাগে কিড়মিড় করতে লাগলো। ক্ষমতা থাকলে তুষার কে ও এক্ষুনি ছাদ দিয়ে ফেলে দিতো।

***
গাড়িতে ওঠার আগে কী মনে করে একবার বিন্তী উপরে তাকালো। শিশির সঙ্গে সঙ্গে সরে গেল।
বিন্তী মনে মনে বলল,

“এতো ঝামেলা না করে আমার সঙ্গে গেলেই তো পারতে শিশির!”

***
বিন্তী চলে যাবার পর একটা দিন শিশিরের অসহ্য যন্ত্রনায় কাটলো। এমনও হবার ছিলো। একটা মেয়ের জন্য এতো পাগল পাগল লাগবে সেটা কখনো ভাবে নি। বিন্তী বাড়ি গিয়ে ও’কে ফোন করলেও ও ফোন টা ধরে নি। ধরে কী বলবে! রাগ দেখাবে! রাগ দেখাতেও ভালো লাগে না। ও তো বিন্তীর কাছে কিচ্ছু চায় না, শুধু চায় সারাক্ষণ চোখের সামনে থাকুক। হাসুক, কাঁদুক, মন খারাপ করুক, রাগ করুক, সব টা ওর সামনে থেকে করুক। মেয়েটা হয়তো বুঝতেও পারছে না ওর চাওয়া। বিন্তী বুঝবে কী করে! শিশির তো নিজেই নিজেকে বুঝতে পারে না। শিশিরের আগে তিন, চার টা গার্লফ্রেন্ড ছিলো। কই তাদের জন্য তো এমন উতলা লাগে নি। এমন পাগল লাগে নি। এমন ঝগড়াঝাটিও কারোর সঙ্গে হয় নি।

***
পুরো একটা দিন ছেলেকে দেখে শিরিনের খারাপ লাগলো। তুষার আর ওর বাবা বাড়িতে রাতটুকু থাকে। কিন্তু শিরিন তো বাড়িতে থাকে তাই ছেলের পাগলামী চোখে পড়ে। বিন্তী যাবার পরদিন দুপুরে খেতে বসে বড় বড় চিংড়ি দেখে রেগে গিয়ে বলল,

“বিন্তী বাড়ি থেকে চলে গেল অমনি তোমার চিংড়ি রাঁধতে হলো!”

শিরিন হেসে ফেলল। বলল,

“তোর বিন্তীর চিংড়িতে এলার্জি আছে। চিংড়ি খায় না। ”

শিশির তবুও কিছু খেতে পারলো না। শিরিনের একবার ইচ্ছে করলো বিন্তীকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে,

“হ্যাঁ রে বিন্তী, আমার ছেলেটা তোকে এতো ভালোবাসলো কেন!”

শিরিন ঠিক করলো শিশির কে পাঠাবে বিন্তীদের বাড়ি। কিন্তু তার আগেই শিশির গায়েব। বিকেলে শিরিন ঘুমিয়েছিল। উঠে দেখে শিশির নেই। ভাবলো বাইরে কোথাও গেছে। রাতে দেরি দেখে ফোন করলো কিন্তু ফোন টা তুলল না। তখন সন্দেহ হলো যে বউপাগল ছেলে শ্বশুর বাড়ি গেছে বউকে আনতে।

***
বাড়িতে আসার পর বিন্তীর মন টা খারাপ। একটা দিন ওরও খুব খারাপ কাটলো। শিশির কে ফোন করে বলতে চাইলো, শিশির আমাকে এসে নিয়ে যাও। এখানে সবাই খুব ভালো। কেউ ঝগড়া করে না, ঝামেলা করে না। এখানে আমার দমবন্ধ লাগে।

বিন্তীর মা’ও খেয়াল করলো মেয়েকে। আগেরবার যেমন হাসিখুশি ছিলো তেমন নেই। কেমন যেন মনমরা। ভাবলেন আর দুই একদিন গেলে মেয়ের সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন। শ্বশুর বাড়ি কোনো সমস্যা আছে কী না।

***
ফজরের দিকে বিন্তীর ঘুম ভাঙলো চেঁচামেচির শব্দে। বিন্তীর মা এসে জানালেন, জামাই এসেছে।

বিন্তী ছুটে গেল। শিশির দাঁড়িয়ে আছে কাঁদামাখা অবস্থায়। বিন্তী দেখেই হেসে ফেলল। শিশির চোখ পাকিয়ে বলল,

“ভ্যাক ভ্যাক করে হেসো না। যাও পানি নিয়ে এসো। ”

চলবে….
চলবে..

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here