অপ্রেমের প্রিয় অধ্যায় পর্ব -০৪

#অপ্রেমের_প্রিয়_অধ্যায়
#পর্ব_৪ (অসুস্থতা)
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ

“আমার বাঁচতে হলেও আপনাকে লাগবে ম্যাম, তিন সত্যি।”

“তবে মরে যাও, তবুও আমার পিছু নেবে না।”

শুদ্ধ অবজ্ঞাটুকু হেসে উড়িয়ে দিলো। এসব ছোটো-খাটো বিষয়ে মান করলে চলবে কী করে? প্রিয় নারীকে মানাতে হলে, নিজের মান করা চলবে না। একবার মেনে যাক! তারপর উঠতে বসতে কেবল শুদ্ধর অভিমানে সিক্ত হতে হবে তাকে। ব্যাপারগুলো ভাবতেই হাসি চওড়া হয়ে উঠল। ঠোঁটের কার্নিশ ঘেষে গজদাঁতটি নিচের ঠোঁটটিতে ডেবে বসল। লাল ঠোঁটদুটো আরও লালচে হয়ে উঠল।
তনুজা পাত্তা না দিয়ে পা চালাল প্রস্থানের উদ্দেশ্যে। আরও কিছু কেনার ছিল, তবে এখন তা কোনোভাবেই সম্ভব না। শুদ্ধ তনুজার পিছু পিছু এলো। নিজের পরনের এমন অশালীন পোশাকটাকে ভাবনায় খুব একটা দিলো না। এমন যে-ভাবে সে-ভাবে কেউ বেরোয়! শুদ্ধ এত বেপরোয়া কেন? প্রকৃতি বলে, হয়তো সে এমনই সুন্দর বলে। তার হাসি সুন্দর, এজন্যই সে বার বার হাসতে থাকে। তার চুলগুলো সুন্দর, এজন্য কথার ছলে হলেও সে বারবার চুলগুলোয় হাত বোলায়। সেভাবেই চুলে হাত চালিয়ে বলল, “ম্যাম, বাড়ির সবাই ভালো আছে?”

তনুজা সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “শুদ্ধ! পিছু ছাড়তে বলেছি!”

শুদ্ধ নির্বিকার। চোখ-মুখে বিন্দুমাত্র ভড়কানোর চিহ্ন নেই, ভড়কানোর কথাও নয়। তবুও! সে সেভাবেই বলল, “ম্যাম, সামনে ফ্রেন্ডের বাসা। ওখানে যাব।”

“তো যাও না! আমার পিছে আসছ কেন?”

“আপনার বাসাটাও একই রাস্তায় হওয়াতে দোষটা কি আমার—বলুন! নিশ্চয়ই আমার নয়! সব দোষ সরকারের। আলাদা রাস্তা না করার দায়ে।”

তনুজা কথা বাড়াল না আর। তার অসম্ভব রকমের গা জ্বলে যাচ্ছে। সম্ভব হলে কী না করে ফেলত! মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতেই শুদ্ধ তনুজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ম্যাম, আজ দুপুরে চিংড়ি মাছ রান্না করবেন নাকি?”

সে এক পলক শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে আবারও হাঁটতে লাগল। শুদ্ধ তনুজার ব্যাগে চিংড়ি মাছের টোপলা দেখে প্রায় নিশ্চিত হয়েই প্রশ্নটি করল। সেই রেশ ধরেই আবার বলল, “আমার ফেবারিট মাছ চিংড়ি। উফফ! মা যা রাঁধে না! একদিন আপনার হাতের রান্নাও খাব। কবে খাওয়াবেন—বলুন।”

তনুজা এবারও কথার প্রত্যুত্তর করল না, যেন বললেই এই আকাশ ফুঁড়ে ঠাডা পড়বে। নিজ মনে একাই হাঁটতে লাগল। তনুজার কাছ থেকে পাত্তা পাওয়াটাও যেন শুদ্ধ আশা করছে না। সে আপন মনে বকবকিয়েই যাচ্ছে। তনুজা অন্যমনস্কভাবেই শুদ্ধকে সুযোগ দিচ্ছে। ঘোর অনুচিত!

তনুজা হাঁটতে হাঁটতে নিজের কলোনিতে চলে এলো। শুদ্ধ এখন চুপটি করে আছে, তনুজার চালচলন দেখে যাচ্ছে। সে যা করছে—হয়তো তা নিন্দনীয়, হয়তো পাপ। তবুও জীবনের ঠিক এই পর্যায়ে এসে সে কিছু এড়াতে পারছে না, আদতে চাইছে কি?

কিছুটা সামনে যেতেই পাশের ফ্ল্যাটের ভাবির মুখোমুখি হলো। সে মুখে হাসি মেখে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “আরে, আপা! কোথা থেকে এলেন?”

তনুজা নিজের পাশে শুদ্ধকে এক পলক বিরক্তিপূর্ণ চোখে দেখল। এর জন্য না জানি পুরো কলোনিতে কী না কী রটে যায়! তবুও শুকনো হেসে রাবেয়াকে বলল, “এইতো বাজার করে এলাম।”

রাবেয়া আড়চোখে শুদ্ধকে ভালো করে অবলোকন করে বলল, “তা, এ কে, আপা?”

শুদ্ধ মুচকি হেসে প্রসঙ্গ এড়াতে বলল, “ভাবি, আপনার চোখ দুটো তো মাশাআল্লাহ! ল্যাশ লাগিয়েছেন বুঝি!”

পাশের বাসার ভাবিকে পটানোর টেকনিক ব্যবহার করছে শুদ্ধ। খানিকটা সফলও। রাবেয়া ভাবি লাজুক হেসে বলল, “না না! ওসব লাগাইনি, লাগাইও না। তোমার ভাই বলে, আমার চোখ নাকি এমনিতেই সুন্দর। ওসবের দরকার পড়ে না।”

শুদ্ধ অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল, “ও-মা! কী বলেন! কিছুই লাগাননি? শিট! এত্ত সুন্দর চোখ আমার মায়ের দেখেছিলাম। এর এত্তদিন পর আপনার!”

ভদ্রমহিলা পটে পটল হয়ে গেল! হাসি তার মুখ সরে না। শুদ্ধর উদ্দেশ্যে বলল, “তা বাসায় চলো। আজ শিরনী রেঁধেছি।”

শুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে হাসল। চোখ টিপে বলল, “কবি শুদ্ধান্দ্রনাথ বসু বলেছেন, ‘যেই রমনীর নয়নে রূপ খেলে, সেই রমনীর রান্না অমৃত!’ আমার প্রিয় কবি উনি। নিশ্চয়ই ভুল বলেননি!”

রাবেয়া উপর্যুক্ত কবিকে চেনেনি, চেনার কথাও নয়। এই নামে আদতে কোনো কবি নেই। তবে সে ওসবে মাথা ঘাটাল না। হাত-পা অদৃশ্য স্বপ্নে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাওয়ায় ভাসছে। তার হাওয়ায় ভাসা মেঘে শুদ্ধ ঠেলা দিয়ে বলল, “কিন্তু ভাবি, আজ তো এক্কেবারেই অসম্ভব। এই যে, বাজার! বাসায় কাজ আছে। অন্যদিন আসব, কেমন? আপনার হাতের শিরনী না খেলে আমার এই মানবজনম বৃথা!”

রাবেয়া মন খারাপ করে বলল, “পরে আর পাবে কই! আচ্ছা এসো তবে।”

শুদ্ধ চালাকি করে রাবেয়া ভাবির নম্বরটাও টুকে নিল। কখন, কে, কীভাবে কাজে লেগে যায়—বলা দায়। রাবেয়ার সাথে কথা শেষ হতেই, শুদ্ধ দেখতে পেল—তনুজা নেই! ভালোভাবে আশেপাশে তাকাল। কখন গেল! নিশ্চয়ই রাবেয়ার সঙ্গে এরকম আলাপের মাঝেই তনুজা অ্যাপার্টমেন্টে চলে গিয়েছে। শুদ্ধ মাথার চুলগুলো চুলকোতে চুলকোতে একটা রিকশা ডাকল। বলল, “মামা, যাবেন?”

রিকশাওয়ালা বললেন, “কই যাবেন, মামা?”

শুদ্ধ তনুজার ঘোরে আচ্ছন্ন ছিল। সেভাবেই বলে বসল, “আপনি কি পারবেন?”

রিকশাওয়ালা শুনতে পারলেন না। তাই শুধালেন, “কি!”

শুদ্ধ আবারও বলল, “আপনি কি পারবেন?”

এবার উনি শুনতে পারলেন ঠিকই, তবে বুঝতে পারছেন না। তাই ফের শুধালেন, “কী?”

শুদ্ধ তার জ্বলজ্বলে চোখে রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল, “ম্যামের মনাঙ্গিনায় আমায় নিয়ে যেতে পারবেন?”

রিকশাওয়ালা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, “কী কন, মিয়াঁ! মাথা খারাপ হইছে নাকি?”

শুদ্ধর সংবিৎশক্তি ফিরল। অতিব্যস্ত হয়ে ডানে-বাঁয়ে তাকাল। তারপর ‘হে হে’ করে হেসে রিকশায় চড়ে বলল, “মামা, কলেজ গেইটে চলেন।”

_________
সে রাতে শুদ্ধর জ্বর উঠল। সবাই মনে করল—সিজন চেঞ্জের জন্য। প্রতি বছরে শুদ্ধর এরকম হুট করে একবার ভীষণ জ্বর আসে। সে জ্বর মোটেও সামান্য নয়! থাকে গোটা এক দিন, এক রাত। তবে এবার ব্যতিক্রম। জ্বরের বিষয়টা শুদ্ধর কথামতো সুভা বেগমের কানে দেওয়া হয়নি। জানতে পারলেই, কেঁদে-কেটে অস্থির হয়ে যেতেন। সেই রাতে হুড়মুড়িয়ে জ্বর তুঙ্গে উঠল। রাত ১০-১১টার দিকে তুহিন আর প্রাপ্তি চলে এলো। সুভা বেগমের জায়গাটা প্রাপ্তি পূরণ করল। সে কী কান্না তার! কাঁদতে কাঁদতে সমানে শুদ্ধকে বকেই যাচ্ছিল।
শুদ্ধ জ্বরের ঘোরে কেবল হাসল। মনে মনে বলতে চাইল, “পাগলি! এত কাঁদছিস কেন? মরে যাচ্ছি না তো! কাঁদে না। তুই কাঁদলে আমাদের তিনজনেরই খুব কষ্ট হয়। এমনিতেও অনেক কষ্ট পাচ্ছি, প্রাপ্তি। আর বাড়াস না, প্লিজ।”

তবে তা মুখে বলতে পারল না, জ্বর এতটাই বেশি। অনেকটাসময় পানি-পট্টি দিয়ে যখন দেখল—জ্বর কমছেই না, উলটো শরীরের তাপমাত্রা আগুনকে হার মানাচ্ছে; তখন ঠিক রাত আড়াইটায় তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হলো। এত রাতে ডাক্তার পাওয়া বহুত কষ্টসাধ্য ব্যাপার! সেই কষ্টটা তাদের খুব একটা করা লাগল না। তুহিনের বড়ো ভাই ডাক্তার, ওরা তাকে ডেকে নিল।
সে কিছু মেডিসিন আনিয়ে শুদ্ধকে ইনজেক্ট করল, অপেক্ষা করতে বলল সকাল অবধি। না কমলে কাল হসপিটালে এডমিট করাতে হবে। কথাটা শুনতেই প্রাপ্তির কান্নার বেগ কয়েকদফা বেড়ে গেল! কাঁদতে কাঁদতে শুদ্ধকে বলল, “সুস্থ হয়ে নে জলদি। আমার হাতের মার খাস না, অনেকদিন হয়েছে।”

শুদ্ধ চুপচাপ দেখল। তার তাকাতেও কষ্ট হচ্ছে। জ্বর কিছুক্ষণের জন্য কমেছিল। তবে পরে আরও ভয়াবহ ভাবে বেড়ে যায়। শেষরাতের দিকে শুদ্ধর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সকালেই পাশের ক্লিনিকে ওকে এডমিট করানো হয়। তুহিন আর উপায় না পেয়ে সুভা বেগমকে কল দিয়ে বিষয়টা জানায়। তিনি নরম মনের মানুষ, তবে এবার শক্ত থাকলেন। শুদ্ধর বাবাকে নিয়ে এই শহরে চলে এলেন। পৌঁছোলেন রাতের দিকে। ছেলের এমন বেগতিক অবস্থা দেখে তিনি থতমত খেয়ে গিয়েছিলেন। জমাটবাঁধা কান্না গলা অবধি এসে আঁটকে গিয়েছিল। টানা ৮ দিন হসপিটালাইজড ছিল শুদ্ধ। এমন মারাত্মক জ্বর এই ২১ বছরের জীবনে এর আগে একবার এসেছিল। তখন শুদ্ধ সবে বারোর। সেবার তার প্রিয় গিটারটি এক দূর্ঘটনাবশত ভেঙ্গে যায়। সারাটারাত সে ভাঙ্গা গিটারটি বুকে জড়িয়ে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে যায়। সকালে সুভা বেগম রুমে এসে ছেলের এলোমেলো অবস্থা দেখে কান্না করে দেন। হস্পিটালে এডমিট করানো হয়। চারদিন জ্বরে ভুগেছিল শুদ্ধ।
কিন্তু এবার! এবার তার কোন প্রিয় জিনিস হারালো? কেউ ভেবে উত্তর পেল না। তবে দেখল—শুদ্ধ বাড়ি ফেরার পর থেকে আর আগের মতো কথা বলছে না। বেশ চুপচাপ! ভার্সিটিতেও যাচ্ছে না। এভাবেই কেটে গেল ১৫টা দিন। সুভা বেগম নিজের বাসায় ফিরেছেন। সবাই জোর করেও শুদ্ধকে ভার্সিটিতে নিতে পারেনি। এর মাঝে শুদ্ধর চোখে-মুখে উপচে-পড়া বিষণ্ণতা দেখা দিয়েছে। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না। কোনো কাজে মন নেই। সারাটাক্ষণ রুমবন্দী হয়ে থাকে। পছন্দের গিটারটিও ছোঁয়নি আজ পনেরোদিন।

তার মাঝ দিয়ে কী যাচ্ছে—কেবল সে-ই জানে। দমবন্ধকর কান্না পায়। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। হাঁসফাঁস লাগে। যেদিকে তাকায়, সেদিকে কেবল এক স্নিগ্ধ মুখ দেখতে পায়। কলম দিয়ে মুখের সামনে এসে জ্বালাতে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজতে গুঁজতে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা, বিরক্ত হয়ে কুঁচকে রাখা চোখ-মুখ, প্রচন্ড রাগে দাঁতে দাঁত পিষে শ্বাস ফেলার ধরন, তীব্র তেজ, তীক্ষ্ণ চাহনি, অভিজ্ঞ সম্মোহনী সবটাই শুদ্ধর চোখের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে। আর কানে! হাতুড়ি দিয়ে মন ভেঙে দেওয়ার মতো একটা কথাই বার-বার ঘুরে-ফিরে আসে, “শুদ্ধ! তুমি কি ভেবেছ—একটা ঊনত্রিশ বছর বয়সী বাঙালি নারী অবিবাহিত থাকে?”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here