অবশেষে পর্ব ১

#অবশেষে প্রথম পর্ব।

আমার গায়ের রং একটু শ্যামলা বর্ণের হওয়ায়, বিয়ের বাজারে দামটা নিম্নমুখী। আমার বড় আপুর দাম ছিল, পিয়াজের মতো চড়া।বড় আপুর বিয়ের আগে, আমাদের বাড়িতে কত মানুষের আনাগোনা ছিল।আত্মীয় স্বজনরা, বিভিন্ন ছেলের খবর নিয়ে হাজির হতো।বড় আপুর বিয়ের পর, এদের যাতায়াত কমে গেল।আমার জন্য কোন প্রস্তাব নিয়ে, কেউ উপস্থিত হয় না।বড় আপুর জন্য পাত্র বাছাই করেছে, আমার ক্ষেত্রে উল্টো পাত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।বাবা মা দুজনেই আমায় নিয়ে মহা চিন্তিত।আমার বিয়েশাদি নিয়ে মাথাব্যথা কম।এইতো বেশ আছি।বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, অনেকে ফেসবুকে নানা ভঙ্গিতে বরের সাথে ছবি আপলোড দেয়।
এসব দেখে মাঝেমধ্যে মনে হয়, একটা বর থাকলে খারাপ হয় না।
পরক্ষনেই আবার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেই।আমি বিয়ে করবো না, এমন পণ করিনি।বাবার পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। প্রতি রাতে বাবা আমার ঘরে আসবে, ঘুমানোর আগে আমাকে না দেখে, বাবা কখনো শুতে যায় না।এটা রোজদিনকার ঘটনা।

কিরে মনি কি করিস?

কিছু না বাবা,বাবা আমার পাশে এসে বসে, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে টুকটাক কথা বলে।বাবার কোলে মাথা দিয়ে, শুয়ে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে।মা প্রায়ই রাগ করে বলে উঠে, মেয়েটাকে এতো আদর দিয়ে বাঁদর বানিয়ো না।পরের ঘরে গেলে কষ্ট পাবে।বাবা হাসে আর বলে, মনি সবখানে আদরে থাকবে।ওকে ভালোবাসবে না এমন মানুষ হয়নি দুনিয়ায়। বাবার এসব কথা শুনে, মনের ভীতর কেমন আনন্দের বাতাস বয়ে যায়।

হ্যারে মনি, তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?

ভালো বাবা

তোর শিমুর সাথে কথা হয়েছে?

শিমু আমার বড় আপা।আপা আমাকে মাঝে মাঝে কল দেয়, দীর্ঘ আলাপ জুড়ে দেয়।আপার স্বামী বিরাট ধনী। আপার কোন কাজ নেই,সারাক্ষণ অবসর।দুলা ভাই ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।সবাইকে কল দিয়ে খোশগল্প করে সময় কাটায়।জী হয়েছে বাবা, আপা ভালো আছে।

ঠিক আছে মা শুয়ে পর।বেশী রাত জাগবি না।

বাবা কিছু সময় বসে থাকবে নিরব হয়ে।আমার মাথায় হাত বুলাবে, তারপর আস্তে করে উঠে যাবে,এমন ভঙ্গিতে কিছু বলারছিল বলা হয়নি।
ধীরে ধীরে হেটে যাবে, দরজায় গিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে। আমার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিয়ে ফিরে যাবে।বাবার একাজগুলোতে কি মায়া জড়ানো থাকে।বাবা চলে যাওয়ার পর মায়ার একটা আমেজে থেকে যায় সারা ঘরটা জুড়ে।

আমি উঠে আমার রুমের আয়নার সামনে দাঁড়ালাম।আমার এরুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো। একটা ছোট খুব সুন্দর ডিজাইনের খাট।একটা টেবিল, একটা চেয়ার, ড্রেসিং টেবিলটা বড় আপুর ছিল, সেটা এখন আমার দখলে বেশ ভালোই লাগে।রুমটায় নীল রংয়ের দেয়াল।দুতলা এই বাড়ীটা আমার বাবার সারাজীবনের সঞ্চিত সম্পদে গড়া।নিজেদের মতো করে সাজিয়েছি।মা একটু বেশি কড়া, মেজাজ গরম করে ফেলে অল্পতেই।
বাবা ঠিক উল্টো। আয়নায় নিজেকে দেখতে বেশ লাগে।আমি নিজেই নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি।গাঁয়ের বর্ণ একটু ময়লা হলেও, আমি দেখতে খারাপ না।রাস্তায় বের হলে দুচারজন আড় চোখে তাকায়, তা ঠিক বুঝতে পারি।মায়ের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

কিরে মনি, এতো রাতে এখনো ঘুমাসনি?
এইতো মা শুয়ে পড়বো।
রাত জেগে চেহারায় কি অবস্থা করেছিস! একবার দেখেছিস আয়নায়?

এখনি শুয়ে পড়ছি।মাটা একটু কেমন জানি!

আজ মা আমাকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে নিষেধ করলেন।এমনটা খুব কম হয়।বরং আমি না যেতে চাইলে, আমাকে জোর করে পাঠানো হয়।মায়ের মতিগতি দেখে বুঝা যাচ্ছে, কি হবে? আজ।আবার কারো সামনে গিয়ে দাঁড়াও, এনিয়ে কয়েকবার হয়েছে ঘটনাটা।

বিকালে বাবার সাথে একটা ছেলে আসলো।দেখতে ভালো।খুব স্মার্ট মনে হলোনা।একটু সহজ সরল। বাবার অফিসে চাকুরি করে।আমরা বেশ কিছুক্ষন একসাথে সময় কাটালাম।বাবা, মা, আমি আর নোমান।
নোমান একবার আমার দিকে, এক নজর তাকালো, তারপর লজ্জায় আর তাকায়নি।কথাও বলে খুব কম।বাবাই কথা বলছিলো।ওশুধু টুকটাক জবাব দিলো।প্রায় ঘন্টাখানিক সময় ছিলো।এতোটা সময় নিচের দিকে, তাকিয়ে থেকেছে বেশি সময়।বাবার খুব পছন্দ নোমান কে।মায়ের পছন্দ না।
ছেলেরা ধনীনা।আমাদের মতো সামান্য একটা মাথাগুজার ঠাই আছে।
পুরোপরিবারের একমাত্র রোজগারী নোমান।ওর বাবা অবসর নিয়েছেন।
একটা সরকারি ব্যাংকে অফিসার ছিলো।ওরা দুই ভাই, এক বোন।
ছোট ভাইটা এবার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।নোমান কে আমার খারাপ লাগেনি।

বাবা নোমানের ব্যাপারে খুব আগ্রহী। মায়ের কথা এমন ফকিরের কাছে, মেয়ে দিয়ে মেয়েকে সারাজীবন কষ্টের সাগরে ভাসাতে পারবো না।
আপাও মায়ের পক্ষে। আমাকে কল দিয়ে বললো, কিছুতেই রাজি হবিনা।
এমন গরীব ঘরে গেলে, তোর সারাটাজীবন আপসোস করে কাটবে।

আমি পড়েছি দুটানায়। নোমানকে আমার একটু একটু ভালো লেগেছে। ওর সরলতা ভালোমানুষির জন্য। তাই বলে আমি নোমানের প্রেমে পড়ে যাইনি।বাবা যে আমাকে জোর করছে তানয়।বাবা বললো মারে, তোর জীবন তুই সিদ্ধান্ত নিবি।আমি দেখেছি নোমান ছেলেটা ভালো।হয়তো অঢেল টাকা নেই।এখন তুই সিদ্ধান্তনে কি করবি?

সেদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে দেখলাম নোমান দাড়িয়ে আছে।দেখেই বুঝলাম, আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।যেই আমাকে দেখলো, একটু অবাক হওয়ার ভান করলো।যেন কিছুই জানেনা।আমি এখানে পড়ি।আমি বিস্মিত হলাম! এতো লাজুক ছেলেটা এতো সাহস পেলো কোথায়?
আপনার হাতে সময় আছে? তাহলে আসুন, এক কাপ কফি খাই

আপনি কিছু বলবেন?
আমায় বুঝি আপনার পছন্দ না!

না না তানয়
তাহলে পালাতে চাচ্ছেন
আচ্ছা চলুন, তবে খুব বেশী সময় থাকতে পারবোনা।বাড়ী ফিরতে হবে।
আচ্ছা চলুন।

একফিশোপটা অনেক নিরিবিলি। এখানের পরিবেশটা খুব সুন্দর। একটা প্রকৃতির ছোয়া আছে। চারদিকে ছোট ছোট গাছ দিয়ে ঘেরা, হালকা আলো আঁধারি পরিবেশটা বেশ রোমান্টিক। যদিও নোমানের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক না। তবুও এখানে এসে খারাপ লাগছে না।এখানে এসে নোমানের সে লাজুকভাবটা ফিরে এসেছে। রাস্তায় কেমন সাহসী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

কি খাবেন?

একটা কফি আর কিছু না।
ওকে, দুকাপ কফির অর্ডার করলো নোমান।

আপনি কিছু বলবেন?

না আমি এদিকে, একটা কাজে এসেছি। হঠাৎ আপনাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম।লাজুক ভঙ্গিতে বললো।আপনার আম্মা ভালো আছে?

জী, ভালো।আপনার বাড়ীর সবাই ভালো?

জী, ভালো আছে।

কথা ফুরিয়ে গেল নোমানের, আর কিছু বলছেনা।আমার দিকে তাকাচ্ছে,
অনেকটা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার চেষ্টা, ধরা পড়ায় বোকা বোকা হাসি দিচ্ছে। বিশ মিনিট ছিলাম, আমরা সামনা সামনি তবুও নোমান লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কয়েকবার।তারপর বেরিয়ে পড়লাম।নোমান আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার অনুরোধ করলো।আমি মানা করায়, আর কিছু বললো না।একটু জোর করে বলার সাহস নোমানের নেই।

পরেরদিন নোমানকে দেখলাম, ওই জায়গাটাতে দাড়িঁয়ে আছে।আমাকে দেখে অন্যদিকে দ্রুত হেটেঁ পালিয়ে গেল।আমিও ডাকলাম না।বোকাটাবোধ হয় আমার প্রেমে পড়ে গেছে!আমি এখন কি করবো?
এবোকাটার গলায় মালা পড়াবো।নাকি মা আর বড় আপুর কথায়, বড়লোক কোন ছেলের অপেক্ষায় থাকবো?

নোমান সোজা হেঁটে চলে গেল।একবারের জন্য পিছনে ফিরে তাকালোনা।আমি বাড়ী চলে আসলাম।একবার ভাবলাম বাবাকে কথাটা বলি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলা হয়নি।

পর পর একই ঘটনা ঘটতে লাগলো।নোমান আমার ইউনিভার্সিটিতে আসছে কিন্তু আমার সাথে দেখা করছে না।দেখা হলে কিবা কথা বলবে?
তাই দেখা করছেনা।এঘটনা আমার মনে একটু কেমন কেমন লাগছে।
নোমানের জন্য একটু একটু মায়া লাগছে।প্রতিদিন বিকালবেলা এসে দাড়িঁয়ে থাকে।আচ্ছা নোমানের অফিস আছে, তাহলে কি করে প্রতিদিন আসে!

আজ মা আমার দিকে একটু কেমন করে দেখছে।আমার কোন পরিবর্তন হয়েছে কি?রাতে খাবার টেবিলে মায়ের গভীর চাহনি খেয়াল করলাম।

মা, মনি তোর কি হয়েছে ?

কিছুই হয়নি মা।

তোকে এমন মনমরা দেখাচ্ছে!কিনিয়ে এতো চিন্তা করছিস?

না মা কোন চিন্তা নেই,সামনে পরীক্ষা তাই। আজ খাবার খেতেও খুব একটা ভালো লাগছে না।এখন না খেয়ে উঠলে মায়ের সন্দেহ ঘনীভুত হবে।অনিচ্ছায় শর্তেও খেয়ে উঠে এলাম।আজ বারবার নিজেকে আয়নায় দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। আজ আমাকে খুব সুন্দরী মনে হচ্ছে নিজের কাছে।
নোমানের মায়া মায়া চেহারা মনে ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে কেমন ঘাপটি মেরে বসেছে।বারবার ওর কথা চিন্তায় চলে আসছে।আমি কি নোমানের প্রেমে পড়ে গেলাম। কি আশ্চর্য! বোকাটা কথা বলে না,দেখা করে না।অতোদূর থেকে আমায় কাবু করে ফেললো? না না আমি বোকার প্রেমে পড়িনি।দাড়িয়ে থাকতে দেখে, হয়তো একটু মায়া জন্মেছে। নিজেকে বুঝাচ্ছি।
আজ দেখি রাতেরবেলা মা এসেছে আমার রুমে, হাতে এক গ্লাস দুধ।
মা আমার টেবিল দুধের গ্লাস রেখে,চেয়ার টেনে পাশাপাশি বসলো।

দুধটা খেয়েনে।

এখন দুধ খেতে ইচ্ছে করছে না,মা

খেয়েনে, ভালো লাগবে।মায়ের কন্ঠ কেমন মোলায়েম!

এখন না খেলে, মা আবার কি করে বসবে? আবার অনিচ্ছায় খেতে হলো।মেয়েদের নিজের ইচ্ছেগুলো কেমন মলিন হয়ে যায়।অন্যের খুশি, আনন্দ, দুঃখের কথা ভাবতে ভাবতে নিজেরও যে আলাদা একটা জগৎ আছে ভুলে যায়।বেশিরভাগ কাজ করতে হয় অন্যের ইচ্ছায়।অন্যের আনন্দে আনন্দ খুঁজে বেড়ায়। প্রজাপতির মতো মেয়েদের দুটি জীবন।প্রজাপতির সৌভাগ্য সে আধাঁর থেকে আলোতে আসে।মেয়েরা আলো থেকে অজানায়। আচ্ছা মা সুখী হতে অনেক টাকা লাগে?

তা জানিনা, তবে জীবনে টাকার দরকার আছে।এই যে শিমুটা দেশবিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, মনের সাধ আহ্লাদ মিটাতে পারছে।এটা দেখে আমার মনটা জুড়িয়ে যায়।নিজেতো কোনদিন পারলাম না, চারদেয়ালে কাটিয়ে দিলাম জীবনটা!তোরা কেন আমার মতো জীবন কাটাবি! তোকে আমি বড় ঘর দেখে বিয়ে দিবো, তুই শিমুর মতো নিজের ইচ্ছেগুলো পূরণ করবি।

মা তুমি কি বাবার সাথে সুখী নও?

তোর বাবা মানুষটা খুব ভালো। এমন মানুষ হয়না।মানুষটা আমাকে সোনা গয়না দামী জিনিসে জড়িয়ে দেয়নি,তবে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছে।

তাহলে এটা কি সুখ না?

হয়তো সুখ।আবার যখন দেখি অন্যরা কত ভালো জীবনযাপন করছে।তখন একটু কষ্ট হয়।অনেক কিছু না পাওয়ার ব্যাথাটা জেগে উঠে।
কতটা স্বপ্ন পূরণ করতে পারলামনা সেটা বড় হয়ে উঠে।দেখ একটা বাড়ী করতে নিজেদের সারাটাজীবন কেটে গেলো।না পারলাম কোথাও ঘুরতে যেতে, না পারলাম নিজের ইচ্ছেমতো পড়তে।একটা অভাবের মধ্যেই কেটে গেলো পুরোজীবন।এটাও বড় কষ্টের মা! তাইতো চাইনা তোরা এ কষ্টটা বয়ে বেড়া।

মা আমারতো আপুর মতো জীবন না,তোমার মতো জীবন ভালো লাগে।মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম।

থাক এতো আহ্লাদ দেখাতে হবে না।সব মায়াতো বাব মেয়ে,আমি কে!এখন বুঝবিনা।পরে যখন কষ্টে ভাসবি তখন কিছু করার থাকবেনা। এসব সুন্দর কথা বইয়ে লেখা থাকে।কষ্ট তুমি মধুময়।বাস্তব বড় কঠিন সেখানে কষ্ঠ মধু না বিষ। কি জানি নাম? ও মনে পড়েছো নোমান।ওকি তোর সাথে কোনরকম যোগাযোগ করে?

না কেন? মাকে আরকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।

মা আমাকে একটু কাছে টেনে নিয়ে, কোন পাত্তা দিবিনা।তোর বাবাও কোথা থেকে ফকির মিসকিন ধরে নিয়ে আসে।মানুষটার চোখ বড় হলোনা।নিজেতো আমার জীবনটা নষ্ট করলো।এখন আবার তোর জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু করেছে।শিমুটাকে কত কষ্ট করে বিয়ে দিয়েছি।তোর বাবাতো এতো বড় ঘরে দিতে রাজিই ছিলনা।তার কত ভয়! আমরা মানিয়ে উঠতে পারবোনা।দেখ শিমুটা কত ভালো আছে!আচ্ছা শুয়ে পড়।এসব নিয়ে ভাবিসনা আমি তোর জন্য, ভালো ছেলে দেখবো।এখন ঘুমিয়ে পড়।

মায়ের কথাগুলো মনের মাঝে ঘুরতে লাগলো।সত্যি সুখ কোথায়! আচ্ছা আপু কি সুখী? দেখে মনে হয় কত ভালো আছে।টাকার পাহাড়। যখন ইচ্ছে শপিং করছে। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সব ঠিক আছে কিন্তু এতো সবের মাঝে আপু খুব একা নিঃসঙ্গ।এটা আমার চেয়ে কে বেশি জানে।দুলা ভাই আপুকে সব দিয়েছে শুধু সময় দেয়নি।নাইবা থাকলো এমন বিরাট অট্টালিকা, দামী গাড়ি। যাওয়া হলো না কানাডা, সুইডেন।
যদি প্রিয় মানুষটির হাত ধরে পদ্মার পাড়ে হাঁটি সেথায় সুখ থাকবেনা।
রিকশায় চড়ে না হয় কাটলো সারটা পথ।ভালো থাকা কি হবে না।
মায়ের দামী শাড়ি নেই,বাবা দামী চুড়ি হয়তো দেয়না।কিন্তু ছোটবেলা থেকে দেখেছি, মেলায় থেকে বাবা মায়ের জন্য একগুচ্ছ কাঁচের চুড়ি কিনতো আমাদের অগোচরে। চুপিচুপি দেখেছি মায়ের হাতে বাবা নিজ হাতে পড়িয়ে দিতো চুড়ি,তখন মায়ের মুখে ফুটে উঠা সে হাসিতে কি সুখ নেই? এইযে বাবা মায়ের জন্মদিনটা ঠিক মনে রেখে, সেদিন মায়ের প্রিয় ছোটখাটো উপহার দেয়।কম দামী বলেতো তখন মাকে মনখারাপ হতে দেখিনি, বরং মায়ের হাসিমাখা মুখ দেখে আমাদের মাঝে আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে। মায়ের আক্ষেপ আছে কিন্তু নিরব কষ্ট নেই।

আজ ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে নোমানকে দেখলাম না।এই কয়দিনে ওকে দেখে কেমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি।দূর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে মায়া মায়া দৃষ্টিতে। তাতে কেমন একটা পূর্নতা পেতো।আজ শুন্য শুন্য লাগছে।মনে হচ্ছে কি যেন নেই! আজ কেন এলোনা?নোমান আশা ছেড়ে দিলো, তাহলে ভালোই হলো, এতোটুকুতে হাল ছাড়া মানুষ দিয়ে, এতো পথ পাড়ি দেয়া যায় না।কিছুসময় ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কেন দাড়িয়ে আছি আমি! আমি কি নোমানের জন্য অপেক্ষা করছি। না কেন আমি অপেক্ষা করবো? অপেক্ষার কথা কি ছিল। কি সব ছাইপাঁশ ভাবছি।
শেষবারের মতো নোমানের দাঁড়ানোর জায়গাটা দেখলাম, না কিছু নেই।
কেমন মরুভূমির মতো হাহাকার করছে।একটুবোধ হয় কষ্ট হলো।একটু হতাশা। আমার মন আশায় ছিলো নোমান ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবে।
ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে দেখি নোমান আমার সামনে! আমি চমকে গেলাম।

কাকে খুঁজছেন?

কাকে খুঁজবো! এমনি দাড়িয়ে আছি রিকশার অপেক্ষায়।

তাই, কত খালি রিকশা পেড়িয়ে গেলো।ডাকলেন নাতো?

ভালো লাগেনি।

নোমান হাসছে, আপনি বুঝি যাচাই বাছাই করে রিকশায় চড়েন?

হ্যা,বাছাই করে চড়তে হয়।মেয়েদের সব কিছুই বাছাই করে পা ফেলতে হয়।আপনারা ছেলেরা তার কি বুঝবেন! মেয়েদের ক্ষুদ্র বিষয়গুলো খেয়াল করতে হয়।কখন কি বিপদ আসে বলা যায় না।একটা মেয়ের হাজারটা চোখ রাখতে হয়।প্রতিটি পদে পদে মেয়েদের জন্য কাটা বিছানো থাকে।একটু অসতর্ক হলে কাটা বিধে যায়।আপনি এখানে!
আজ কি কাজে এসেছেন?

মিথ্যে বলবো না সত্যি বলবো?

মিথ্যা কেন বলবেন!

মানুষ মিথ্যা বলে কিছু লুকাতে। লুকাতে চায় ভয়ে।

এখানে কিশের ভয় আপনার?

ভয় মানে কি! সব সময় ভয়ংকর কিছু হয়? ধ্বংসের ভয়ে মানুষ সব সময় কাবু হয়।এর বাহিরেও ভয় থাকে কিছু হারানোর ভয়।ধ্বংসের ভয়তো তুচ্ছ। হারানোর ভয় মানুষ কে নিঃশেষ করে দেয়।

কি হারানোর ভয় আপনার!

বুঝেন না, নাকি বুঝতে চান না?

আপনার কথা বুঝতে পারছিনা?

আচ্ছা বুঝতে হবে না।পরে বুঝিয়ে দিবো।একটু সময়তো দেয়া যাবে?

তা দেয়া যায় কিন্তু তাতে কি কোন লাভ হবে?

সব কাজ কি লাভ লোকসান হিসাবে হয়।কত কাজে হিসাব করাই দায়।

আজ নোমানকে অনেক ভালো লাগলো।আগেরদিনের চেয়ে লাজুকভাবটা কমেছে। কিছুটা আত্মবিশ্বাসী হয়ে কথা বলছিলো।খুব ধীরে কথা বলে।মনে হয় কথাগুলো অনেকবার রিহার্সাল দিয়ে এসেছে। খুব বেশি কথা জুড়িতে জমাতে পারেনি।কথার মালা বুনতে গেলে, তাতে কম পড়ে যায়।হারিয়ে যাওয়া কথা খুজতে থাকে।চিন্তিত মনে হয়।কত কথা বলতে হতো, বলতে পারেনি হতাশায় ভোগে।আজও আসার সময়, সাথে এক রিকশায় আসার সাহসী হয়ে উঠেনি ঠিকই, তবে একটা কাজ করেছে আমাকে রিকশায় তুলে দিয়ে অন্য রিকশায় পিছু নিয়েছে। বোকাটা একবার বলতে পারেনি চলেন এক সাথে যাই।বললে আমি ফেলতে পারতাম কি? মনে হয় পারতাম না।কি ক্ষতি হতো দু’জন এক সাথে রিকশায় চড়লে।মানুষজন দেখলে হয়তো কথা ছড়াতো।এটাই নোমান ভেবেছে।বলদটার সবদিকে খেয়াল আছে।আমি রিকশায় বসে আছি, আমার পিছনের রিকশায় নোমান আসছে। কেমন একটা ভালোলাগা ঘিরে ধরেছে। কেউ একজন আমার জন্যই আছে,এটা মনকে উদ্বেলিত করছে।

বাসায় এসে দেখি আপা এসেছে।দুলাভাই আসতে পারেনি, ড্রাইভার দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। এটা দেখে আমার বুকের মধ্যে কেমন চক্কর দিলো।
নোমান অন্য রিকশায় পিছু নিয়ে বাড়ী পর্যন্ত এসেছে। আমি দেখেছি কিনা ও জানেনা।তবুও এতোটা পথ পিছনে এসেছে। ওর এ ভালোবাসা আমায় আঁকড়ে ধরলো।আমি বোধহয় জড়িয়ে গেলাম ভালোবাসার জালে।

চলবে—

® নাবিল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here