#অবুঝ বেলার তুমি
পর্ব ২
ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দাটা সরাতেই সূর্য টা উঁকি দিলো জানালা দিয়ে। আধার কালো রাত পেরিয়ে মিষ্টি একটা সকালের আহবান জানাচ্ছে যেন। জীবনের সব কটা কালো অধ্যায় গুলোও যদি ফেরিয়ে গিয়ে এরকম মিষ্টি একটা নতুন দিনের আহবান জানাতো তাহলে কতই না ভালো হতো।
দেখতে দেখতে আরো ছয় টা বছর কেটে গেলো। কিন্তু তুলতুলময় অসুখ টা আমার নিত্যদিনকার সঙ্গি হয়েই রয়ে গেলো।মাঝে মাঝে সেই অসুখ আরো খানিকটা গাড়ো হয়ে তার অস্তিত্বের জানান দেয়। অসুখ টা কতখানি বেড়েছে সেটা মাপতে গিয়ে পাড়ি দিতে হয় নির্ঘুম রাত।আচ্ছা তুলতুল দেখতে এখন কেমন হয়েছে নিশ্চয়ই অনেক টা বড়।এখন তো সদ্য একটা কিশোরী তে পরিণত হয়েছে।তার কি আমার কথা মনে আছে!
ধূর আমি ও না কি ভাবছি! সেই সময় টা কাউকে মন রাখার বয়স নাকি?যে তার আমাকে মনে পড়বে!তার জীবনে কি অন্য কেউ এসেছে?ভাবতেই চিনচিনে একটা ব্যাথার অনুভূতি হলো মন পাজরের সেই ভাঙ্গা ঘরটায় যেটা গড়ে তুলবার আগেই ধমকা হাওয়ার মতো একটা ঝড় এসে সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে চলে গেলো।বারান্দায় গিয়ে একটু হাটতে মন চাইলো।দখিনা বাতাস মৃদু মন্দ বইছে।মন টাকে কেমন শীতল করে দিয়ে যাচ্ছে।আর আমিও চাইছি।তুলতুলের তুলতুলময় নরম হাত গুলো আমাকে ঠিক এই বাতাসের মতোই ছুয়ে দিয়ে যাক।যেনো হৃদয়ের সব গুলো ঝড় থামিয়ে দিয়ে মৃদুমন্দা বাতাসের মতো হৃদয় টাকে একটু শীতল করে দিক।
ব্যাচেলর লাইফ নিজেকেই সব করতে হয়।যাই এক কাপ কফি বানিয়ে আসি। সময় হয়ে এসেছে কলেজ যাবার।একটা ভার্সিটি তে জয়েন হলাম দু বছর। নবীন বরণ অনুষ্ঠানে আমার দুটি চোখ চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে ছিলো, সেই নবীনদের মাঝে যদি তুলতুলকে একবার খুজে পাওয়া যেতো!এবছর তো গুঞ্জনের এইচ. এস.সি তে ভর্তি হওয়ার কথা। খুব তো চেয়েছিলাম সব ভুলে যেতে।নিজের বাবা মা ভাই এমন কি নিজের গড়ে তোলা এক একটা যত্নের গাছ সব ছেড়ে দিলাম। সেই বিভীষিকা ময় ব্যাথা টাকে ভুলতে।কিন্তু ওই যে বলে না,
“তুমি যাকে চাওনা সে তোমাকেই চায়,আর তুমি যাকে চাও সে তোমকেই চায় না”
ঠিক এই একই ব্যাপার টাই ঘটছে এখন আমার সাথে।আমি তো তুলতুল কে চেয়েছিলাম।তুলতুলময় অসুখ টাকে তো নয়!
কিন্তু সেই অসুখ টাই আমার আপন হয়ে আমাকে আকড়ে ধরে রইলো।অথচ যার নামের সেই অসুখ টা সে ই নিখোঁজ।
কফি তে চুমুক দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলাম আঙ্কেল গাছে পানি দিচ্ছে।খুব সুন্দর কতগুলো ফুল ফুটে আছে।কিন্তু আমাকে যদি কেউ এখন জিজ্ঞেস করে আমার সব চাইতে অপছন্দের জিনিস টা কি?
আমি নিঃসন্দেহে বলে দিতে পারবো “ফুল।” হয়তো সবাই আমাকে পাগল ভাবছেন কিন্তু না এটাই বাস্তব।ফুল শুধু দেখতেই সুন্দর।তার মাতাল করা ঘ্রান ও সুন্দর।কিন্তু সেটা কখনো আপনি বা আমার জন্য প্রযোজ্য নয়।এই ফুল কেই ভুল করে চেয়ে বসেছিলাম কিন্তু পেলাম আর কই?
আমরা খালি দূর থেকে তার সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারি। নিজের কাছে আর রাখিতে পারি কই।সে তার নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী ঝরে তো যাবেই।
নাহ আর দেরী করা যাবে না।এবার তো নিজেকে ফিলোসোফি মনে হচ্ছে।কলেজের জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো অঙ্কুর।আজ প্রথম ক্লাস ফার্স্ট ইয়ারদের।কলেজে পা রাখতেই নতুন নতুন কতশত মুখ চোখে পড়ছে।সবার মনে এক একটা নতুন স্বপ্ন।এই অবুঝ মনে কত শত স্বপ্ন ই তো উঁকি দেয়।সব টা পূরন হয় কি!
গতকাল যেদুটো চোখ একটা মুখ কে দেখার আশায় হন্য হয়ে খুজে ছিলো।আজ তাকে খোজার কোন চিহ্নের ছিটেফোটা নেই। মেনে নিয়েছে সে তার বাস্তবতাকে।
ক্লাসে ঢুকতেই সবাই দাড়িয়ে সালাম জানালো।অঙ্কুর সবাই কে গুড মর্নিং জানালো।আর সাথে সাথে বাকি রা ও তার প্রতি উত্তরে “গুড মর্নিং স্যার” বলে আওয়াজ করে উঠলো।আজ প্রথম দিন তাই সবার সাথে পরিচিত হওয়া যাক। অঙ্কুর একেক জন করে দাড় করিয়ে নাম আর এস.এস.সি র পয়েন্ট জিজ্ঞেস করলো।
অনেকেই একটু সংকোচ বোধ করলো যারা পয়েন্ট কম পেয়েছে।কিন্তু অঙ্কুর খুব সহজ কঅরে সবাই কে বুঝিয়ে দিলো।
_____”তোমাদের ফ্যামিলিতে সবার বড় ভাই বোন আছে তো?
____সবাই একসাথে হ্যা জানালো।
____কখনো কি মনে হয়েছে বড়দের কোন ও আচরণ খারাপ কিংবা বাবা মা বা অন্য কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে।বা লোকটাকে সঠিক বলে মনে হয় নি!
____অনেকেই হ্যা জানালো আবার অনেকেই না।
____আমরা অনেকেই আন্দাজ করে বলতে পারি লোকটা আমাদের থেকে বয়সে বড় অথচ কি অদ্ভুদ আর খারাপ আচরণ ই না করছে।সে আসলে বয়সেই বড় হয়েছে জ্ঞান কিংবা মানে নয়।
___ঠিক তেমনি তুমি কত পয়েন্ট পেয়েছো সেটা ফ্যাক্ট না ফ্যাক্ট হলো কতটা জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছো।কি লাভ পয়েন্ট বাড়িয়ে যদি জ্ঞান টাই অর্জন না হয়,মনুষ্যত্ব বোধ ই না জাগে।
পড়ালেখা করার মূল কারণ হচ্ছে জ্ঞান অর্জন।তাই কে বেশি কিংবা কে কম পেলো সেটা নিয়ে লজ্জা না পেয়ে কে কতটুকু জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছো সেটাই ভাবো।
অঙ্কুর তার বক্তব্য শেষ করার আগেই দরজায় মেয়ে কন্ঠের কেউ দাড়িয়ে বললো,
___স্যার’ আমি কি আসতে পারি?
____অঙ্কুর মুখ ঘুরিয়ে তাকাতেই বুকের সেই জায়গা টায় আবার চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলো।সেই নাক সেই গুলু মুলু মুখ,আর সেই থুতনির নিচের কাঁটা দাগ টা।
____অঙ্কুর যেনো কিছুক্ষন ঘোরের মাঝে ছিলো। মেয়েটা আবার বলে উঠলো আমি কি আসতে পারি?
____অঙ্কুর এবার নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো।আর বললো” ইয়েস কাম ইন”।
বুকের ভেতর ঢিপঢিপ আওয়াজ টা যেনো বাড়তেই লাগলো।কি করে এতো টা মিল হতে পারে!কিউরিসিয়াস হয়ে অঙ্কুর জিজ্ঞেস করলো আসতে এতো লেইট হলো যে?
____আসলে বাসা চেঞ্জ করলো তো তাই। আর তাছাড়া ক্লাস খুজে পাচ্ছিলাম না।
____অঙ্কুর এবার অস্থিরতা বোধ করতে লাগলো। এ তুলতুল নয়তো!ধ্যাৎ কি সব সিনেমা সিনেমা ফিলিং।
____তবুও কিউরিসিটি নিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেললো।সবার সাথে তো পরিচিয়তা হলো।এবার তুমি তোমার পরিচয়টা বলো।
____মেয়েটা তার নাম জানালো “গুঞ্জন”।
____অঙ্কুর এর নাম টা খুব চেনা চেনা মনে হতে লাগলো।কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলো না।কিন্তু সে হলফ করে বলতে পারবে নাম টা সে শুনেছে এর আগেও।ভাগ্য হয়তো তাদের একসাথে এখনি মিলাতে চাইছে না।
কিন্তু মনের ভেতর খুদ টা রয়েই গেলো।
____ক্লাস শেষে গুঞ্জন অন্য মনোষ্ক হয়ে হাঁটছিলো।কেন জানিনা তার ও স্যার টাকে দেখে বাবুন দার কথা মনে পড়লো।বাবুন দার ও তো কপালে একটা কাঁটা দাগ ছিলো স্যার টার মতোই।
গুঞ্জন বড় হওয়ার পর একদিন তার বাবুন দাই তাকে বলেছিলো।সেদিন যখন ছাদের কার্নিশে বসে পা দুলিয়ে বসেছিলো।কিন্তু বিহানের সাথে ঝগড়া বাধায়,দুজন যখন হাতাহাতি করছিলো গুঞ্জন পড়েই যাচ্ছিলো অল্পের জন্য বেঁচে গেলো।যদি বাবুন দা এসে তাকে না ধরতো।সেটা মনে পড়লে গুঞ্জন এখনো ভয় পেয়ে গা শিউরে উঠে।
তার বাবুনদার মুখে অদ্ভুদ এক ভয় দেখেছিলো গুঞ্জন।এতোটা ভয় পেয়েছিলো যে বিহান কে খুব জোরে একটা চড় ও দিয়েছিলো।বেচারা ছোট্র বিহান এই নিয়েই সবসময় গুঞ্জনের সাথে জটলা বাধাতো যে তার বাবুন দা তার থেকেও বেশি গুঞ্জন কে ভালোবাসে।
কথাগুলো মনে পড়তেই গুঞ্জনের মন পুরনো দিন গুলোতে ফিরে যায়।আর অন্যমনস্ক হয়ে হাটতে গিয়ে কিসের সাথে উষ্ঠা খেয়েই পড়ে গেলো।বাকি রা সবাই কেমন হো হো হাসতে লাগলো।এদের কমন সেন্স টুকু অবদি নেই।কেউ পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেলো কি পেলো না তাতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না।কিন্তু কিভাবে কারো মজা বানাবে সে বিষয়ে খুব পাক্কা এরা।এদের কি করে শায়েস্তা করতে হয় সেটা গুঞ্জনের বেশ ভালো করে জানা আছে।
গুঞ্জন যেই উঠতে যাবে তখনি কেউ এসে ওর দিকে হাত বাড়ালো ধরে উঠার জন্য।গুঞ্জন মুখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলো ক্লাসের সেই স্যার টা যাকে দেখতে ঠিক তার বাবুন দার মতো।বাবুন দা বড় হলে ঠিক এতোখানি ই লম্বা হতো।বাবুন দা ও তো দেখতে বেশ অনেক খানি ই লম্বা ছিলো কিন্তু এতো বেশি স্বাস্থ্য ছিলো না।প্রিম্যাচিউর বেবি হওয়ায় স্বাস্থ্যের দিক থেকে একটু উইক ছিলো।ফর্সা হওয়ায় চুল গুলো অনেকটা লাল বর্নের দেখতে ছিলো।
এই স্যার টা ও ঠিক তেমন।কি করে এতোটা মিলে যেতে পারে।অঙ্কুর গুঞ্জন কে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে খানিকটা লজ্জা পেয়ে হেসে উঠলো।তারপর বললো,
___কি হলো উঠতে পারবে তো? নাকি ধরতে হবে?
_____গুঞ্জন ও বেশ খানিক টা লজ্জা পেলো।তার পর বলল না না ঠিক আছে উঠতে পারবো আমি।
____গুঞ্জন আর পারছে না কিউরিসিটি দমিয়ে রাখতে। তাই প্রশ্নের ছলেই জিজ্ঞেস করল।
___থ্যাংক ইউ –স্যার?
___অঙ্কুর বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলো গুঞ্জন আসলে কি জানতে চাইছে।
____তাই হেসে উঠে বললো “অঙ্কুর।”
___তোমাদের কেমিস্ট্রি টিচার।
কিন্তু গুঞ্জনের ও দুর্ভাগ্য সে ও শুধু বাবুন দা নাম টাই জানে। অঙ্কুর নাম টা কখনো শুনেছে বলে ও মনে হচ্ছে না।
চলবে