#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৫
‘আমরা এখানে কেনো এসেছি রাহান?’
নিজের মাঝে নিঃশ্বাস আটকে কাপা কাপা গলায় প্রশ্ন করলো ঝুমকো। রাহান উত্তর দিলো না। চোয়াল শক্ত করে বসে থাকলো। ঝুমকো এবার তেজি গলায় বলল,
‘আমরা কাজী অফিসে কেনো রাহান? টেল মি। ‘
নিজে গাড়ি থেকে নেমে ঝুমকোর হাত ধরেও টেনে গাড়ি থেকে বের করলো রাহান। ঝুমকোর হাতের কব্জি শক্ত করে মুচড়িয়ে ধরে নিয়ে যেতে লাগলো ভাঙাচুরা বিল্ডিং টার দিকে।
‘রাহান আমার হাত ছাড়ো। লিভ মাই হেন্ড প্লিজ। তুমি কি করছো? আমরা এখানে কেনো এসেছি? রাহান তুমি এটা আমার সাথে করতে পারো না। তোমার কোনো রাইট নেই। হোয়াট আর ইউ ডুয়িং? আর ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড? কথার উত্তর দেও রাহান।’
পা থামিয়ে পেছন দিকে ঘুরে মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করে থাকার জন্য দেখিয়ে রাহান ভয়ানক ভাবে চোখ লাল করে বলল,
‘হিশশ….ডোন্ট সাউট। চেঁচিয়ে লাভ নেই। আমার কোনো রাইট নেই তাই না? সেই রাইট টাই আজ তৈরি করবো। তোমার উপর শুধু আমার অধিকার। বয়ফ্রেন্ড না? বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাও? রেসটুরেন্টে যাও? ফষ্টিনষ্টি করো? আজকের পর থেকে তোমার জীবনে শুধু হাসবেন্ড রাহান আদমান থাকবে আর কেউ নয়।’
রাহান দাত কিড়িমিড়ি করে বলে আবার সামনের দিকে হাটা দিলো। রাহানের কথায় ঝুমকোর চোখ বেয়ে ঝর্ণার মতো পানি পরতে লাগলো। ঝুমকো কাদতে কাদতে বলল,
‘রাহান আমার কথাটা শুনো প্লিজ। তুমি এমন করতে পারো না। ইউ ক্যান্ট ডু দিস টু মি। তুমি তো আমাকে ভালোবাসো? আমাকে একটু বিশ্বাস করো প্লিজ।’
‘ভালোবাসি বলেই বিয়ে করছি। নাও কিপ ইউর মাউথ জাস্ট সাট।’
রাহান টেনে হিচড়ে নিয়ে যায় ঝুমকোকে। তার শ্যামলা মুখশ্রীতে রাগের ছলক। চলন ফেরন উদ্ধত। হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে পরেছে মস্তিষ্ক। সে খবর পেয়েছে কাল রাতেও ঝুমকো সোহেলের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। আবার আজ ও রেস্টুরেন্টে গেছে। সে নিজের মাঝে নেই। একবার যে ভুল করেছে এবার আর তা করবে না। কোনোরকম রিস্ক এবার নিবে না।
‘রাহান প্লিজ আমার কথাটা একবার শুনো লক্ষিটি। আমি সেইদিন… ‘ আর বলল না ঝুমকো। সামনে তাকাতেই বোবায় ধরলো তাকে। রাজ্যের বিস্ময়তা অবাকতা ফুটে উঠলো চোখে। মুখে ফুটে উঠলো অসহায়ত্ব। ঠোঁটে ফুটলো এক চিলতে হাসি।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাহানের ছোটো ভাই তামিম আর রিয়া। তামিম এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে। ঝুমকোর থেকে দু বছরের ছোটো। তামিম ছোট করে বলল, ‘হাই ভাবী। কেমন আছো?
ঝুমকো রাহানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলতে লাগলো,
‘তামিম?? তুমি? রিয়া? তামিম প্লিজ তোমার ভাইকে একটু বোঝাও। রিয়া তুই এখানে কেনো? সে যাই হোক, ওকে একটু বোঝা। ও আমাকে কাজী অফিসে কেনো নিয়ে এসেছে? একটু বল তোরা।’
‘কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করেন। সাক্ষী থাকবে তামিম আর রিয়া।’ রাহান বলল চড়া গলায়।
ঝুমকোর মাথায় বজ্রযানী ঘটলো। গোটা আকাশ ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো। অবাক হয়ে তাকালো রাহানের দিকে এরপর তাকালো রিয়ার দিকে। রিয়া মাথা নিচু করে। ঝুমকোর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না। অনেক কষ্টে সে বলে, ‘শেষ পর্যন্ত রিয়া তুই এটা করলি? তুই? আমি নিজের ছোটো বোনের চেয়ে বেশি ভালোবাসি তোকে। আর তুই কিনা…?’
ঝুমকো বলতে পারলো না ধপ করে সামনের চেয়ারটাতে বসে পরলো। রাহান কোথা থেকে একটা লাল উড়না নিয়ে এসে ঝুমকোর মাথায় পরিয়ে দিলো। ঝুমকো বাকরুদ্ধ। কাজী বললেন, ‘বলো মা কবুল….’
ঝুমকো বিরবির করে বলল, ‘আমি এই বিয়ে করবো না। কিছুতেই কবুল বলবো না। কিছুতেই না।’
‘কবুল বলো ঝুমকো।’ দাঁতে দাঁত পিষে রাহান বলল।
‘বলবো না কি করবে? আমি কবুল না বললে তুমি কীভাবে বিয়ে করবে? আমি কবুল বলবো না বলবো না বলবো না। আর ইউ ক্রেজি রাহান? কেনো আমার জীবনটা নরক করে দিচ্ছো? আমি আমার নানুমনি মামা তাদের না জানিয়ে বিয়ে করতে পারবো না তুমি বুঝতে পারছো না?’
প্রথম কথা গুলো জেদি গলায় বললেও শেষের কথাগুলো কাদতে কাদতে বলল ঝুমকো। রাহান আবারো ঠোঁট চেপে কটমটিয়ে বলল,
‘কবুল বলো ঝুমকো। আদারওয়াইজ আই উইল কিল মি।’
ঝুমকো থেমে গেলো। নিঃশ্বাস আটকে গেলো। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে তখন অবধি গড়িয়ে পরছে অবাধ্যতার পানি। অনেক কষ্টে নিজ দায়িত্বে ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে শুধু বলল, ‘রাহান….’
রাহান পকেট থেকে ছুরি বের করে। ঝুমকোর চোখের সামনে দেখিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে,
‘কবুল বলো। ওও…বরদের তো আগে বলতে হয়। ঠিকাছে আমি বলছি। কবুল কবুল কবুল। এই কাজী আলহামদুলিল্লাহ বলেন। আমি কবুল বলেছি। তামিম রিয়া তোমরা শুনেছো তো?’
তামিম রিয়া মাথা নাড়ায়। রাহান পাগলের মতো করে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ওরা শুনেছে। এবার তুমি বলো। বলো না জান…প্লিন বলো। না হলে কিন্তু আমি… ‘
রাহান ছুরি নিজের গলায় ধরতে যায়। ঝুমকো চেঁচিয়ে উঠলো,
‘রাহান…আর ইউ এ মেড। সাইক্রিয়াটিস দেখাও। মানষিক ভাবে অসুস্থ তুমি। কি বলছো এসব? ব্ল্যাকমেইল করছো আমাকে? ওকে করো….যা খুশি করো। আমিও দেখতে চাই। তবুও কবুল বলবো না।’
ঝুমকো নির্বিকার। রাহান বলল, ‘তুমি বলবে না?’
‘না।’
সাথে সাথে ছুরি হাতের উপর চালালো হীতাহীত জ্ঞান শূন্য পাগলাটে রাহান। গড়গড় করে পরতে লাগলো লাল টকটকে তাজা রক্ত। ঝুমকোর হৃদপিন্ড লাফিয়ে উঠলো। রাহান আবার নিজের হাতে ফেস দিতে গেলো। ঝুমকো দৌড়ে গিয়ে চেপে ধরলো রাহানের হাত। তার মুখ ফ্যাকাসে। সে কল্পনাও করে নি রাহান এমন কিছু ঘটাবে। ধম বন্ধ হয়ে আসছে তার। চোখ দুটো উলটে আসছে। হাত পা কাপছে। কাদতে কাদতে অস্ফুটে ভীতি কন্ঠে অসহায় ভাবে বলল ঝুমকো,
‘আমি বিয়ে করবো তোমায় রাহান। আমার ফ্যামিলিকে না জানিয়েই করবো। তবুও তুমি এসব বন্ধ করো প্লিজ। আমি তো ভালোবাসি তোমায়…’
ঝুমকো হাত জোড় করে কেদে কেদে বলে। রাহান মুখে ব্যাথার হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘তাহলে কবুল বলে রেজিষ্ট্রেশন পেপারে সাইন করে দাও জান।’
‘সব করবো আমি সব করবো। তুমি ছুরিটা রাখো প্লিজ।’
‘না আগে সব কমপ্লিট করো তারপর।’
ঝুমকো তার নিষ্পাপ চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে রাহানের দিকে। এই উদ্ধৃত পাগলাটে রাহানকে সে আজ প্রথম আবিষ্কার করছে। এ মানুষ বড় অচেনা। এ তার রাহান না। কি করে তার রাহান হয়? এতো অবুঝ তো তার রাহান নয়। কেনো এমন বাচ্চামো করছে রাহান?
ঘোরের মাঝে থেকেই ঝুমকো তিনবার কবুল বলে দেয়। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু রাহানের রক্তাক্ত হাত।
রাহান তামিম রিয়া একসাথে বলে উঠে ‘আলহামদুলিল্লাহ।’ এদিকে কাজী সাহেব হা করে তাকিয়ে সিনেমা গিলছেন। তার মনে হচ্ছে তিনি কোনো সিনেমার হলে আছেন। রাহান তা দেখে দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল,
‘ওই ব্যাটা, কবুল বলছে শুনেন নাই? আলহামদুলিল্লাহ বলেন। কাজীরা আলহামদুলিল্লাহ সবার আগে বলে। না হলে বিয়ে বিয়ে ফিলিংস আসে না বুঝলেন? ‘
কাজী বোকার মতো মাথা ঝাকিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলেন। এরপর পেপার এগিয়ে দেন। কলম হাতে নিয়ে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে ঝুমকো সাইন করে দেয়। মনে পরে তার নানুমনির মুখ, মামার মুখ, মামীর মুখ, আদরের ছোটোভাই রুম এর মুখ। তারা কত আশা নিয়ে ছিলো ধুমধাম করে ঝুমকোর বিয়ে দিবে। তা আর হলো না। জানাতেই পারলো না ঝুমকো।
রাহান পেপারে সাইন করে শান্ত হলো। হাতে ব্যান্ডেজ বাধলো। চোখ মুখ এবার আগের রূপে ফিরে এসেছে। ঝুমকো তাকিয়ে থাকলো। তার মনে হলো কিছুক্ষন আগে বুঝি রাহানের উপর কোনো জিন আছড় করেছিলো। পাগল হয়ে গিয়েছিলো রাহান। এক্টিং করেছে রাহান? হ্যা? অভিনয় করেছে? রাহান অভিনয় করেছে এতোক্ষন…। কক্ষনো ক্ষমা করবে না ঝুমকো। কক্ষনো না। তার অভিমানের পাল্লা টা এবার বুঝি আরো ভারী হলো। রাহান হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে আমোদিত গলায় বলল,
‘তুমি বলেছিলে ঝুম…আমরা কখনো মিল হয়েও হবো না। দেখলে মিল হয়ে গেলাম।’
ঝুমকো স্বগতোক্তির মতো বলল,
‘একদিন অনেক বড় শাস্তি পাবে রাহান তুমি। প্রকৃতি নিজ দায়িত্বে দিবে তোমায়। বিয়ে করা মানেই মিল হওয়া নয়।’
রাহানের মুখ নিমিষে কালো হয়ে গেলো। ঝুমকো উঠে দাড়ালো। একটানে খুলে ফেলে দিলো মাথার উপরের লাল উড়না। মাথার চুল এলোমেলো করলো। মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কয়েক মিনিট। জোরে জোরে ফুস ফুস করে নিঃশ্বাস নিলো। রিয়া এগিয়ে এসে ঝুমকোকে ধরলো। ধরার সাথে সাথে ঝুমকো ছিটকে সরে দাড়ালো। দাঁত কিড়িমিড়ি করে লাল চোখে তাকিয়ে বলল,
‘তুই আমাকে ছুবি না রিয়া। আমাকে শেষ করে দিয়েছিস তুই। শেষ….। আমার পরিবারের স্বপ্ন টা ভেঙে দিয়েছিস।’
‘আপু শোনো। আমি তোমার ভালোর জন্য করেছি। রাহান ভাইয়ার চেয়ে আর কেউ কখনো তোমাকে বেশি ভালোবাসতে পারবে না।’
‘ব্যস আর কোনো কথা নয়। আর কিচ্ছু বলিস না।’
ঝুমকো ঘুরে দাড়ালো। রাহানের কাছে গিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
‘তুমি প্রেম করার সময়ও আমার অনুমতির অপেক্ষা করো নি। ভাঙার সময়ও আমার অনুমতির অপেক্ষা করো নি। বিয়ে করার সময় ও আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না। সবকিছুতে জোর জবরদস্তি। এটা কি লাইফ? ইউ আর দ্যা বিগেস্ট মিস্টেক অফ মাই লাইফ মি. রাহান আদমান। আই জাস্ট হেইট ইউ। হেইট ইউ।’
ঝুমকো চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে চলে গেলো। গাড়িতে উঠে বসে সে বুক কাপিয়ে কাদতে লাগলো। রাহান সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। তার কানে এখনো বাজছে ঝুমকোর বলা কথা। চোখ বন্ধ হয়ে এলো। হ্যা, সে একটু আগে পাগলামো করেছে। যেটা তার উচিত হয় নি। কিন্তু না করে উপায় ছিলো না। সে তার ঝুমকে হারাতে পারবে না। এক ভুল বারবার করতে পারবে না। সে দেখেছে সোহেলের চোখে ঝুমকোর প্রতি ভালোবাসা। ঝুমকোও হেসে খেলে কথা বলছে ছেলেটার সাথে। সেখান থেকে মাথা নষ্ট রাহানের। আবার পুনরাবৃত্তি ঘটছে ঘটনার। সে আর পারছিলো না। ঝুমকোর শূন্যতা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিলো। তাই তো এই ডিসিশন নেয়া। এমন পাগলামো করা।
রাহান গাড়িতে বসলো। ঝুমকো সামনের দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবে বসে আছে গাড়িতে৷ মুখে কথা নেই। রোবটের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে শুধু সামনের দিকে। রাহান গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে গলা উঁচিয়ে তামিমকে বলল,
‘বাড়িতে পৌঁছে ফোন দিও। আর কাউকে কিচ্ছু জানিয়ো না। মাকে তো না ই। আমি আমার ফ্ল্যাটে যাচ্ছি।’
রাহান গাড়ি ঘুরালো। এরপর চলে এলো ওর ফ্ল্যাটে।
ঝুমকো হেটে যাচ্ছে রোবটের মতো। চোখের পলক পরছে না। কথা বলছে না। যেনো একটা যন্ত্র মানব।
রাহান ঝুমকোর হাত ধরলো। খাটে বসলো। ঝুমকো দাঁড়িয়ে আছে এক দৃষ্টিতে বারান্দার দিকে তাকিয়ে। রাহান ঝুমকোর পেটে মাথা ঠেস দিলো। মুখ গুজে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
‘স্যরি জান….যা শাস্তি দেবে তাই মাথা পেতে নিবো। তবুও চুপ করে থেকো না। আচ্ছা তুমি কি আমায় ভালোবাসো না বলো? আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে? পারবে না আমি জানি। প্লিজ জান.. মাফ করে দেও…আর কক্ষনো এমন হবে না। আই প্রমিজ। তোমাকে আমি আর কোনো কিছুর জন্য কখনো জোর করবো না।’
ঝুমকোর পেটে রাহানের মাথা গুজা। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস গিয়ে আছড়ে পড়ছে পেটের আশেপাশে। তার এক হাত আবদ্ধ ঝুমকোর কোমড়ে। এই প্রথম এতোটা কাছে! এতোটা সন্নিবেশিত তারা। তবুও ঝুমকোর শরীরে অনুভূতি নেই। শরীরে কাপন নেই। শারীরিক উত্তেজনা নেই। সব মৃত। অনেক কষ্টে অনেকক্ষন পর ঠোঁট দুটো নিজ দায়িত্বে বলে উঠলো,
‘আমাকে বাড়ি দিয়ে আসো রাহান…’
রাহান বিষন্ন চাহনি দিয়ে তাকালো ঝুমকোর দিকে। ঝুমকো নিরর্গল। রাহান বাচ্চাদের মতো বলল, ‘আজ থাকো আমার সাথে। আজ আমাদের বাসর রাত। মানুষ বিয়ে করে স্পেশালি এই রাতটার জন্যই।’
‘আমাকে বাড়ি দিয়ে এসো।’
রাহানের মুখ কালো হয়ে গেলো। মজা করতে গিয়ে সে পরিবেশ টা আরো নষ্ট করে ফেলল। তার বুঝা উচিত ছিলো এখন মজা করার সময় না। অতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘চলো।’
#অভিমান
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-১৬
যৌবন কালের প্রথম প্রেম ছিলো ভয় মাখা, উত্তেজনাপূর্বক, একদম অন্যরকম। কত অবজ্ঞা অবহেলা করেছে প্রেমের প্রথম দিকে ঝুমকো। কথা বলতে চাইতো না, ভয় পেতো রাহানকে, রাহান সামনে এলে ভয়ে তটস্থ থাকতো, পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতো। সেই মেয়েই একদিন প্রেমে পরলো। ভয়ানক প্রেম! আর সেই জোরপূর্বক প্রেম গিয়ে গড়ালো জোরপূর্বক বিয়ে অবধি। কি দোষ ছিলো ঝুমকোর! জীবনে শুধু সাফার ই করে গেলো।
এলোমেলো পায়ে এবড়োথেবড়ো ভাবে হেটে বাড়িতে প্রবেশ করে ঝুমকো। চুল আওলা ঝাওলা, কান্নার মোটা স্তর পরেছে গাল পর্যন্ত, ফোলা লাল দুটো চোখ, শুকনো জীর্ণ খয়েরি বর্ণ ঠোঁট, ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে যখন বাড়িতে ডুকলো তখন ই দেখা হলো কামিনী বেগমের সাথে। সোফায় বসে তিনি চা খাচ্ছেন আর তসবি পড়ছেন। মাথায় সাদা কাপড়ের একটা বড় হিজাব। মহিলাটি এক সেকেন্ড ও আল্লাহর ইবাদত থেকে নড়েন না। হয় নামাজ পড়েন নয়তো তসবি নয়তো কুরআন শরীফ। শ্যামলা মুখশ্রীর ভাঙা গালের হিজাব পরিহিতা কামিনী বেগমকে তখন ভারী স্নিগ্ধ লাগছে।
কামিনী বেগমকে দেখে ঝুমকো কেমন চমকে উঠলো। চোরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। মুখ লুকাতে চেষ্টা করলো। যেনো মনে হচ্ছে তার শরীরে বিয়ের ছাপ স্পষ্ট। আর সেই ছাপ লুকাতেই হবে যে করেই হোক। কামিনী বেগম উঠে এলেন। নাতনীর থুতনি ধরে আহাজারি গলায় বললেন,
‘এ কি দশা আমার নানুমনির! কি হয়েছে বাবু?? বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে কেনো তোকে?’
ঝুমকো অনেক কষ্টে মিথ্যা কথা গুলো বলল, ‘এমনি সারাদিন পর বাড়ি ফিরলাম তো। বাইরে প্রচুর রোদ। রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে নানুমনি।’
কামিনী বেগম মুখটাকে কালো বানিয়ে বললেন, ‘ফ্রেস হতে যাবি?’
‘হুম। কেনো কিছু বলবে?’
‘আসলে হয়েছে কি নানুমনি।’
‘কি হয়েছে?’
‘তোর মামা তোর বিয়ের কথা বলছিলো। আমি তো রাহানের কথা বলেছি। তোর মামা তখন বলল, রাহানের সাথে তো ওর সম্পর্ক ভেঙে গেছে। আমি বলেছি জোড়া লেগে গেছে। এখন তোর মামা তোকে বিয়ে দিতে চায় ধুমধাম করে আত্মীয় স্বজন সবাইকে জানিয়ে। দেখ, তুই রাগ করিস না। আমি তো জানি তুই রাহানকে ভালোবাসিস। রাহান ছাড়া অন্য কাউকে তোর মনে কখনো জায়গা দিতে পারবি না। তাই রাহানের সাথেই তোর বিয়ে। তোর মামার কতো ইচ্ছা তোকে ধুমধাম করে বিয়ে দিবে। লোকজন খাওয়াবে। তার একমাত্র ভাগনীর বিয়ে সাত এলাকা জানবে।’
কামিনী বেগম থামেন। ঝুমকোর বুক ভেঙে কান্না আসতে চায়। ঠোঁট চেপে কান্না আটকিয়ে বলে, ‘আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর এতো তাড়া?’
‘না রে নানুমনি। এভাবে বলিস না। সব মেয়েকেই তো বাপের বাড়ি ছাড়তে হয়। আর বয়স ও তো তোর কম হলো না। চব্বিশ হয়ে গেছে। এখন ই তো বিয়ের সময় রে পাগলী। আর বিয়ে তো রাহানের সাথেই হচ্ছে। তুই না করিস না বোন।’
ঝুমকো কেদে দিলো। নিজের সত্তা কে আর আয়ত্তে রাখা যাচ্ছে না। কামিনী বেগমকে জড়িয়ে ধরলো। রাহান কেনো এসব করলো? সব তো ঠিক আছে। তার পরিবার ধুমধাম করে বিয়ে দিতে চাইছে। রাহানের সাথেই দিতে চাইছে। এতোটুকু মাত্র ইচ্ছে তাদের ধুমধাম করে সাত এলাকা জানিয়ে বিয়ে দিবে! সেই ইচ্ছেও ঝুমকো পূরন করতে পারলো না। পালিয়ে বিয়ে করতে হলো তাকে। বুকে পাথর চেপে অনেক কষ্টে সে বলল,
‘আমি যদি কখনো তোমাদের ইচ্ছের মর্যাদা দিতে না পারি। তাহলে কি খুব কষ্ট পাবে নানুমনি?’
কামিনী বেগম ঝুমকোকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে তটস্থ গলায় বললেন, ‘এভাবে কেনো বলছিস? রাহানকে কি তুই ভালোবাসিস না?’
‘না বাসি না।’ ঝুমকো বলল চেচিয়ে। কামিনী বেগম অবাক হয়ে গেলেন। ঝুমকো দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
নিজের প্রানপ্রিয় অতিপরিচিত ঘরটাতে এসে বিছানায় লুটিয়ে পরে ঝুমকো। চাদর খামচে ধরে কাদে। বালিশ মুখে দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলতে লাগে, ‘কেনো রাহান? কেনো এমন করলে? আমার পরিবারের স্বপ্ন টা ভেঙে চুরমার করে দিলে। আই হেইট ইউ রাহান… আই হেইট ইউ।’
অনেকক্ষণ পর ফোনের বিদগুটে রিংটোনে ঝুমকো কান্না থামায়। ফোন হাতে নিয়ে দেখে প্রাপ্তি ফোন করেছে। ঝুমকো ভালো করে চোখ মুছে গলাটাকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে ফোন কানে ধরে। প্রাপ্তি সাথেসাথেই তার স্বরে বলে উঠে,
‘ওই শালী, হারামি, কুত্তা, বিলাই কই তুই হ্যা? আমাকে ওই ঝগড়ুটে ব্যাটার কাছে রাইখে তুমি মামা হাওয়া হয়ে গেলা? হাতের কাছে পাইলে আম গাছের ডাল দিয়ে তোরে পিটামু।’
‘শরীর ভালো লাগছিলো না রে দোস্ত। তাই এসে পরেছি।’ নাক টেনে ভাঙা গলায় বলল ঝুমকো।
প্রাপ্তি তখন বুঝে গেছে ঝুমকোর কিছু একটা হয়েছে। এই মেয়েটা খুব তাড়াতাড়ি মানুষের মন পড়তে পারে। ও তারাহুরো করে বলল,
‘দোস্ত, জান আমার কি হইছে রে কলিজা? কান্দস কেন? দুলাভাই কিছু কইছে? খালি একবার ক। মাইরে ভূত বানায় দিমু শালারে।’
প্রাপ্তির ছেলেমানুষী কথার কাছে ঝুমকো আর অভিনয় করতে পারলো না। হরহর করে কেদে দিলো। প্রাপ্তি অস্থির হয়ে বলল, ‘দোস্ত কান্দস কেন? কি হইছে আমারে বল।’
ঝুমকো অতিকষ্টে ঠোঁট দুটি নাড়িয়ে বলল, ‘একবার বাসায় আয়।’
‘আসছি আমি এক্ষুনি আসছি। ২০ মিনিট টাইম দে তুই আমারে।’ প্রাপ্তি বলল তড়িঘরি গলায়।
,
রাতের আধারে ডুবে গেছে প্রকৃতি, কোলাহল, আওয়াজ। এদিকে, সব কিছু বলে ঝুমকো বার কয়েক জোরে নিঃশ্বাস টেনে নিলো নিজের মাঝে। প্রাপ্তি কিছুক্ষন থম মেরে বসে রইল। এরপর উত্তেজিত গলায় বলল,
‘মানে? হোয়াট দ্যা ফাক! তুই এর জন্য কাদছিস? আরে চিল ইয়ার। আমি হলে তো খুশিতে পুকুরে ডুব দিতাম। সো, ইউ শুড বি ডুব ইন দ্যা নদী। আর তা না করে কেদে ভাসাচ্ছিস? গাধী কোথাকার! নিজের ভালোবাসার সাথেই তো বিয়ে হয়েছে। কোনো চোর বাটপারের সাথে তো হয় নি এটলিস্ট ওই সোহেলের সাথে তো হয় ই নি। বাঁচা গেলো বাবা! আই এম রিয়েলি ভেরি ভেরি হ্যাপি। হুদাই আমার টাইম ওয়েস্ট করলি বাল।’
ঝুমকো বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে এক ধমক দিলো প্রাপ্তিকে। কিড়িমিড়ি করে বলল, ‘বেশি লাফাস সব কিছুতে। আমি ওকে ভালোবাসি না। আর সবচেয়ে বড় কথা আমার পরিবার জানতে পারলে কত কষ্ট পাবে জানিস। ‘
প্রাপ্তি চোখ উলটে বলল, ‘কষ্টের কি আছে এখানে? তারা যার সাথে বিয়ে দিতে চাইছিলো তার সাথে তাদের মেয়ে আগেই বিয়ে করে নিছে। সিম্পেল। এতে তাদের খরচ কমলো আরো। বিয়েতে কতো খরচ হতো তুই ভাব একবার।’ প্রাপ্তি গালে হাত দিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে বলে।
ওর বলার স্টাইল দেখে ঝুমকো ধুমধাম কয়েকটা কিল দেয়। এর মাঝেই প্রাপ্তির ফোনে কল আসে সোহেলের। প্রাপ্তি নাম্বার টা দেখেই কটমট করে তাকালো ঝুমকোর দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘এই এসহোলের বাচ্চারে তুই আমার নাম্বার দিছিলি কেন? দিন রাত তোরে ফোনে না পাইলেই আমারে ফোন দেয়। অসহ্য! মন চায় ব্যাটার সিরিয়াস জায়গায় একটা লাত্থি দেই।’
‘তোর ভাষা কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন প্রাপ্তি। ইউ শুড ইম্প্রুভ ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ।’ ঝুমক বলল শাসানো গলায়।
প্রাপ্তি চড়া গলায় বলল, ‘জ্ঞান দিস না তো শালী।’
‘ফোন ধর। দেখ কি বলে?’
‘তোর ফোন চেক কর। নিশ্চিত তোর ফোন সাইলেন্ট। আর ফোন ধরস নাই দেইখেই আমারে ফোন দিছে। ব্যাটা আস্ত একটা লুইচ্চা। খালি একটা করে ছুতা খুজে। দেখলেই দিনে রাতে নিয়ম করে থাপড়াবার মন চায়।’
গালি দিতে দিতে প্রাপ্তি ফোন কানে ধরে বিরক্ত গলা ঠেলে দিয়ে বলে উঠলো, ‘কি সমস্যা বলেন?’
সোহেল একটু থতমত খেয়ে গেলো। এই মেয়ের কথা, হাবভাব, চলন ফেরন সব উদ্ধত। কথা বলার মাঝে কোনো নরম করুন সাবলীলবতা নেই। সবসময় উদ্ধত আচরণ। মেয়েটাকে দিনে রাতে নিয়ম করে থাপ্পড় দিয়ে আচরন শেখাতে মন চায় সোহেলের। হ্যা ঝুমকোও এমন আচরন করতো। কিন্তু সোহেলের গায়ে লাগতো না। কিন্তু এই মেয়ের আচরন তার শরীরে কাটার মতো ফুটে। কেনো কে জানে? সোহেল তো ঝুমকোকে ভালোবাসে। এই এক মাসে তো তাই বুঝেছে সে। কিন্তু কেনো যেনো ঝুমকো না থাকলেও তেমন শূন্যতা কাজ করে না। যতটা এই মেয়ের উড়নচণ্ডী কথাবার্তা না শুনলে লাগে। তাই তো হাজার অপমানের পর ও ‘ঝুমকোকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না’ বাহানায় এই মেয়েকে কল লাগায় সে। এবারো একি বাহানা দিলো সোহেল।
‘ঝুমকো কোথায়? ফোন ধরছে না কেনো?’
প্রাপ্তির রাগ আকাশ ছুলো। আকাশচুম্বি রাগ নিয়ে সে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। উঁচু গলায় বলল,
‘ওই মিয়া শুনেন আমার বান্ধবীর বিয়া হয়ে গেছে বুঝছেন। আমার বান্ধবীকে আর জ্বালাবেন না। ওর হাসবেন্ড পছন্দ করে না এসব। হ্যা, এখন পালিয়ে বিয়ে করছে দেখে আপনাদের দাওয়াত দিতে পারে নি। কিন্তু কিছুদিন পর ধুমধাম করে বিয়ে করে আপনাদের দাওয়াত দিবে। এখন আমার বান্ধবীকে ফোনে না পাওয়ার অছিলায় আমাকে আর ফোন দিবেন না বুঝছেন? কারন সে অলটাইম জামাইয়ের সঙ্গে কল টু কল বিজি থাকে। বুঝলেন? ফোন দিবেন না আর। বাই বাই। আল্লাহ হাফেজ। ‘
প্রাপ্তি এক নিঃশ্বাসে সোহেলের উপর উগড়ে ফেলে দিলো সকল রাগ। এরপর ফোন কাটলো। এদিকে ঝুমকো প্রথম থেকে ইশারা করছিলো যাতে প্রাপ্তি ওদের বিয়ের কথা না বলে। কিন্তু উড়নচণ্ডী প্রাপ্তি তার কোনোকিছুই শুনে নি। সে নিজের মতো হরহর করে সব বলে দিলো। ঝুমকো কপালে হাত দিয়ে বিছানায় বসে পরলো। তারপর হায়হায় করে বলল,
‘তুই আসলেই একটা বেয়াদবের বাচ্চা। খারাপ। নেমকহারাম একটা। বারবার ইশারা করতাছি তাও বুঝস না। আবাল বলদ মহিলা। যা দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। এখনি বাইর হ।’
প্রাপ্তি ঝুমকোর বিছানায় রাজকীয় ভাবে শুয়ে পড়লো। বলল, ‘যামু না। আজ তোর লগে থাকমু। এই ভাই তোর না আজকে বাসররাত? চল সেলিব্রেট করি।’
ঝুমকো নাক ছিটকে বলে, ‘ছি! তুই লেসবিয়ান না কি?’
প্রাপ্তি কটমট করে তাকায়। ঝুমকো দমে যায়। প্রাপ্তি আমুদ গলায় বলল, ‘পার্টি করুম মামা।’
‘আমার মুড ভালো নাই। কোনো পার্টি সার্টি হবো না।’
‘হবো।’
‘না’
‘হ।’
‘না।’
‘হ। আরে ইয়ার। নিজের বিয়া। তাও পালায় গিয়ে। তুই আরো ইঞ্জয় করবি মাস্তি করবি তা না। তুই ভাব, তুই জাতির গর্ব! কয়টা মানুষ পালায় যায়ে বিয়ে করতে পারে বল? হাতে গোনা কয়েকজন? তার মধ্যে তুই একটা। ইউ আর স্পেশাল মামা। স্পেশাল! ইউ হেভ টু বুঝতে হবে মাম্মা…. তোর জায়গায় আমি হইলে না লুঙ্গি ডান্স দিতাম! বুঝছস।’
‘হ বুঝছি নিজের বাড়িত যায়ে দে। আমার মন মেজাজ খুব খারাপ।’
‘যামু না। এই দোস্ত ভাইয়ার কয়েকটা পিক দেখা। ভাইয়াকে তো দেখলাম ই না।’
‘কোনো পিক নাই আমার কাছে।’
‘নাই?’
‘না।’
‘আচ্ছা না থাকলো সমস্যা নাই। লাইভ টেলিকাস্ট দেখমু মামা। লাইভ! বাসররাতে সিসিক্যামেরা! সিসিক্যামেরা ইজ আন্ডার দ্যা খাট ইন বাসররাত।’
প্রাপ্তি বলল দাঁত কালিয়ে হাতকে ক্যামেরার মতো করে।
ঝুমকো বিরক্তি নিয়ে উঠে গেলো। এই মেয়ে বড্ড পাগল!
চলবে❤️
প্রথম রোজার অগ্রিম শুভেচ্ছা সবাইকে। সবাই রোজা রাখবেন। এবং কাল গল্প দিবো না।
চলবে❤️