অরূপ জ্যোৎস্না পর্ব -১৭

#অরূপ_জ্যোৎস্না
পর্ব-১৭
লেখনীতে-তানিয়া শেখ

শেষ ক্লাসটা করে বাইরে বেরিয়ে এলো ঈপ্সা। সাথে ওর দু বান্ধবী নাফিসা ও সৌমি। নাফিসা পার্পেল রঙের বোরকায় আবৃত। শুধু ওর ডাগর চোখদুটো দেখা যায়। সৌমির পোশাক পুরোপুরি বিপরীত। জিন্স ও কুর্তি পরনে। গলার দু পাশ বেয়ে নেমে গেছে ওড়না। দিঘল কালো চুলগুলো বেণী করা। একবার বুকের একপাশে টেনে আনে তো আবার পিঠে ছুঁড়ে ফেলে। সারাক্ষণ চলে ওর এই বেণী খেলা। ঈপ্সার চুলগুলো এত সুন্দর না। কটা, কোঁকড়া। টেনেটুনে পিঠের অর্ধেক আসবে। ছোটোবেলা এই চুল নিয়ে কত আক্ষেপ ছিল। কিন্তু ওর মা বলতেন,”এই কটা কোঁকড়া চুলে ঈপ্সা যেন পুতুল।” বিশ্বাস করাতে পুতুলের মতো একটা ছবি পর্যন্ত তুলে বাঁধায় করে রেখেছেন। মা নেই। ঈপ্সার আক্ষেপ দূর হয় ওই ছবিতে তাকালে। গোলাপ রাঙা ত্বক, গোলগাল মুখে ভাসা ভাসা দুটো চোখ, পাতলা গোলাপি ঠোঁট, ছোট্ট উঁচু নাক। নিষ্পাপ মিষ্টি হাসি। বিশ্বাস করে ও একসময় পুতুল ছিল। এখন সেই পুতুলটা অযত্নে, অবহেলায় বড্ড অসুন্দর হয়ে গেছে।

“ঈপ্সা, শুনছিস?”

সিঁড়ির কাছে আসতে সৌমি ওর হাত টেনে ধরে। ভাবনার সুতা ছিঁড়ল। বলল,

“কিছু বলছিলি?”

সৌমি সরু ভুরু জোড়া কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করল।

“তোর হয়েছে কী বলতো? আজকাল বেশ অমনোযোগী হয়ে উঠছিস। সমস্যা কী?”

“হ্যাঁ, আমিও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি। পুরো ক্লাসে ও অমনোযোগী ছিল। এহসাস ভাইয়ের জন্য চিন্তা করছিলি তাই না?” নাফিসা বলল। ঈপ্সা জবাব দেয় না। হিজাবের পিনটা ঠিক করার ছলে সিঁড়ি বেয়ে নামল চুপচাপ।

নাফিসা ও সৌমি পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। তারপর দৌড়ে ওর দু’পাশে দাঁড়ায়। দু’বাহু জড়িয়ে ধরে বলে,

“মন খারাপ করিস না। আমরা নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করব। আল্লাহ তাআ’লা সব ঠিক করে দেবেন। তাই না বল সৌমি?” নাফিসার কথায় সৌমি মাথা নাড়িয়ে বলে,

“হ্যাঁ, প্লিজ ঈপু মন খারাপ করিস না। তোর মন খারাপ হলে আমাদের কান্না পায়। এহসাস ভাইয়ের কিছু হবে না দেখিস। হি ইজ অ্যা ভেরি টাফ অ্যান্ড ক্লেভার ম্যান। তাছাড়া তোর বাবা তো আছেই। তিনি সব ঠিক করে দেবেন দেখে নিস। আমার মন বলছে সব ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক বলেছি না নাফি?”

নাফিসা মাথা দোলায় ওপর নিচ। ওরা সিঁড়ি বেয়ে মাঠের পাশ দিয়ে কলেজের সামনের গেটে যেতে লাগল। ঈপ্সা লক্ষ্য করে সৌমি আর নাফিসা ইশারায় ইশারায় কিছু বলছে। মুখে বলতে যেন ইতস্তত করছে।

“আমাকে তোরা ভয় পাস?”

“ভয়? তোকে? পাগল!” দুই বান্ধবীই হেসে ওঠে। ঈপ্সা চোখ রাঙিয়ে ওদের সামনে দাঁড়ায়।

“তাহলে তখন থেকে ইশারায় ইশারায় কী বলছিস? ভয়ই যদি না পাস তো বল!”

এবার দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে যায়। নাফিসা সৌমিকে আগে ঠেলে দেয়।

“সৌমি সব জানে।”

“আমি! কিন্তু দেখা তো তুই করতে চাস দুলামিঞার সাথে!”

“সৌমি!”

“দেখা? দুলামিঞার সাথে? কোথায়? কার দুলামিঞা?” ঈপ্সার প্রশ্নে দুজনই চুপ করল। নাফিসা লজ্জায় সৌমির আড়ালে দাঁড়িয়ে বলে,

“তুই বল।”

“জামাই কি আমার হবে?”

“সৌমি, প্লিজ!”

“লজ্জায় বাঁচে না আবার দুলামিঞার সাথে দেখা করার জন্য উনার মন আনচান শুরু করেছে। হু!”

নাফিসা ওর হাতে চিমটি দিতে ইচ্ছে করে জোরে চেঁচিয়ে ওঠে। বকলো বান্ধবীকে। তারপর ঈপ্সার কৌতূহলী মুখে চেয়ে সবটা খুলে বলল। নাফিসার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ওদের পরিবারে স্কুল পেরোলেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার রীতি। নাফিসার বেলায় ব্যতিক্রম হবে না। ওর যার সাথে কথাবার্তা চূড়ান্ত সে ওরই মামাতো ভাই। পেশায় আর্মি। এক সপ্তাহের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। নাফিসার সাথে দেখা করতে চায়। সরাসরি বা একান্তে না। নাফিসার হবু ননদ থাকবে সেখানে। ব্যাপারটা পরিবারের বড়োদের অগোচরে হচ্ছে। তাই একা যেতে ভয় পাচ্ছে নাফিসা। সৌমিকে ওর হবু ননদই ম্যানেজ করেছে। ঈপ্সাকে লজ্জায় বলতে পারছিল না ও।

যেতে সৌমির সমস্যা নেই। কিন্তু ঈপ্সা চাইলেও যেতে পারবে না। ইদানীং ওর বাবা ওকে গার্ড ছাড়া বাড়ির বাইরে এক পা রাখতে দিচ্ছেন না। কবরস্থানে ভয় পাওয়ার ঘটনাটা হয়তো ড্রাইভার তাকে বলে দিয়েছে। ওর বাবা অল্পতেই খুব বেশও সতর্ক হন। নাফিসা ও সৌমির মন খারাপ হলো। কিন্তু ওরা বুঝল।

বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে ঈপ্সা গাড়ির দিকে যায়। নাফিসা ও সৌমির সাথে যেতে খুব ইচ্ছে করছে। বাড়িতে ভালো লাগে না। জেলখানা মনে হয়। না, ও ওদের সাথে যাবে। বাবা বকলে বকুক। ঈপ্সা এখন ওইটুকু বকা সহ্য করতে পারবে। ড্রাইভারের চোখে পড়ার আগেই পেছন দিকে হাঁটা ধরল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সৌমি ও নাফিসা বাসে উঠে পড়েছে। ঈপ্সা দৌড়েও বাসটা ধরতে পারল না। মোবাইল বের করে সৌমিকে কল করল। সৌমি ওর আসার সিদ্ধান্তে খুশি। বলল, খিলক্ষেত নেমে কল করতে। ওরা ওখানেই থাকবে। ঈপ্সা কিছুক্ষণ পরে অন্য একটি বাসে উঠে বসল। দৌড়াদৌড়ি আর উত্তেজনায় ওর হাঁপ ধরে। সিটে বসে দম নিলো। একটু পরে টের পেল পাশের খালি সিটে কেউ বসেছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, ওরই বয়সী একটি ছেলে। হ্যাংলা পাতলা, শ্যাম বর্ণের। সেও আড়াঠারে তাকাচ্ছে। পা ছড়িয়ে বসেছে। ঈপ্সা সংকুচিত হয়ে বসল।

“তুমি কর্মাসের ঈপ্সা না?”

ছেলেটা হাসিমুখে জানতে চাইল। ঈপ্সা সৌজন্য বজায় রেখে বলল,

“হ্যাঁ, আপনি?”

“আমি তোমার মতো কলেজের পরিচিত মুখ না। মানবিকের এক নগন্য ছাত্র।”

“ওহ!” ঈপ্সা কথা বাড়াতে চাইল না। অপরিচিত কারো সাথে কথা বলতে ওর ভালো লাগে না। কলেজে পরিচিত মুখ বলে ছেলেটা ওকে খোঁচা দিলো কি? যারা ঈপ্সাকে অপছন্দ করে তারাই এটা বলে খোঁচা দেয়। অহংকারী বলে। ঈপ্সার ভারি খারাপ লাগে। বাপ-ভাইয়ের জনপ্রিয়তায় পরিচিত হওয়া ওর কাছে বিব্রতকর।

“এহসাস ভাইকে অনেকদিন কলেজে আসতে দেখিনি। কেমন আছেন ভাই?”

“ভালো।”

ছেলেটা একটু চুপ করে আবার বলল,”আমার নাম শান্ত। এহসাস ভাইয়ের বন্ধু রাহাত ভাই কিন্তু আমার আপন ফুপাতো ভাই ছিল।”

“আপনি রাহাত ভাইয়ের ফুপাত ভাই?” ঈপ্সা সরাসরি তাকাল। রাহাত ভাই মানেই ওর কাছে সেরা একজন মানুষ। এহসাস আর তাকে খুব বেশি আলাদা নজরে দেখেনি। রাহাতও অবশ্য তাই করত। ঈপ্সাকে আপন বোনের মতো ভালোবাসত।

“হ্যাঁ, উনার জানাজার দিন আপনাকে আমি দেখেছিলাম। সেখান থেকেই মূলত আপনাকে চেনা। একই ক্লাসে পড়ি অথচ আপনি বলছি। তুমি করে বলি?”

“ঠিক আছে।” ঈপ্সা মুচকি হাসল। ছেলেটা বোধহয় খারাপ না। রাহাত ভাইয়ের ফুপাত ভাই বলে কথা। মনটা খারাপ হলো তার কথা মনে করে। অকালেই মানুষটা চলে গেল। ভালো মানুষগুলো পৃথিবীতে বেশিদিন বাঁচে না। পৃথিবীটা তাদের জন্য না বোধহয়।

“আপনার বাসা তো এদিকে না। কোথাও যাচ্ছেন?”

“উমম.. হ্যাঁ। আমার বান্ধবীর বাসায়।”

“কোথায়?”

“এই তো খিলক্ষেত?”

“আমরও তো ওখানেই বাসা। খিলক্ষেত কোথায় যাবেন? এহসাস ভাইয়ের বোন আপনি। আমার এলাকায় এসে ঠিকঠাক আপ্যায়ন না করে ছাড়ব না।”

“আরে না, না। আমার বান্ধবীরা বাস স্টপেজই থাকবে।”

ছেলেটা যেন হতাশ হলো। দেখতে দেখতে খিলক্ষেত বাস স্টপেজ চলে এলো। ঈপ্সা যেন নামতে পারলে বাঁচে। ও নামতে ব্যাগে হাত দিলো সৌমিকে একটা কল করা দরকার। কিন্তু হঠাৎ অঘটন ঘটে গেল। ব্যাগের চেইন খোলা। মোবাইল নেই! এখন কী হবে? ঈপ্সা অসহায়ের মতো এদিক ওদিক তাকায়। এর আগে এখানে আসেনি। চেনেওনা জায়গাটা। সৌমি বলেছিল এখানেই অপেক্ষা করবে। কোথায় ওরা? ঈপ্সা এদিক ওদিক খুঁজেও ওদের পেল না। ওর হাত-পা কাঁপছে।

“ঈপ্সা, কী হয়েছে?” ছেলেটা কোথা থেকে আবার ওর সামনে উদয় হলো। ঈপ্সা নার্ভাস। আমতা আমতা করে বলল,

“আমার মোবাইলটা চুরি হয়ে গেছে। আপনার মোবাইলটা একটু দেবেন?” কথাগুলো কেমন যেন শোনালো। ঈপ্সার একটুও ভালো লাগল না। ছোটো ছোটো লাগে। ছেলেটা কোনো কথা না বলে মোবাইলটা বের করে দেয়। ঈপ্সা কাঁপা হাতে মোবাইলটা নিলো। কিন্তু হায়! সৌমি বা নাফিসার নাম্বার যে মুখস্থ নেই। ওর যেন কান্না পেয়ে গেল। এখানে আসতে চাওয়ার সিদ্ধান্তই ভুল হয়েছে। বেশি ভালো থাকার লোভে মোবাইলটা খুইয়ে এখন নাস্তানাবুদ অবস্থা।

“থ্যাংকস।” মোবাইলটা ফেরত দিয়ে দিতে ছেলেটা কপাল কুঁচকে বলল,

“কল করলে না?”

“নাম্বার মনে নেই।” ছেলেটা নিশ্চয়ই ওকে বোকা ভাবছে। তাই তো ও। শুধু বোকাই না পৃথিবীর সেরা গর্দভ৷ কাল হয়তো কলেজে গিয়ে হাসাহাসি করবে ওকে নিয়ে।

“এখন কী করবে তাহলে?” মোবাইলটা পকেটে পুরে নিলো ছেলেটা। সহানুভূতি প্রকাশ পেল মুখে। ঈপ্সা বাস স্টপেজে তাকালো,

“বাসায় ফিরে যাব।”

“তুমি আগে কখনো এদিকে আসোনি?”

ঈপ্সা দুদিকে মাথা নাড়ায়। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

“তোমার বান্ধবি যেদিকে থাকে সেই এলাকার নাম জানো?”

ঈপ্সা আবার মাথা নাড়ায় দুদিকে। কিছু জানে না। জানবে কী করে বোকা না!

“আমি যাই।” এক পা এগোতেই হোঁচট খেল। ছেলেটা থামালো।

“একটু বসে যাও ঈপ্সা। ওই যে হোটেলটাতে গিয়ে বসি, এসো। তোমাকে ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে। অন্তত এক গ্লাস পানি খেয়ে যাও। প্লিজ না করো না৷ একটু বসলে ভালো লাগবে।”

ঈপ্সার না তে কাজ হলো না। ছেলেটা ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে হোটেলের দিকে এগোয়। কাছাকাছি যেতে কেউ ওর হাত টেনে ধরে। ঈপ্সা চমকে তাকায়। সম্মুখীন হয় একজোড়া কঠোর, নির্মোহ দৃষ্টির।

“তুই এখানে কী করছিস মিনি?”

ঈপ্সা মৃদু কম্পিত হয় আদরূপের কর্কশ ধমকে।

“আ..আ..মি..”

“এই ছেলে কে?”

ঈপ্সার কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ও যদি ওর জীবনে কাওকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় তবে আদরূপকে। শান্ত নামের ছেলেটির মুখের রঙ উড়ে গেছে ভয়ে। পালাতে চাইছে কিন্তু আদরূপের চাহনি ওকে এক পা নড়তে দেয় না।

“দা..দাভাই…” কান্না ঈপ্সার গলায় দলা পাকিয়ে কণ্ঠরোধ করে দিলো। একা এভাবে আদরূপের সামনা সামনি হওয়া ওর জন্য দুঃস্বপ্ন ছাড়া কিছু না। অশ্রুতে চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এলো। পথচারীরা দেখছে। কী ভাবছে ওকে? বাজে মেয়ে? ঈপ্সা আর যেন কিছু ভাবতে পারছে না। এহসাসকে ভীষণ মনে পড়ছে। ওই ভাই ছাড়া ঈপ্সা বড্ড দুর্বল, বড্ড বোকা ও বড্ড অসহায়। ওর জীবনের সবকিছু জটিল হয় তখন।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here