#অস্তিত্বে_তুমি
#পর্ব_১১
#সুলতানা_পারভীন
-হ্যালো সাদাফ? কোনো খবর বের করতে পারলি মিস্টার খন্দকারকে নিয়ে উনার চামচা শিহাব কোথায় গিয়েছিলেন? আবার নতুন কোনো একটা প্ল্যান চলছে ওই বদমাইশটার মাথায় আমি ড্যাম শিওর। কাকে কল করবি বললি যে সে কোনো নিউজ দিতে পারলো? ভাই চুপ করে থাকিস না প্লিজ? কিছু তো বল?
নীলাকে নিজের মোবাইলটা দিয়ে আর অপেক্ষা না করে রুম থেকে বেরিয়ে গেছে নিহার। নীলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কয়েকবার জিহানের নাম্বারটা ডায়েল করেও বারবার ক্যানসেল করে দিয়েছে। জিহানকে কল করাটা কতোটা যুক্তিযুক্ত সেটাই নীলার মাথায় ঢুকছে না। যে জিহানের উপস্থিতি আজো প্রতিরাতে স্বপ্নের মতো ওর সমস্ত শরীর আর স্বত্তা দিয়ে টের পায়, সেই লোকটাই নিজের মামার সাথে মিলে এতো কিছু ষড়যন্ত্র করবে ব্যাপারটা মানতে নীলার কষ্ট হচ্ছে। বাবার বলা কথাগুলো ভুল হোক এটাই মনে প্রাণে প্রার্থনা করছে নীলা। যে শিহাবকে নীলার আশেপাশে একটা সেকেন্ডের জন্যও জিহান সহ্য করতে পারে না, হুটহাুট রেগে যায় যে লোকটার নাম শুনে, সেই শিহাবের সাথেই নিজের বিয়ে করা বউয়ের বিয়ে হতে চলেছে সেটা জানার পর জিহানের রিএকশনটা কি হবে সেটা চিন্তা করতেই করতেই কখন জিহানের নাম্বারে কল চলে গিয়েছিল নীলা খেয়ালই করে নি। মোবাইলটা হালকা ভাইব্রেট হওয়ায় নীলা কলটা রিসিভ হয়েছে টের পেয়ে মোবাইল কানে তুলে ধরতেই অপরপ্রান্ত থেকে জিহানের বলা কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল নীলা। জিহানের লোকেরা বাবা আর শিহাবকেও ফলো করছে? তাহলে বাবার আর শিহাবের কথাগুলো সব সত্যি ছিল?
-হ্যালো, সাদাফ? কিছু তো বল প্লিজ? জানিস তো কি পরিমাণ টেনশনের মধ্যে আছি? একে তো খন্দকারদের সাথে টেন্ডারটা নিয়ে ঝামেলা চলছে। তার উপরে নীলা! মেয়েটা এতো বাচ্চাদের মতো জেদ ধরে বসে আছে! উফ! একটা কথা যদি আমার শোনার চেষ্টা করে। কি করে যে ওকে বোঝাই আমি! আহহহ! আর এই শালার শিহাব! ওকেই কোনদিন শুট করে দিই আমি দেখিস। শালা এতো গন্ডগোল করে আমার সব প্ল্যানিং এ! আমি বুঝি না আমি নীলাকে নিয়ে যাই প্ল্যান করি ওই লোকের কাছে তার খবর পৌঁছে যায় কি করে! ডিজগাস্টিং!
-সো স্যাড মিস্টার জিহান! এবারও তাহলে ওই শিহাবই আপনার পাকা ধানে মই দিল রাইট? আপনার কাছে যেমন বাবা আর শিহাব কোথায় যাচ্ছে, কি করছে তার খবর পৌঁছে যায়, তেমনি সেইম জাদুটা শিহাবেরও আছে বুঝলেন। তাই আপনার এতো এতো প্ল্যানিং সব মাঠে মারা যায় বারবারই।
-নীল? নীল? তুমি? এটা? এটা কার নাম্বার? আমি তো ভাবলাম আমার ফ্রেন্ড কল করেছে? নীল? হ্যালো? আর ইউ দেয়ার? প্লিজ টক টু মি প্লিজ? নীল?
-কিছু বলার জন্য কল করিনি, একটা প্রশ্ন করবো বলে কল করলাম। ঠিক ঠিক আনসার দিবেন প্লিজ?
-নীল? আজ পর্যন্ত এমন কখনো হয়েছে তুমি কিছু জানতে চেয়েছ আমি আনসার করি নি? বরং প্রতিবার উল্টোটা ঘটে। তুমি রাগ করে গাল ফুলিয়ে রাখো। আর আমার তোমাকে সিচুয়েশনটা এক্সপ্লেইন করতে হয়, কি করেছি, কেন করেছি। তাই না বলো?
-ওকে। এবার তাহলে আপনার এই আফসোসটা যেন না হয় সেটাই করছি। আপনি বলুন তো কি চান কি আপনারা? ভালোবাসেন না, তবু কেন এমন করছেন? শুধুই আমার পরিবারকে কষ্ট দেয়ার জন্য? নাকি বিজনেসের রাইভাল পার্টি বলে তাদেরকে কম্পিটিশন থেকে সরাতে যতটা নিচে নামা যায় তার থেকেও নিচে নামতে পারেন আপনি আর আপনার মামা?
-নীল? আর ইউ ক্রেজি? কিসব বলছ? এসব আজাইরা কথা তোমার মাথায় কে ঢুকাচ্ছে বলো তো? ওই শিহাব রাইট? ওকে যদি আমি সামনে পাই তাহলে! আহহহহ! শোনো জান? নীল? তোমার ফ্যামেলির সাথে আমার রাইভাল পার্টির জন্য শত্রুতা নয়। অনেক ব্যাপার আছে যা তুমি জানো না। ইভেন বললেও বিলিভ করবে না তোমার ফ্যামেলির কারণে আমার জীবনে কি ভয়ংকর ঝড় ঘটে গেছে।
-ওরা আপনার সাথে বা আপনার ফ্যামেলির সাথে কি করেছে আমি জানি না। কিন্তু যাই করে থাকুক একটা লিগ্যাল প্রসেসে সেটার বিচার চাইতে পারতেন আপনি। তা না করে নিজের মামার সাথে মিলে এই নোংরা পলিটিক্স করছেন আপনিও? ছিহ জিহান! যে লোকটা স্টুডেন্ট পলিটিক্সে জড়িত থেকেও নিজের আদর্শ থেকে কখনো পিছু হটে নি, সে কিনা নিজের রাইভাল পার্টির সাথে টেন্ডারে জিতার জন্য স্পাই লাগাচ্ছে তাদের পিছনে! বাহ!
-আমরা সবসময় যা দেখি তাই যদি সত্যি হতো তাহলে কি ভালোই না হতো তাই না নীল? সেদিন চোখের সামনে যা দেখলে সেটাকেই সত্যি মেনে বিয়েটা ক্যানসেল করে দিয়ে ভালো আছো তো?
-আমার প্রশ্নের উত্তরটা কিন্তু আমি এখনও পাই নি মিস্টার জিহান চৌধূরী।
-আমার মামা মামী কি চায় সেটা নাহয় বাদ দাও নীল। তোমাকে প্রথমবার দেখার পর থেকে প্রতিটা মূহুর্তে আমি শুধু তোমাকে চেয়েছি নীলা। তোমার ছেলেমানুষি, পাগলামিগুলোকে নিজের বুকে করে আগলে রাখতে চেয়েছি প্রতিটা দিন। এখনও চাই, আজীবন চাইবো। আর রইলো বিজনেসে আর রিভেঞ্জের ব্যাপারটা। সেদিন কলেজে তোমাকে না দেখলে বা তোমার বাচ্চামি স্বভাবে এভাবে জড়িয়ে না গেলে এতোদিনে তোমার বাবা আর ভাই দুজনের কেউই বেঁচে থাকতো না।
-জিহান!
-সুইটহার্ট তুমি জানতে চেয়েছ তাই বললাম কথাটা। শুনতে খারাপ লাগলেও কথাটা এক বিন্দুও মিথ্যে নয় নীল। তোমাকে ভালোবাসি বলেই তাদেরকে ক্ষমা করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি আমি। যতবার নিজের অতীতটা সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে ততবার নিজের উপরে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছি। বাট বিলিভ মি, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি যাতে আমার কারণে তোমার ফ্যামেলির কিছু না হয় এটা শিওর করতে।
-স্টে এওয়ে ফ্রম মাই ফ্যামেলি জিহান। আমার বাবার, ভাইয়ার বা ভাবির কারো কোনো ক্ষতি করবেন না আপনি প্লিজ।
-উমমমমম। ওকে। করবো না। তুমি আমার কাছে ফিরে এসো। আর ওদের কাউকে নিয়েই মাথা ঘামাবো না আমি প্রমিস। আমার শুধু তুমি হলেই এনাফ।
-যে লোকটা আমার পরিবারটাকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে তার জীবনে ফিরে যাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়াই বেটার আমার জন্য।
-নীল! কাজটা কিন্তু ঠিক করলে না। যে কোনো মূল্যে তোমাকে আমার হতেই হবে। তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী আশা করি কথাটা মনে আছে তোমার। বোকার মতো ভেবো না ম্যারেজ রেজিস্ট্রি পেপার তোমাকে ফেলে দিতে দিয়ে দিয়েছি। এতোটা গাধাও আমি নই।
-বিয়ে নিয়েও নাটক করবেন এবারে? সবার কাছে আমার পরিবারকে আর কত নিচে নামাবেন জিহান?
-উমমম। নিচে নামাবো কেন জান? আমার বউকে তার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে আসার প্ল্যান করছি। কতোদিন আর বউকে ছাড়া একাএকা থাকা যায় বলো তো? এতোক্ষণে খবরটা তোমার বাবার কানে পৌঁছে গেছে রাইট? তা শ্বশুরমশাই কি বলছে? আমার বউকে নিয়ে আসতে দিবে তো? বরযাত্রী নিয়ে আসবো কালকে? আবার বিয়ে করে নিয়ে যেতেও আপত্তি নেই আমার। তাহলে আগেই কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করার ব্যাপারটা কেউ জানতেও পারবে না। কি বলো নীলপাখি?
-কক্খনো না। যে মেয়ের সাথে ফার্মহাউজে ছিলেন তাকেই বিয়ে করে ঘরে তুলুন। একটু হলেও তাহলে আপনার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে।
-ওহো! বউ দেখি জেলাস! ওফ! এই নীল? এখন একটু ভিডিও কলে আসো না প্লিজ? আমার বউটার জেলাসিভরা মুখটা দেখি একটু।
-আহহহহ।
-এই এই এই নীল? হঠাৎ কল করলে কেন সেটাই তো বললে না? রাগ করে তো নিজের মোবাইল ভেঙ্গে বসে আছো। এটা কার মোবাইল? ভাবির? নাকি আবরার ভাইয়ের?
-সেটা জেনে আপনার লাভ কি? যে কারণে কল করেছি সেটা আপনাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করছি না। লোক লাগিয়েছেন না বাবা আর শিহাবের পিছনে? ভাইয়ার পিছনেও লাগিয়েছেন নিশ্চয়ই? তাদের খবর দেয়ার জন্যই অপেক্ষা করুন নাহয়।
-চ্যালেঞ্জ করছ মেয়ে? তোমার বাবা উল্টোপাল্টা কোনো প্ল্যান করলে এই মূহুর্তে তোমাকে গিয়ে তুলে আনতে পারি এটা জানো তুমি? কাজটা ভালো দেখাবে না আমিও জানি। বাট আমার বউকে আমার কাছ থেকে দূরে সরাতে চাইলে তোমার বাবার সম্মানের কথাও ভাবার কথা খেয়াল থাকবে না, কথাটা মাথায় রাখবেন সুইটহার্ট।
-রাখছি আমি।
-এই নীল নীল নীল? শোনো না?
নীলা জিহানের আর কোনো কথা না শুনেই কলটা কেটে দিল। জিহানও হেসে নিজের কাজে মন দিলো। কিছু একটা তো ঘটেছে আর নীলাদের বাড়িতে। সেটা জানতে আপাতত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে?
দুটো দিন কেটে গেছে দেখতে দেখতেই। ঘরোয়াভাবে ছোটোখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে নীলা আর শিহাবের বিয়ের। আত্মীয় স্বজন বলতে নীলার বাবা, ভাই, ভাবি আর অফিসের কয়েকজন স্টাফ। টকটকে লাল বেনারসি পড়ে নীলা নিজের রুমেই পায়চারি করছে। গত দুদিনে জিহান না নিজে এসেছে না তার কোনো কল। লোকটা নীলার বিয়ের কোনো খবর না পায় এর জন্য সবরকম ব্যবস্থা করেছে বাবা। তাহলে কি আসলেই নীলা আর শিহাবের বিয়ের ব্যাপারটা জানে না জিহান? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই দরজার নকের শব্দে চমকে উঠলো নীলা। দরজার ওপাশ থেকে আসা শব্দগুলো কেমন ভয়ের কাঁপন ধরালো নীলার শরীর আর মনে। জেগে থেকেও নীলার মনে হচ্ছে এর চেয়ে বড় কোনো দুঃস্বপ্ন বুঝি এই পৃথিবীতে আর একটাও নেই।
-নীলামা কাজীসাহেব চলে এসেছে। এবার যে আমাদেরকে যেতে হবে মা?
চলবে, ইনশাআল্লাহ