অস্তিত্বে_তুমি পর্ব ১২

#অস্তিত্বে_তুমি
#পর্ব_১২
#সুলতানা_পারভীন

-আমার সাথে বিয়ে হওয়া স্বত্বেও নিজের মেয়ের আবার নতুন করে বিয়ে দিচ্ছেন কোন আইনের বদৌলতে বলতে পারেন মিস্টার আফসান খন্দকার? তাও আবার যেখানে আমরা লিগ্যালি ম্যারেড সেটা জানার পরও আমার ওয়াইফকে জোর করে নিজের বাড়িতে আটকে রেখেছেন, আবার আমাকে না জানিয়ে তার বিয়েও দিয়ে দিচ্ছেন, এর শাস্তি কি হতে পারে সেটা জানেন?

আফসান খন্দকারের কথা শুনে নীলা ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে ড্রইংরুমে এসে গুটিশুটি হয়ে একটা সোফায় বসে ছিল নীলা। পাশের অল্প কয়জন মানুষ গুনগুন করে কি নিয়ে এতো কথা বলছে সেটা নীলার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। মুখোমুখি সোফায় বসা কাজী সাহেবের করা প্রশ্নগুলোও যেন কান পর্যন্ত আসছে না নীলার। তাই হয়তো ড্রইংরুমের ভিতরে গুঞ্জনটা আরো বাড়ছে মিনিটে মিনিটে। কাজী সাহেব আরেকবার নীলাকে কবুল বলার জন্য প্রশ্ন করতেই হুট করে ড্রইংরুমটায় পিন পতন নিরবতা নামলো। আর তার মিনিট খানেকের মাথায় জিহানের বলা কথাগুলো শুনে নীলা চমকে মুখ তুলে তাকাতেই জিহানকে কাজীর পাশেই সোফায় বসা দেখে চমকে উঠলো আরেকবার। জিহান আফসান খন্দকারের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিল।

-কি ভেবেছিলে নীল? তুমি বা তোমার বাবা, ভাই, ভাবি কেউ কিছু না বললে আমি জানতে পারবো না তোমার বিয়ের ব্যাপারটা? দুটোদিন আমি শুধু তামাশা দেখেছি আর কি কি করতে পারে তোমার বাবা আর ভাই, ওই চিটারটার সাথে মিলে। আর তুমি? ওরা কেউ জানুক, বা না মানুক, তুমি আমার ওয়াইফ, তুমি কি করে পারলে এই টকটকে লাল বেনারসি সেজে বিয়ে করতে বসে পড়লে? ভাবতে পারো নি না আমি চলে আসবো যে রাইট? শিহাবের সাথেই বিয়ে করতে রাজিও হয়ে গেলে? একবারও মনে পড়ে নি আমাদের ‘কবুল’ বলার মূহুর্তটা?

-জিহান? একদম নাটক করবি না এখানে। এখানে একটা শুভ কাজ হচ্ছে। এন্ড ইউ আর নট ইনভাইটেড হেয়ার। আর আমাদের মেয়ের কার সাথে বিয়ে দিবো সেটা নিয়ে তোকে কৈফিয়ত দিতে আমি বা বাবা কেউ বাধ্য নয়।

-ওহ রিয়েলি? আমার ওয়াইফকে তোমরা অন্য কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিবে আর আমি কিছু বলতেই পারবো না? ভারি মজার তো ব্যাপারটা? আচ্ছা কাজীসাহেবই বলুক শুনি। একটা মেয়ের হাজবেন্ড জীবিত থাকতে অন্য একটা লোকের সাথে বিয়ে দেয়া যায়েজ হলো কবে থেকে? আমাদের তো ডিভোর্সও হয়নি যে তোমরা নীলার উপরে নিজেদের অধিকার দেখাচ্ছ!

-তোর এসব ফেইক ডকুমেন্ট, ফেইক সার্টিফিকেট এখানে কোনো কাজে লাগবে না জিহান। জাস্ট গেট লস্ট। নইলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো।

-নীল? আমাদের ম্যারেজ রেজিস্ট্রির কথা তোমার বাবা আর ভাইয়াকে বলো নি? সো ব্যাড নীল। আর মিস্টার আবরার, ডকুমেন্টগুলো আসল না নকল সেটা নীলাকেই জিজ্ঞেস করে দেখ। আশা করি বিয়ের ডেইটটা ভুলে যায় নি নীলা।

-জিহান! আর একটাও বাজে কথা বলবি না।

-ডোন্ট শাউট মিস্টার আবরার। পুলিশ আর মিডিয়ার কাছে এই পেপারগুলোর কপি দিলে তারা লুফে নিবে এটা জানিস? তখন মান সম্মান কোথায় থাকবে বল তো? একে তো আরেকজনের বউকে জোর করে বিয়ে দেয়ার দায়ে জেলে যাবি, আর মিডিয়ায় ইজ্জত নিলামের কথা তো বাদই দিলাম। বাট হাজার হোক শ্বশুরবাড়ির এতো অসম্মান করতে চাইছি না। নীল? চলো তো? এসো? গাড়ি সাজিয়েই নিয়ে এসেছি তোমাকে নিয়ে ফিরবো বলে।

-জিহান? স্টে এওয়ে ফ্রম হার। নীলা তোর সাথে যাবে না। আর তোর এসব মিথ্যে বিয়ের গল্প নিজের কাছেই রাখ। বের হয়ে যা এখান থেকে।

আবরার এগিয়ে এসে জিহানের একটা হাত ধরে টেনে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার জন্য উদ্ধত হয়েছে এমন সময় প্রায় বিশ বাইশজন লোক কোথা থেকে এসে সবাইকে ঘিরে ধরেছে। সবার হাতেই হয় কোনো না কোনো অস্ত্র থাকায় অসিফ স্টাফরা সব ভয়ে জড়সড় হয়ে গেছে। জিহান আবরারের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে এসে নীলার সামনে এসে দাঁড়ালো। জিহানের দু জন লোক এসে শিহাবকে টেনে নীলার পাশ থেকে সরিয়ে আনতেই জিহান ধপ করে নীলার পাশে বসে পড়লো। বাকি লোকগুলো সবাইকে ঘিরে রেখেছে। পুরো ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটেছে যে নীলা, আবরার, আফসান সাহেব, শিহাব বা নিহার কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারে নি। বিস্ময়ের দমক কাটতে নীলা নিজের সোফা ছেড়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতেই জিহান নীলার একটা হাত চেপে ধরে আবার নিজের পাশেই টেনে বসিয়ে দিলো।

-এতোক্ষণ ওই হারামিটার পাশে বসে বসে তামাশা দেখছিলে, তখন তো কোনো অসুবিধা হয়নি। এখন যেই আমি তোমার পাশে এসে বসলাম ওমনি উঠে পালাচ্ছ? চুপচাপ এখানে বসে থাকো নীলা। তোমার বাপ ভাইয়ের সাথে ডিলটা শেষ করি, তারপর আমার সাথে বাড়িতে যাবে। ততক্ষণ পর্যন্ত একটা কথাও না। গট ইট?

-কি চান টা কি আপনি? যখন ইচ্ছে এসে বলবেন বিয়ে করা বউ, যখন ইচ্ছে আরেকটা মেয়ের সাথে—-।

-আর একবার যদি ওই ঘটনাটা টেনে আনো তাহলে কষে দুগালে দুইটা থাপ্পড় লাগাবো নীলা। ভালোবেসে নম নম করে বুঝাতে চাইছি তো তাই মাথায় চড়ে বসেছ না? কথা শোনার ধৈর্য্য যদি না থাকে তাহলে চুপ করে কান বন্ধ করে বসে থাকো। অযথা তোমার ফ্যামেলির মতো কথা প্যাঁচাবে না একদম। তোমাকে চাই, তার মানে এই নয় যে তোমাদের এসব আলতু ফালতু বিহেভিয়ার মেনে নিবো আমি। আর আজ যা করেছ সেটার পানিশমেন্ট তো বাড়িতে গিয়ে পাবে। এখানে নতুন করে আরেকটা সিনক্রিয়েট করিও না আমাকে দিয়ে।

-আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না। বুঝতে পেরেছেন আপনি? আর দুদিন পরে আপনি যে নিজের মামার কথায় আবার নতুন নাটক করবেন না তার গ্যারান্টি কোথায়? বিজনেসের নাম করে রীতিমতো গুন্ডামি শুরু করেছেন। আপনার এই লোকগুলোকে না এক্ষুণি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে বলুন। নইলে খুব খারাপ হয়ে যাবে জিহান।

-আমি তে জোর করতে আসি নি। তোমার বাবার কাছ থেকে টেন্ডারের ফাইল চুরি করতেও আসি নি। আমি আমার বউকে নিয়ে যেতে এসেছি। আর আমার কাজে যে বাধা দিবে তাকে সোজা উপরে পাঠিয়ে দিবো। বুঝতে পেরেছ?

-ছাড়ুন আমাকে?

-নীল? তুমিও এখন বিয়ের ডকুমেন্টগুলোকে নকল, ফেইল, জাল এসব বলে উড়িয়ে দিচ্ছ নাকি? ওকে ফাইন। সবাই যখন এখানেই আছে, কাজী সাহেবও আছেন, তাহলে আরেকবার বিয়েটা করে ফেলা যাক কি বলো? কাজীসাহেব? আপনি নতুন করে বিয়ে পড়ানো শুরু করুন তো। পাত্র বদলে যাবে শুধু। আমি, জিহান চৌধূরী, বাবা মৃত—–।

-আমি মরে গেলেও এই বিয়েটা করবো না মিস্টার জিহান।

নীলার কথাটা শুনে জিহান রাগী চোখে একবার নীলার দিকে তাকিয়ে আফসান খন্দকারের দিকে একনজর তাকিয়ে নিজের একজন লোককে কিছু একটা ইশারা করে আবার নীলার দিকে তাকালো।

-তুমি মরে গেলে তো এমনিতেও বিয়েটা করতে পারবে না নীল। তাছাড়া বউই মরে গেলে আমার লাভটা কি? এরচেয়ে অন্য কেউই মরুক। কি বলো?

-মানে? কা-কার? কার কথা বলছেন আপনি? প্লিজ এমন কিচ্ছু করবেন না আপনি।

-আমি তো কিছুই করবো না জান। যা করবে ওরাই করবে। হেই সাদিক? আমার শ্বশুরমশাই সবটা জেনে শুনেও কেমন চুপ করে আছে দেখতে পাচ্ছ? বাবার লাড়লি মেয়ে তো? বাবার অনুমতি ছাড়া বিয়েতে মত দিচ্ছে না বুঝলে? কি করা যায় বলো তো? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া?

সাদিক নামের লোকটা বিভৎস একটা হাসি দিয়ে হাতে ধরা ছুরির তীক্ষ্ণ ফলাটা দিয়ে আফসান খন্দকারের হাতে আচমকা একটা টান বসিয়ে দিতেই নীলা আঁতকে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বাবার দিকে ছুটে যাওয়ার আগেই জিহান নীলার হাতটা টেনে ধরে আটকালো। নীলা রীতিমতো কাঁদতে কাঁদতে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। জিহান অবশ্য সেটাকে মোটেও পাত্তা না দিয়েই কাজীসাহেবের সাথে নিচু গলায় কথা বলছে। আবরারকেও দু তিনজন লোক মিলে চেপে ধরে রেখেছে। তবু আবরার নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে চলেছে। আফসান খন্দকারের হাতের কাটা অংশটা দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝড়ার দৃশ্যটা নীলা আর আবরার দুজনকেই পাগল করে তুলেছে যেন। নীলা এবারে রাগে জিহানের কোটের কলার খামচে ধরে সোজা চোখে চোখ রেখে তাকালো জিহানের দিকে।

-কি চান টা কি আপনি? মেরে ফেলতে চান তো আমাকে? মেরেই ফেলুন। একবারেই শেষ করে দিন। তবু আমার পরিবারকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিন প্লিজ?

জিহান শান্ত দৃষ্টিতে এবারে নীলার কান্নাভেজা মুখটার দিকে অপলকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। নিজের কোটের কলারটা নীলার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রুমে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের ভীত সন্ত্রস্ত মুখগুলোর দিক থেকে একনজর চোখ বুলিয়ে নিল জিহান।

-শাস্তি তো তুমি পাবেই নীল। তবে এতো সহজ শাস্তি? নো ওয়ে। তুমি মরবে, তীলে তীলে মরবে, এতো সহজে মুক্তি পাবে ভেবেছ? উঁহু। বাট এখানে নয়। আমার বাড়িতে। যেখানে আরো কতোগুলো মানুষ একটু একটু করে শেষ হয়ে গেছে শুধু তোমার ফ্যামেলির কারণে। তোমার এই ভাইয়ের কারণে, বাবার কারণে। তাদের প্রতিদিনের হাহাকারগুলো তোমার গলা চিড়ে বের না হওয়া পর্যন্ত তো তোমার মুক্তি নেই নীলা। কি ভেবেছিলে কি? কলেজের একটা বখাটে, গুন্ডা, মাস্তান তোমার প্রেমে পড়ে জেন্টেলম্যান হতে পারলে আবার তোমার দেয়া ধোঁকায় সে আগের রূপে ফিরতে পারবে না? এখন তুমি ঠিক করো। আমার সাথে যাবে? নাকি জেদ করে বসে থেকে সবার মৃত্যুর কারণ হবে।

-আমি—–।

-সাদিক? ম্যাডামের মে বি সিদ্ধান্ত নিতে একটু প্রবলেম হচ্ছে। এদিকে শ্বশুরমশাইও কিছুতেই অনুমতি দিচ্ছেন না। কি করা যায় বলো তো?

সাদিক নামের লোকটা রক্তাক্ত ছুরিটা আবার তুলে আফসান খন্দকারের দিকে এগিয়ে নিতেই নীলা ছুটে গিয়ে আফসান খন্দকারের সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে চিৎকার করলো নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে।

-আমি রাজি, আমি রাজি, আমি রাজি। পাপাকে কিচ্ছু করবেন না প্লিজ? আপনার সব কথা আমি মানতে রাজি প্লিজ? কাউকে কিচ্ছু করবেন না প্লিজ?

চলবে, ইনশাআল্লাহ

((গল্পের ভিউ নেই বললেই চলে। ভাল না লাগলে কমেন্ট করে জানিয়ে দিবেন প্লিজ। আর ২/৩ পর্ব দেখবো। তার পর বন্ধ করে দিবো। ধন্যবাদ।))

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here