আওয়াজ পর্ব -০২ ও শেষ

#আওয়াজ
#আরুশা_নূর
পর্ব-২
আমি আমার বাসায় কিভাবে পৌঁছেছিলাম তা আমার মনে নেই। বাসার দরজাটা খোলাই ছিল। আসিফ দরজার সামনে মাথানিচু করেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমার খুব ইচ্ছা করছিল দৌড়ে পালিয়ে যেতে। বাসায় ঢুকেই আমি কি দেখবো তা আমি জানতাম। তা সহ্য করার ক্ষমতা আমাকে সৃষ্টিকর্তা দিয়েছে কি না তা আমি জানতাম না।
অনন্যা ডিভানেই বসে ছিল। আমার মেয়ের র*ক্তা*ক্ত নি*থর শরীর কোলে নিয়ে। আমি অনুভব করলাম আমার পা দুটো খুব ভারী হয়ে উঠেছিল। ভীষণ ভারী। দশটা ইট যেন একেকটা পায়ে বাঁধা৷ সামনে পা বাড়িয়ে দেয়ার শক্তি পাচ্ছিলাম না। আমি অনেক কষ্ট করে অনন্যার সামনে যেতে পেরেছিলাম। হাটু গেড়ে বসে পড়েছিলাম অনন্যার সামনে। আমার মেয়ের বন্ধ থাকা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে আমি অনুভব করতে পারছিলাম আমার সহ্য ক্ষমতা কতো বেশি। আমি আরমিনার নি*থর শরীর অনন্যার থেকে নিজের কাছে নিলাম। আমার ছোট্ট আরমিনা আমাকে জড়িয়ে ধরেনি। হেসে দেয়নি। আমার বুকে মাথা রেখে মুখ দিয়ে চু চু শব্দ করেনি। আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার আরমিনা আর কখনোই আমাকে জড়িয়ে ধরবে না। খুব জোরে চি*ৎকার দিয়ে কেঁদে উঠেছিলাম আমি। আরমিনার ছোট্ট নিথর ঠান্ডা র*ক্তা*ক্ত শরীরে মুখ গুঁজে আমি কেঁদেছিলাম বহুক্ষন।

আরমিনার ছোট্ট শরীরে একটাই গু*লি পাওয়া গিয়েছিল। ০.২২ এ*ল আ*র। বুক ভেদ করে ফুসফুসে আটকে গিয়েছিল। স্পট ডে*ড। আসিফরা গিয়ে দরজা ভে*ঙে বাসায় ঢুকেছিল। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। অনন্যার হাত পা মুখ তখনো বাঁ*ধা ছিল। পুরো বাসায় অনন্যা একা জীবিত মানুষ ছিল। যার সামনে দুইটা মৃ*ত লা*শ ছিল। যার একটি অনন্যার নিজের মেয়ের।
আসিফ জানায় অনন্যার বাঁধন খুলে দেওয়ার পর অনন্যা দৌড়ে গিয়ে আরমিনার শরীর কোলে নিয়ে হাসপাতালে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু টিমের সাথে থাকা ডাক্তার অনন্যার সামনেই অনন্যার একমাত্র মেয়ের শরীরের না*ড়ি টিপে জানিয়ে দিয়েছিল অনন্যার কোলে থাকা শিশুটি মৃ*ত।

আরমিনার দা*ফনের ব্যবস্থা করা হয় আমার বাবার বাসার ওখানে। বাবার নির্দেশে। আমাদের পারিবারিক ক*ব*রস্থানে। আরমিনাকে যখন গোসল করিয়ে কা*ফনের কাপড় পেচিয়ে শেষবারের মতো অনন্যার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, অনন্যা তখন ও নীরব ছিল। আরমিনার মৃ*ত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে একবারো কাঁদেনি অনন্যা। নিজের মেয়ের মৃ*ত্যুতে মা কাঁদেনি একবার ও। এ যেন অ*স্বা*ভাবিক মানুষের সংজ্ঞা। পা*গলের সংজ্ঞা। আমার আত্নীয় স্বজন সহ অনেকেই অনন্যাকে কাঁদতে উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু অনন্যা কাঁদেনি। অনন্যা নিজের মেয়েকে শেষবারের মতো কোলে নিয়ে একটা চুমু খেয়েছিল কপালে। কাফনের কাপড় সড়িয়ে গু*লি লাগার জায়গাটা দেখেছিল একবার। তারপরেই খা*টিয়ায় রেখে দিয়েছিল মেয়েকে। সবাই যতটা অবাক, তার চেয়ে বেশি বিরক্ত। কেন মৃ*ত মেয়ের শরীর নিয়ে অনন্যা পা*গলের মতো কাঁদেনি তাই এখন পর্যন্ত আমার আত্মীয় স্বজনদের কাছে আলোচনার বিষয় বস্তু।

আমি যখন আমার মেয়ের নি*থর দেহটা ক*বরে রাখি তখন আমার মনে হয়েছিল আমিও আমার মেয়ের সাথে ক*বরে শুয়ে পড়ি৷ আমার মেয়েটা রাতে যেভাবে আমার হাত জড়িয়ে ঘুমায়, অথবা আমার বুকে, সেভাবেই যেন ওর কব*রে আমাকে নিয়ে ঘুমাতে পারে৷ আমার এতো আদরের মেয়ে কিভাবে থাকবে এই মাটির নিচে, তা আমার এই মাথায় ধরছিল না। ভালবাসা কি জিনিস, তা আমি সত্যিকার অর্থে সেইদিন বুঝেছিলাম৷ বুকে কতো বড় পাথর চাপা দিয়ে আমি আমার মেয়েকে ক*বরে শুইয়ে রেখে বাসায় এসেছিলাম তা শুধু আমি জানি।

অনন্যা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। ওর জীবনযাপন ভীষণ রকম স্বাভাবিক৷ তবুও যেন সবকিছু অস্বাভাবিক। ও একবারের জন্য ও কাঁদেনি৷ খেয়েছে, ঘুমিয়েছে, কথাও বলেছে। যেন ওর মেয়ে না, পাশের বাসার কেউ মা*রা গিয়েছে। কি নির্লিপ্ত চেহারা অনন্যার। যেন কিছুই হয়নি। দুইদিন পর মিরপুরে আমাদের বাসায় চলে এসেছিল। ওই ফ্ল্যাটে আমাদের যাওয়া বারন ছিল। কারন ইয়াকুব কোন জায়গা দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল তা কেউ বের করতে পারেনি। তা শুধু কুসুম জানত। সে তো আর বেঁ*চে নেই। তাই ইয়াকুবের আবার ফিরে আসার ভয়ে আসিফ সহ অনেকেই আমাদের ওই ফ্ল্যাটে ফিরে যেতে বারন করে৷ কিন্তু অনন্যা চলে গিয়েছিল। কারোর কথা শোনেনি। ডুপ্লিকেট চাবি মেইন ডোরের সামনের পাপোশের নিচ থেকে বের করে বাসায় ঢুকে পড়েছিল। বাসায় এসে রান্নাবান্না, খাওয়া দাওয়া সব আগের মতো। নিজের রুমেই ঘুমাচ্ছে। বাবা মা ভাইয়া আমি সবাই হাজার বার বারন করলেও অনন্যা বলেছিল, “আমার মেয়ের সব স্মৃতি এখানে, আমি এখানে না থাকলে শান্তি পাবো না।”
আমাকে ও চলে আসতে হয়েছিল। বিল্ডিংয়ে নিরাপত্তা খুব জোরদার করা হয়েছিল।
একসপ্তাহের মাথায় অনন্যা অফিস ও জয়েন করেছিল। অনন্যার জীবন ভীষণ রকম স্বাভাবিকভাবে চলছিল। আমি অনন্যাকে দেখে বুঝে উঠতে পারতাম না অনন্যা কি চাইতো। এতো স্বাভাবিক কেন ও।
আসিফ সহ অনেকেই বলেছিল, “নিজের মেয়ের মৃ*ত্যু চোখের সামনে দেখেছে, স্বাভাবিক থাকবে কি করে, ভাবীকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও।”
আমি শুনেছিলাম আসিফের কথা। আমি ভীষণ ভালবাসি অনন্যাকে। ওকে হারাতে পারবো না। আমি দেশের সব বড় বড় সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে অনন্যাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সবাই কিছু ঔষধ দিয়ে অনন্যাকে ছেড়ে দিতো। কয়েকজন বলেছিল ও এসব ইচ্ছা করে করছে। ওর কোনো সমস্যা নেই। আমি প্রশ্ন করেছিলাম কেন করছে? মোটিভ কি ওর। জবাব দিতে পারেনি কেউ। অনন্যার যেন ওর মতো। অফিসে যায়। অফিস থেকে আসে। রান্না করে। খায়। আমাকে খেতে দেয়। নিজের রুমে গিয়ে ঘুমায়। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম অনন্যাকে, কেন সে এতো চুপচাপ। কান্নাকাটি কেন করছে না।
খুব শান্ত শীতল কন্ঠে জবাব দিয়েছিল, “কান্নাকাটি করলে আমার মেয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে?”
আমার আর অনন্যাকে কোনোকিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি।

আরমিনা বেঁচে থাকতে প্রতিদিন সকালে আধা লিটার গরুর দুধ দিয়ে যেতো ফার্মের লোকেরা। সেই দুধ দিয়ে অনন্যা সন্ধ্যায় অফিস থেকে এসে সুজি দিয়ে হালুয়া রান্না করতো। ঘন করে। আরমিনা সেটা খেতো খুব তৃপ্তি করে।
আরমিনার মৃত্যুর পর ও অনন্যা ফার্মের লোকেদের বলে প্রতিদিন সকালে দুধ দিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। এবং প্রতিদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে এসে সেই দুধ দিয়ে সুজির হালুয়া রান্না করে। কেউ খায় না। মাঝে মাঝে অনন্যা খায়। প্রায়ই ফেলে দেয়৷ জিজ্ঞেস করতেই বলল, “এটা একটা অভ্যাস। এই অভ্যাস আমাকে আনন্দ দেয়। আমি জানি এটা একদিন না একদিন ঠিক কাজে লাগবে।”
এরকম অসংগতিপূর্ন কথাবার্তা অনন্যা প্রায়ই বলতো। এমন পা*গলামি অনন্যা প্রায়ই করতো।
আমি ধরেই নিয়েছিলাম অনন্যা শোকে পা*গল হয়ে গিয়েছে।
আমার মতো আমার পরিবার ও এ সম্পর্কে বুঝতে পেরেছিল। বিল্ডিংয়ের অনেকে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল অনন্যাকে বিদেশে নিয়ে গিয়ে সঠিক চিকিৎসা করাতে।
কিন্তু আমার কোনো এক জায়গায় মনে হতো অনন্যার মস্তিষ্ক সচল, স্বাভাবিক, সুস্থ। আমার মনে হতো আমিই পা*গল হয়ে যাবো।

ইয়াকুবকে ধরার কোনো প্রচেষ্টায় আমাকে ডিপার্টমেন্ট যুক্ত রাখলো না। নিজেরা নিজেরা চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। আমি কোনো কিছুতেই ছিলাম না। অফিসে গিয়েও শুধু শুধু বসে থাকতাম। আরমীনার ছবি দেখে সময় পার করতাম। মাঝে মাঝে কেঁদে উঠতাম। সহকর্মীরা সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পেত না। বিকালের মধ্যে বাসায় চলে আসতাম। আরমীনার জামা কাপড়, খেলনা গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম।

এরকমই এক বিকালে—–
আমি অফিস থেকে এসে আরমিনার খেলনা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। ড্রয়িরুমে বসা আমি। কিছু একটার আওয়াজ শুনেই আমি নিজের রুমে গেলাম দেখতে৷ অনন্যা তখন নিজের ঘরে।
নিজের ঘরে ঢুকতেই বুঝতে পারলাম এই রুমে আমি ছাড়া আরো মানুষ আছে। বারান্দা দিয়ে আসা হাল্কা চাঁদের আলোয় আমি একটা বিশাল আকৃতি মানুষের ছায়া দেখতে পেয়েছি। হাত দিয়ে লাইট টা জ্বালাতেই দেখতে পেলাম একটা লম্বা মোটা মানুষ। হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। হাসির আওয়াজ শুনেই আমার কানে একটা গু*লির আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়। এই আওয়াজ প্রায়ই প্রতিধ্বনিত হয় আমার কানে। আমার মেয়ের মৃ*ত্যুর জন্য দায়ী গু*লির আওয়াজ। আমি প্রায়ই শুনি৷ ঘুমের মধ্যে আচমকা আমি জেগে উঠি এই আওয়াজেই।
এই হাসির সাথে সেই গু*লির আওয়াজের নিগূঢ় সম্পর্ক আমাকে আমার মস্তিষ্কই জানান দিচ্ছিল।
আমার মস্তিষ্কই জানান দিচ্ছিল এই হাসি ইয়াকুবের। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি ইয়াকুব। ইয়াকুবকে আমি কখনোই দেখিনি। কেউই দেখেনি। ওর খুব কাছের মানুষ ছাড়া ওর চেহারা কেউই দেখেনি। সেই কাছের মানুষ জনকে আমি কু*কুরের মতো পিটিয়েও ইয়াকুবের চেহারার বর্ননা বের করতে পারিনি মুখ দিয়ে। ইয়াকুবের চেহারার জীবিত সাক্ষী ছিল অনন্যা। কিন্তু অনন্যা কিছুই বলতে পারেনি। বা বলতে চায়নি। ওকে জোরাজোরি করা হয়নি৷
আমি স্পষ্ট টের পেলাম পেছন থেকে একটা বন্দুকের নল আমার মাথায় স্পর্শ করল। আমি বুঝলাম ইয়াকুব কথা রেখেছে। ইয়াকুব ফিরে এসেছে।
আমি তখনো ভাবছিলাম ইয়াকুব কিভাবে আমার রুমে ঢুকেছে। চোখ গেল বারান্দায়। বারান্দা পুরোটাই গ্রিল দেয়া। নিচে কোনায় ছোট্ট করে একটা জায়গা সব বারান্দার গ্রিলেই থাকে যেটা খোলা যায়। আমার বারান্দায় সেই জায়গাটায় তালা দেয়া ছিল। সেটা এখন খোলা। কুসুম ই এই তালার চাবি ইয়াকুবকে দিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো ১৪ তলায় থাকা বারান্দা পর্যন্ত উঠল কি করে?

ইয়াকুব মুখ খুলল। “চিনছোস? ইয়াকুব আমি। যারে ধরার জন্য দু*নিয়া এদিক ওদিক কইর‍্যা দিছোস, আমি সেই ইয়াকুব।”
ইয়াকুবের মুখে চওড়া হাসি। আমার বারান্দার দিকের দৃষ্টি অনুসরন করে সেইদিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকায় আবার ইয়াকুব।
বলতে থাকে, “কি? কেমনে আইলাম এতোদূর? তোর নিচের তলার খালি ফ্ল্যাটের চাবি দারোয়ানে দিসে। আর এই বারান্দার ছোট দরজার চাবি কুসুম ই দিসিল। সেইডা দিয়াই সেইদিন ও আইছিলাম, আইজ ও আইছি। যা*ওয়ার আগে দারোয়ানরে শ্যাষ কইর‍্যা দিয়া যামু। চিন্তা করিস না”
এটুকু বলেই ইয়াকুব আমার দিকে এগিয়ে এলো।

“তোরে দেখা দিলাম কেন জানোস? কারন আইজ তোর শ্যাষ দিন। বলছিলাম না লাইভ টেলিকাস্ট দেখামু। আইজ তোর সামনে আগে তোর পা*গল বউডারে লইয়া খেলুম। তারপর তোরে লইয়া। ল, আইজকা ম্যালা সময় আমাগো হাতে। আর কোনো চালাকি করিস না, কুলাইতে পারবি আমার লগে। শুধু শুধু খেলায় মজা নষ্ট।”

আমার পেছনে ব*ন্দুক তাক করা ছেলেটা আমার দুই হাত শক্ত করে ধরে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলো, আমাকে অনন্যার মতোই দ*ড়ি দিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারের সাথে বাঁ*ধল।
ততক্ষনে অনন্যা ড্রয়িংরুমে হাজির। হাসিমুখে। এতো সুন্দর হাসি, এতো উজ্জ্বলতা আমি অনন্যার মুখে আগে দেখিনি। যেন কতো আকাঙ্ক্ষিত মানুষকে অনন্যা পেয়েছে। অনন্যার এতো চওড়া হাসি দেখে আমি যতটা অবাক হয়েছি ইয়াকুব ততটাই খুশি হয়েছে যেন। অনন্যা চওড়া হাসি দিয়ে ইয়াকুবের কাছে এসে বলল, “আপনি এসেছেন? আমি জানতাম আপনি আসবেন। আসুন, বসুন।”
অনন্যা হাত ধরে ইয়াকুবকে ডিভানে বসাচ্ছিল।
ইয়াকুব আমার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি, ব্যাঙ্গাত্মক হাসি সব হাসি হেসে যাচ্ছিল।
আমার মনে হয় এই পুরা জীবনে আমি এতো অবাক হইনি। এতো বড় ধা*ক্কা খাইনি।
যে মানুষটা অনন্যার মেয়েকে অনন্যার সামনেই মেরে ফেলেছে, তাকে ও হাত ধরে বসাচ্ছে, আবার বলছে আমি জানতাম আপনি আসবেন।

ইয়াকুব হাসতে হাসতে বলল, “শা*লা, তোর বউ তো দেখি পুরা পা*গল। এতোদিন মানুষের থেকে শুনছি। অফিসে তোর বউরে সবাই পা*গল কইয়া হাসে। আর এখন নিজের চোক্ষে দেখলাম। এতো হাফ না রে ফুল পাগ*লা। আমারে হাত ধইর‍্যা বসাইতেছে। যেন আমি তার অতিথি। হা হা হা।”
ইয়াকুব পাগলের মতো হাসছিল। অনন্যার মুখে তখনো চওড়া হাসি।
ইয়াকুব বলেই চলল, “আরে পা*গলাগা*রদে দেস নাই কেন? দুইদিন পর তো মনে হয় গা*য়ে জামা কাপড় ও রাখবো না। হা হা হা হা হা… থাক আর দেওয়া লাগবো না। আইজই তো শ্যাষ দিন।”
অনন্যা বলে উঠল, “আপনি সেদিন হালুয়াটা খেয়েছিলেন না? আমার মেয়ের জন্য বানিয়েছিলাম। ওইটা আপনি খেয়েছিলেন। বলেছিলেন মজা হয়েছে। আজ ও বানিয়েছি। খাবেন? নিয়ে আসি?”

ইয়াকুব বলল, ” হ হ। নিয়া আসো। আমি তো ওই হালুয়ার লো*ভেই আইছি। যাও লইয়া আহো।”
অনন্যা কিচেনে চলে গেল।
ইয়াকুব আমার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, “দেখ মা*দা*রের বাচ্চা,দেখ আমি তোর কি হাল করছি। তোর বউরে পা*গল বানাইছি। আমার গোয়েন্দারা যারা তোর বউরে সারাদিন নজরবন্দি কইর‍্যা রাখতো তারা প্রত্যেকে কইছিল বস এ আর স্বাভাবিক নাই। ফুল পা*গল হইয়া গেসে। রাস্তায় একা একা কথা কয়। আমি বিশ্বাস করি নাই। চোক্ষে দেখলাম আইজ।”

আমার কিছুই বলতে ইচ্ছা করছিল না। আমার বুকের ভেতর ভীষণ জোরে হা*তুড়ি পে*টাচ্ছিল কেউ। আমি ভাবছিলাম এই বুঝি ইয়াকুব সেই হা*তুড়ি পে*টানোর শব্দ শুনতে পায়।

অনন্যা একটা সুন্দর বাটিতে করে হালুয়া নিয়ে এসেছিল। একটা সুন্দর চামচ। বাটিটা একটা ট্রে এর উপর ছিল। পাশে এক গ্লাস পানি।
আমি অনন্যার চেহারার দিকে তাকালাম। চোখ জোড়া নিষ্পাপ। মুখে সুন্দর হাসি। অনন্যা পা*গল হয়ে গিয়েছে। আমি নিশ্চিত।

ডিভানে বসে ইয়াকুব অনন্যার দেয়া হালুয়া খাচ্ছিল। আর প্রসংশা করছিল। তার পাশে বসে আছে হাসোজ্জল অনন্যা। আমি অপলক দৃষ্টিতে অনন্যাকে দেখছিলাম।
আমার সামনে ইয়াকুবের সহচর দাঁড়ানো। হাতে বন্দুক।
অনন্যা বলল, “মজা হয়েছে?”
ইয়াকুব মাথা নাড়ল।
অনন্যা বলল, “আধা লিটার দুধ জাল দিয়ে ঘন করি। সেই দুধ দিয়ে এই সুজির হালুয়া বানাই। আমার মেয়ের ভীষণ পছন্দ ছিল। সেইদিন খেতে পারেনি। আপনি আমার হাত থেকে নিয়ে খেলেন, আমার মেয়ের আর খাওয়া হলো না। আমি এর পর থেকে প্রতিদিন ই এই হালুয়া বানাই। অভ্যাস। আমি জানতাম আপনি আসবেন। আপনি যাওয়ার আগে সেদিন বলেছিলেন অপেক্ষা করতে। আমি প্রতিদিন হালুয়া বানাই আর অপেক্ষা করি আপনার জন্য। “.
ইয়াকুবের খাওয়া শেষ। পানিও খেল ইয়াকুব। ইয়াকুবের মুখের হাসিটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। অনন্যার হাসিটা ও। অনন্যার চোখ সচল হচ্ছিল।নির্লিপ্ততা মুছে যাচ্ছিল চোখ থেকে। আমি বুঝতে পারছিলাম না অনন্যাকে। কেউই কোনো কথা বলছিল না। মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর ইয়াকুবের সহচর ইয়াকুবকে জিজ্ঞেস করল, ” বস কোনো সমস্যা?”.
ইয়াকুব মস্তক উপরে উঠালো। আমার অ*ন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। ইয়াকুবের পুরো মুখ ঘেমে একাকার৷ ইয়াকুবের সহচর কিছু বলতে চেয়েছিল, তার আগেই অনন্যা বলে উঠল, “আমি নিজের হাতে বি*ষটা তৈরী করেছিলাম, ল্যাবে। ভেষজ বি*ষ। এ*কোনা*ইট থেকে তৈরি। খুব দামী বি*ষ। নাম শুনেছেন? একটা বেগুনী রঙের ফুল থেকে এই বি*ষ পাওয়া যায়। সেই এ*কো*নাই*ট থেকে আপনার জন্য নিজের হাত ল্যাবে বি*ষ তৈরী করেছিলাম আমি। আপনার ব্লা*ড প্রেসার একেবারে লো করে দেবে মূহুর্তেই। না*র্ভ ও দূর্বল করে দেবে। হা**র্ট বিট ও স্টপ করে দেবে যে কোন সময়। ইদুরের উপর প্রয়োগ করেছিলাম ল্যাবে। পনের মিনিটের মধ্যে নি*স্তেজ হয়ে গিয়েছিল। আপনার হাতে আরো কিছুক্ষন সময় আছে।”

আমার মস্তিষ্ক এ সাথে সাথেই কিছু ছবি ভেসে উঠল। টুকরো টুকরো ছবি। নামকরা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরী করা অনন্যার সাদা এপ্রোন গায়ে ল্যাবে কাজ করার ছবি, একটা শিশি, প্রতিদিনের হালুয়া। আরো অনেক কিছু৷

এক নিঃশ্বাসে এটুকু বলেই অনন্যা ইয়াকুবের যে হাতে পি*স্তল সেই হাতটাকেই ঘুড়িয়ে ইয়াকুবের সহচরের দিকে তাক করল। ইয়াকুবের হাত দিয়ে ইয়াকুবের সহচরকে গুলি করল। অনন্যা এসবে একদমই অভ্যস্ত না। বোঝাই যাচ্ছিল। গু*লিটা লেগেছিল ছেলেটার উরুর একটু উপরে। আমি দম বন্ধ করে সব দেখে যাচ্ছি।
তারপর অনন্যা পি*স্তল টা ইয়াকুবের হাত দিয়েই ইয়াকুবের বুকের উপর তাক করল। বুকের উপর স্পর্শ করে ছিল পি*স্ত*লের ন*ল। ওভাবে ধরেই অনন্যা বলল, “ঠিক এই জায়গায়, আমার মেয়ের শরীরের ঠিক এই জায়গায় গু*লি করেছিলেন। মনে আছে? আমার মনে আছে। ”
আমি দেখেই যাচ্ছিলাম অনন্যাকে। ইয়াকুবের অবস্থা খারাপ। ওর কানে কথা ঢুকছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। ওর শরীর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।
অনন্যা হঠাৎ করেই পি*স্তল্টাকে স্লা*ইড করেই ট্রি*গারে চাপ দিয়ে দিল। ইয়াকুব লুটিয়ে পড়ল ডিভেনের উপর। ফের আরো একবার এই ডিভান ভেসে গেল র*ক্তে। অনন্যা পেছনে ধাক্কা খেয়েছিল গু*লি করার সময়ে। বোঝাই যাচ্ছিল প্রথমবার।
আমি চুপচাপ বসে আছি।
আমার কোনো উত্তেজনা হচ্ছে না। নির্লিপ্ত অনন্যাকে আমি দেখেই যাচ্ছিলাম। অনন্যা ধীরে ধীরে উঠে এসে আমার হাত পায়ের বাঁ*ধন খুলে দিয়ে কিচেনে চলে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল হালুয়ার বাটি, পানির গ্লাস।
আমি ডিভানের উপর পরে থাকা ইউয়াকুবের পি*স্তলটা নিয়ে বেশ কয়েকটা গু*লি করলাম ইয়াকুবের নিথর শরীরটার বুকের উপর। এই গু*লির আওয়াজ আমাকে ভীষণ নাড়া দিচ্ছিল। আমার আরো কয়েক রাউন্ড গু*লি ছুড়তে ইচ্ছে হল। আমি আমার রুমে গিয়ে বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে আমার রি*ভ*লবার নিলাম। এরপর ফোন নিয়ে খবর দিলাম আসিফকে।
তারপর রি*ভ*লবার নিয়ে ইয়াকুবের নিথর শরীরের সামনে দাঁড়ালাম। অনন্যা কিচেনে বাটি ধুচ্ছে। কলকল পানির আওয়াজ। বি*ষের চিহ্ন মুছে দিচ্ছে। সেই আওয়াজ ছাপিয়ে আমার করা মুহুর্মুহু গু*লির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। দূরে কোথাও এশারের আযান দিচ্ছিল। সেই আওয়াজ ও শোনা যাচ্ছে। আমি থামিয়ে দিলাম গু*লি করা। শুধু আযানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here