আওয়াজ পর্ব -০১

একদৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে অনন্যা। এই দৃষ্টি কি তা লিখে প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই। আমি জীবনে কখনো চিন্তাও করিনি অনন্যাকে এভাবে দেখবো। অনন্যার এখন চিৎকার করে কাঁদা উচিত। কিন্তু অনন্যা নির্লিপ্ত ভাবে বসে আছে। বিয়ের পর পর অনন্যা আমার বহু অ*ত্যাচার সহ্য করে হলেও নির্লিপ্ত থাকতে চাইতো। কিন্তু আমার অ*ত্যাচার ছিল ভ*য়ান*ক পর্যায়ের৷ অনন্যা নির্লিপ্ত থাকতে পারতো না। ভীষন ক*ষ্ট যন্ত্র*ণা ওর চোখে চেহারায় ফুটে উঠতো। কিন্তু আজ পৃথিবীর সকল অত্যাচার, যন্ত্র*ণা, কষ্ট মাত্রা ছাড়িয়ে অনন্যার কাছে ধরা দিয়েছে। তবুও অনন্যা নির্লিপ্ত।
বিয়ের প্রথম দিন থেকেই আমার অনন্যাকে সহ্য হতো না। আমি চাইনি বিয়ে করতে। আট বছরের প্রেমে, বিশ্বাসে বিশাল ফাটল আমাকে সারাজীবনের জন্য একটা অ*মানুষে পরিনত করে দিয়েছিল। অ*মানুষদের বিয়ে করা উচিত না। বিয়ে মানুষের জন্য। কিন্তু বাবা মায়ের নাটকের কাছে হার মেনে বিয়ে করতে হয়েছে আমার মতো অ*মানুষকে। মায়ের অবশ্য আমার জন্য অন্য পছন্দ ছিল। কিন্তু বাবা, ভাইয়া, আপু, দুলাভাই মিলে অনন্যার মধ্যে কি দেখলো কে জানে, অনন্যার মতো ভাল একটা মানুষকে আমার মতো অ*মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। সেই রা*গ আমি অনন্যার উপর ঝেড়েছি টানা দুইটা বছর। অ*মানুষের মতো আচরন করেছি। যতটা মানসিক, তার চেয়ে বেশি শারিরীক। আমার অ*ত্যাচারের জন্যই অনন্যার পেটে থাকা আমার প্রথম বাচ্চাটা মা*রা গিয়েছিল অনন্যার পেটেই। প্রথম বাচ্চাটা মা*রা যাওয়ার পর পরই অনন্যা আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সকল প্রকার চেষ্টা করেছিল। অনন্যা ছিল এ*তিম। ওর ভাই বোনেরা ও অনন্যাকে সমর্থন জানায়নি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে। একা একা চেষ্টা করেও পারেনি আমার অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল বাবার কারনে। এই কারনে বাবা অনন্যার সামনে ভেজা চোখে মাথা নিচু করে অনেকবার বলেছিলেন, “মা, আমি ভীষণ স্বা*র্থপর, আমাকে ক্ষমা করো।”
এরপরে বাবা বহুদিন অনন্যার মুখোমুখি হননি। আমার পরিবারের সকলে থাকে সাভার ক্যান্টনমেন্ট ছাড়িয়ে বহু দূরে বাবার বহু সাধের গড়ে তোলা ডুপ্লেক্স বাড়িতে। আমাকে থাকতে হয় চাকুরীর জন্য মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে। ২১০০ স্কয়ার ফিটের এই ফ্ল্যাটে আমি থাকি অনন্যাকে নিয়ে।

প্রথম বাচ্চা মা*রা যাওয়ার ছয়মাস পর অনন্যা পুনরায় আমার বাচ্চার অস্তিত্ব নিজের মধ্যে টের পায়। কাউকে জানায়নি। কারন আমার প্রথম বাচ্চাটাকে আমি সজ্ঞানেই মে*রেছিলাম। অনন্যা ভয়ে আমার থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে থাকার চেষ্ট করতো। পাশের রুমে ঘুমাতো। আমি কিছুই বলতাম না। ভাবতাম বুঝি অভিমান হয়েছে অনন্যার। ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি অনন্যা প্রেগন্যান্ট। আমি সকালে যেতাম, রাতে আসতাম। অনন্যাকে দেখতেই পেতাম না। তখন এক ধু*র*ন্ধর আ*ন্ডারগ্রা*উন্ড মা*ফি*য়া ইয়াকুবকে ধরার দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। ক্ষমতাসীনরা ইয়াকুবকে কাজে লাগিয়ে উপরে উঠে ইয়াকুবকেই উপড়ে ফেলতে চাইছে। আমি, আমার টিম হুকুমের গোলাম৷ ইয়াকুবের খুব কাছের ডান হাত বাম হাত আমি নিজের হাতে গু*লি করে মে*রেছি। যার মধ্যে ইয়াকুবের ছেলে, ভাই সবাই ছিল। ইয়াকুবের মা*দক পা*চারের পুরো গ্যাংকে সঙ্গে নিয়ে আমি আর আমার টিম প্রেস ব্রিফিং করেছি। ইয়াকুবকে ধরাটা শুধু বাকি ছিল। কিন্তু ওকে ধরি ধরি করে ও ধরতে পারছিলাম না। তখনি জানতে পারি অনন্যা নয় মাসের প্রেগন্যান্ট। বাসায় তখন বাবা মা ভাইয়া ভাবী সবাই। না হলে তখনি আমি অনন্যার পেটে একটা লা*থি দিয়ে সব শেষ করে দিতাম৷ মা বাবা তখন ভীষন রাগ আমাদের উপর। কেন নয় মাসেও অনন্যার প্রেগ্ন্যাসির খবর তাদের জানানো হয়নি। আমার মা সংগে করে অনন্যাকে নিয়ে গেলেন নিজের সাথে। তাই সে যাত্রায় অনন্যা আমার সন্তানকে আমার মতো অ*মানুষের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেছিল।
জুন মাসের ২৫ তারিখ রাত ১১ টায় আমি যখন ইয়াকুবের গ্যাঙের ৮ জনকে একসাথে ব্রা*শফা*য়ার করে গাড়িতে বসে মনের সুখে সি*গা*রে*ট টানতে টানতে ওদের নারী পা*চারের হিস্ট্রি শুনছিলাম টিম মেম্বারদের থেকে, সে রাতেই বাবা আমাকে ফোন করে জানায়, আমি কন্যাসন্তানের জনক হয়েছি। এই সংবাদ আমাকে এতোটুকু ও নাড়া দেয়নি। আমাকে পুলকিত বিচলিত কিছুই করেনি।
আমি আমার মতোই সে রাতে বাসায় চলে গিয়েছিলাম। গোসল করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
সকালে ভাইয়া পিঠে থা*প্পড় মা*রতে মা*রতে ঘুম ভাঙিয়ে বাজে কয়েকটা গা*লি দিয়ে রেডি করে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।
আমি নির্বিকার। ভাইয়া ভীষণ এক্সাইটেড। আমার মেয়ের চেহারা বর্ননা দিয়ে চলেছে গাড়ি চালাতে চালাতে। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করছে আমার নির্লিপ্ততার কারন। আমি নিরুত্তর।
হাসপাতালে অনন্যার কেবিনে পা রাখতেই মা আমার কোলে একটা তোয়ালে পেঁচানো কিছু একটা দিয়ে দিয়েছিল। তাকিয়ে দেখি চোখ বুজে ঘুমিয়ে থাকা একটা পুতুল। পরীও বলা যেতে পারে। আমি জানিনা আমার কি হয়েছিল। আমার মনে ভীষণ রকমের ভাল লাগা ছড়িয়ে গিয়েছিল। আমি শুধু ওই মুখখানার দিকেই তাকিয়েছিলাম। এতো সুন্দর একটা মুখ, আমি দেখে দেখেই জীবন পার করে দিতে রাজি ছিলাম।
ঠিক চারদিন পর অনন্যা বাসায় আসলো। আমার মা নিজের বাসা ছেড়ে কোথাও রাতে থাকতে পারেন না। আমার বাচ্চা আর অনন্যার দেখভালের জন্য তাই একটা মেয়েকে রাখা হয়েছিল। কুসুম মেয়েটার নাম। কিচেনের পাশে একটা স্টোর রুমের মতো, ওখানে থাকতো মেয়েটা। অনন্যা আর আমার মেয়ে আমার পাশের রুমে ঘুমাতো। আমার মনটা পড়ে থাকতো পাশের রুমে। আমি একঘন্টা পর পর অনন্যার রুমের দরজায় নক করতাম। মেয়েকে দেখার জন্য। অনন্যা ঘুম ঘুম চোখে বলতো ” দেখা শেষ? রুমে যান, ঘুমান।”
তবুও অনন্যা আমাকে একবার বলতো না, “আপনিও এখানে ঘুমান।” আমি ও আমার অ*মানুষিক অ*হংবোধ থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়ে বলতে পারতাম না, “আমিও তোমাদের সাথে এই রুমে ঘুমাবো। ”
আমার মেয়ে যদি রাতে কান্না করে উঠতো, আমার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠতো। অনন্যার রুমের দরজায় আমি ডা*কাত দলের সর্দার সেজে জোরে জোরে বাড়ি দিতাম। অনন্যা আমার কান্নারত মেয়েকে কোলে নিয়ে দরজা খুলে বিরক্তি ফুটিয়ে তোলা মুখ নিয়ে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। আমি অনন্যার কোল থেকে আমার মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে শান্ত করার চেষ্ট করতাম। আমার মেয়েটা আমার কোলে কি শান্তি পেতো আমি জানি না। কান্না থামিয়ে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকতো। আমি না তাকিয়ে ও বুঝতে পারতাম অনন্যা অবাক চোখে আমাকে আর আমার কোলে শান্ত হয়ে থাকা আমার মেয়েকে দেখছে। আমার ভীষণ ভাল লাগতো। ভীষণ।

বাবা আমার মেয়ের নাম রেখেছিল আরমীনা বিনতে সাইফ। আমি অপেক্ষায় ছিলাম কবে আরমিনা বড় হবে, আর আমার সাথে ঘুমাবে। আমার খুব ইচ্ছে করতো স্বাভাবিক মানুষের মতো স্ত্রী বাচ্চা নিয়ে একরুমে ঘুমাই। কিন্তু অনন্যাকে বলতে সাহস পেতাম না। আমার মনে হতো আমি অনন্যাকে ভীষণ ভালবাসি। আমার মনে হতো আমি একজন স্বাভাবিক মানুষ। আমি ভীষণ ভাললাগায় ভাসতাম তখন।

আমার আর ইয়াকুবকে ধরা হলো না। ইয়াকুবের রাজত্বকে ধ্বং*স করে দিয়ে আমি বেশ সুনাম, সুনজর কুড়িয়েছিলাম। কিন্তু ইয়াকুবকে আমার ধরা হলো না। উপর মহল থেকে ও কোনো চাপাচাপি ছিল না ইয়াকুবকে ধরার। কারন এককালের আ*ন্ডা*রগ্রা*উন্ড মা*ফি*য়া ইয়াকুব, যাকে ম*ন্ত্রীরা পর্যন্ত ভয় করতো, সেই ইয়াকুবকে আমি প*ঙ্গু করে দিয়েছিলাম। ওর সকল প্রকার অ*বৈধ ব্যাবসা আমি শেষ করে দিয়েছিলাম। লোকজনকে ব্রা*শফা*য়ার করে মেরেছিলাম। আমার উপর, আমার টিমের উপর পুরো ডিপার্টমেন্ট অনেক খুশি ছিল। আমার প্রমোশন হবে হবে করছে। অফিসে ঢুকলেই চারিদিকে প্রশংসা। বাসায় আমার মেয়ে। অনন্যার প্রতি আমার মন উপচে ভরা গোপন ভালবাসা। আমার তখন বৃহস্পতি তুঙ্গে। আমার সবসময়ই তখন মন ভাল থাকতো। আমার হঠাৎ হঠাৎ মনে হতো আমি মানুষ। আমি বাবা। আরমিনার বাবা। ধীরে ধীরে বড় হওয়া আরমিনা যখন ছোট ছোট দুইটা হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরতো, আমার মনে হতো এই পৃথিবীতে মানুষ হওয়ার চেয়ে, বাবা হওয়ার চেয়ে সুখের আর কিছু নাই।
অনন্যা অফিসে আরমিনাকে নিয়ে যেতো।
আমি হুটহাট অনন্যার অফিসে হানা দিতাম। আমার এই র‍্যাবের কালো পোশাকেই। শুধুমাত্র আরমিনাকে দেখবো বলে। প্রথম প্রথম সিকিউরিটি গার্ডরা ভয় পেতো। পরে যখন সবাই অনন্যার হাজব্যান্ড হিসেবে পরিচয় পেলো আমার, তখন অনন্যা বিরক্ত হলেও বাকিরা সবাই খুব খুশি হতো বলেই মনে হতো। অন্তত চেহারা দেখে তো তাই মনে হতো। আমি আরমিনাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতাম। আরমিনাও খুব খুশি হতো আমাকে পেয়ে। বোঝা যেতো ওর হাসি দেখে।

আরমিনার পাঁচ মাস তখন। ততদিনে অনন্যার বু*কের দুধ আরমিনা আর খায় না। ফিডার খায়। আমি একদিন সন্ধ্যায় অনন্যাকে বলেছিলাম “তোমাকে তো আর প্রয়োজন নেই, আমি নিজেই ফিডার বানিয়ে আমার মেয়েকে খাওয়াতে পারবো। রাতে আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে।” অনন্যা বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, “আচ্ছা। তাহলে তো ভালই হয়, আমি একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। ”
অনন্যার ফোলা ফোলা ঠোঁট জোড়ায় তখন কষ্ট করে হাসি চেপে রাখার আভাস।
সত্যি সত্যি রাতে অনন্যা আরমিনাকে আরমিনার বালিশ, কাঁথা, দুধের কৌটা, ফিডার, গরম পানির ফ্লাস্ক সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমার রুমে দিয়ে গিয়েছিল। আমার মেয়ে তখন ঘুম। আমি আরমিনার পাশে শুয়ে আরমিনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। ঘুম ভাঙল আরমিনার কান্নায়।
আমি কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছি, কাজে দিচ্ছে না। কান্না কিছুক্ষনের জন্য থামলেও আবার থেকে থেকে কান্না করছে আমার মেয়ে। আমি ঘুম ঘুম চোখে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিছু ক্ষন পর অনন্যা দরজার বাইরে থেকে চিৎকার করে বললো “ক্ষিধে পেয়েছে আরমিনার”
আমি তড়িঘড়ি করে মেয়ের জন্য ফিডার বানাতে বসলাম। কতো চামচ পাউডার পানিতে মেশাতে হয় তা না জানা আমি চিৎকার করে এটা জিজ্ঞেস করতেই অনন্যা দরজার ওপাশ থেকে চিৎকার করে উত্তর দিল, “আমাকে তো আর প্রয়োজন নাই কারোর, আমাকে ছাড়াই তো সব চলে, আবার জিজ্ঞেস করেন কেন?”
উত্তর শুনে মেজাজ এতো গরম হয়েছিল, মনে চেয়েছিল গিয়ে অনন্যার দু গালে দুইটা চ*র মেরে দিয়ে আসি। কিন্তু মেয়ের কান্না দেখে সেই চিন্তা বাদ দিয়েছিলাম। কোনোরকমে দুধ বানিয়ে মেয়ের মুখে দিতেই তারস্বরে চিৎকার করে কান্না।
কোনো সাধারণ কান্না নয়। আমি ফিডার সড়িয়ে আবার ওর মুখে দিতেই ও মুখ সড়িয়ে আরো জোরে কান্না করা শুরু করলো। ওইদিকে অনন্যা দরজায় সমানে নক করে চলছিল।
উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই অনন্যা, কুসুম হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে পড়েছিল। অনন্যা মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছিলো। অনন্যা কিছুই না বলে আরমিনাকে নিয়ে রুম থেকে চলে গিয়েছিল। কুসুম আরমিনার সব জিনিসপত্র নিয়ে গিয়েছিল।
আমি অনেক ক*ষ্ট বুকে চাপা দিয়ে অনন্যার রুমের দরজার সামনে বসে থেকে রাত পার করেছিলাম।

সকালে অনন্যার রুমের দরজা খুলতেই আমার ঘুমন্ত শরীরটি অনন্যার নরম পায়ের উপর লুটিয়ে পড়েছিল। আমার ঘুম ভেঙেছিল। কিন্তু অনন্যার বিস্ময় কাটেনি। আমি দ*ন্ডপ্রাপ্ত আ*সামীর মতো মাথা নিচু করে অনন্যাকে পাশ কাটিয়ে অনন্যার রুমে ঢুকে আমার মেয়ের কাছে চলে গিয়েছিলাম। অনন্যা আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “দুধটা গরম ছিল, জিহবা পু*রে গিয়েছে আরমীনার, তাই অমন কেঁদেছিল, এখন ঠিকাছে।”
আমার বুকের ভেতরকার য*ন্ত্রণা কোনো ভাষায় প্রকাশ করা গেলে হয়ত ভাল হতো, আমি কাউকে বোঝাতে পারতাম আমার সেই মুহুর্তের হওয়া ক*ষ্ট। মাঝে মাঝে আমার এমন ক*ষ্ট হয় বুকের মধ্যে। যখন মনে পড়ে, আমি চাইনি আরমিনা দু*নিয়ার আলো দেখুক, যখন মনে পড়ে আমার প্রথম সন্তান আ*মার জন্যই দুনি*য়ার আলো দেখতে পারেনি৷

আরমিনার ছয়মাস পূর্ন হওয়ার দশদিন পর এক সন্ধ্যায় আমার কাছে অনন্যার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার থেকে একটা কল আসে। ভিডিও কল। আমি যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম। অনন্যা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কখনো কলই দিতো না, সেখানে ভিডিও কল?
আমি রিসিভ করবো না করবো না ভেবেও রিসিভ করেছিলাম। রিসিভ করার পর আমি যা দেখেছিলাম, তাতে আমার শরীরের সকল র*ক্ত ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল।
অনন্যাকে কেউ খুব শ*ক্ত করে মোটা দড়ি দিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারের সাথে বেঁ*ধে রেখেছিল। আমারই বাসার ড্রইংরুমে। মুখ শক্ত করে অনন্যার ওড়না দিয়ে বাঁ*ধা। অনন্যা খুবই চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়াতে।
কেউ একজন অনন্যার মোবাইলের ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে সব আমাকে দেখাচ্ছে। অনন্যার থেকে একটু দূরেই আমার মেয়ে ডিভানে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে, খেলছে আমার দেয়া নতুন খেলনা দিয়ে। কুসুম তার পাশেই দাঁড়িয়ে।
আমার মুখ থেকে কোনো কথাই আসছিলো না। হঠাৎ করেই একটা গলা শুনতেই পাই, “কিরে শু*য়ো*রের বাচ্চা, তোর মুখ হা হই গেসে কেন? গু*লি কই তোর? কর গু*লি আমারে। আমারে ধরার জন্য আসমান জমিন এক কইর‍্যা ফেলছোস, আমার ছেলে, আমার ভাই, আমার কাছের সব মানুষরে তুই খু*ন করছোস, এখন তো আমি তোর বাসায় আছি, তোর আস্তানায়। তোর বউয়ের কাছে, তোর মাইয়ার কাছে। কই তুই? আয় মা*ইর‍্যা যা আমারে। ধর আমারে।”
আমার মস্তিষ্কে শুধু এইটুকুই কাজ করতেছিল যে ইয়াকুব প্রতিশো*ধ নিতে যদি আরমীনাকে বা অনন্যাকে কিছু করে…
আমার সামনে আমার সহকর্মী আসিফ বসেছিল। ও ইয়াকুবের বলা কথাটুকু শুনেই রুম থেকে চলে যায়। আমি জানতাম ও বিশাল বড় এক দক্ষ আ*র্মড টিম নিয়ে আমার বাসায় যাবে, ইয়াকুবকে ধরতে, আমার মেয়ে স্ত্রীকে বাঁচাতে। কিন্তু আমি এ ও জানতাম ও পারবে না ইয়াকুবকে ধরতে। ইয়াকুবকে নিয়ে আমি অনেক গুলো দিন কাজ করেছি, ওকে আমার চেনা। ওকে ধরার কম চেষ্টা আমি করিনি, কিন্তু ওকে আমি ধরতে পারিনি। আমি জানতাম, আসিফ ইয়াকুবকে ধরতে পারবে না। ইয়াকুব ঠিক ওর প্র*তিশো*ধ নিবে। আমি অনুরোধ করলাম ইয়াকুবকে। ওর শ*ত্রুতা আমার সাথে, ও যেন আমাকে মারে, আমার মেয়ের যেন ও কিছুই না করে।
ইয়াকুব তার প্রতিউত্তরে বলেছিল, “তোর মনে হয়, আমি এতো কাঠখড় পু*ড়াইয়া, তোর বাসার কাজের মেয়েরে হাত কইর‍্যা, তোর বউয়ের পেছনে চারজন গোয়েন্দা লাগাইয়া, তোর বাসায় আইছি শুধু ভিডিও করে তোরে থ্রে*ট দিতে? আমারে তোর এতো বো*কা*চো*দা মনে হয়?”
ভিডিও কলে আমি আরমিনাকে দেখছিলাম, হাসছিল। একটা খেলনা গাড়ি দিয়ে খুব সুন্দর করে খেলছিল। হঠাৎ করেই গু*লির শব্দে আরমিনার পাশে থাকা কুসুম মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আমার আরমিনা তাকিয়ে আছে সেদিকে। আমি সবটাই স্পষ্ট দেখতে পারছি। তারপরেই ভিডিও অফ হয়ে গেল অপর পাশ থেকে। ইয়াকুব হাসছিল আর কুসুমকে গা*লি দিচ্ছিল। আমি চিৎকার করে অনুরোধ করছিলাম যেন আরমিনা অনন্যাকে কিছু না করে। ওই বাসা থেকে যেন চলে আসে। ইয়াকুব হাসতে হাসতে বলল, ” সময় বেশি নাই। তোর পাঠানো কু*ত্তার বাচ্চা গুলা চলে আসছে আমারে ধরতে। না হলে তোর সাথে আরো রসিকতা করতাম। মজা দেখতাম আমি।”
“তুই যখন আমার ছেলেরে গু*লি করছিলি আমি তখন ওর সাথে ফোনে কথা বলতেছিলাম, আমি গুলির আওয়াজ শুনছি, আজ তুই ও শোন।”
আমি আওয়াজ পাচ্ছিলাম অনন্যার অস্বাভাবিক গোঙানির, চেয়ারের পায়ার দাপাদাপির। এবং তারপরেই একটা গু*লির আওয়াজ আমি শুনতে পাই।
গু*লির আওয়াজ আমার কাছে সবসময়ই একটা রোমাঞ্চকর আওয়াজ ছিল। আমি যখন ব্রা*শফা*য়ার করে মানুষ মেরেছি, তখন এই রোমাঞ্চকর শব্দ আমার রোমাঞ্চ দিতো, মনে উত্তেজনা তৈরি করতো।
কিন্তু সেইদিন আমি সেই গু*লির আওয়াজ শুনে কোনো রোমাঞ্চকর অনুভূতি পাইনি। আমার শুধু বুকটা খালি হয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়েছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমার বুকটা খালি হয়ে গিয়েছে। আমার দম ব*ন্ধ হয়ে আসছিল।

ইয়াকুব বলে চলছিল, “ট্রেলার দেখাইলাম জাস্ট। তোর বউরে আইজ কিছু করলাম না। এরপরে আরেকদিন আমু। তখন আর এই ভিডিও কলে সিন দেখামু না, শোনামু না। লাইভ টেলিকাস্ট করুম। তোর সামনে। অপেক্ষায় থাকিস।”
চলবে।

#আওয়াজ
#আরুশা_নূর
পর্ব-১
(দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here