#আগুন_ঝরার_দিনে
পর্ব: ১
মানুষটা অনেকটা আগুনের মত। অন্ধকারে হোক কিংবা আলোতে, নির্জনে কিংবা ব্যস্তমুখর কোনো কোলাহলে হোক মানুষটার উপস্থিতি বড় বেশী প্রকট। গায়ের রং অসম্ভব ফর্সা আর বাঙালী ছেলেদের তুলনায় উচ্চতা খানিকটা বেশী বলে মানুষটাকে অনেক ভিড়ের মাঝেও আলাদা করা যায়। রুহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে প্রেমে পড়েছে। ভুল জায়গায়, ভুল সময়ে সে একটা ভুল মানুষের প্রেমে পড়েছে। সজল নামের একটি ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে মাস তিনেক আগে। সামনে ঈদের পরেই সজলের সাথে তার বিয়ে। বাবা যখন সজলের প্রস্তাব নিয়ে রুহির সামনে এসেছিলেন তখন রুহির না করার কোনো কারন ছিল না। দেখতে বেশ সুদর্শন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরিরত সজলের ছবি দেখে রুহি এক বাক্যেই বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়েছিল। তবে বাধ সাধলো দিন পনের আগে। যখন এই মানুষটা গত জানুয়ারি মাসের এগারো তারিখে তাদের ফ্যাকাল্টিতে এসিসটেন্ট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করলেন। মানুষটাকে এক নজর দেখেই রুহির মনোজগতে ভীষণ রকমের তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই তো সেই মানুষ যার জন্য সে এতদিন ধরে অপেক্ষা করে রয়েছে।
– এক্সকিউজ মি। হ্যাঁ আপনাকেই বলছি।
রুহি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, ক্লাস ভর্তি ছাত্র ছাত্রীর সামনে মানুষটা তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রুহির কয়েক সেকেন্ড বুঝে উঠতে সময় লাগলো মানুষটা বোধহয় তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছেন।
রুহি মনে মনে প্রমোদ গুনলো। এতক্ষণ ইকোনোমিক্সের এই প্রফেসর ক্লাসে কী পড়িয়েছেন তা রুহির মাথাতেও ঢুকেনি। অবাক হলেও সত্য, পড়ানোর টপিকটা পর্যন্ত সে জানে না।
রুহি ফ্যালফ্যাল করে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল।
– আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে? খুব বেশী খারাপ লাগলে আপনি ক্লাসের বাইরে যেতে পারেন। একটু খোলা হাওয়ায় দাঁড়ালে আপনার হয়ত ভালো লাগবে।
রুহি আর কথা বাড়াল না। বই খাতা গুলো ব্যাগে গুছিয়ে সে মাথা নিচু করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। সে খুব ভালো মত জানে আজ ক্লাসে তাকে নিয়ে বেশ বড় রকমের একটা গুঞ্জন শুরু হবে। কারন আশফাক নামের এই মানুষটা ক্লাসে কাউকে অ্যাবসেন্ট মাইন্ডে দেখলে কোনো না কোন ভাবে তাকে হেনস্থা করেন। তবে রুহির ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটলো না। অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে মানুষটা তাকে মস্ত বড় অপমানের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।
– এই রুহি।
রুহি সামনের দিকে তাকিয়ে আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার সামনে সজল দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলে প্রায়ই অফিস কামাই করে তার ক্যাম্পাসে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথমদিকে বিষয়টা খুব ভালো লাগলেও এখন রুহির খুব বিরক্ত লাগে। এত অফিস কামাই করেও সজল তার চাকরিটা করছে কীভাবে কে জানে!
রুহি নিজের বিরক্তিটা লুকিয়ে বলল, তুমি এই সময়?
সজল হাসিমুখে বলল, এটাই তো তোমার আজকের শেষ ক্লাস ছিল, তাই না? একটা কাজে তোমার ক্যাম্পাসের পাশে এসেছিলাম ভাবলাম তোমাকে নিয়ে বাসায় ফিরি।
রুহি অবাক হয়ে বলল, বাসায় ফিরি মানে?
– না মানে তোমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরে যাব।
রুহি মুখ গোজ করে বলল, তুমি এখন চলে যাও। পড়া পারিনি বলে স্যার আমাকে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছেন। এখন ক্লাস শেষে সুমির কাছ থেকে আমার আজকের নোটগুলো তুলতে হবে।
– বেশ তো। আমি থাকি। তোমার নোট তোলা শেষ হলে তবে নাহয় যাবো। আমার তো আজ আর কোনো কাজ নেই।
রুহি বুঝল, সজল তার সামনে মিথ্যে কথা বলছে। সে নিশ্চয়ই আজ তার সাথে দেখা করবে বলে অফিস থেকে হাফ বেলা ছুটি নিয়েছে। রুহি খুব মোনোযোগ দিয়ে সজলকে লক্ষ্য করল। ছেলেটার চোখ দুটো আশ্চর্য রকমের সুন্দর। খুব মোনোযোগ দিয়ে তাকালে মনে হয়, কেউ বুঝি খুব আলতো করে তার চোখের নিচে কাজল দিয়ে দিয়েছে! রুহির মন খারাপ হয়ে গেল। সে জানে কাজটা খুব অন্যায় হচ্ছে। এই ছেলেটার তো কোনো দোষ নেই। সে তার ভাবী স্ত্রীর সাথে দেখা করার জন্য তার ক্যাম্পাস পর্যন্ত এসেছে অথচ রুহির ভালোলাগার বদলে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। রুহি মন খারাপ করে বলল, থাক বাদ দাও। সুমির কাছে নোট কাল তুলে নিব। চলো আজ নাহয় বাসায় ফিরি।
– বাসায় ফেরার আগে কোথাও খেতে যাবে নাকি? তোমরা মুখটা দেখতে আজ বেশ শুকনো লাগছে।
রুহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, চলো কোথায় খেতে যেতে চাও।
……………
অনেকক্ষন থেকে একটানা রিং বেজে চলেছে। আশফাক হতাশ চোখে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়ে একবার ফোন করা শুরু করলে না ধরা পর্যন্ত আর নিস্তার নেই। ফোন সে এক টানা দিয়ে যাবে। একবার সে টানা একাশি বার ফোন করেছিল। কোনো মানে হয়! আশফাক বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলো।
– হ্যাঁ দীপা বলো।
– কী ব্যাপার ফোন ধরছিলে না যে?
– ক্লাসে ছিলাম।
– মোটেও না। এই সময় তোমার ক্লাস নেই আমি খুব ভালো মত জানি। আজ শুধু মাত্র তোমার একটা ক্লাস। তাও বিকেল চারটায়।
আশফাক একটু অবাক হলো। দীপা কি কোনোভাবে তার উপর নজর রাখে? আজ আসলেই তার কোনো ক্লাস ছিল না। আশফাক কথা ঘুরিয়ে বলল, কী বলার জন্য ফোন করেছ তাই বলো?
– নিজের বৌ বাচ্চার কোনো খবর আছে তোমার! আমি কিছু বুঝি না ভেবেছ? নায়কের মত এই লালটু মার্কা চেহারা দেখিয়ে তুমি তোমার কচি কচি ছাত্রীদের ইমপ্রেস করতে চাও। তাই তো কোনো ক্লাস না থাকলেও সারাদিন ক্যাম্পাসে যেয়ে বসে থাকো।
– বাজে কথা বলো না দীপা। গত তিন মাস আগে রাগ করে আমি তোমায় ছেড়ে যাইনি। বরং তুমি ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি যেয়ে বসে আছো।
– তবুও ছেলেকে দেখতে একবার আসতে পারতে না তুমি? কেমন বাপ তুমি? ছেলের কথা তোমার গত তিনমাসে একবারও মনে পড়েনি!
আশফাক আর কথা বাড়াল না। দীপার মুখের উপরেই ফোনটা রেখে দিল। দীপার সাথে কথা বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই। এই মেয়ে শুধু কথা টানতে জানে। আর কিছু জানে না। অথচ বিয়ের প্রথম দুটো বছর এই দীপার সাথে তার দিনগুলো খুবই চমৎকার কেটেছিল। তবে ছেলেটা হবার পর দীপা যেন আমূলে বদলে গেল। তার মাথার মধ্যে কোথা থেকে যেন এক গাদা সন্দেহের পোকা ঢুকল। প্রথম দিকে আশফাক অনেক মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। দীপাকে অসংখ্যবার বুঝিয়েছে অন্য নারীর প্রতি তার কোনো আকর্ষণ নেই। তবে কে শোনে কার কথা। দীপা যেন অবুঝ। সে কিছুতেই চায় না আশফাক ক্যাম্পাসে শিক্ষকতা করুক। তার ধারনা আশফাকের পেছনে তার ছাত্রীরা সব সময় লেগে থাকে। দীপার ধারনাটা যে একেবারে ভুল তা অবশ্য বলা যায় না। আশফাক তার ছাত্রী মহলে আসলেই ভীষণ জনপ্রিয়। রাত বিরাতে তার ছাত্রীরা যে তাকে আননোন নম্বর থেকে ফোন করে, টেক্সট করে সেটা সে খুব ভালোমত বোঝে। তবে এগুলো আশফাককে সেভাবে আলোড়িত করে না। নিজেকে কীভাবে নিয়ন্ত্রন করতে হয় সেটা সে খুব ভালোমত জানে। তবে এটাও ঠিক, দীপাকে নিয়ন্ত্রন করার উপায় তার জানা নেই। সে দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে যাচ্ছে। আশফাক নিজের অজান্তেই দুদিকে মাথা নাড়াল। একটু পর তার থার্ড সেমিষ্টারের একটা ক্লাস আছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল চারটা বাজতে আর মাত্র দশ মিনিট বাকি। আশফাক একটু বিরক্তি নিয়ে টিচার্স রুম থেকে ক্লাস রুমের দিকে পা বাড়াল।
ক্লাস নেয়ার ফাঁকে আশফাকের জীবনে যে ঘটনা কখনো ঘটেনি সেই ঘটনা আজ ঘটলো। আশফাকের চোখ আজ কেন যেন বার বার বড় বড় দুই চোখের একজন মালিকের উপর পড়ছিল। নিজের উপর তার নিয়ন্ত্রন অবিশ্বাস্য। তবে আজ আশফাক নিজেকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছিল না। অনেকটা নিজেকে প্রবোধ দেয়ার জন্যই আশফাক বড় বড় চোখের সেই মালিকটিকে অসুস্থতার কথা বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। মেয়েটি বেরিয়ে যেতেই ক্লাসের অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের গুঞ্জন শুনে আশফাক জানতে পারলো, রুহি! মেয়েটার নাম ছিল রুহি!
চলবে
“