আগুন ঝরার দিনে পর্ব -১৩

#আগুন_ঝরার_দিনে

#পর্ব_১৩

রুহী অবাক হয়ে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল। অন্তত এই মুহুর্তে ক্যান্টিনে সবার মাঝে আশফাক স্যারকে সে আশা করেনি। তাছাড়া স্যারের এখন ক্লাস থাকার কথা। রুহী ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, তবে স্যার কি ক্লাস না নিয়ে তার খোঁজে ক্যান্টিন পর্যন্ত এসেছেন?

আশফাক স্যারের কথায় রুহীর ভুল ভাঙলো। আশফাক স্যার চিন্তিত গলায় বলল, দীপা কোথায়? সকাল থেকে তার কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ফোন করলেও ফোন ধরছে না। আমার দীপার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে।

রুহী ফ্যালফ্যাল করে আশফাকের দিকে তাকিয়ে রইল। দীপা আশফাকের স্ত্রী। দীপার জন্যে তার চিন্তা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এই মুহুর্তে আশফাকের চিন্তার কিছু অংশ বোধহয় রুহীরও পাওনা ছিল। রুহী আশফাকের কথার কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

আশফাক আবারো বলল, দীপা কি এসেছিল? তোমার সাথে তার দেখা হয়েছে?

আশফাকের কথার সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে রুহী বলল, আপনি কীভাবে জানলেন আমি এখানে?

– তোমার বান্ধবী সুমী বলল। তাছাড়া আমার মনে হয়েছিল, দীপা ক্যাম্পাসে এলে সবার প্রথমে ক্যান্টিনে আসবে।

স্বাভাবিকভাবেই এত কোলাহলের মাঝে তারা দুজন নিজেদের মধ্যে ঠিক মত কথা বলতে পারছিল না। ক্যান্টিনে ছাত্র, শিক্ষক সহ অনেকেই আছে। এদের মাঝে কেউ কেউ আবার তাদের দিকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে। আশফাক চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, তুমি আর এখানে থেকো না। বাসায় চলে যাও। আমি তোমার সাথে পরে যোগাযোগ করব।

রুহী আশফাকের চোখে চোখ রেখে বলল, পালিয়ে যেতে বলছেন?

– না তা কেন! দেখছো তো সবাই আমাদের দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে। এভাবে কি কথা বলা যায়? তাছাড়া দীপাকে আগে খুঁজে বের করা দরকার। রাগের মাথায় সে কী করে বসে কে জানে! এদিকে আমার ফোনটাও খুঁজে পাচ্ছি না। আমার ধারনা ফোনটা দীপার কাছে। তুমি আপাতত আমার সাথে যোগাযোগ করো না। আমি সময় সুযোগ পেলে তোমার সাথে যোগাযোগ করব।

কথাগুলো বলার পর আশফাক আর ক্যান্টিনে দাঁড়ালো না। যেভাবে ঝড়ের মত এসেছিল সেভাবে বেরিয়ে গেল। রুহী আবারো বসে পড়লো। আজ আর সে কোনো ক্লাস করবে না। মাথাটা একেবারে জট পেকে গেছে। অদ্ভুৎ ভাবে আজ সে আশফাকের চোখে নিজের ছায়া দেখতে পেলো না। অথচ এই ক’দিনে আশফাকের চোখে নিজের বসবাস দেখতে পাওয়াটা রুহীর কাছে অন্যতম সুখের কারন ছিল।

রুহীকে বেশিক্ষণ একা একা বসে থাকতে হলো না। আশফাক চলে যাওয়ার একটু পরেই সুমি ক্যান্টিনে এলো। নরম গলায় বলল, বাসায় যাবি না? চল বাসায় চলে যাই। আজ আমিও তোর সাথে তোদের ওখানে যাব। একটু আগে বাসায় ফোন করে জানিয়েছি। আজ আমি তোর সাথে রাতে থাকব।

রুহী বলল, দরকার নেই তোর এত ঝামেলা করার। আমি ঠিক আছি।

– বললেই হবে তুই ঠিক আছিস। আমি তোকে চিনি না! বুঝতেই পারছি তোর মন ভেঙে একাকার হয়ে গেছে।

– মন ভাঙার মত কিছু ঘটে নাই সুমী। সব কিছু ঠিক আছে।

– মানে! তুই কি ভাবছিস আশফাক স্যার তোর সাথে এখনো যোগযোগ রাখবে? আর যদি যোগাযোগ রাখেও তোর নিজেরই উচিৎ উনার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া।

রুহী অসহায় গলায় বলল, আমাকে আজকের দিনটা একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবতে দে সুমী। আমার মাথা কাজ করছে না।

– ঠান্ডা মাথায় ভাবার আগে তোর জেনে রাখা দরকার, তাদের স্বামী স্ত্রীর কিন্তু একটু আগেই দেখা হয়েছে। দেখলাম তারা দুজনেই বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গাড়িতে উঠল যেন তাদের মধ্যে কোনো ঝামেলা নেই।

সুমীর কথাগুলো শুনে রুহী অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো।

সুমী আবারো বলল, এত অবাক হবার কিছু নেই রুহী। পৃথিবীর কোনো মানুষই নিজের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দের পতন ঘটুক তা চাইবে না। ঠিক তেমনভাবে নিজের অধিকারটুকুও কেউ সহজে হাতছাড়া করতে চাইবে না। প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু অদ্ভুৎ ইচ্ছে থাকে, যা হয়ত অন্যের সামনে প্রকাশ করা অসম্ভব। সেই ইচ্ছেগুলোকে পূরণ করার জন্য কিছুটা রিস্ক হয়ত নেয়া যায় তাই বলে সেই ইচ্ছে পূরনের জন্য নিজের জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাক সেটা কোনো মানুষই চাইবে না।

রুহী অবাক হয়ে বলল, তুই মানুষের মনের খবর এত জানিস কীভাবে?

সুমী করুন হেসে বলল, ভুলে যাচ্ছিস কেন আমার যখন দশ বছর বয়স তখন আমার বাবা মার ডিভোর্স হয়েছে। আমি দেখেছি একটা অবৈধ সম্পর্কের কারনে কীভাবে অনেকগুলো জীবন নষ্ট হয়, কীভাবে সুন্দর একটা সংসারের, নিত্য দিনের অভ্যাসগুলোর ছন্দপতন ঘটে। রুহী বিশ্বাস কর, এমন কোনো দিন নেই যেদিন আমি আমার স্টেপ মাকে অভিসম্পাত করি না, এমন কোনো দিন নেই যেদিন আমার নিজের মা সেই মহিলার কারনে চোখের পানি ফেলেন না। আর যদি বাবার কথা জিজ্ঞেস করিস তাহলে বলব আমার বাবাও নাকি সেই মহিলার সাথে ভালো নেই। বিয়ের এত বছর পরেও তাদের এখনো সন্তান হয়নি। শুনেছি বাবা নাকি দ্বিতীয় পক্ষের ঘরে সন্তান নিতে আগ্রহী নয়। কারন আমাদের দুই ভাই বোনের পড়ালেখার যাবতীয় খরচ বাবাকেই বহন করতে হয়। তাই বাবা হয়ত চাননি ওই পক্ষের কোনো সন্তান আসুক। সুতরাং বুঝতেই পারছিস, ওই মহিলা মনে কত কষ্ট নিয়ে আমার বাবার সাথে সংসার করছে। এসব দেখে আমার কখনো কখনো মনে হয়, আমার মা-ই হয়ত ওই মহিলার কাছে হেরে যাওয়ার পরেও জিতে গেছে।

…………….

দেখতে দেখতে পনের দিন পার হয়ে গেলো। এরমাঝে আশফাক স্যারের সাথে রুহীর কোনোরকম যোগাযোগ হলো না। রুহী খুব স্বাভাবিক ভাবে ক্যাম্পাসে যাচ্ছে। রুটিন অনুযায়ী আশফাক স্যারের সাথে তাদের যে ক্লাসগুলো ছিল সেই ক্লাসগুলো অন্য একজন স্যার নিচ্ছেন। রুহী শুনেছে, আশফাক স্যার নাকি মাস খানেকের ছুটি নিয়েছেন। এদিকে সুমীও সেদিনের পর আর রুহীর সাথে আশফাক স্যারের বিষয়ে কোনো কথা বলেনি। এসবের মাঝে রুহীর বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। আর মাত্র আটাশ দিন পর রুহীর বিয়ে। গত সপ্তাহে সে সজলের সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবে বিয়ের শপিং করেছে। শপিং এর পর ডিনার শেষে বাড়ি ফেরার পথে সজল যখন ওর গালে একটা চুমু খেয়েছে তখনও সে বেশ স্বাভাবিক আচরন করেছে। রুহীকে স্বাভাবিক থাকতে দেখে সজলের সাহস আরো এক ধাপ বেড়েছে। আজ সকালে সে রুহীর শরীরের প্রাইভেট পার্টসে হাত দিয়েছে। রুহী এরপরেও কোনো রিয়াক্ট করেনি। আজ ক্লাস শেষ হবার পর সজলের তার ক্যাম্পাসে আসার কথা। রুহী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক’মাস আগেও তার জীবনটা অনেক সহজ আর সুন্দর ছিল। এ ক’দিনেই কীভাবে যেন সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। সেদিন সুমী যে কথাগুলো তাকে বলেছিল তা যদি সত্য হয় তাহলে রুহী হয়ত আশফাক স্যারের জীবনের অদ্ভুৎ সেই ইচ্ছে ছিল যার জন্য সে নিজের জীবনের এতটুকু ছন্দপতন ঘটাতে রাজি নয়। তবে রুহী খুব ভালোমত জানে আশফাক স্যার তার জীবনের অদ্ভুৎ কোনো ইচ্ছে ছিল না। বরং তার জীবনে আশফাক স্যারের জায়গা ছিল এক টুকরো খোলা আকাশের মত, সতেজ মিষ্টি বিকেলের নরম হাওয়ায়র মত, ভেজা ঘাসের উপর দুলতে থাকা নরম শিশির কনার মত , এক চিলতে রৌদের মত…..

রুহী ঝরঝর করে নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেলল। নিজেকে বারবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা এসব ছাড়া কি বেঁচে থাকা যায়? একজন মানুষের পক্ষে কি আদৌ এগুলো ছাড়া বাঁচা সম্ভব? স্বাভাবিকভাবেই রুহী কোনো জবাব পেল না। নিজের প্রশ্নগুলো তাই উত্তরের পরিবর্তে শুধুই প্রতিধ্বনি হয়ে নিজের কাছে ফিরে এলো।

“চলবে”

“আমার লেখা পড়তে ভালো লাগলে ২০২৩ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত আমার থ্রিলার উপন্যাস “ত্ন” বইটি সংগ্রহ করতে পারেন। রকমারি, বুকমার্ক, প্রজ্ঞা, ধী ছাড়াও বিভিন্ন অনলাইন বুকশপে বইটি পাওয়া যাচ্ছে। ধন্যবাদ সবাইকে। “

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here