আধার রাতের আলো পর্ব -০৩

#আধার_রাতের_আলো
#নুসাইবা_ইভানা
পর্ব -৩

হুরাইনকে তার মা আর বোন মিলে সাজিয়ে দিচ্ছে। একটা মেয়ের ছোট থেকে ইচ্ছে থাকে বউ সাজার। সেই ছোট বেলায় মায়ের ওড়না অথবা গামছা দিয়ে বউ সাজার চেষ্টা করে মেয়েরা। খেলনা দিয়ে রান্না বান্নার খেলা খেলে।বিয়ে নিয়ে কত শত স্বপ্ন থাকে। হুরের সব স্বপ্ন আজ বৃথা। চোখের জল আটকে রেখে নির্জীব হয়ে বসে আছে।কথা ভেতর থেকে আসতে চেয়েও গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে, কেউ আমাকে মুক্ত কর। কেউ তো আল্লাহ তায়ালা পক্ষ থেকে আমার জন্য #আধার_রাতের_আলো হয়ে আসো। কিন্তু সেই চিৎকার নিজের ভেতরেই দাফন করছে হুর। মেয়ে মানুষ মানেই হাজার কষ্ট বুকে চেপে মুখে শুকনো হাসি। তবে আজ হুরের মুখে সেই হাসিও নেই। হুরের মা হুরের চুল বেঁধে দেয়ার সময় হুর খেয়াল করলো হুরের পিঠে পানি জাতীয় কিছু পরছে।হুরের মা রুহুল মিয়াকে বলেছিলেন, দেহো আমাগো এতোটুকু মাইয়াডারে এই বেডার লগে বিয়া দিও না। আমাগো ভাগ্যে যা আছে তাই ওইবো। আমার মাইয়াডার মুখের দিকে চাওন যায় না।
রুহুল মিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, হারাডা জীবন কষ্ট করছি। যেই একটু সুখের মুখ দেহার সৌভাগ্য ওইছে। ওমনি হের সমস্যা শুরু ওইছে। হুনো হিরার মা। আমাগো মাইয়া সুখে থাকবো আর আমারও সুখে থাকবো। মাইয়ারে বুঝাও এই বেডার পঞ্চান্ন বছর বয়স। আর কয় বছরি বাঁচবো। লাগলে তহন তোমার মাইয়ারে আরো ভালো পোলা দেইখা বিয়া দিমু। তও কোন তিরিং বিরিং কথা কইবা না। যাও যাইয়া মাইয়ারে রেডি কর।
হুর নিজের মায়ের হাত থেকে চিরুনি নিয়ে বলে দাও আমি নিজেই বাঁধি।
– তোর জন্য কিছু করতে পারলাম না মা। তুই আমারে মাফ করে দিস।

– এভাবে কেন বলছো মা।সব সময় ধৈর্য ধরতে হয়। জানোনা…إن الله مع الصابرين “নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন” (কুরআনের বাণী)
তাহলে এতোটুকুতে ধৈর্য হারা হলে হবে?

আর কুরআনে তো বলাই আছে, إن مع العسر يسرا….কষ্টের সাথেই রয়েছে
স্বস্তি।

লাল টুকটুকে বেনারসি পরে বঁধু বেশে বসে আছে হুর। নিজের মনকে নিজেই স্বান্তনা দিচ্ছে। মনে মনে স্বরণ করছে আল্লাহ তায়ালা বানী… ومن يتوكل علي الله فهو حسبه
অর্থ -যে ব্যাক্তি আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করে,তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। (সূরা আত্ব তালাক- ৩)

হুরের বোন হিরা। সেও চাইছে না বিয়েটা হোক আবার প্রতিবাদও করতে পারছে না।কারণ বিয়েটা হলে সেও স্বামীর সংসারটা ফেরত পাবে।জীবনে কিছু কিছু সময় আসে যখন মানুষ বড্ড স্বার্থপর হয়ে যায়। তখন শুধু মানুষ নিজের কথা চিন্তা করে। কাছের মানুষের আকুতি তাদের কানে পৌঁঁছায় না।হিরাও আজ সেই মানুষের কাতারে। নিজের ছোট বোনের জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বুঝেও কিছু বলছেনা।

হুরের ছোট ভাই হারুন এসে বলে কি মজা কি মজা আজকে আপুর বিয়ে। চার বছরের হারুন যদি বুঝত বিয়ের নামে তার বোনকে কোন নরকে পাঠাচ্ছে। তাহলে হয়তো তার এই উচ্ছ্বাস থাকতো না।
হুর আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করে বসে আছে।কারন সে জানে তার ভাগ্যে যা আছে তা হবেই।
সালমা বেগম কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে নিজের শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। শতহোক মায়ের মন তো কিছুতেই মানেনা।তার হৃদয় তুফান বইছে। তবে তা আড়াল করার মিথ্যে চেষ্টা করছে।

একমাত্র রুহল মিয়ার মুখেই লেগে আছে হাসি। তার যেনে আজ ঈদ লেগেছে। মানুষ কতটা নিচু মানসিকতার হলে এমন জগন্য কাজ করেও বুক ফুলিয়ে চলে।সমান্য খারাপ লাগাও নেই। রুহল মিয়া নিজের পান খাওয়া দাঁতগুলো বেড় করে হেসে হেসে বলে,কি গো হিরার মা। হুরকে রেডি কারা হলো। সেই কখন থেকে কাজী সাহেব বসে আছেন।

সালমা বেগম কান্না ভেজা কন্ঠে বললেন হ্যাঁ শেষ হয়েছে।
সালামা বেগমের কণ্ঠস্বর শুনে রুহুল মিয়া এসে বলে,জীবনে আমার সুখ শান্তি তোমার সহ্য হইলো না। কতবার কইলাম মাইয়ারে বোঝাও। তার বদলে উনিই কান্দে। মাইনষে ঠিকি বলে, “পাঠার কপালে সিন্দুর লাগে না”।সহ্য হইতাছে না এতো ভালো কিছু। যেমন কু*কু*রের পেঠে ঘী সহ্য হয়না। এইসব নাটক বন্ধ কর এহনি কাজি সাহেব বিয়া পড়ান শুরু করবো।স্ত্রীকে কথা শুনানো শেষ করে হুরের কাছে আসলেন। হুরের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,বাপ মায়ে সারাজীবন কালি তোমাগো লইগা কষ্ট করবো।আর যহন তোমাগো সুযোগ আইবো কিছু করার তখন নাটক শুরু করবা। এইডা কি ঠিক? তুমি না মাদরাসায় পড়তাছো তুমি তো জানো বাপ মায়েরে খুশি রাখলে কত সওয়াব।

হুর বলল,আমিতো কোন অভিযোগ করিনি বাবা।তুমি অবশ্যই আমার খারাপ চাইবে না।তারচেয়ে বড় কথা। আল্লাহ তায়ালা যা করেন বান্দার ভালোর জন্যই করেন।আমি মোটেই মন খারাপ করিনি।
রুহল মিয়া হাসতে হাসতে বলে কত লক্ষী আমার মেয়েটা।

______________________________________________
আলো বেগমকে বের হতে দেখে ফুয়াদ বলে,তুমি এই সময় কেন যাচ্ছ? কাল সাকালে দেয়া যাবে না ব্যাগটা!
– দেখো তোমাকে বললে তুমি বুঝবে না তাই তোমাকে বলতেও চাইছি না।
– আমি ছোট বাচ্চা না আম্মু।তুমি বললে অবশ্যই বুঝবো।
– শুধু এতোটুকু শুনে রাখো, যার পকেটে টাকা থাকে সে টাকান প্রয়োজন বুঝবে না।মেয়েটা মাস শেষ হওয়ার আগেই আমার থেকে টাকা চেয়েছে।তারমানে খুবে প্রয়োজন।তোমাকে এসব বলে লাভ নেই তুমি খাচ্ছ খাও। খাওয়া শেষ হলে নূরের খেয়াল রেখো। আর নাহিদের হুশ ফিরলে ওকেও খেতে দিও।

-এই রাতে ওইদিকে তুমি কি ভাবে যাবে?

– আমি যেতে পারবো তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।

– আমি চিন্তা না করলে কে করবে? আমি ছাড়া তোমার কে আছে?

– তুমি যদি আমার কথা এতোই চিন্তা করতে তাহলে আমার একটা ভুলকে ধরে রেখে এভাবে নিজের জীবন নষ্ট করে দিতে না। আমি তো ইচ্ছে করে এমনটা করিনি।

– দেখো আম্মু আমি ভালো আছি তোমারদের নিয়ে নতুন করে কাউকে প্রতারণা করার সুযোগ দিতে চাইনা। আর সেসবের সাথে তোমার যাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। কথা বলতে বলতে কোন মতে খেয়ে হাত ধুয়ে আলো বেগমের হাত থেকে হুরের ব্যাগটা নিয়ে বলে, তুমি আমাকে ঠিকানা বল, আমি পৌঁছে দিচ্ছি।

– না তোমার যেতে হবে না। আমি নিজেই যেতে পারবো।

– ঠিকানা বলবে নাকি বলবে না?

খেলার মাঠের পাশের গলিতে, তিন নাম্বার বাসা। ওই যে উকিলের বাসাটা আছে না। তার নিচ তলায় মনে হয়।

– তুমি বললে মেয়েটা দরিদ্র। তো একজন দরিদ্র মানুষ ওই বাসায় দশ হাজার টাকা ফ্লাট বাসা ভাড়া নিয়ে কি করে থাকে?

– উকিল ওদেরকে এমনি থাকতে দিয়েছে আর বাড়ির দেখাশোনা করার দ্বায়িত্ব দিয়েছে। আর কিছু জানার আছে তোমার?

– আচ্ছা আসি।

ফুয়াদ বের হয়ে যেতেই আলো বেগম বললেন, আল্লাহ আমার ছেলেকে ধৈর্য দাও ও যেনো সেখানো যেয়ে কারো সাথে খারাপ আচরণ না করে। আল্লাহ আমার ছেলেটাকে সুবুদ্ধি দান করুন। বলেই নুরের রুমে আসলো নুর তখন পরছে, শিশুর পণ রুহানি কবি

মিথ্যে কথা বলবো না।
কাউকে গালি দিবো না।
ভাই বোনেদের মারবো না
পিতার আদেশ ছাড়বো না……
(কবিতাটা আরবি ম্যামের থেকে শুনেছিলাম আর মনে নেই তবে সুন্দর ছিলো)

আলো বেগম আসতেই নুর বলল,ভাই বোনতো নেই তাহলে এই লাইনটা না পরলেও তো হয় দাদু মনি।

– পড়া তো পড়তেই হবে। আর ভাইবোন নেই মানে নিরা, জারা,হামিম ওরা তোমার কে?

– ওরা আমার ভাই বোন?

– হুম ওরা তোমার ভাই, বোন।

– না জারা তো বলেছে ওরা আমার আপন বোন না।

– এসব পঁচা কথা। তোমার আরবি ম্যাম না তোমাকে পঁচা কথা বলতে মানা করেছেন।

– ঠিক আছে ঠিক আছে বলবো না।

– এই তো আমার ভালো বাচ্চা। আসো খাবার খাবে। খাবার খেয়ে ঘুম।

ফুয়াদ বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে দেখে নিচ তলার এক ফ্লাটে অনেক মানুষের ভির। আর দরজাও খোলা সেই ফ্লাটের।একটু সামনে যেতেই মানুষের কানাঘুষা শুনতে পেলো। কি সুন্দর মেয়েটাকে বুড়ো লোকের কাছে বিয়ে দিচ্ছে। আরেকজন বলছে সব হলো টাকার খেলা। টাকা থাকলে কেউ আর বুড়ো জুয়ান দেখে না। ভির ঠেলে সামনে যেতেই ফুয়াদের চোখ পরলো মাহতাব সাহেবের দিকে। তখন হুজুর মাত্র বিয়ে পরানো শুরু করেছে। ফুয়াদের মাথা মূহুর্তেই গরম হয়ে গেলো। নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে সোজা মাহতাব সাহেবের কলার ধরে…..

#চলবে

ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমি আগেই বলেছি গল্পে ইসলামিক কথা থাকবে। যাদের ভালো না লাগবে ইগনোর করুন। আর ভালো লাগলে সাথেই থাকুন।
হ্যাপি রিডিং।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here