আপন যে জন পর্ব -০১

#আপন_যে_জন

১.

ঘরে ঢুকেই হৃদয় হৃদির গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়। আচমকা চড়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে হৃদি চেয়ারটা ধরবার চেষ্টা করে। কিন্তু হৃদয় তাকে জোরে ধাক্কা দেয়। চেয়ার সহ মেঝেতে পড়ে যায় সে। ঠোঁটের পাশে কেটে দরদর করে রক্ত পড়তে থাকে। হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে উঠে বসে সে। কান্নার বদলে রাগে কাঁপতে থাকে হৃদি।
-কেন মারছো বলবে কি? এমন কি করলাম আমি ?
-কি করেছিস জানিস না? কেন তুই অয়নকে বিরক্ত করিস? জানিস না ও বিবাহিত। তার পরেও দিনের পর দিন ফোন করিস। এসএমএস পাঠাস। তোর কারণে ওর বউ ওকে সন্দেহ করে। বিয়ে প্রায় ভেঙ্গে যাচ্ছে। এতদিন তো ও কিছু বলেনি। এখন না পেরে আমাকে ডেকে সব বলল। তোর টেক্সটগুলো দেখালো। তুই কি মানুষ? লজ্জায় তো আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।
-ভালবাসা কি অপরাধ ভাইয়া? আর আমি তো তাকে তার বিয়ের আগে থেকে ভালবাসি। তাতে কি আজ সে বিবাহিত। তাই বলে আমার ভালবাসা তো তার প্রতি এক বিন্দু কমে যায়নি।
হৃদির গলা চেপে ধরে হৃদয়।
-আর একবার যদি অয়ন কিছু বলে আমায়, আমি তোকে খুন করবো। এই কথাটা মাথায় রাখিস।

হৃদয় ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

বাথরুমের আয়নার সামনে দাড়িয়ে হৃদি নিজেকে দেখে। মুখে পানির ঝাপ্টা দেয়। বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। অয়নকে কি করে ভুলবে সে? কোনো ভাবেই তা সম্ভব না। তার থেকে মরে যাওয়া সহজ।

নাস্তার টেবিলে এসে বসতেই হৃদির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে হৃদির বাবা মা।
-কি হয়েছে তোর?
হৃদি কিছু না বলে তার ভাইয়ের দিকে তাকায়।
-হৃদয় তুই মেরেছিস? কি এমন করেছে ও? মারার আগে তো আমাদের বলতে পারতিস?
জামাল সাহেব রেগে ওঠেন।
-কি করেছে তা বলা যায় না বাবা। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। তোমরা ওর বিয়ের ব্যাবস্থা কর।
-হঠাৎ বিয়ে কেন? পড়ালেখা তো শেষ করতে হবে।
-পড়ার দরকার হলে বিয়ের পরে পড়বে। তোমরা বললে আমি ছেলে দেখার ব্যবস্থা করি?
-কি হয়েছে বলবি তো হৃদয়?
হৃদির মা হৃদির পাশে গিয়ে দাঁড়ান।
-কি রে বলবো কি করেছিস তুই?
হৃদি নিজের ঘরে চলে আসে। যদি পারতো তবে কান বন্ধ করে ফেলতো।

কিছুক্ষন পর হৃদির মা ঘরে আসেন।

-তুই সত্যি এমন করেছিস। তোর বিবেক একটুও বাঁধা দিল না। একটা সংসার ভেঁঙ্গে যাচ্ছে তোর জন্য? কেন এমন করলি?
-আমি সত্যি অয়ন ভাইয়াকে খুব ভালবাসি মা। কি করবো বলো?
-এই বিষয়ে একটা কথাও না। ভেবেছিলাম হৃদয়ের বিয়ে দিয়ে তারপর তোর বিয়ে দেব। কিন্তু এখন দেখি তোকেই আগে বিদায় করতে হবে।

২.

আজ হৃদির গায়ে হলুদ। হৃদি তার বিয়ে নিয়ে কোনো রকম আগ্রহ দেখায়নি এমনকি বাঁধা দেবার চেষ্টাও করেনি। বিয়ে অবশ্য হৃদয়ের স্কুলের বন্ধু পিয়ালের সাথে হচ্ছে। পিয়াল আগে থেকেই হৃদিকে পছন্দ করতো। তাই যখন হৃদির বিয়ের জন্য ছেলে খোঁজার কথা বন্ধুদের জানিয়েছিল, তার কদিন পরেই পিয়াল পারিবারিক ভাবে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। পিয়াল খুব ভাল ছেলে তাই আর বাসা থেকে কেউ আপত্তি করেনি। মাস খানেকের মধ্যেই সব আয়োজন করে ফেলেছে তারা। আপাতত ঘরোয়া ভাবেই বিয়ে হবে। হৃদির পড়া শেষ হলেই অনুষ্ঠান। তবুও আত্মীয় স্বজন, হৃদি আর হৃদয়ের কিছু বন্ধু বান্ধব কে বলা হয়েছে। অয়নকেও বলেছে হৃদয়। বউ সহ যেন আসে তাও বলে দিয়েছে। তাহলে যদি ওর বউয়ের সন্দেহ কিছুটা দূর হয়।

দূর থেকে হৃদিকে লক্ষ্য করে হৃদয়। বেশ হাসিখুশি ভাবেই সব করছে হৃদি। তবে তার কেন জানি খটকা লাগছে। সে ভেবেছিল হৃদি এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক হইচই করবে। কোনো অঘটন ঘটাবে না তো এই মেয়ে? বুকের মধ্যে কেমন একটা ভয় খিঁচ ধরে আছে।

হৃদয় তার চাচাতো বোন ফাবিহাকে ডেকে নেয়।
-শোন ফাবিহা, সব সময় তোর হৃদি বুবুর সাথে থাকবি? একটুর জন্যও চোখের আড়াল করবি না ঠিক আছে।
-কেন ভাইয়া?
-যা বলছি তাই কর। যা বুবুর সাথে পার্লারে যা।

হৃদয় অন্য দিকে চলে যায়। বাসার ছাদে গায়ে হলুদের স্টেজ করা হয়েছে। হৃদির পছন্দ মত কাঁচা হলুদ রঙ্গে সব সাজানো হয়েছে। বাবা আর চাচা সব তদারকি করছেন দেখে সে নিজের ঘরে আসে। তাদের বাড়ি বেশ বড় হলেও সবার জায়গা হবে না দেখে হৃদয় তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের থাকার ব্যাবস্থা সরকারী বাংলোতে করেছে। নিচের তলাটা ভাড়া দেয়া। তা না হলে বাসায় থাকার ব্যাবস্থা করা যেত।

হলুদের অনুষ্ঠানে যখন অয়ন তার বউকে নিয়ে এসে দাঁড়ালো হৃদি তখন ফুলের সাজে ঝলমল করছে। ঠিক যেন শিশির মাখা হলুদ গোলাপ। সবার হইচই, নাচগান মিলিয়ে বাড়িটা কিছুক্ষনের জন্য মুখর হয়ে রইলো।

অয়ন তো হৃদির আচরণে পুরাই অবাক। কে বলবে এই মেয়ে কদিন আগেও তাকে ছুঁয়ে দেখতে চাইতো। তার হাত ধরে বসে থাকতে চাইতো। মেয়েদের বোঝা আসলেই অনেক কঠিন।
-কি প্রেমিকার বিয়েতে এসে দেখি পাথর হয়ে গেলে?
প্রমার কথায় অয়ন ঘুরে তাকায়।
-আফসোস হচ্ছে নাকি? এত সুন্দর প্রেমিকা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলে?
– কি বলছো তুমি? চুপ কর দয়া করে। কেউ শুনলে কি ভাববে?
– কে কি ভাবলো এটা ভাবতে আমার বয়েই গেছে। কি করে সহ্য করবে গো?
ঠোঁট দিয়ে চুক চুক শব্দ করে প্রমা। অয়ন প্রমার কাছ থেকে উঠে এসে ছাদের এক কোনায় দাঁড়ায়। দিনাজপুর বলেই হৃদয়দের বাড়িটা বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে। বাড়ির পেছন দিকটায় ফলের গাছ। আর একটু জঙ্গলা মত। নীল মরিচ বাতির আলোয় কেমন রহস্যময় লাগে। নিচের শিউলি গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। অন্য ভুবনের সুবাস আসে। সিগারেট ধরিয়ে সে অজানা ভুবনকে দূরে সরায়। একমনে টানতে থাকে।

-কি রে ? এখানে কেন? চল হৃদিকে হলুদ দিবি। প্রমা আমাকে পাঠালো।
-তুই যা। আমি সিগারেট শেষ করে আসছি।
-তাড়াতাড়ি আয়। সব বন্ধুরা মিলে এক সাথে ছবি তুলবো।

হৃদয় চলে যায়। অয়ন ভাবে সময় কত তাড়াতাড়ি চলে যায়। যখন সে এবাড়িতে বেড়াতে এসেছিল তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। গরমের ছুটিতে হৃদয়ের সাথে সাত দিনের জন্য এসেছিল। হৃদি তখন কলেজে পড়ে। পুঁচকি মেয়ে সারাদিন তাদের আশেপাশে ঘুরতো।
হৃদয়ের সাথে তার বিশ্ববিদ্যালয়েই পরিচয়। আর কিছুদিনের মধ্যেই এক আত্মা হয়ে গেল দুজনের। প্রমাও ছিল একই ক্লাসে। প্রমার সাথে সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েছিল খুব তাড়াতাড়ি। আর এরই মাঝে পাঁচটা বছর চলে গেল।

-কার ধ্যান করছো শুনি। সবাই ডাকছে কখন থেকে।
প্রমার কথায় হাতের সিগারেট ফেলে দেয় সে। প্রমার হাত ধরে বলে,
-চলো।

অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকায় হৃদি। কি সুন্দর বউয়ের হাত ধরে হেটে আসছে। কেন যে ভাইয়া অয়নকে বললো।
মাথা নিচু করে বসে থাকে সে। আঙুলের ডগায় একটু হলুদ নিয়ে অয়ন হৃদির কপালে ছোঁয়ায়। হৃদি হালকা কেঁপে ওঠে। এই সেই কাঙ্খিত স্পর্শ যা নিয়ে কাটিয়ে দিতে পারে সে তার সারটি জীবন। সে মাথা নিচু করে ফেলে।

কেউ লক্ষ না করলেও প্রমা ঠিক লক্ষ করে হৃদির চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।

-কি আপু ঘুমাবে না? কি লিখছো?

-কিছু না। জানিস তো আমার ডায়েরী লিখার অভ্যাস।
-এইসব হাবিজাবি না লিখে পিয়াল ভাইয়ার সাথে কথা বল। বেচারার ঘুম হচ্ছে না মনে হয়।
-পাকামি না করে ঘুমা। আমার দেরি হবে। গোসল করবো তারপর চুল শুখাবো।
-আমি তাহলে ঘুমাই। কাল আবার সকালে যেতে হবে পার্লারে।
-হমম। ঘুমিয়ে পড়।

লাল ডায়েরীটা টেবিলের ড্রয়ারে রেখে হৃদি উঠে পড়ে। অনেকক্ষন সময় নিয়ে গোসল করে সে। আয়নার সামনে বসে নিজেকে দেখে। চুলগুলো শুখিয়ে নিয়ে এলো খোঁপা করে। বেলী ফুলের মালা জড়ায়। আলমারী থেকে সাদা শাড়ী লাল পাড়ের কাতানটা বাহির করে পরে। রাতে তিনটার দিকে ঘর থেকে বাহির হয়। বাড়ী পুরা নিশ্চুপ। পা টিপে টিপে ছাদে আসে। বিয়ের অনুষ্ঠান কমিউনিটি হলে বলে বাড়িতে কোন কাজ নেই। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
অয়ন যেখানে দাড়িয়েছিল সেখানে এসে দাঁড়ায় সে। প্রাণ ভরে শিউলীর গন্ধ নেয়। আর কি কখনো পাবে এই সুবাস। একটা চেয়ার টেনে ছাদের রেলিং টপকায় সে। কার্নিশে দাঁড়ায়। বুক ভরে শ্বাস নেয়….

বিড়বিড় করে বলে,
-কেন এলে তুমি?

খুব ভোরে হৃদয় এসে হৃদির ঘরের দরজায় টোকা দেয়। দেখে দরজা খোলা। ফাবিহা একাই কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বাথরুমও খালি। হৃদয় দৌড়ে ছাদে আসে। ছাদের কোনায় চেয়ারটা চোখে পড়ে। নীচে তাকাতেই মাথা ঘুরে ওঠে।

বাড়ির সবাই চুপ। শুধু হৃদির মা মাঝে মাঝে চিৎকার করে হৃদিকে ডাকছে।

হৃদয় বসে আছে তার বোনের পাশে। টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে শিউলী ফুল। হৃদিও যেন ঝরে পড়া শিউলী।

পুলিশ এখনো এসে পৌঁছায় নি। ডাক্তার এসে দেখে গেছে। মাথায় আঘাত লাগার কারনেই মৃত্যু।

অয়ন এসে শিউলী গাছের গোড়ায় বসে পড়ে। “ কেন এমন করলি বোকা মেয়ে?”
পিয়াল দূরে দাড়িয়ে আছে পাথরের মত। “ কিসের এত কষ্ট ছিল তোমার হৃদি? একবার তো বলতে পারতে।”

আগামী পর্বে সমাপ্ত…

এমি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here