আফিম বড্ড নেশালো ০২-পর্ব ১৮+১৯

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১৮

দু’হাতে নাফিয়ার গাল আলতো করে আঁকড়ে ধরে আফিম।চোখবুঁজে কপালে কপাল ঠেকায়।হৃৎপিণ্ডে কেমন এক মিশ্র অনুভূতি অনুভব করছে সে।ক্রোধ ও পীড়ার এ এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি।
আচ্ছা,তার মায়াবীনি কি জানে যে তার কষ্টে আফিম ও সম পরিমাণ কষ্ট অনুভব করে?সে কি অনুভব করে,তার অতীতের ক্ষতগুলো আফিমকে কতোটা ক্ষত-বিক্ষত করে?সে কি বোঝে তার অতীত আফিমকে কতোটা অসহায় বা অপারগ অনুভব করায়?
ছেলেটা ভেতরে ভেতরেই নিজের অপারগতার দহনে জ্বলছে।অপারগতা এটিই যে সে কেনো তার মায়াবীনির জীবনে আরো আগে এলো না,কেনো সে তার মায়াবীনিকে এসব কষ্টের স্পর্শ থেকে বাঁচিয়ে যত্নে আগলে রাখতে পারলো না!সে জানে এসবে তার জোর ছিলো না,পুরোটাই ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল ছিলো।কিন্তু তাও মন তার প্রেয়সীর কষ্টগুলো মানতে নারাজ আর নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করার প্রয়াসে মত্ত।

আফিমের মিশ্রানুভূতিতে পূর্ণ হৃদয়ে এক অবাস্তব ইচ্ছের উঁকিঝুঁকি দেখা দিচ্ছে।তার ইচ্ছে জাগছে, মেয়েটিকে নিজের বক্ষ পিঞ্জরে আবদ্ধ করে নিতে।খুব যত্নে সেথায় আগলে রাখবে সে এই কিশোরীকে।বাহ্যিক যেকোনো আঘাত,শোক,কষ্টকে তার মায়াবীনির ধারেকাছেও আসতে দিবে না সে।পুরো দুনিয়া হতে লুকিয়ে রাখবে সে তার মায়াকে।এমন চিন্তে মনে জায়গা করে নিতেই এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে আফিম।এই ইচ্ছেকে বাস্তব রূপ দেওয়া সম্ভব নয় কারণ নাফিয়াকে লড়তে শিখাবে সে,লুকিয়ে থাকতে নয়।শেষ কথাখানা ভেবে চোখ মেলে তাকায় আফিম।
নাফিয়া চোখ বুজে আফিমের কোমরের কাছের দিকের শার্টের খানিকটা অংশ আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটার চোখের কোণে এক বিন্দু পানি জ্বলজ্বল করছে।আফিম অনতিবিলম্বে তার বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা সে জল মুছে দেয়।দু’হাতে মেয়েটার গাল আঁকড়ে ধরে টেনে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসে।আফিমের স্পর্শে চোখ মেলে তাকায় নাফিয়া।এবার দু’জনার দৃষ্টি একে-অপরের চোখে আবদ্ধ।আফিম মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-সমাজে অহরহ বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষের বসবাস আছে,মিস.শেখ।এরা মানসিক ভাবে এতোটাই অসুস্থ যে একটা ৬ মাসের শিশুতেও যৌনতা খুঁজে পায়।শুধু নারী নয় এখন তো এমন যুগ চলছে যেখানে পশুরও ধর্ষন হয়।আর যারা এসব করে তারা কি করে স্বাভাবিক মস্তিষ্কের হতে পারে?
প্রশ্নটি করে থামে আফিম।নাফিয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে আফিমের চোখ পানে।উত্তরের অপেক্ষা না করে আফিম আবারও বলে ওঠে,
-যেসব পুরুষ নিজের স্ত্রী ব্যাতীত অন্য যেকোনো নারীর দিকে কামুকী দৃষ্টি তাকায় তারা আসলে মানুষের কাতারেই পড়ে না।কারণ মনুষ্যত্ব তাদের নেই।আর যারা ছোট শিশু বা কিশোরীর দিকে বাজে দৃষ্টিতে তাকায় তারা তো এক কথায় বিকৃত মস্তিষ্কের পশু।এখন নিজে ভাবো একটা পশু তো যেকোনো কিছুই করতে পারে।তাদের তো আল্লাহ বিবেকবুদ্ধি দেয়নি।সহজভাবে ভাবো একটা হিংস্র পশুর সামনে যদি তুমি যাও তাহলে তারা তো তোমার উপর আক্রমণ করবেই।এখন আক্রমণে তাদের নখের ক’টা দাগ তোমার শরীরে লাগার অর্থ কি এই যে তুমি অপবিত্র?
এ প্রশ্নে থামে আফিম।নাফিয়া এবারও চুপ।মেয়েটা যেনো আফিমের কথায় গভীর মনোযোগী।সে চাইছে না আফিমের কথার মাঝে কথা বলে ছেলেটার কথায় ব্যাঘাত ঘটাতে।তাই সে নিরব মনোযোগী শ্রোতা।আফিম আবারও বলতে আরম্ভ করে,
-উত্তর হচ্ছে, ‘না’।কারণ পশুর আক্রমণে আমরা ব্যথা পাবো, শরীরের খানিকটা অংশে ক্ষত সৃষ্টি হবে, অপরিষ্কার হবে।তাই হয় অ্যান্টিসেপ্টিক দিয়ে জায়গা পরিষ্কার করে নিতে হবে নাহয় ডাক্তার কাছে ক্ষত সারবার ওষুধের জন্য যেতে হবে।এখানে কোথাও ‘পবিত্র’ বা ‘অপবিত্র’ হওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে?
আসেনি।কারণ ‘পবিত্রতা’ আর ‘অপবিত্রতা’ থাকে মানুষের মনে,নিয়তে।একটা পশুর আক্রমণে তুমি ‘অপবিত্র’ হবে না মিস.শেখ।কিন্তু যে পশু টা তোমার দিকে বাজে নিয়তে তাকিয়েছে সেই পশুটাই অপবিত্র।তুমি অপবিত্র নও,কোনোভাবেই নও।
কথাগুলো বলে থামে আফিম।নাফিয়া নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে আফিমের চোখ পানে।যে চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে আছে।যে চোখে নাফিয়া স্পষ্ট রাগ আর কষ্টের উপস্থিতি দেখতে পারছে।এ রাগ টা কিসের জন্য বা কার উপর তা বুঝতে কষ্ট হয়নি নাফিয়ার।সে জানে এই রাগ আফিমের নিজের উপর হচ্ছে।কারণ সে পারেনি ঐ নরপশুর বাজে দৃষ্টির হাত থেকে নাফিয়াকে বাঁচাতে।আর কষ্ট টা অনুভব করছে তার মায়াবীনির কষ্ট দেখে।
আবেগ বেসামাল হওয়ায় নিরবে ক’ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পরে নাফিয়ার।অনতিবিলম্বে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে আফিমকে।কানে বাজতে থাকে আফিমের জোর গলায় বলা শেষ বাক্যটি, “তুমি অপবিত্র নও,কোনোভাবেই নও”।
ছেলেটার বুকে মাথা রেখে তৃপ্তির হাসি ঠোঁটে টেনে নেয় সে।এই মানুষটার মতো করে পৃথিবীতে আর কেউ হয়তো কোনোদিনও তাকে এভাবে ভালোবাসতে পারতো না।
নাফিয়া আফিমকে জড়িয়ে ধরতেই দ্বিগুণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে আফিম।চুলে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে ওঠে,
-তোমাকে অনেক স্ট্রোং হতে হবে মিস.শেখ।অনেক বেশি।এই সমাজে নরপিশাচদের অভাব নেই।তারা নারীদেহ পেলেই সুযোগ খোঁজে হামলে পড়ার।এসব হায়নাদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে তোমাকে নিজেরই প্রতিবাদী হতে হবে।মনে রাখবে এই পৃথিবী,’শক্তের ভক্ত,নরমের যম’।যেটা সব থেকে বেশি প্রয়োজন তা হলো মনোবল,সাহস।আর বাকিটা প্রয়োজন নিজের আত্মরক্ষার কিছু ট্রিকস জেনে রাখা।এসব ট্রিকস আমি নিজ দায়িত্বে শিখিয়ে দিবো তোমায়।কারণ আমি চাই তুমি আত্মনির্ভরশীল হও।আর তা তুমি হবেই।নিজের লড়াই নিজে লড়বে।এই পৃথিবীতে ভালোভাবে টিকে থাকতে হলে নিজেকে শক্তভাবে গড়তে হবে।মনে থাকবে?
আফিমের বুকে মাথা রেখেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় নাফিয়া।চোখের পানি মুছে নেয় সে।অবলা, অসহায় মেয়েদের মতো নিজের এই অতীত মনে করে আর কখনো কাঁদবে না সে।চেষ্টা করবে নিজেকে ভেতর থেকে শক্ত করে গড়ে তোলার।নিজের জন্য নাহলেও নিজের ভালোবাসার মানুষটার কথা রাখার জন্য।আর কেনোই বা ঐ অতীত নিয়ে এতোটা ভাববে সে।একটা হিংস্র পশু আক্রমণ করতেই পারে। তা নিয়ে এতো ভাব্বার কিছু নেই, আসলেই নেই।কথা খানা ভেবে ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে নেয় নাফিয়া।অনেক বছর ধরে বয়ে বেড়ানো বোঝা হতে আজ মুক্ত হলো সে।মনে অনুভব করছে এক প্রশান্তির ছোঁয়া।
নিজের মনের বোঝা কমলেও হটাৎ তার মনে একটি প্রশ্নের উৎপত্তি ঘটে।
“একটা নরপশু কি কখনো ভাবে যে তার বিকৃত মস্তিষ্কে উৎপন্ন হওয়া নিকৃষ্ট লোভ একটা শিশু বা কিশোরী বা নারীর মনে কতোটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে?তারা কি কোনোদিন অনুভব করতে পারবে যে তাদের জঘন্য স্পর্শ একটা মেয়ের মনে কতোটা ঘৃণা সৃষ্টি করে?একটা বাজে স্পর্শে একটা মেয়ে নিজের শরীরটাকেই অপবিত্র বলে মনে করতে আরম্ভ করে।এই এক-দুটো বাজে স্পর্শের বিষাক্ত স্মৃতি একটা মেয়ে তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বয়ে বেড়ায়।এই নরপিশাচ গুলো কখনো বুঝবে না তারা কয়েক সেকেন্ডের সুখের লোভে একটা মেয়ের কতশত চোখের পানির কারণ হয়,কত অভিশাপ-বদদোয়ার অধিকারী হয়।”
নাফিয়ার মাথায় হাত রেখে আফিম বলে ওঠে,
-চলো এবার বাসায় যাওয়া যাক।
আফিমের বুক হতে মাথা তুলে ছেলেটার চোখে চোখ রেখে নাফিয়া বলে ওঠে,
-উহু। বৃষ্টি বিলাস করবো তারপর।
-নো বৃষ্টি বিলাস।এতো রাতে বৃষ্টিতে ভিজা যাবে না।
আফিমের নিষেধাজ্ঞা গায় মাখলো না নাফিয়া।সে আফিমের থেকে সরে এসে ব্রীজের কিনারায় দাঁড়িয়ে আকাশ পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।ঠান্ডা বাতাসেরা ছুঁয়ে দিচ্ছে তাকে।ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি টেনে নাফিয়া বলে ওঠে,
-জানেন ঐ ঘটনার দিনেও বৃষ্টি হয়েছিলো।আবার আমার জীবনে যেদিন আপনি এলেন সেদিনও বৃষ্টি ছিলো।কেনোই যেনো আমার জীবনে ঘটা সব বড় বড় ঘটনার দিন বৃষ্টি হয়।
নাফিয়ার কথায় মৃদু হাসি ফুটে ওঠে আফিমের ঠোঁটে।মনে মনে বলে ওঠে, “তোমার বিয়ের দিনেও বৃষ্টি হয়েছিলো যা এখনো তোমার অজানা”।কথা খানা মনে মনে আওড়িয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে সে বলে ওঠে,
-তোমার জীবনে আমার আগমন বড় ঘটনা?
ঠোঁটের হাসিটা বজায়ে রাখে নাফিয়া।নিম্ন স্বরে বলে ওঠে,
-বড় এবং বিশেষ ঘটনা।
কথাটি ধীর কন্ঠে বললেও তা ঠিকই আফিমের কর্ণকুহোর অব্দি এসে পৌঁছায়।এক চিলতে ফুটে ওঠে ছেলেটার ঠোঁটে।কিন্তু তা লুকিয়ে কন্ঠে কঠোরতা ফুটিয়ে তুলে সে বলে ওঠে,
-এখনি বাড়ি ফিরবো।গাড়িতে ওঠো।
আফিমের কথাখানা বলতে দেরি হলেও মেঘ গর্জে উঠতে দেরি হলো না।ঠান্ডা বাতাস তো বইছিলোই এখন শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টির বর্ষণ।মুহূর্তেই এ বর্ষন ভিজিয়ে দিতে আরম্ভ করলো দু’জনকে।সবকিছু এতো দ্রুত হলো যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময়ই পেলো না আফিম।ভ্যাবলার ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে সে।আফিমের এমন ভ্যাবলা মার্কা অবস্থা দেখে শব্দ করে হেসে ওঠে নাফিয়া।হাসতে হাসতেই বলে ওঠে,
-দেখেছেন আমি সত্যিই মেঘকন্যা।খুব হুকুম দিচ্ছিলেন না আমাকে?কিন্তু দেখেন মেঘ বিকট শব্দে বকে দিয়েছে আপনাকে।
নাফিয়ার কথায় চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকায় আফিম।বলে ওঠে,
-তাই না?
প্রশ্নটি করে আর দেরি করে না সে।তেড়ে অগ্রসর হয় নাফিয়ার দিকে। আফিমের মতিগতি ভালো ঠেকলো না নাফিয়ার।তাই সেও দৌড়ে সরে যেতে অগ্রসর হলো।মধ্য রাতের এক বর্ষনে বাচ্চাদের মতো দৌড়প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করেছে দু’জন মানব-মানবী।
#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১৯

এক কাপ আদা চা ও এক কাপ ব্লাক কফি হাতে নিয়ে আফিমের কক্ষের দিকে এগিয়ে চলছে নাফিয়া।অনেকটা সময় বৃষ্টিতে বাচ্চাদের মতো দুষ্টুমি করে মন ভরতেই কিছুক্ষণ আগে বাড়ি ফিরেছে তারা।বাড়ি ফিরেই দু’জন দু’জনার কক্ষে গিয়ে গোসল সেরে নিয়েছে।নাফিয়ার গোসল শেষ হতেই সে চলে যায় রান্না ঘরে।নিজের জন্য আদা চা এবং আফিমের জন্য আফিমের পছন্দের ব্লাক কফি বানিয়ে এখন সে অগ্রসর হয়েছে ছেলেটার কক্ষের দিকে।
কক্ষে প্রবেশ করতেই নাফিয়া দেখতে পায় ভিজে চুলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টিশার্ট পরিধানে ব্যস্ত আফিম।চুল ভালোভাবে মোছেও নাই ছেলেটা।তার মাথা ভর্তি মসৃণ,সোজা ছোট চুলগুলো হতে টুপ টুপ করে পানি বেয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার ঘাড়,গলা।হাতে থাকা কাপ দু’টো আফিমের বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলটার উপর রেখে বিছনায় পড়ে থাকা আফিমের টাওয়াল টা হাতে তুলে নেয় নাফিয়া।আফিম তখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শরীরে পারফিউম লাগাতে ব্যস্ত।আফিমের এমন কান্ড দেখে ব্রু দ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ ফেলে নাফিয়া।মনে মনেই প্রশ্ন করে ওঠে,
“রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পারফিউম আবার কে লাগায়?”
মনের প্রশ্ন মনেই রাখে সে।নিজে নিজে উত্তর বানিয়ে নেয়,
“পাগলে কিনা বলে,ছাগলে কিনা খায়”
আফিমের কাছে গিয়ে তার হাত আঁকড়ে ধরে নাফিয়া।হটাৎ মেয়েটার এমন স্পর্শে থেমে যায় আফিম।হাতের পারফিউম টা টেবিলের উপর রেখে নাফিয়ার দিকে ফিরে দাঁড়ায় সে।আফিম তার দিকে ফিরে দাঁড়াতেই নাফিয়া বলে ওঠে,
-এদিকে আসুন।
নাফিয়াকে অনুসরণ করে আফিম নিজের বিছানা অব্দি এসে থামে।নাফিয়া ইশারায় তাকে বসতে বলতেই সে ভদ্র ছেলের মতো নিজের বিছানায় বসে পড়ে।কিন্তু চোখে স্পষ্ট প্রশ্ন ফুটে আছে তার।নাফিয়া কি করতে চাইছে তা-ই নিরবে বুঝার চেষ্টা করছে আফিম।
আফিম বিছানায় বসতেই নাফিয়া ব্লাক কফির মগটা হাতে ধরিয়ে দেয় তার।তারপর যত্নের সহিত তার মাথা মুছে দিতে আরম্ভ করে।অবাক হয় আফিম।মুহূর্তেই মুগ্ধতায় ভরে ওঠে তার মন।এতোটা তো নাফিয়ার থেকে আশা করেছিলো না সে।বরং ভেবেছিলো বাচ্চা একটা মেয়ের দায়িত্ব নিচ্ছে সে।এই বাচ্চাটাকে দেখে রাখা,হেফাজতে রাখা আর একজন সফল মানুষ হিসেবে গড়তে সাহায্য করা তার দায়িত্ব।তাই মেয়েটার খেয়াল রাখাও তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।কিন্তু যেখানে তার দায়িত্ব মেয়েটার খেয়াল রাখার সেখানে মেয়েটাই তার খেয়াল রাখছে।আসলে লোকমুখে প্রচলিত কথাটা যথার্থ যে,
“দায়িত্ববোধটা বয়সের সাথে আসে না বরং পরিস্থিতি,বাস্তবতা ও অভিভাবকের দেওয়া উত্তম শিক্ষাই মানুষকে দায়িত্ববান বানিয়ে দেয়”

আফিমের মাথা মুছতে মুছতেই বিরক্ত কন্ঠে নাফিয়া বলে ওঠে,
-বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন অথচ নিজের খেয়াল রাখা শিখলেন না।একে তো এতো রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছেন তারপর ভিজা কাপর গায়ে জড়ানো ছিলো পুরোটা রাস্তা।তার উপর গোসল সেরে এসে মাথাটাও মুছেন নাই ঠিক মতো।ঠান্ডা লেগে যাবে না?
নাফিয়ার কথা শেষ হতেই তাকে এক হেঁচকা টানে নিজের কোলে বসিয়ে নেয় আফিম।দু’হাতে আঁকড়ে ধরে নাফিয়ার কোমর।মেয়েটাকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে আফিম বলে ওঠে,
-বুড়ো হচ্ছি মানে?আমাকে কোন দিক থেকে বুড়ো মনে হয় তোমার?
আফিমের কাজে চমকে গেলেও তার করা প্রশ্ন কানে আসতেই ঠোঁট চেপে হাসে নাফিয়া।আফিমের গলা জড়িয়ে ধরে দুষ্টু কন্ঠে বলে ওঠে,
-পা হতে মাথা অব্দি সব দিক থেকেই তো বুড়ো হচ্ছেন।
নাফিয়া দুষ্টুমি করছে তা ঠিকই বোধগম্য হলো আফিমের।কিন্তু তাও মিথ্যে রাগ দেখিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে ওঠে,
-২৮ বছর বয়সের এক তাগড়া যুবককে তুমি বুড়ো বলছো কোন সাহসে?
আফিমের প্রশ্নে হাসি বৃদ্ধি পায় নাফিয়ার।ভেংচি কেটে বলে ওঠে,
-এহ আসছে ‘তাগড়া যুবক’!!
চোখ পূর্বের ন্যায় ছোট ছোট করে আফিম।বিনাবাক্য ব্যয়ে নাফিয়াকে কোলে নিয়েই উঠে দাঁড়ায় সে।বারান্দার দিকে এগোতে এগোতে বলে ওঠে,
-আজই ভাঙ্গা হাড়-গোড় নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হবা।
আফিমের কথা কানে আসতেই চোখ গুলো রসগোল্লার ন্যায় বড় হয়ে যায় নাফিয়ার।ভয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আফিমের গলা।চোখ-মুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে সে বলে ওঠে,
-না না প্লিজ স্যরি।আপনি তো অনেককক হ্যান্ডসাম, একদম কিউটের ডিব্বা, বাচ্চা একটা ছেলে।একটু আগে তো আমি মজা করেই বুড়ো বলেছি।
নাফিয়ার পল্টি খাওয়া দেখে মৃদু হাসে আফিম।মূহুর্তেই গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে সে বলে ওঠে,
-আচ্ছা তাই!ধন্যবাদ সত্যি টা স্বীকার করার জন্য। কিন্তু তাও আজ তোমার হাড়-গোড় আমি ভেঙেই ছাড়বো।
কথাগুলো বলতে বলতে বারান্দার একদম কিনারায় চলে আসে আফিম।রেলিং এ গা ঠেকেছে তার।আর নাফিয়া শূন্যে ভাসছে।আফিম ছেড়ে দিলেই ২ তলা থেকে সোজা মাটিতে গিয়ে পড়বে সে।আর যদি ভুলে কোনো ইট,পাথরে মাথা বারি খায় তাহলে সোজা আসমানে পৌঁছে যাবে।এসব ভাবতেই গলা শুকিয়ে যায় নাফিয়ার। আফিমের গলা আরো শক্তপোক্তভাবে জড়িয়ে ধরে চোখ-মুখ কুঁচকে সে বলে ওঠে,
-প্লিজ আফিম স্যরি তো।আর বলবো না কখনো।
নাফিয়ার ভয় পাওয়া দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে আফিমের।বহু কষ্টে নিজের হাসি লুকিয়ে সে গম্ভীর কণ্ঠেই বলে ওঠে,
-তোমার কথা রেখে আমার লাভ কি?
-যা যা বলবেন সব করবো।
-যেকোনো কিছু করতে রাজি?
-রাজি।
-Are you ready to kiss me?
-Yes
ভয়ে কিছু না ভেবেই উত্তরখানা দেয় নাফিয়া।নাফিয়ার উত্তরে ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে নেয় আফিম।ধীরে তাকে কোল থেকে নামাতেই যেনো প্রাণ ফিরে পায় মেয়েটা।জোরে জোরে ২-৩ টে শ্বাস নিয়ে আফিমের দিকে তাকায় সে।আফিম বুকে দু’হাত গুঁজে বারান্দার দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে চেয়ে আছে।
নাফিয়ার চোখে চোখ পড়তেই আফিম বলে ওঠে,
-Now do your work fast Miss. Sheikh. [এখন দ্রুত নিজের কাজ করো মিস.শেখ]
আফিমের কথা কানে আসতেই নাফিয়ার মনে পড়ে তার এখন আফিমকে চুমু দিতে হবে।মুহুর্তেই চোখমুখে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে তার।মনের গহীনে লজ্জাদের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছে।কোনোভাবে এই কাজ থেকে বাঁচা যায় কিনা ভেবে কিছু একটা মাথায় আসতেই নাফিয়া বলে ওঠে,
-এমন সন্ত্রাসী মার্কা কাজ করে একটা মেয়ের কাছ থেকে চুমু নিবেন আফিম?আপনার মতো এমন উত্তম পুরুষকে কি এ কাজে মানায়?
নাফিয়ার চালাকি বুঝতে কষ্ট হয় না আফিমের।সে বেপরোয়া কন্ঠেই বলে ওঠে,
-সোজা আঙুলে কি ঘি উঠবে নাকি হাড়গোড় ভাঙতেই হবে?
আফিমের উক্ত প্রশ্নে যা বোঝার বুঝে নেয় নাফিয়া।তার চালাকি যে এই ছেলের উপর প্রভাব ফেলবে না তা বুঝে নিয়ে ধীর কদমে আফিমের দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে সে।এ পরিস্থিতিতে সোজা আঙুলে ঘি উঠাই শ্রেয়।
সে এগোতে এগোতে আফিমের একদম কাছে চলে যায়।হৃৎস্পন্দনের গতি ক্রমশ বাড়ছে তার।মনে লজ্জাদের উঁকিঝুঁকি।দু’হাতে আঁকড়ে ধরে সে আফিমের কাঁধ।ধীর গতিতে ছেলেটার মুখের কাছে এগিয়ে যাচ্ছে তার ওষ্ঠদ্বয়।লজ্জার ছাপ চেহারাতেও ফুটে উঠেছে তার।আর এই লালাভ মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিবদ্ধ আফিমের।
কক্ষের কিছু আলো এসে অন্ধকার বারান্দাটাকে কিছুটা আলোকিত করে রেখেছে।সেই মৃদু আলোয় নাফিয়ার লালাভ মুখশ্রী দারুণ লাগছে দেখতে।ধীরে ধীরে আফিমেরও হৃৎস্পন্দন বাড়তে আরম্ভ করেছে।তার হৃদয় অপেক্ষার প্রহর গুনে চলছে কখন মেয়েটার ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করবে তাকে!
দু’জনের মাঝের দূরত্ব শূন্যের কোঠায় যাবায় ঠিক আগ মুহুর্তেই,
“হাঁচিইইইইইই”
ঘটে গেলো অঘটন।হুট করে হাঁচি আসায় তা আঁটকে রাখতে অক্ষম হলো নাফিয়া।আফিম চোখ-মুখ কুঁচকে মৃদু উচ্চ স্বরে বলে উঠলো,
“ইয়ুক,মিস.শেখ”
কথাখানা বলে আর দাঁড়ায় না আফিম।এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের দিকে।উদ্দেশ্য নিজের মুখখানা পরিস্কার করে নেওয়া।
এদিকে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হওয়ার উপক্রম নাফিয়ার।কোনোভাবেই হাসি থামাতে পারছে না সে।হাসতে হাসতেই সে বলে ওঠে,
“খুব শখ না চুমু খাওয়ার!খাও খাও”

অতঃপর হাসতে হাসতেই আফিমের কক্ষে প্রবেশ করে তার বিছানার এক কোণে বসে পড়ে নাফিয়া।হাতে নিজের ঠান্ডা হয়ে যাওয়া আদা চা টা নিয়ে তাতে চুমুক বসায়।ঠান্ডা চা খাওয়ার এক বাজে অভ্যেস আছে তার।এ নিয়ে কতো কথাই তো শুনতে হতো তাকে তার মাম্মির কাছ থেকে।প্রচলিত বাক্যটা ছিলো,
“চা না খাইয়া সরবত খাইলেই পারিস।ঠান্ডা দুধে চিনি,চা পাতা মিক্স কইরা খাবি।ঢং করতে গ্যাস নষ্ট করিস কেন?”
নিজের মাম্মিকে ভীষণ মনে করে সে।কিন্তু বাড়ি থেকে পালাবার আগে তো মাম্মি তাকে নিষেধ করেছিলো তার সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করতে।তাই জন্যেই তো কোনো ফোন কল এখনো অব্দি করেনি সে।আচ্ছা তার মাম্মির কি তার জন্য চিন্তা হয় না?তার মাম্মির কি জানতে ইচ্ছে হয় না যে ও কি অবস্থায়,কোথায় আছে?
মনে প্রশ্নগুলো উদয় হতেই খারাপ লাগতে আরম্ভ করে নাফিয়ার।এরই মধ্যে আফিম বেড়িয়ে এসেছে ওয়াশরুম থেকে।মুখ মুছতে মুছতে মেয়েটার দিকে আড়চোখে তাকায় আফিম।বুঝতে পারে মেয়েটার মনে মেঘ জমেছে কোনো কারণে।কিন্তু কি কারণে তা বুঝতে সক্ষম হলো না সে।এগিয়ে গিয়ে নাফিয়ার পাশেই নিজের বিছনায় বসে পরে আফিম।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-কি হয়েছে?
-মনের আকাশে মেঘ জমেছে।
নাফিয়ার এমন কাব্যিক উত্তর আশা করেছিলো না আফিম।মেয়েটার কবিতা টবিতা লেখার শখ আছে কি না কে জানে!নাফিয়ার উত্তর শুনে আফিম আবারও প্রশ্ন করে ওঠে,
-কেনো?
আফিমের প্রশ্নে তার দিকে তাকায় নাফিয়া।ব্রু কুঁচকে উল্টো প্রশ্ন করে ওঠে,
-আগে বলেন,আপনি কেনো জানতে চান নাই যে আমি সেই রাতে ব্রীজে কি করছিলাম বা নিজের বাসা রেখে আপনার কাছে কেনো পরে আছি?

‘প্রশ্ন করা মানে হচ্ছে জানার ইচ্ছা প্রকাশ করা।একটা মানুষ যা নিজে থেকেই জেনে নিয়েছে সে কেনো তা আবার জিজ্ঞেস করে জানতে চাইবে?’ আফিম নিজের যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন খানা নিজের মনেই গোপন রাখে।প্রকাশ্যে বলে ওঠে,
-কারণ চেয়েছিলাম তুমি নিজে থেকে বলো।
আফিমের এ উত্তর খানা তেমন একটা পছন্দ হয়না নাফিয়ার।কি অদ্ভুত পুরুষ! সে যদি না বলে সারাজীবন এভাবেই কাটিয়ে দিতো তাহলেও কি জানতে চাইতো না আফিম?একটা মানুষের মধ্যে অন্তত একটু হলেও কৌতূহল তো কাজ করে!

আফিমের দিকে ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে নাফিয়া জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-তাহলে কি এখনো জানতে চাইবেন না?
নাফিয়ার প্রশ্নে মৃদু হাসে আফিম।বলে ওঠে,
-তুমি বললে শুনবো।

চলবে।

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here