আফিম বড্ড নেশালো ০২-পর্ব ২০

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ২০

অতিতের খণ্ডাংশঃ-

“নুরি, কিছু কথা আছে তোমার সাথে।”
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন নুরানি বেগম।হটাৎ নিজের স্বামীর উচ্চারিত উক্ত বাক্যটি কানে আসতেই থেমে যান তিনি।লোকটার দিকে তাকাতে বা কোনো কথা বলতে রুচিতে বাঁধে নুরানি বেগমের।কেমন ঘেন্না লাগে তার এই লোকটাকে দেখলেই।বিগত দিনে লোকটার কাজ কর্মই এসবের জন্যে দায়ী তাতে দ্বিমত নেই।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও লোকটার দিকে তাকান নুরানি বেগম।লোকটা বলে ওঠে,
-আমার বন্ধু ইরফান নুফির জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।ও এতোকাল বিদেশে ছিলো আর একমাস আগে যে দেশে ফিরেছে তাতো তুমি জানোই।এবার আর বিদেশে যাবে না।বাকি জীবন দেশেই কাটাবে।আর ওর অর্থনৈতিক অবস্থা যে ভালো সে বিষয়েও তুমি জানো।
স্বামীর কথায় ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে নুরানি বেগমের।তিনি উৎসাহী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠেন,
-ইরফান ভাই তার ছেলে ইমরানের জন্য নাফিয়াকে পছন্দ করেছে?এর থেকে সুখবর তো কিছু হতেই পারে না।ইমরান এমনিও ভীষন ভদ্র ছেলে।ওর সাথে বিয়ে হলে নুফি সুখী হবে।
-আরে থামো।কি সব আবোল-তাবোল বকছো?টাকা সব বাপের আর নুফি সুখী থাকবে বেকার ছেলেরে বিয়ে করে?ইমরান এখনো মাস্টার্স কমপ্লিট করে নাই।নাই কোনো আয়-ইনকাম।ওর সাথে বিয়ে হইলে নুফি সুখী হবে?তার চেয়ে ইরফানের সাথে নুফি সুখে থাকবে।টাকা-পয়সার অভাব হবে না।যা চাবে সব পাবে।ইরফান ওরে মাথার মুকুট বানায়ে রাখবে।
স্বামীর কথায় ব্রু দ্বয়ের মাঝে ভাজ পরে নুরানি বেগমের।তিনি আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে বলে ওঠেন,
-কি বলতে চাইছেন আপনি?
-ইরফান নিজের জন্য নুফিকে পছন্দ করেছে।
কথাখানা শুনতেই নুরানি বেগম চোখমুখে ঘেন্নার ছাপ ফেলে বলে ওঠে,
-ছিঃ!নিজের সন্তানের মতো মেয়ের দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাতে বিবেকে বাঁধলো না তার?
নুরানি বেগমের কথায় বিরক্ত হোন হিমেল সাহেব।বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠেন,
-তোমার নীতি বাক্য রাখো তো।নাফিয়ার বিয়ে ইরফানের সাথেই হবে আর আগামীকালই ওদের কাবিন হবে।সব ঠিকঠাক করাই আছে।তোমাকে জানানো দরকার ছিলো তাই জানিয়েছি।ব্যাস,যা হচ্ছে চুপচাপ হতে দেও।
-আমার মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে হিমেল?
রাগী গলায় প্রশ্ন করলেন নুরানি বেগম।হিমেল সাহেবও রেগে গেলেন।দাঁতে দাত চেপে বলে উঠলেন,
-এতো বছর আমার টাকায় খেয়ে-পড়ে আবার জিজ্ঞেস করছো আমি অধিকার কোথায় পেলাম?
এ প্রশ্নে দমে গেলেন নুরানি বেগম।আত্মবিশ্বাসের অভাবে নিজে কখনো টাকা কামানোর চেষ্টা করেননি তিনি।আসলে তিনি নিজেকে ভীতু,অবলা এক গৃহিনী হিসেবেই মেনে নিয়েছেন।তাই তো সাহস দেখিয়ে এই কাপুরষের হাতে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিতে পারেননি তিনি,পারেননি নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করতে,পারেননি নিজের যোগ্যতায় একটা টাকা ইনকাম করার সাহস অর্জন করতে।সেদিন নাফিয়ার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী যে রণচণ্ডী রূপ ধারণ তিনি করেছিলেন সেই সাহস টা যদি নিজের মাঝে ধরে রাখতে পারতেন,যদি নিজের প্রতি হওয়া সব অন্যায় মেনে না নিয়ে নিজের ভেতরে জিদ পুষতে সক্ষম হতেন তাহলে হয়তো আজ নিজের স্বামীর এমন প্রশ্নের সম্মুখীন তার হতে হতো না।
নুরানি বেগমকে দমে গিয়ে চুপ থাকতে দেখে ঠোঁটে বিজয়ের হাসি টেনে নেন হিমেল সাহেব।বলে ওঠেন,
-যাও গিয়ে নাফিয়াকে বোঝাও।বিয়েতে যেনো কোনো ঝামেলা না হয়।
কথাটি বলেই ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হোন হিমেল সাহেব।কিন্তু মাঝ পথেই থেমে যান নুরানি বেগমের প্রশ্নে,
-আমাদের মেয়ে হুমায়রাকে যদি ইরফান বিয়ে করতে চাইতো তাহলে বিয়ে দিতেন আপনি?
প্রশ্নটা যেনো পানির মতোই সহজ ঠেকলো হিমেল সাহেবের।সোজা উত্তর দিলেন,
-আমার মেয়েকে ঐ নজরে দেখার সাহস ওর নেই।
-আর নাফিয়াকে ঐ নজরে দেখার সাহস কি করে পেলো?নাফিয়ার বেলায় কেনো এই অন্যায়?
স্ত্রীর প্রশ্নে আলতো হাসেন হিমেল সাহেব।দ্বিধাহীন কন্ঠে বলে ওঠেন,
-কারণ হুমায়রা আমার সন্তান আর নাফিয়া আমার স্ত্রীর মৃত বোনের সন্তান।দু’জনের মাঝে অনেক তফাৎ নুরি।যা তোমার চোখে পড়েনা কারণ মৃত বোনের ভালোবাসায় অন্ধ তুমি।এতোটাই অন্ধ যে মৃত বোনের মেয়েকে পালতে যেয়ে নিজের মেয়েকে কি পরিমাণ অবহেলা করছো তা নিজেও বুঝতে পারোনি।
স্বামীর কথায় থমকে যান নুরানি বেগম।সত্যিই কি নাফিয়াকে মায়ের ভালোবাসা দিতে গিয়ে নিজের সন্তানকে বড্ড কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন তিনি?তাই জন্যেই কি হুমায়রা তাকে ছেড়ে পড়ালেখার অযুহাত দেখিয়ে নিজের ফুফুর বাসায় উঠেছিলো?
নিজের কথা শেষ করে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েন হিমেল সাহেব।এদিকে ধুপ করে বিছানায় বসে পড়েন নুরানি বেগম।মন-মস্তিষ্ক জুড়ে বিভিন্ন চিন্তেরা এসে জায়গা করে নিচ্ছে তার।কি হবে কাল?কি করে এতো বড় ক্ষতি হওয়া থেকে নাফিয়াকে বাঁচাবেন তিনি?যেখানে নাফিয়ার বয়স সবে ১৬ পূর্ণ হয়ে ১৭ তে পড়েছে সেখানে ইরফানের বয়স ৪৮ এর কম নয়।দু’টো বড় বড় ছেলে-মেয়ের বাপ সে।যৌবনকালে টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে স্ত্রী মরার পরও বিয়ে করেনি ইরফান কিন্তু এখন শেষ বয়সে এসে বিয়ে কেন করতে চাইছে? তাও নিজের মেয়ের বয়সী এক কিশোরীকে?
সমাজের অবক্ষয় দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন নুরানি বেগম।এখন সমাজের মানুষ না বয়স দেখে না সম্পর্ক দেখে।এদের মানবিক মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে?
সব চিন্তেরা একে-অপরের সাথে দলা পাকিয়ে পাগল করে দিচ্ছে নুরানি বেগমকে।আর যাই হোক নিজের মৃত বোনের আমানতকে যেমন যত্নে বড় করেছেন তিনি তেমন আজও এই বিপদ থেকে নিজের মেয়েকে যেভাবেই হোক বাঁচাবেন নুরানি বেগম।নিজের চোখের পানি মুছে নেয় সে।অগ্রসর হয় নাফিয়ার কক্ষের দিকে।চোখমুখে কাঠিন্যতা ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।এক কঠিন সিদ্ধান্তে মনঃস্থির তার।

নিজের কক্ষে পাতানো পড়ার টেবিলে বই খাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে নিয়ে সহজ এক অংক সমাধান করতে গুনে গুনে ২৫ মিনিট অপচয় করে ফেলেছে নাফিয়া।অথচ অংক মিললো না তার।মাথার মগজ গরম হতেই বই-খাতা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো সে।বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-উফ,কয়টা দিন আগে মাত্র এসএসসি পরিক্ষা ডা শেষ করলাম!কই মাম্মি আমাকে নিয়ে একটু ঘুরতে যাবে তা না সে আমাকে ইন্টারের বই খাতা ধরায়ে দিসে।ইন্টারে নাকি সময় কম পড়া বেশি তাই এখন দিয়েই পড়তে হবে।ধুর,স্টুডেন্টসরা কি মানুষ না?এদের জীবনে পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু নাই?এতো কেন পড়তে হবে?
নাফিয়ার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই কক্ষে প্রবেশ করেন নুরানি বেগম।কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মেয়ের কাছে এসে দাঁড়ান তিনি।নুরানি বেগমের চোখ-মুখ স্বাভাবিক ঠেকলো না নাফিয়ার।সে ব্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে উঠলো,
-কি হয়েছে মাম্মি?
উত্তরে সোজাসাপটা দৃঢ় কন্ঠে নুরানি বেগম বলে উঠলেন,
-তোকে পালাতে হবে নুফি।
মায়ের কথায় অবাক হলো নাফিয়া।বোধগম্য হলো না এ কথার অর্থ।তাই জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-কি বললে?
মায়ের কঠিন রূপ হেরে গেলো মমতার কাছে।প্রকাশ পেলো তার দূর্বলতা।চোখের পানি আঁটকে রাখতে পারলেন না নুরানি বেগম।মেয়েকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন তিনি।বলে উঠলেন,
-তোকে এখান থেকে পালাতে হবে নুফি।এই দানব টা তোকে বাঁচতে দিবে না।
মায়ের কথায় ধুক করে ওঠে নাফিয়ার হৃদয়।মনে ভয়ের সৃষ্টি হয়।কি হয়েছে বা কি হতে চলছে বুঝতে পারছে না সে।ভীত ও চিন্তিত কন্ঠে নাফিয়া প্রশ্ন করে ওঠে,
-কি হয়েছে মাম্মি?কাঁদছো কেনো?আর হটাৎ এগুলো কেনো বলছো?
মেয়ের প্রশ্নে সব খুলে বলেন নুরানি বেগম।সবটা শুনে চুপ করে রয় নাফিয়া।কেমন শূন্য শূন্য লাগছে তার।মনে শুধু ঘৃণার পাহাড় জমেছে খালু নামক লোকটার প্রতি।কিন্তু পরিস্থিতি আজ তার প্রতিকূলে।ঠিক যেনো সমুদ্রের মাঝখান টায় ভেসে আছে সে আর চারিপাশে কোনো কূল-কিনারা নেই।খালুর প্রতি ঘৃণা সযত্নে নিজের হৃদয়ে পুষে রাখলো নাফিয়া।সময় কখনো তার অনুকূল হলে একদিন লোকটাকে উচিৎ শিক্ষা দিবে বলে ভেবে রাখলো।
এদিকে নুরানি বেগম নিজের শাড়িতে গুঁজে রাখা ক’হাজার টাকা গুঁজে দিলেন নাফিয়ার হাতে।বললেন,
-এই টাকা টা রাখ নুফি।আমি রুম থেকে বেরিয়ে গেলে লুকিয়ে ছোট্ট একটা ব্যাগে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো ঢুকিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকবি।রাতে ঐ লোক ঘুমোনোর পর আমি তোর রুমে এসে তোরে পালায়ে যেতে সাহায্য করবো।বুঝছিস?
-কিন্তু মাম্মি,এতো বছর যেভাবে লোকটাকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে সোজা রেখেছি এবারও একি কাজ করতে পারবো না?আর বাল্যবিবাহ তো এমনিও ক্রাইম।
-না এবার এতে কাজ হবে না।কারণ তোর খালু পুলিশ ভয় পেলেও ইরফান পায় না।ইরফানের যেমন টাকা তেমন পাওয়ার।এসব পুলিশ কেস ও ভয় পাবে না।
শেষ আশার আলো টাও নিভে গেলো নাফিয়ার।মন খারাপের স্বরেই সে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
-পালিয়ে আমি যাবো কোথায়?
-ভুলেও তোর কাছের কোনো বান্ধবীর বাসায় যাবি না।এই লোক খুঁজে ফেলবে তোরে।তোর কোন জানি একটা সিনিয়র আপু আছে না?তোরে খুব ভালো জানে?
-রিয়ানা আপু?
-হ্যাঁ।ওর বাসা চিনিস?
-চিনি।
-তাইলে ঐ মেয়ের বাসায় যাবি।থাকতে দিবে?
-দিবে।আপু খুব আদর করে আমাকে।আমি থাকতে চাইলে খুশি হবে।
-আচ্ছা।রিয়ানার নাম্বার দিয়ে যাবি আমাকে।আমি সুযোগ বুঝে কল করে তোর খবর জেনে নেবো।আর প্রথম কিছু দিনের খরচ তো দিয়েই দিলাম।আবার পড়ে সুযোগ বুঝে ঐ মেয়েটার কাছে টাকা পাঠায়ে দিবো, ঠিক আছে?
-ঠিক আছে।
-আর কসম দে তুই নিজে থেকে আমাকে কল দিবি না।কারণ ওরা জানে তুই আমার সাথে অবশ্যই যোগাযোগের চেষ্টা করবি।এ জন্য আমার উপর কড়া নজর রাখবে।তুই কোনোভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করলেই ধরা খাবি।আমার অনেক স্বপ্ন তোরে নিয়ে নুফি।এই দানবটার জন্য তোর জীবনটা নষ্ট হতে দেখতে পারবো না মা আমার।যেভাবে পারিস,যত কষ্টই হোক নিজেকে গড়ার চেষ্টা করিস,ঠিক আছে?
-ঠিক আছে।
কথা খানা বলেই নুরানি বেগমকে জড়িয়ে ধরলো নাফিয়া।চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়ছে তার।আল্লাহ কেন তার জীবনটাকে এতো কঠিন বানিয়েছেন?কিভাবে থাকবে সে তার মাম্মিকে ছাড়া?শক্তপোক্ত ভাবে নিজের মাম্মিকে জড়িয়ে ধরে রাখলো নাফিয়া।বিদায় বেলা গোড়ার বেগে তেড়ে আসছে তাদের দিকে।

চলবে।

[ভুল-ত্রুটি অবশ্যই জানাবেন আর গল্প কেমন লাগছে জানাতে ভুলবেন না যেনো প্রিয় পাঠক মহল ❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here