আফিম বড্ড নেশালো ০২-পর্ব ১১

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১১

অপরিচিতা মেয়েটি আসার পর থেকে আফিমের ঠোঁট থেকে যেনো এক সেকেন্ডের জন্যেই আলতো হাসিটি সরছে না।আসবার পর থেকেই সোফায় বসে একের পর এক গল্পে মেতে আছে মেয়েটি।আফিমও সায় দিচ্ছে তাকে।যদিও আফিম খুব একটা কথা বলছে না শুধু ঠোঁটে হাসিটিই টেনে রেখেছে।
রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাফিয়া।মেয়েটিকে ভালো ঠেকছে না তার।মোটেও না।ইচ্ছে করছে এখনই এ অপরিচিতাকে অফিস থেকে বের করে দিতে।কিন্তু এ তো তার সাধ্যে নেই।আবার আফিমের ব্যবহারেও বিরক্ত সে।অপরিচিতা মেয়েটি আসার আগে তো আফিম কাজ নিয়ে বহু ব্যস্ত হয়ে ছিলো।তাহলে মেয়েটি আসতেই কাজ ভুলে গল্পে মেতেছে কেনো ছেলেটা?এখন কি সময় অপচয় হচ্ছে না?নাকি তার কাজের থেকেও এই মেয়েটা তার জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
গল্প চলার মাঝেই হটাৎ নাফিয়ার দিকে চোখ যায় অপরিচিতা মেয়েটির।সে আফিমকে উদ্দেশ্য করে নাফিয়ার দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-আফিম,ও মেয়েটা কে?
এবার নাফিয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আফিম।ঠোঁটে সেই আলতো হাসি নিয়েই নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-মিস.শেখ এদিকে এসো।
আফিমের আদেশ পেয়ে তাদের কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় নাফিয়া।অনিচ্ছা স্বত্তেও ঠোঁটে একটু হাসি টেনে রেখেছে সে।
নাফিয়া কাছে এসে দাঁড়াতেই আফিম তার বান্ধবীকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-ও হচ্ছে নাফিয়া।সারাদিন আমার সাথে থেকে আমার কাজে সাহায্য করে।
-মানে তোর পি.এ?
এ প্রশ্নের উত্তরে আফিমের মন বলে ওঠে,
“উহু,ব্যক্তিগত সহকারী নয় বরং আমার একান্তই ব্যক্তিগত একজন।”
এবারও মনের কথাটি নিজের হৃদমাঝারেই আবদ্ধ রাখলো আফিম।উত্তরে কিছু না বলে প্রশ্নটি উপেক্ষা করে সে।নাফিয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বলে ওঠে,
-আর মিস.শেখ,ও হচ্ছে আমার ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ের বান্ধবী,অন্তরা।
অন্তরা নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে একটু সৌজন্যমূলক একটি হাসি দেয়।নাফিয়াও একই কাজ করে।

!!
প্রয়োজনীয় কিছু ফাইল গুছানোর ফাঁকে ফাঁকে আফিম-অন্তরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে নাফিয়া।মেয়েটির প্রতিটি কাজের দিকে নাফিয়ার নজর রয়েছে।আসার পর থেকেই যে মেয়েটা গল্পের ঝুলি খুলে বসেছে তা শেষ হবার নামই নিচ্ছে না।অবশ্য গুনে গুনে ২ বছর পর বিদেশ হতে বাংলাদেশে ফিরেছে মেয়েটা।বিদেশে গিয়েছিলো হায়ার স্টাডিজের জন্যে।এখন দেশে ফিরে পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করছে।গল্প তো আর কম জমেনি তার।
আফিম ল্যাপটপে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সাথে ঠোঁট হাসি ঝুলিয়ে ও মাঝে মাঝে মাথা নাড়িয়ে এমন ভাব নিচ্ছে যেনো মেয়েটার গল্পেই তার সমস্ত মনোযোগ,ল্যাপটপটা তো হুদাই নিয়ে বসে আছে।কথা বলার মাঝেই ক্ষণে ক্ষণে হাসতে হাসতে আফিমের গায়ে লুটিয়ে পড়ছে অন্তরা।এ বিষয়টিতে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে নাফিয়া।কিন্তু খুব একটা রাগ লাগছে না তার।কারণ আফিম মেয়েটিকে খুব একটা নিজের কাছে আসার অনুমতি দিচ্ছে না।নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে।না মেয়েটির দিকে অপ্রয়োজনে তাকাচ্ছে আর না একবারের জন্যেও আফিমের হাতের স্পর্শ লেগেছে মেয়েটির গায়ে।
কথার এক পর্যায়ে এসে অন্তরা আফিমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-দোস্ত,আমার না একটা জিনিস খুব বেমানান লাগছেরে!
ল্যাপটপে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই আফিম বলে ওঠে,
-কোনটা?
-এইযে তোর পি.এ একটা মেয়ে!না মানে ভার্সিটিতে থাকাকালীন সময়ে তো তুই পুরোপুরি শুদ্ধ পুরুষ ছিলি।মেয়ে মানেই যেনো যম।
এ কথায় মৃদু হাসে আফিম।বলে ওঠে,
-মেয়ে মানুষ মানেই মায়া।ব্যাস,মায়ায় জড়াতে চাইনি।
আফিমের কথার উত্তরে দুষ্টু হেসে অন্তরা বলে ওঠে,
-তা তোর পি.এ. কি মেয়ে না? নাকি তার মাঝে মায়া বলতে কিছু নেই?
এমন প্রশ্ন শুনে একটু খারাপ লাগে নাফিয়ার।আসলেই কি তার মাঝে মায়া নেই?মনে এ প্রশ্ন নিয়ে আফিমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে।স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় আফিমের উত্তরের আশায়।হয়তো ছেলে টা খুব বেশি কিছু না হলেও শুধু এতোটুকুই বলবে যে,”আছে”।
বান্ধবীর প্রশ্নের উত্তরে মনে মনেই আফিম বলে ওঠে,
“এ মায়া তো সেই সর্বনাশী,ভয়ংকর তীব্র মায়া যে এমন এক পুরুষকে নিজের মায়াজালে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে যে পুরুষটিকে শত সুন্দরী রমনী নিজের রুপের জালে আবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছিলো।”
মনের উত্তরখানা ঠোঁট অব্দি আনলো না আফিম।সে নিরবতাটাকেই বেছে নিলো।কিন্তু তার উত্তরের আশায় অপেক্ষেয়মান ছিলো দু দুটো নারী, তাদের উৎসাহী দৃষ্টি পানে একবারো তো তাকালো না আফিম।তাকালে হয়তো দেখতে পেতো কোনো একজনের মনে মেঘ জমছে ক্রমশ।
আফিমের কোনো উত্তর না পেয়ে বিরক্ত কন্ঠে অন্তরা বলে ওঠে,
-এইজন্য তোর উপর মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ হয় বুঝলি! চাপা স্বভাইব্বা কোথাকার।
উত্তরে এবারও মৃদু হাসে আফিম।দৃষ্টি সরিয়ে নেয় নাফিয়া।অভিমান হচ্ছে তার।আফিম কেনো কিছু বললো না।একটা ছোট্ট উত্তর দিলে কি হতো।মানুষ তো বলে নিরবতাই সম্মতির লক্ষণ। তবে কি অন্তরার কথায় সম্মতি দিয়েছে আফিম?অর্থাৎ তার মাঝে মায়া নেই?তবে আফিম কেনো তাকে কাছে টানে? তাহলে কি সেসব শুধুই মোহ?
এসকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না নাফিয়া।ভালো লাগছে না তার আর এক মুহূর্তও অফিসে থাকতে।এসব ভাবার মাঝেই নাফিয়ার কানে আসে অন্তরার করা একটি প্রশ্ন।
“আফিম,চল না বাইরে কোথাও খাইতে যাই?”
অন্তরার করা প্রশ্নে নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকায় আফিম।দু’টো বাজতে চলছে।বাইরে যাওয়াই যায় ভেবে অন্তরার দিকে সম্মতির ইশারা করে নাফিয়ার দিকে তাকায় আফিম।বলে ওঠে,
-মিস.শেখ চলুন।
প্রায় সাথে সাথেই অন্তরা বলে ওঠে,
-ও আমাদের সাথে যাবে?
ব্রুদ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ ফেলে আফিম বলে ওঠে,
-হ্যাঁ,কেন?
-সিরিয়াসলি?আমাদের ব্যক্তিগত কোনো কথা থাকতে পারে না নাকি?সবজায়গায় ও কেন যাবে?
এবার আফিম একটু বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-ওর কাজই আমার ছায়া হয়ে থাকা।যে শুধু মাত্র রাতের আঁধারে আমার সঙ্গ ছাড়ে।
আফিমের কথার উত্তরে একটু দুষ্টু কন্ঠে অন্তরা বলে ওঠে,
-তা ওয়াশরুমেও সাথে যায় না ছায়া?
অন্তরার প্রশ্নে চোখগুলো বড়বড় করে আফিমের দিকে তাকায় নাফিয়া।তার মনে পড়ে যায় গোসলে সাহায্য করার জন্যে আফিমের সাথে ওয়াশরুমে যাওয়া ও বাদ পড়েনি তার।নাফিয়ার বড়বড় চাহনির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে আফিম। সাথে সাথে চোখ সরিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে ওঠে,
-কথাটা মন্দ বলিসনি।এখন থেকে নাহয় ওয়াশরুমেও আমার সাথেই যাবে।
কথাখানা বলে আবারও তাকায় আফিম নাফিয়ার দিকে।অন্তরার অগোচরে নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ মারে আফিম।নাফিয়ার চোখ যেনো আর একটুর জন্যে চোখের কোটর থেকে বেড়িয়ে আসেনি।দৃষ্টি অস্বাভাবিক রকমের বড় করে আফিমের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
আফিমের উত্তরে হেসে ওঠে অন্তরা।হাসতে হাসতেই বলে ওঠে,
-তোর এই ফাজিল রুপ তো আগে কখনো দেখিনি।আমাদের আফিম যে শুধু শান্তশিষ্টই নয় বরং লেজবিশিষ্টও তা আজ জানলাম।
অন্তরার এ কথার উত্তরে আফিম আর কিছু বলে না। শুধু একটু হেসে বলে ওঠে,
-চল বেরোই।
কথাটি বলেই নিজের ক্যাবিনের দরজার দিকে অগ্রসর হতে যায় আফিম।তখনই তাকে থামিয়ে দিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আফিম,আমি কি এখন বাসায় যেতে পারি প্লিজ? আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।
আফিমের কিছু বলার আগেই অন্তরা বলে ওঠে,
-আফিম? নাম ধরে ডাকছো তুমি?
নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে উক্ত প্রশ্ন টি করে আফিমের দিকে তাকায় অন্তরা।অবাক দৃষ্টি ও স্বরে আফিমকে বলে ওঠে,
-কি হচ্ছে আফিম বল তো?তোর পি.এ একে তো মেয়ে,তার উপর বয়স দেখে মনে হয় এইচএসসি পাস ও করে নাই।আবার তোকে নাম ধরে ডাকছে! কি হচ্ছে এসব?
অন্তরার কথাগুলো ভীষণ অপমানজনক লাগছে নাফিয়ার।নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ কিছু মনে হচ্ছে তার।চোখজোড়াও জ্বলজ্বল করছে।
রাগে দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে আফিম।কঠিন কিছু জবাব দিতে ইচ্ছে করছে তার।কিন্তু সে জানে অন্তরার জায়গা থেকে অন্তরা পুরোপুরি ভুল নয় কারণ মেয়েটা সবকিছু সমন্ধে অবগত নয়।তাই নিজেকে সামলিয়ে অন্তরার কথার কোনো জবাব না দিয়ে নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে আফিম বলে ওঠে,
-মিস.শেখ,তোমাকে রিয়াদ বাসা অব্দি ড্রপ করে দিবে।আমি বলে যাচ্ছি।
কথাটি বলেই নিজের ক্যাবিন হতে বেরিয়ে যায় আফিম।পেছন পেছন অন্তরাও বেরিয়ে যায়।আর নাফিয়া মেঝের দিকে নিজের পানিতে টলমল করা দৃষ্টি আবদ্ধ করে রাখে।

!!
রেস্টুরেন্টে এসে বসেছে আফিম ও অন্তরা।মন টিকছে না আফিমের।ইচ্ছে করছে এক্ষুনি নিজের মিস.শেখের কাছে ছুটে যেতে।আসার সময় মেয়েটার জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখদুটো না দেখলেও অনুভব করতে পারছিলো সে।রিয়াদকেও সে বলে এসেছে সাবধানে যেনো মেয়েটিকে বাসা অব্দি পৌঁছে দেয়।কিন্তু তাও মেয়েটার জন্য চিন্তে হচ্ছে তার।সাথে সাথে নিজের মুঠোফোনে রিয়াদের নাম্বার ডায়াল করে ফোন কানে তুলে নেয় আফিম।ফোনের ওপাশ হতে রিয়াদের কন্ঠস্বর কানে আসতেই আফিম বলে ওঠে,
-মিস.শেখ কোথায়?
-বাসায় স্যার।ম্যামকে পৌঁছে দিয়ে এসেছি সবে।
-গুড।
কথাটি বলে কল কাটে আফিম।একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় অন্তরা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।আফিম মৃদু ব্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
-কি হইছে?
-আসল কাহিনি টা ক এবার!
-কি কাহিনি?
-নাফিয়া কি হয় তোর?
প্রশ্নটি শুনে নিজের চেয়ারে আরাম করে বসে আফিম।ঠোঁটে একটু বাঁকা হাসি টেনে বলে ওঠে,
-ইট’স অ্যা সিক্রেট।
-মানে?
-পড়ে বুঝবি।
-না না না প্লিজ দোস্ত এহনই ক।দেখ এতোটুক তো বুঝতেছি যে এই মেয়ে তোর কাছে অন্য সবার মতো না।বরং বিশেষ কেউ।
-গুড।
আফিমের উত্তরে রাগ উঠে অন্তরার।ছেলেটা কেন ঠিক মতো কিছু বলছে তাকে!রেগে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বসে রয় সে।এতে আফিম পাত্তা না দিয়ে ওয়েটার বয়কে ডেকে কিছু খাবার অর্ডার দেয়।সব খাবারই অন্তরার ফেভারিট।ব্যাস,রাগ ভ্যানিশ তার।খুশিতে গদগদ হয়ে বলে ওঠে,
-থ্যাংকস দোস্ত।
অন্তরার এমন বাচ্চামোতে একটু হাসে আফিম।কিন্তু তা পুরোপুরি মন থেকে না।মনে বারংবার নাফিয়ার চিন্তা আসছে।
আফিমকে চুপ থাকতে দেখে অন্তরা বলে ওঠে,
-মেয়েটা হয়তো ভালোবাসতে আরম্ভ করেছে তোকে।
অন্তরার কথায় তার দিকে তাকায় আফিম।অন্তরা আবার বলে ওঠে,
-ও জ্বলছিলো আমাকে তোর কাছাকাছি দেখে।কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আমাদের দিকে তা ঠিকই নোটিস করেছি আমি।সন্দেহ হচ্ছিলো আমার তোদের দু’টোকে দেখে।কোনো বস্-স্টাফের সম্পর্কের মতো না তোদের টা।প্লিজ সব কাহিনি টা খুলে বল না?
-সময় আসলে জানবি।না ও আমার পি.এ. আর না প্রেমিকা। There is a secret.[একটা রহস্য আছে]
কথাটি বলে বাঁকা হাসে আফিম।মনে মনে একটু খুশিও হচ্ছে সে।এটি ভেবে যে নাফিয়ার অনুভূতি জ্বলন অব্দি এসে ঠেকেছে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here