আফিম বড্ড নেশালো ০২-পর্ব ১২

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১২

এক মেঘবালিকা ছাঁদের কোণে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে মেঘলা আকাশ পানে।পড়ন্ত বিকেল,সন্ধ্যে নামবে নামবে ভাব।যেখানে সূর্যের বিদায়ে আকাশে আলো শূন্যতা দেখা দিতে আরম্ভ করেছে সেখানে মেঘেরা আরও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কালো আবরণে আকাশকে আবৃত করে নিতে।সেই আঁধারে ছেয়ে যাওয়া আকাশ পানেই দৃষ্টি আবদ্ধ নাফিয়ার।মনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিমানেরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে বারংবার।বিনা কারণেই এক পুরুষের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে নাফিয়ার মন।সেই পুরুষের বিলম্বে মনে অভিমান জমছে ক্রমশ।
বক্ষ মাঝারে এক সূক্ষ্ম কষ্ট অনুভব করছে নাফিয়া।মানুষটা কেনো বাড়ি ফিরছে না? এখনো কি ব্যস্ত সে সেই মানবীর সাথে?নাফিয়ার কথা কি একবারও মনে পড়ছে না মানুষটার?টানা ১ মাস ঘুমের সময়টা বাদে প্রতিটি মুহূর্ত তো দু’জনে একসাথে কাটিয়েছে তাও কি ঐ মানুষটার অভ্যেসে পরিণত হয়নি নাফিয়া?তাকে ছাড়া নাফিয়া যেমন শূন্য শূন্য অনুভব করছে তেমনই কি অনুভূতি হচ্ছে না ঐ মানুষটারও?হলে অবশ্যই এতোক্ষণে সে মানুষটা বাড়ি ফিরতো।কিন্তু কই,ফেরেনি তো সে।হয়তো পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গ তাকে নাফিয়ার অনুপস্থিতির শূন্যতা ভুলিয়ে দিয়েছে।
এসব ভাবতেই চোখের কোণ জ্বলজ্বল করে ওঠে নাফিয়ার।টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু কণা গড়িয়ে পরে বাম আঁখির কোণ বেয়ে।মাত্র এক মাসের পরিচয়ে একটা মানুষের প্রতি তৈরি হওয়া অভিমান এতোটা তীব্র হতে পারে জানা ছিলো না নাফিয়ার।নিজের এমন আবেগে নিজেই বিরক্ত সে।কেনো আফিমের কার্যকলাপ এতোটা প্রভাবিত করছে তাকে?কিই বা হয় সে আফিমের?কেনো এসব অভিমান?
নাফিয়ার এসব ভাবনার মাঝেই প্রচন্ড বেগে বাতাস বইতে আরম্ভ করেছে।বাতাসের বেগে উড়ছে নাফিয়ার ঘন লম্বা চুল।এলোমেলো হয়ে উড়ছে তার পড়নের কাপড় টাও।ছাঁদে লাগানো ছোট্ট ছোট্ট হলদে আলোতে নাফিয়ার এ রূপ যেনো যেকোনো যুবকের মনে ঝড় তুলতে সক্ষম।মেয়েটা আনমনে চেয়ে আছে আকাশ পানে।বৃষ্টির অপেক্ষায় অপেক্ষেয়মান তার হৃদয়।খুব করে এ আসন্ন বৃষ্টিতে তার বৃষ্টি বিলাসের সঙ্গী হিসেবে আফিমের সঙ্গ চাইছে তার হৃদয়।চাইছে ছেলেটা তার সাথেই বৃষ্টি বিলাস করুক,কোনো পরনারীর সঙ্গে নয়।এমন কোনো এক ঝড়ের রাতেই তো আফিমের জীবনে এসেছিলো সে।আজ আবারও এক ঝড়-বৃষ্টিমাখা সন্ধ্যেতে আফিম আসবে কি তার শূন্যতা দূর করতে?
মনে মনে এসবই আওড়াচ্ছে নাফিয়া।বাতাসের বেগে তার শরীরের ওরনা উড়ে যে এক যুবকের নাক-মুখে আছড়ে পরেছে সেদিকে বিন্দু পরিমাণ খেয়াল তার নেই।ছেলেটা ওরনা সরিয়ে নিজের সামনে বরাবর তাকাতেই দেখতে পায় এক হৃদহরণ করা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।যেখানে এক রমনী আনমনে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে আকাশ পানে আর বাতাসের তীব্র বেগে উড়ছে তার এলোমেলো ঘন লম্বা কেশ।মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় আফিম।নাফিয়ার কাছে গিয়ে পেছন থেকেই এক হাত এগিয়ে মেয়েটির পেটের উপর রেখে আলতো করে মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে।হটাৎ কারো স্পর্শে কেঁপে ওঠে নাফিয়া।কিন্তু পেছনে ঘুরে মানুষটির চেহারা দেখার প্রয়োজন হলো না তার।কারণ এ স্পর্শ,শক্তপোক্ত বক্ষের ছোঁয়া ও ছেলেটির গায়ের সুঘ্রাণই যথেষ্ট নাফিয়ার এ মানুষটিকে চেনার জন্যে।
আফিম নাফিয়ার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলে ওঠে,
-এমন খারাপ আবহাওয়ায় ছাঁদে কি করছো?
আফিমের কন্ঠস্বর কানে আসে নাফিয়ার।কিন্তু উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে হলো না তার।নিজেকে আফিমের বাহুবন্ধন হতে শান্তভাবে মুক্ত করে স্বাভাবিক কন্ঠে সে বলে ওঠে,
-একা থাকতে চাই।
বাতাসের শব্দে নাফিয়ার কথাগুলো ঠিকঠাক শুনলো না আফিম।কিন্তু মেয়েটার ব্যবহার কেমন যেনো অস্বাভাবিক ঠেকছে তার কাছে।আফিম ব্রু দ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ ফেলে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-Are you okay Miss. Sheikh?[তুমি ঠিক আছো মিস.শেখ?]
নাফিয়া উত্তরে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আফিম।বুঝতে চেষ্টা করছে মেয়েটার নিরবতায় লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত অনুভূতি গুলো।
এদিকে বৃষ্টি না হয়েই বাতাস প্রবাহের বেগ কমে গিয়েছে অনেকটা।হয়তো আবারও প্রবল বেগে বাতাস ছেড়ে বৃষ্টি নামার পূর্বের নিরবতা বিরাজ করছে এখন।
আফিম কিছুটা সময় নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই মেয়েটার হাত আঁকড়ে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিজের একদম কাছে টেনে নেয়।অন্য হাত দ্বারা গাল স্পর্শ করে বলে ওঠে,
-What happened Miss. Sheikh?[কি হয়েছে মিস.শেখ?]
আফিমের করা প্রশ্নটি কাটা গায়ে নুনের ছিটার ন্যায় ঠেকছে নাফিয়ার।এতোটা সময় কই ছিলো এই চিন্তা গুলো?এতোক্ষণ বান্ধবীর সাথে ঘুরা শেষ করে এসে এখন দরদ দেখানো হচ্ছে তাকে!
রাগে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো এই কিশোরী।এক ঝটকায় আফিমকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো সে।ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আফিমের দিকে তাকিয়ে অনতিবিলম্বে ছেলেটির শার্টের কলার শক্ত করে মুঠোবন্দি করে নিলো।ক্ষিপ্ত স্বরে বলে উঠলো,
-খুব চিন্তা হচ্ছে এখন আমার জন্য?সকাল থেকে কই ছিলো এই চিন্তা?সারাদিন তো বান্ধবীকে নিয়ে পড়ে ছিলেন, একবারও কি তাকিয়েছিলেন আমার দিকে?তাকান নাই।এখন যখন বান্ধবী চলে গেছে তখন খুব দরদ উথলায়ে পড়ছে আমার উপর তাই না?
কিশোরীর ক্রোধান্বিত অগ্নির ন্যায় তীব্র তেজি এই রূপ দেখে বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে আফিম।কি ঝাঁজালো এ কণ্ঠস্বর!চোখে তার ফুটে উঠেছে কঠোরতার উপস্থিতি।
আফিমকে নিরব থাকতে দেখে রাগ বাড়লো নাফিয়ার।অভিমানগুলো বেসামাল হলো তার।ক্ষিপ্ত স্বরে আবারও বলে ওঠলো,
-কি করছিলেন এতোক্ষণ ঐ মেয়ের সাথে?এতো কিসের কথা?এতোক্ষণ ঐ মেয়ের সাথে কাটিয়ে এসেছেন আর এসে দরদ দেখাচ্ছেন আমাকে?এতোই যদি আমার চিন্তা হতো তাহলে অন্তত খোঁজ নিতেন আমি খেয়েছি কিনা!একা বাসায় এতোটা সময় কি করছি!যদি এক বিন্দুও আমার শূন্যতা অনুভব করতেন তাহলে এতো দেরি করে বাড়ি ফিরতেন না।
কথাগুলো বলে একটু থামে নাফিয়া।তার স্বরে কাঠিন্যতা কমে গিয়েছে।বড্ড কষ্টেই শেষ কথাখানা বলে সে।অভিমান, রাগগুলো কান্না হয়ে বেরোতে চাইছে,চোখ টলমল করছে।সেইসাথে কন্ঠস্বরও স্বাভাবিক নেই তার।একটু সময় নিয়ে আবারও নিজেকে স্বাভাবিক করে নাফিয়া।পূণরায় চোখে কাঠিন্য ও কন্ঠে ঝাঁজালো ভাব এনে বলে ওঠে,
-আমাকে অবলা নারী ভাব্বেন না আফিম।ভাব্বেন না যে আমি মুখ বুঁজে সয়ে যাওয়া টাইপের মেয়ে।এমনটা ভেবে থাকলে বড্ড ভুল ভাবছেন।আমি কখনো মেনে নেবো না আপনাকে অন্য কোনো নারীর আশেপাশে।এক বিন্দুও মানবো না।
চোখমুখে ক্রোধ বজায়ে রেখেই কথাগুলো বলে নাফিয়া।ক্রোধের বসে কি এক সাংঘাতিক কথা সে বলে বসেছে সেদিকে বিন্দু পরিমাণ খেয়াল নেই তার।তার ও আফিমের নামহীন অনুভূতিপূর্ণ এ সম্পর্কে কি আদৌও এতোটা অধিকার ফলানো সাজে?আফিমকে শুধু মাত্র নিজের ভাব্বার অধিকার কে দিয়েছে তাকে?তবে কি তার হৃদয় আফিমের অনুমতি না নিয়েই ছেলেটিকে নিজের একান্তই ব্যক্তিগত সম্পদ ভেবে নিয়েছে?
নাফিয়ার কথাগুলো শেষ হতেই অবাধ্য এক ফোঁটা অশ্রু বিন্দু তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।পড়ে বললে ভুল হবে অবশ্য।কারণ সেই এক বিন্দু অশ্রু অতিব যত্নে নিজের হাতে নেয় আফিম।
এতোটা সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে অবাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে ছিলো সে মেয়েটির দিকে।তার অবাক হওয়ার পরিমাণ যেনো আসমান ছুঁই ছুঁই।আশা করেনি এ কিশোরী এতোটা অভিমানীনি,এতোটা তেজি,এতোটা আবেগপ্রবণ।আশা এও করেনি যে,এই কিশোরীর হৃদয়ে নিজের জন্য এতোটা জায়গা বানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে সে।হাতে নেওয়া অভিমানীনির অভিমানী অশ্রু কণার দিকে তাকিয়ে আছে আফিম।এ অশ্রু কণাই সাক্ষ্য দিচ্ছে এই কিশোরীর অভিমানের তীব্রতা।বুকে শীতল প্রশান্তিময় বাতাস বইছে আফিমের।তার ইচ্ছে করছে চেঁচিয়ে ঐ বিশাল আকাশ পানে তাকিয়ে বলতে,
“ঐ আকাশের মতো একা নই আমি,শূন্য নই,নিঃস্ব নই।আমারও আছে একজন,একান্তই আমার।”

আফিমের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তার শার্টের কলার আঁকড়ে ধরা হাতের মুঠো ঢিলে করে আস্তে করে ছেড়ে দেয় তাকে নাফিয়া।ধীর কদমে এগিয়ে গিয়ে ছাঁদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায় সে।নিস্তব্ধ পরিবেশ,চারিপাশে বিরাজ করছে নিরবতা।কিন্তু শো শো বাতাস বয়ে চলায় শব্দ কানে লাগছে।আফিমকে কথাগুলো বলেও মন শান্ত হয়নি নাফিয়ার।না রাগ কমেছে আর না অভিমান।মন ভরা বিষাদ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি কামনা করে চলছে সে।বৃষ্টিতে ভিজলে হয়তো মনের বিষাদ খানিকটা কমবে!
হটাৎ কানের কাছে কারো শীতল হাতের স্পর্শে শিহরিত হয়ে চোখ বুজে নেয় মেঘবিলাসী।আফিম আলতো হাতে কানের কাছ থেকে নাফিয়ার চুল সরিয়ে সেথায় ঠোঁট লাগিয়ে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,
-এ বাড়ির সব জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে মিস.শেখ।তাই বাড়িতে থাকা কারো খবর নিতে কল করতে হয় না আমার।জানি দুপুরে খাওনি।বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েই ছাঁদে এসেছো।সেই দুপুর থেকে এখনো ছাঁদে।
কথাগুলো বলে সে দু’হাত রাখে নাফিয়ার পেটে।শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মেয়েটিকে নিজের সাথে।এতে মৃদু কেঁপে ওঠে নাফিয়া।চোখজোড়া বুঁজেই রেখেছে সে।আফিমও চোখবুঁজে নাফিয়ার কানের কাছে নাক ঘষতে ঘষতে মৃদু কন্ঠে বলে ওঠে,
-অন্তরা রেস্টুরেন্টে খাবার শেষ করেই বিদায় নিয়েছিলো।ইচ্ছে ছিলো তখনই বাসায় ফিরবো কিন্তু রিয়াদের কল পেয়ে সোজা অফিসে যেতে হয়েছে।কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকায় সেসব শেষ করে বাসায় ফিরেছি।
আফিমের কথাগুলো শুনে ঠোঁটে একটু হাসি ফুটে উঠেছে নাফিয়ার।অভিমানী মেঘেদের মাঝে সূর্যের কিরণ উঁকি দিচ্ছে।ছেলেটা দূরে থেকেও সে কি করেছে না করেছে সেসবের দিকে দৃষ্টি রেখেছে।আবার ‘অন্তরা’ নামক মেয়েটার সাথেও ছিলো না এতোটা সময় বরং কাজে ব্যস্ত ছিলো।আর সব থেকে বড় কথা,আফিমের মতো একজন সফল ব্যবসায়ী তার মতো বলতে গেলে একটা নিঃস্ব মেয়েকে জবাবদিহি করছে!এতেই বুঝে যায় নাফিয়া যে,সে কতোটা বিশেষ এই মানুষটার কাছে।ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি টেনে নিজের পেটের উপর অবস্থিত আফিমের হাতজোড়ার উপর হাত রাখে সে।ইচ্ছে করে আরেকটু মিশে যায় আফিমের সাথে।এতোক্ষণের রাগ,অভিমান,অভিযোগে ক্লান্ত তার হৃদয়।আফিমের বক্ষে মাথা ঠেকিয়ে এবার একটু বিশ্রাম চাইছে।এতে আফিমের খোচাখোচা দাঁড়ি তার গলায় বিঁধছে এবং এক অদ্ভুত শিহরণে শিহরিত হচ্ছে সে।
নাফিয়ার ইতিবাচক সাড়া পেয়ে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে আফিমের ঠোঁটে।সে ধীরে ধীরে নিজের ঠোঁট দ্বারা নাফিয়ার গলায় স্পর্শ আঁকতে আরম্ভ করে।মেয়েটি শিহরণে খামচে ধরে তার হাত।এতে আফিমের ঠোঁটের স্পর্শ আরো গাঢ় হয়।নাফিয়ার খামচির জোরও বৃদ্ধি পায়।
এমন মুহূর্তে হটাৎই একটি প্রশ্ন মাথায় আসে নাফিয়ার।সে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-আমার সমন্ধে কিছু না জেনেই কি করে নিজের এতোটা কাছে টেনে নিচ্ছেন আফিম?আপনার কি জানতে ইচ্ছে হয় না আমার পরিচয়?
নাফিয়ার প্রশ্ন কানে আসতেই আফিমের ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে।

চলবে।

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here