আফিম বড্ড নেশালো ০২-পর্ব ১৩

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১৩

“চারিদিকে তাকালে যার শত্রুর সংখ্যা অগণিত সে এক অপরিচিতা মেয়েকে ২৪ ঘন্টা নিজের সাথে সাথে রাখে ঐ অপরিচিতা মেয়ের সমন্ধে কোনো খোঁজ না নিয়েই?”
আফিমের প্রশ্নে টনক নড়ে নাফিয়ার।এমন সফল মানুষটির পিছনে হিংসুকের সংখ্যা তো আর কম হবে না।প্রতিটি সফল মানুষের পেছনেই হিংসুক, সমালোচক আর কিছু পেছনে টেনে ধরার মতো লোক থাকবেই থাকবে।যারা হিংসুক তারা অন্যের অনিষ্ট কামনা করে এবং অন্যের ক্ষতি করে তার সফলতার পথকে কঠিন করে তোলে।সমালোচকেরা নিন্দা রটিয়ে সফল মানুষটিকে অসম্মানিত করতে চায়।কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমালোচকের সমালোচনা পরোক্ষভাবে উপকার করে বিপরীত ব্যক্তিটিকে আরো সফল হতে।আর কিছু পিছুটান প্রতিটি মানুষেরই থাকে।সমাজে এমন প্রচুর মানুষ আছে যারা মানুষকে উৎসাহিত করার বদলে অনুৎসাহী করে,ভয় দেখায়।অনুপ্রাণিত করার বলদে মানুষের অনুপ্রেরণা ছিনিয়ে নেয়।
এসব কিছু থাকা সত্ত্বেও সফল মানুষ ঠিকই নিজের সফলতার পথ রচনা করে ফেলে।শত ঝড়-তুফানেও তারা দৃঢ়ভাবে নিজের স্থানে অনড় থাকে।সাহস,দৃঢ় সংকল্প ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সফল মানুষগুলো এগিয়ে গেলেও হিংসুক,সমালোচক ও নির্জীব মানুষগুলো পেছনেই রয়ে যায়।তাদের অবস্থান পেছনেই।কারণ তারা নিজেদের এগিয়ে নিতে সময় ও শ্রম ব্যায় না করে অন্যদের পেছনে টানতে সময় ব্যয় করে।এতে অন্যদের খুব একটা ক্ষতি না হলেও তারা নিজেরাই নিজেদের বিরাট ক্ষতি করে বসে,নিজেরাই নিজেদেরকে অন্যদের থেকে পিছিয়ে রাখে।
আফিমের করা প্রশ্নটি নিয়ে একটু ভেবে আফিমের দিকে ফিরে তাকায় নাফিয়া।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-আপনি খোঁজ নিয়েছিলেন আমার?
নাফিয়ার প্রশ্নে বাঁকা হাসে আফিম।জোরে নাফিয়ার এক গাল টেনে বলে ওঠে,
-Yes my zawja. [Zawja অ্যারাবিক শব্দ]
গালে ব্যথা লাগায় চোখমুখ কুঁচকে নেয় নাফিয়া। আফিম তার গাল ছাড়তেই সেথায় হাত বুলোতে বুলোতে নাফিয়া বলে ওঠে,
-যাওজা মানে কি?
আফিম জানতো নাফিয়া এ শব্দের অর্থ জানে না।সেজন্যেই উক্ত শব্দটি ব্যবহার করেছে সে।কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নটি শুনে মৃদু হাসে আফিম।নাফিয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শূন্যতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। কন্ঠে রহস্যময় ভাব এনে বলে ওঠে,
-Wait for the right time, Miss. Sheikh.
ছেলেটা কোনো কিছুই সম্পূর্ণ পরিস্কার করে বলে না।এতে ভীষণ বিরক্ত নাফিয়া।খবর নিয়ে তার সমন্ধে কি কি জেনেছে তা নিয়েও জানতে ইচ্ছে করছে তার।কিন্তু সে জানে আফিমকে প্রশ্ন করলেও এই চাপা স্বভাবের মানুষটার মুখ দিয়ে তেমন কিছুই বের করতে সক্ষম হবে না সে।
আচ্ছা,আফিম কি জেনেছে তার বাড়ি ছাড়ার পেছনের কাহিনি টা?আফিম কি জেনেছে তার অগণিত হৃদক্ষতগুলোর কাহিনি?আফিম কি জেনেছে তার না বলা হাজারো যন্ত্রণাময় সব স্মৃতি সমন্ধে?
প্রশ্নগুলোর উদয় হতেই এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নাফিয়ার বক্ষ মাঝারে স্পন্দিত হওয়া এক দুঃখী হৃদপিণ্ড হতে।পরক্ষণেই ভাবে কি করে জানবে আফিম?কে বলবে তাকে?ছেলেটা জানলেও হয়তো শুধু মাত্র তার বাহ্যিক পরিচয়টাই জেনেছে।
কিশোরীর হৃদয়ে জমানো কিছু না বলা যন্ত্রণারা উঁকি ঝুঁকি দিতেই গর্জে উঠে মেঘ,আবারও বাতাস ছেড়ে অম্বরের বক্ষ হতে ভুবনের বক্ষে নেমে আসতে আরম্ভ করে অগণিত বৃষ্টি কণা।
মুহূর্তেই বৃষ্টি বিলাসীর মনের আঙ্গিনা জুড়ে বর্ষণের আনন্দ ছেয়ে যায়।ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে দু’হাত প্রসারিত করে দেয় সে।অম্বর হতে ভুবনে নেমে আসা অমৃত নিজের গায়ে মেখে নেওয়ার মনোবাসনা তার। এক বিষাদমাখা পড়ন্ত বিকেলের পর বৃষ্টি মাখা সন্ধ্যেতে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সঙ্গ পেয়ে হৃদমাঝারে খুশির জোয়ার বইছে তার।চোখমুখে সে খুশির ঝলক দৃশ্যমান হয়ে আছে।আর এই আনন্দে মুখরিত মুখখানায় দৃষ্টি আবদ্ধ করে রেখেছে আফিম।এ বৃষ্টি বিলাসীর বৃষ্টি বিলাস দেখেই চোখের প্রশান্তি মিলছে তার।
প্রতিবারের মতো এবারও নাফিয়ার আবেদনময়ী রূপে দৃষ্টি আবদ্ধ আফিমের।মনে ভয়ংকর কামনার উঁকিঝুঁকি।আছে কঠিন সব নিষেধাজ্ঞা।সবকিছু মনের মাঝে যতনে রেখে ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে নেয় আফিম।এগিয়ে যায় তার মিস.শেখ এর কাছে।’মিস’ বলা টা ভুল হলেও এ পরিস্থিতিতে এটিই সঠিক বলে ধরে নিয়েছে সে।নিজের কিশোরী হৃদহরণীর কাছে গিয়ে এক হাত বাড়িয়ে দেয় আফিম।চোখে মাদকতা ও নেশালো কন্ঠস্বরে প্রশ্ন করে ওঠে,
-Will you dance Miss. Sheikh?
হটাৎ আফিমের কন্ঠস্বর কানে আসতেই তার দিকে তাকায় নাফিয়া।তাকাতেই চোখ আঁটকে যায় তার।বৃষ্টির বর্ষণে ভিজে ছিপছিপে হয়ে আছে সুদর্শন এ যুবক।ভিজে চুল গুলো কপালজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।শরীরে জড়ানো ভিজে সাদা শার্টখানা শরীরে লেপ্টে আছে তার।দারুণ লাগছে শ্যামবর্ণা,সুঠাম দেহী এ পুরুষটাকে।
নাফিয়ার অপলক এ চাহনির পেছনের কারণ বুঝতে পারে আফিম।ঠোঁট কামড়ে আলতো হেসে নাফিয়ার কোমর আঁকড়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় সে।চমকে যায় নাফিয়া।ধ্যান ভাঙে তার।বড়বড় চোখে তাকায় আফিমের মাদকতায় ভরা আঁখিদ্বয়ে।কপালে কপাল ঠেকিয়ে আফিম আবারও জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-Will you dance?
ঠোঁটে একটু হাসি টেনে আফিমের হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙুল গুঁজে দেয় নাফিয়া।অপর হাতে আঁকড়ে ধরে আফিমের কাঁধ।নাফিয়ার কোমরে থাকা আফিমের হাত আরো জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরে মেয়েটির কোমর।আশেপাশে কোনো সুরেলা ধ্বনি না থাকলেও দুজনার হৃৎস্পন্দনের ধুনই যথেষ্ট দু’জনার জন্যে।

!!
পাশাপাশি কক্ষে নিজেদের বিছানায় বসে আছে দু’জন মানব-মানবী।দু’জনার হাতেই আদা চা এবং ঠোঁটে মৃদু হাসি।বৃষ্টি বিলাস করতে গিয়ে দু’জনেরই মাথা ধরেছে, হাঁচি হচ্ছে বারংবার।সেই সাথে নাক দিয়েও পদ্মা,মেঘনা,জমুনা বেয়ে পড়তে আরম্ভ করেছে।কিন্তু এতে আফসোস নেই দু’জনার মাঝে কারোরই।বরং মনজুড়ে মুগ্ধতা! সুন্দর সব স্মৃতি কুড়োতে গিয়ে একটু যদি কষ্ট করতে হয় তবে তাতে ক্ষতি কি?
চা হাতে নিয়ে মুচকি হাসছে নাফিয়া।আফিম তার জীবনে আসার পর থেকেই জীবন এক সুন্দর স্বপ্নে পরিণত হয়েছে তার।মনজুড়ে অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতিদের বসবাস।পৃথিবীটা রঙিন লাগছে নাফিয়ার।মনে হচ্ছে নতুন করে বাঁচতে আরম্ভ করেছে সে।কতো নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে তার,কত নতুন অনুভূতিদের সাথে পরিচিত হচ্ছে সে।নাফিয়া মনে মনেই বলে ওঠে,
“এ সময় টা এখানেই থমকে যাক,এ অনুভূতিরা এভাবেই সারাজীবন সতেজ থাক,আফিম নামক নেশাটা সারা জীবন আমারই থাক।”
কথাগুলো বলতেই গালদুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করে তার।চেহারায় লজ্জার ছাপ ফুটে ওঠে।ঠিক এ সময়েই নাফিয়ার মনে পড়ে এ বাড়িতে নাকি সব জায়গায় ক্যামেরা লাগানো।অর্থাৎ তার কক্ষের সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে।আচ্ছা, আফিম কি দেখছে তাকে?তার মুখের এ লজ্জার ছাপ কি তবে দেখে নিয়েছে আফিম?সে যে বিনে কারণেই একটু আগে মিটিমিটি হাসছিলো তাও কি দেখেছে ছেলেটা?
এসব ভাবতেই আবার লজ্জায় লাল হয়ে যায় নাফিয়ার মুখখানা।আফিম কি ভাবছে তাকে নিয়ে এসব ভেবেই ভীষণ লজ্জা লাগছে তার।উফ, এখন এই ছেলের জন্য কি নিজের কক্ষে বসে একটু লজ্জাও পেতে পারবে না সে?চোখমুখ বিরক্তির ছাপ ফেলে নাফিয়া মনে মনে বলে ওঠে,
“আমাকে জ্বালিয়ে ক’দিন খুব শান্তিতে আছেন উনি।নাহ,আর শান্তিতে থাকতে দেওয়া যাবে না।কাল দিয়ে উনি টের পাবেন নাফিয়ার বাঁদরামি কাকে বলে!”
কথাটি মনে মনে আওরায়ে দুষ্টু একটি হাসি টেনে নেয় সে নিজের ঠোঁটে।

!!
চায়ের মগটি নিজের হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায় আফিম।বৃষ্টিভেজা শহর পানে দৃষ্টি আবদ্ধ রেখে মনে মনেই বলে ওঠে,
“আর কত সময় লাগবে তোমার হৃদয় জুড়ে আফিমের মাদকতা ছড়াতে?আর কতো সময় লাগবে আমাকে নিজের বিশ্বাস ও ভরসার মানুষরূপে গ্রহণ করতে?কবে আমায় অধিকার দিবে নিজের ক্ষতগুলোর মলম হতে?কবে নিজের স্বপ্নগুলোকে ঐ বিশাল আকাশে উড়তে দিবে?তুমি মুক্ত পাখির ন্যায় ঐ আকাশে উড়বে নাফিয়া।তোমার স্বপ্নগুলো আকাশ ছুঁবে।আমি ভুবনে থেকেই তোমায় উৎসাহিত করবো,অনুপ্রাণিত করবো,সাহস ও শক্তি জোগাবো।আমি তোমার নীড় হবো, মায়াবীনি।উড়তে উড়তে যখন ক্লান্তী আসবে তোমাতে তখন নিজের নীড়ে ফিরবে তুমি।তোমার নীড় নিজের বক্ষমাঝারে যতনে আবদ্ধ করে নিবে তোমায়।
এ দ্বায়িত্বই তো নিয়েছি আমি।তোমার খুব কাছের একজনকে ওয়াদা করেছি আমি তোমারই নীড় হবো, মায়াবীনি পাখি।”

চলবে।

[ বলবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here