আফিম বড্ড নেশালো ০২-পর্ব ৬

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ০৬

একই সময়ে দুজনের হাঁচি হওয়ায় একে-অপরের দিকে তাকায় আফিম-নাফিয়া।আবার অনতিবিলম্বে চোখ সরিয়ে নেয়।দুপুরে নিজেদের করা যুদ্ধের কথা মনে পড়তেই উভয়েই একে-অপরের দৃষ্টি এরিয়ে মৃদু হেসেও নেয়।
দুপুরের সেই আকামের পর উভয়েরই একটু আধটু ঠান্ডা লেগেছে।হাঁচি হচ্ছে সেই সাথে মাথাটাও ভার হয়ে আছে।
আফিমের দিকে আদা চা এগিয়ে দিয়ে নাফিয়া বলে ওঠে,
-এতে হয়তো একটু ভাল লাগবে আপনার।
ল্যাপটপ হতে দৃষ্টি উঠিয়ে এক নজর তাকায় আফিম নাফিয়ার দিকে।অতঃপর আবারও দৃষ্টি ল্যাপটপে আবদ্ধ করে চায়ের মগটি হাতে নিয়ে তা হতে এক চুমুক পান করে সে বলে ওঠে,
-Thanks!
চা পান করার সাথে সাথে নিজের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে আফিম আর নাফিয়া চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার কাজ দেখার চেষ্টা করছে।
হটাৎ আফিম ল্যাপটপ হতে চোখ না সরিয়েই প্রশ্ন করে ওঠে,
-কি হতে চাও জীবনে?
হুট করে এমন প্রশ্ন শুনে একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায় নাফিয়া।ছেলেটা তার সম্বন্ধে কিছুই জানে না।তার পরিচয় বা তাকে সেদিন রাতে ওভাবে রাস্তায় পাওয়ার পেছনের কারণ কোনোটাই জিজ্ঞেস করেনি।যার এসব জানার ইচ্ছে হয়নি তার আবার হুট করে নাফিয়ার জীবনের লক্ষ্য সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছে হলো কেনো সেটিতে একটু অবাক ও হয়েছে নাফিয়া।অবশেষে এসব ভাবনা বাদ দিয়ে সে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে ওঠে,
-আপনার মতো।
নাফিয়ার উত্তরে তার দিকে তাকায় আফিম।নাফিয়ার চোখে দৃষ্টি স্থির রেখে শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করে ওঠে,
-কেনো?
-ছোটবেলা থেকেই ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার শখ আমার।
উত্তরে আর কিছু বলে না আফিম।আবারো নিজের ল্যাপটপে দৃষ্টি আবদ্ধ করে সে।ঠোঁটে অল্প একটু, সামান্য হাসি দৃশ্যমান।
কিছু একটা ভেবে নাফিয়া জিজ্ঞেস করে ওঠে,
-আপনার আব্বু-আম্মু কি গ্রামের বাড়িতে থাকে?
এমন প্রশ্নে আফিম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না বরং সে নিজের কাজ করতে করতেই বলে উঠলো,
-না।
-তাহলে?কোথায় তারা?বিদেশে?
-মা নেই দুনিয়াতে আর বাবাকে টাকা কিনে নিয়েছে।
-মানে?
-শিল্পপতি আরহান ইবনান! নিজের নামের আগে “শিল্পপতি” ট্যাগ লাগানোর জন্য নিজের জীবন,স্ত্রী, সন্তান কোনো কিছুর পরোয়া করেনি তিনি।এখনো ইউএসএ তে টাকা কামাবার উদ্দেশ্যেই পরে আছেন।
কথাগুলো শেষ করেই ঠাস করে নিজের ল্যাপটপ অফ দেয় আফিম।মুহূর্তেই চোখমুখে কিসের জানি একটা ছাপ ফুটে উঠেছে তার।এটা রাগ নাকি বিরক্তি নাকি কষ্ট! বুঝতে সক্ষম হলো না নাফিয়া।
আফিম সময় ব্যায় না করে নিজের বিছানা থেকে উঠে তৎক্ষনাৎ নিজ কক্ষ ত্যাগ করে।
নাফিয়া অতক্ষণ অবাক চাহনি নিয়ে শুধু তাকিয়ে ছিলো আফিমের দিকে।আফিম কক্ষ ত্যাগ করতেই একটু নড়েচড়ে উঠে সে।বুঝতে চেষ্টা করে কিছুক্ষণের মাঝেই কি থেকে কি হয়ে গেলো!

!!
ছাঁদে এসে রেলিং ধরে দাঁড়ায় আফিম।আকাশে একটি পূর্ণ চাঁদ জ্বলজ্বল করছে।ঐ চাঁদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে।নিজের দৃষ্টি চাঁদে আবদ্ধ রেখেই আফিম বলে ওঠে,
-একা থাকতে চাইছি মিস.শেখ।তুমি যেতে পারো।
আফিমের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কথায় একটু চমকে ওঠে নাফিয়া।ছেলেটা তাকে না দেখেই কিভাবে তার উপস্থিতি টের পেলো তা বোধগম্য হলো না তার।তবুও আফিমের আদেশ পেয়ে চলে যাবার জন্য এক পা বাড়িয়েও থেমে যায় সে।যাওয়ার জন্য মন সায় দিচ্ছে না।বড়সড় ছাঁদ টার একদিকে রয়েছে সুইমিং পুল।আবার এক কোণায় পাতানো রয়েছে চেয়ার-টেবিল।অন্যদিকে অনেকগুলো ফুল গাছ এবং তার মাঝেই রয়েছে একটি দোলনা।অনেক সুন্দর করে সাজানো এবং পরিপাটি করে রাখা এই ছাঁদ টা।রাতের ঠান্ডা বাতাস,আকাশের চাঁদ সব মিলিয়ে মনোমুগ্ধকর সব কিছুই এখানে আছে।এ স্থান ত্যাগ করার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে নাফিয়ার নেই।আর আফিমেরও হয়তো মনটা ভালো নেই।এভাবে ছেলেটাকেও একা থাকতে দিতে মন চাইছে না তার।
সবটা ভেবে নিয়ে আফিমের উদ্দেশ্যে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আমার ডিউটি তো এখনো শেষ হয়নি।আপনার ঘুমের আগ অব্দি আমার কাজ আপনার সাথে থাকা সো আমি থাকবো।
উত্তরে কিছু বলে না আফিম।সে তার মতো করে রাতের এই সুন্দর পরিবেশটা উপভোগ করায় মনোনিবেশ করে।নাফিয়াও কিচ্ছুটি না বলে ধীর পায়ে আফিমের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।সেও নিরবে এই নিস্তব্ধ সুন্দর পরিবেশ টা উপভোগ করতে আরম্ভ করে।সেই সাথে একটু একটু তাকাচ্ছেও সে আফিমের দিকে।বুঝার চেষ্টা করছে কি চলছে ছেলেটার মনে!যদিও তার চেষ্টার ফলাফল শূন্যই।কিছুই বুঝতে পারলো না আফিমের মনের হাল।
কিছুটা সময় এভাবেই পাড় হয়ে যায়।নিস্তব্ধ পরিবেশে শব্দের উৎপত্তি হয় আফিমের কন্ঠনালী হতে।ছেলেটি শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-ঐ চাঁদ টা দেখছো, মিস.শেখ?
চাঁদ টা কিন্তু বড্ড একা।দেখো পুরো কালো অন্ধকারে ঢাকা বিশাল আকাশটার বুকে একটি চাঁদই জ্বলজ্বল করছে।ও একা কিন্তু অসহায় নয়।এই বিশালতার মাঝে ও একাই শক্তপোক্ত ভাবে নিজের অবস্থানে নিজেকে উজ্জ্বলিত করে রেখেছে।দেখো তো,চাঁদ টাকে দেখে কি তোমার মনে হয় সে দুঃখি?
আমার তো মনে হয় না।চাঁদের দিকে তাকালেই আমার মনে হয় চাঁদ হাসছে।সে একাই নিজের মতো করে আনন্দে আছে।
চাঁদের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে আফিম।এবার নিজের দৃষ্টি চাঁদ হতে সরিয়ে নাফিয়ার দিকে আবদ্ধ করে সে।
আফিম নাফিয়ার দিকে তাকাতেই নাফিয়া বলে ওঠে,
-ঠিক বলেছেন।আমারও চাঁদের দিকে তাকালে এমনই মনে হয় যে,চাঁদ মামা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।কিন্তু আমাদের মানুষের বেলায় ব্যাপার টা হতো উল্টো।আমরা মানুষরা একাকিত্ব ভয় পাই।একাকিত্ব,নিঃসঙ্গতা আমাদের ডিপ্রেশন,সুইসাইড এসবের কারণ হয়।আমরা মানুষরা একা থাকতে ভীষণ রকমের অপছন্দ করি।আমরা চাই আমাদের আপন মানুষগুলোকে নিয়ে একযোগ হয়ে থাকতে।

নাফিয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মেয়েটির সব কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে আফিম।নাফিয়ার কথা শেষ হতেই তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে আফিম বলে ওঠে,
-কিন্তু বাস্তবতা টা হচ্ছে পৃথিবীতে প্রকৃতপক্ষে কেউই আমাদের আপন নাহ।এ পৃথিবীতে কেউ আমাদের স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসে না।এমনকি নিজের বাবা-মা ও আমাদের স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসেন না।দিনশেষে আমরা প্রতিটা মানুষ শুধু নিজেই নিজের।কেউ শেষ অব্দি আমাদের সাথে,আমাদের পাশে থাকে না।একটা নির্দিষ্ট সময় পর সবাই ই আমাদের সঙ্গ ছেড়ে দেয়।রয়ে যাই আমরা নিজেই নিজের জন্য।প্রকৃত সত্যি হচ্ছে আমরা মানুষরা পৃথিবীতে আসি একা, যাবো ও একা আর পৃথিবীতে যতদিনই বাঁচি আমাদের জন্য শুধু আমরা নিজেরাই রই।বাকি সব স্বার্থ।
কথাগুলো বলে একটু থামে আফিম।নাফিয়া গভীর মনোযোগী হয়ে আফিমের কথাগুলো শুনছে।আফিম কিছুটা সময় নিস্তব্ধ থেকে আবারও বলে ওঠে,
-কিন্তু এতো স্বার্থের ভীড়ে আমরা প্রতিটি মানুষই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা জন্ম হতে মৃত্যু অব্দি পাই।আর এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা টা হচ্ছে আমাদের স্রস্টার।একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই তার সকল বান্দাদের নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসেন।তিনি ভালোবেসে আমাদের সৃষ্টি করেছেন।তার এতো এতো আদেশের অবাধ্য হওয়ার পরও,এতো এতো গুনাহ করবার পরও তিনি তার নিয়ামত,রহমত দিয়ে আমাদের বঞ্চিত করেন না।বরং বারংবার সুযোগ দিয়ে যান, ক্ষমা করে যান।তার কিছুই পাওয়ার নেই আমাদের থেকে। তিনি তো অভাবমুক্ত বাদশাহ।যার ধনভাণ্ডার কখনো ফুরাবে না তবুও তিনি আমাদের ভালোবাসেন।
কথাগুলো বলে থামে আফিম।একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে তাকায় নাফিয়ার দিকে।নাফিয়া মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় তাকিয়ে আছে আফিমের দিকে।একবার নাফিয়াকে দেখে নিয়ে নিজের দৃষ্টি আবারও অন্ধকার আকাশে আবদ্ধ করে আফিম।নিরবে চেয়ে থাকে সেথায়।আফিমকে চুপ থাকতে দেখে নাফিয়া বলে ওঠে,
-তাহলে এতো এতো ব্যাখ্যার উপসংহারে এসে বলা যায়,পৃথিবীতে কেউই কারো নয়।আমরা নিজেই শুধু নিজের।প্রতিটা মানুষ নিজেই নিজের জন্য যথেষ্ট আল্লাহর রহমতে।
নাফিয়ার কথায় মৃদু হাসে আফিম।চাঁদের দিকে ইশারা করে বলে ওঠে,
-আমাদের উচিৎ ঐ চাঁদের মতো হওয়া।যে একাই বাঁচতে জানে।একাকিত্ব উপভোগ করে আনন্দ কুড়াতে জানে।যার চারিপাশে কেউ নেই এ শোকে সে ভেঙ্গে পড়েনি বরং এ বিশাল শূন্য আকাশে মজবুত বা শক্ত ভাবে নিজে জ্বলজ্বল করে পৃথিবীর বুকে জোৎস্না পাঠাচ্ছে।
মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আফিমের কথাগুলো শুনছে নাফিয়া।বেশ ভালো লাগছে তার কথাগুলো শুনে। সত্যিই তো পৃথিবীতে কেউই কারো আপন নয়।খুব কাছের কারোরও যদি স্বার্থতে একটু আঘাত লাগে তাহলে সেও রুপ পরিবর্তন করতে সময় নেয় না।দিনশেষে আমরা নিজেই নিজের।এটি মাথায় রেখে নিজেকে শক্তভাবে গড়ে তুলে চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যৎ গড়া খুব তো অসম্ভব নয়।
এই প্রথমবার আফিমে এতোটা মুগ্ধ হয় নাফিয়া।ছেলেটা যে এতো সুন্দর করে এতো কথা বলতে জানে তা তো নাফিয়া স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।নাফিয়া ভাবতো আফিম গম্ভীর স্বভাবের ছেলে যার মুখ দিয়ে কথা বের হতে ট্যাক্স লাগে,যে শুধু কথায় কথায় ইংলিশ বলে ভাব নেয়।কিন্তু আসলে আফিম তো এমন নয়। এই মানুষটার ভেতরে আরেকটা মুগ্ধতায় ভরা মানুষ আছে তা আজই প্রথমবার উপলব্ধি করলো নাফিয়া।
অনেকটা সময় উভয়েই নিরবে কাটিয়ে দেয়।নিরবতা ভাঙতে নাফিয়া বলে ওঠে,
-আপনি কি আরো কিছু ভাবছেন?
নাফিয়ার প্রশ্নে তার দিকে তাকায় আফিম।পরিবেশ টা খুব গম্ভীর হয়ে আছে যা চাইছে না সে।নিজের মনের ভেতর চলতে থাকা কথাগুলো নাফিয়াকে বলে এখন অনেকটা হালকা লাগছে আফিমের।কিন্তু সে ভাবছে এসব কথা আদৌও নাফিয়াকে বলা ঠিক হয়েছে কিনা।কারণ মেয়েটার বাচ্চামিই ভাল্লাগে তার।সে চায় না বাস্তবতার এসব কুৎসিত দিকগুলো মেয়েটার বাচ্চামিগুলোকে শেষ করে দিক।
তাই গম্ভীর পরিবেশ টাকে স্বাভাবিক করতেই আফিম বলে ওঠে,
-হু।
-কি ভাবছেন?
-ভাবছি এই ডুপ্লেক্স বাসার ছাঁদ থেকে তোমাকে নিচে ফেলে দিলে কেমন হয়?
হটাৎ আফিমের এমন কথা শুনে বেকুব বনে যায় নাফিয়া।ভয়ে একটু ঢোক গিলে বলে ওঠে,
-মানে?
-এখান থেকে তোমাকে ফেলে দিলে মন হয় তুমি মরবা না।ব্যাস কয়েকটা হাড়গোড় ভাঙবে আরকি!কি বলো একবার ফেলে টেস্ট করবো নাকি যে মরবা কিনা?
-মজা করছেন?
কথাটি বলে ভয়ে এক পা এক পা করে পিছাতে আরম্ভ করে নাফিয়া।নাফিয়াকে ভয় পেতে দেখে মজা পায় আফিম।কিন্তু তা প্রকাশ না করে এক পা এক পা করে নাফিয়ার দিকে এগোতে এগোতে সে বলে ওঠে,
-নাহ।যে পরিমাণ জ্বালাও তুমি।এভাবে তোমাকে একটা শিক্ষা দেওয়াই উচিৎ।
আফিমের কথাটি বলতে দেরি হলেও নাফিয়ার দৌড়ে পালাতে দেরি হলো না।দৌড়ে ছাঁদের দরজা অব্দি গিয়ে বলে ওঠে,
-ছাঁদটা ভালো করে খুঁজে দেখুন তো কোথায় জানি আপনার মাথার একটা স্ক্রু খুলে পরে গিয়েছে।
বলেই আবারও দৌড় দেয় নাফিয়া।নাফিয়া যেতেই হেসে ওঠে আফিম।মৃদু শব্দ করেই হাসে সে।জীবনে কত বছর আগে এভাবে হেসেছিলো তা আফিমের নিজেরই মনে নেই।

চলবে।

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here