আফিম বড্ড নেশালো ০২-পর্ব ৭

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ০৭

গাড়ির ড্রাইভিং সিট এ বসে ড্রাইভ করছে আফিম।তার পাশের সিটেই বসে আছে নাফিয়া।উদ্দেশ্য অফিসে পৌঁছানো।প্রতিদিন ড্রাইভার ড্রাইভ করলেও আজ আবহাওয়া ভালো থাকায় আফিমের নিজেরই ইচ্ছে হলো ড্রাইভ করার।তাই জন্যে ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে নিজেই বেরিয়ে পরলো গাড়ি নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে।
আকাশ মেঘলা।অল্প রোদের উঁকিঝুঁকি দেখা যাচ্ছে কিন্তু মেঘেরা সূর্যকে আড়াল করে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত।চারিদিকে বয়ে চলছে ঠান্ডা বাতাস।
এমন মনোমুগ্ধকর আবহাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে নিস্তব্ধ কোনো রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে বেশ লাগে।এই মুহূর্তে নাফিয়ারও ইচ্ছে হচ্ছে কোনো এক জনমানবহীন প্রকৃতিতে ঘেরা জায়গায় গিয়ে নিরবে হেঁটে চলতে,মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে,প্রকৃতির নির্মল বাতাস নিজের মাঝে টেনে নিতে।কিন্তু এ মুহূর্তে তো তা সম্ভব নয় এটি ভেবে মন খারাপ করে জানালা হতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
গাড়ি চালানোর মাঝেই নাফিয়ার দিকে এক-দুবার তাকায় আফিম।মেয়েটির মন ভালো না তা বুঝতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না তার।কিন্তু কি কারণে মন খারাপ সেটিই ভাবনার বিষয়।
আফিমের এসব ভাবার মাঝেই হুট করে তার কানে আসে নাফিয়ার উত্তেজিত কন্ঠে উচ্চারিত শব্দ ত্রয়।
-আফিম আফিম আফিম!
হটাৎ নাফিয়ার এভাবে তাকে ডেকে ওঠার কারণ বোধগম্য হয় না আফিমের।সাথে সাথে গাড়ির স্পিড কমিয়ে নাফিয়ার দিকে তাকায় সে।চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন করে ওঠে,
-Anything happened?Are you alright?[কিছু হয়েছে?তুমি ঠিক আছো?]
আফিমের প্রশ্নদ্বয় উপেক্ষা করে নাফিয়া তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,
-গাড়ি থামান না প্লিজ! দ্রুত।
নাফিয়ার কথা শুনে আর কোনো বাক্য ব্যায় করে না আফিম।ফুটপাতের পাশে পার্কিং এর জায়গা দেখতে পেয়েই গাড়ি পার্ক করে ফেলে।
আফিম গাড়ি থামাতেই নাফিয়া ঠোঁটে হাসি ও চোখ-মুখে উত্তেজনার ছাপ ফেলে বলে ওঠে,
-ঐযে ঐ দিকে দেখুন,ঘোড়ার গাড়ি।আমার ঘোড়ার গাড়ি খুব খুব খুব পছন্দ।উঠতে চাই।জীবনে কখনো উঠার সুযোগ হয়নি।
শেষ বাক্যটি বলার সময় ঠোঁট উল্টে মন খারাপের সুরে বলে ওঠে নাফিয়া।আফিম চরম বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।এইটুকু কথা বলতে এতো ঢং!মেজাজ খারাপ হওয়ায় আফিম বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
-আজও সুযোগ পাবা না।
কথাটি বলেই আবারও গাড়ি স্টার্ট দিতে যায় আফিম।কিন্তু তাকে থামাবার উদ্দেশ্যে নাফিয়া বলে ওঠে,
-প্লিজ একটু সুযোগ দিন।এর বদৌলতে আমি বাড়তি কিছু কাজ করে দিবো।যা বলবেন তাই ই করবো।
-যা বলবো তা ই করবা?
-হ্যাঁ।
-ভেবে বলছো?
-হ্যাঁ।
নাফিয়াকে নতুন একভাবে জ্বালানোর বুদ্ধি মাথায় আসতেই মেয়েটির কথায় সম্মতি দিয়ে বাঁকা হেসে আফিম বলে ওঠে,
-Done.
ছেলেটির বাঁকা হাসি মোটেও সুবিধার নয় তা জানে নাফিয়া।সামনে তার জন্য যে ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে তাও বুঝে নিয়েছে সে।কিন্তু এখনের জন্য ঘোড়ার গাড়িতে ওঠাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

!!
চালকের সাথে কথা বলে নিয়ে নাফিয়ার আগে নিজেই ঘোড়ার গাড়িতে ওঠে আফিম।উঠে নিজের ডান হাত এগিয়ে দেয় নাফিয়ার দিকে।ঘোড়ার গাড়িগুলো একটু উঁচু হওয়ায় উঠার সময় একটি সাহায্যের হাত প্রয়োজন হয়।আফিমের এভাবে তার দিকে হাত এগিয়ে দেওয়াটা ভালো লাগে নাফিয়ার।সম্পর্কে সে আফিমের কিছুই হয় না।আর না আফিম তার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানে।তবুও একটি অপরিচিত মেয়ের প্রয়োজনের দিকে যে ছেলেটা চাওয়ার আগেই নিজে থেকে খেয়াল রাখে সে ছেলেটা কতটুকু যত্নশীল তা বুঝতে বাকি রয় না নাফিয়ার।সে ঠোঁটে মৃদু মুগ্ধতার হাসি ফুটিয়ে আফিমের হাতে হাত রেখে ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে বসে।

গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে।ঘোড়া দৌড়ে চলছে সেই সাথে গাড়িটাও মৃদু দুলছে।ঘোড়ার পায়ের আওয়াজও শোনা যাচ্ছে।রাস্তায় যানজট নেই।বলতে গেলে খুব বেশি মানুষ নেই রাস্তায়।এমন সুন্দর আবহাওয়া ও পরিবেশে ঘোড়ার গাড়িতে ঘুরার অনুভূতি টা ভীষণ সুন্দর।খুশিতে নাফিয়ার ঠোঁট থেকে হাসি সরছেই না।সে তার ডানে-বামের দৃশ্য এবং এ সময় টা উপভোগে ব্যস্ত।আর আফিম তার ঠোঁটের হাসি ও চোখমুখে ফুটে ওঠা খুশির ঝলক দেখতে ব্যস্ত।

হটাৎ একটি শব্দ কানে এসে লাগায় নিজের সামনে বরাবর তাকায় নাফিয়া।দেখতে পায়,গাড়ি চালক চাবুক দ্বারা ঘোড়াদ্বয়ের উপর প্রহার করছে।এ দৃশ্য দেখতেই ঠোঁটের হাসি গায়েব হয়ে যায় তার।এতোদিন এ নিষ্ঠুরতা সম্বন্ধে অবগত ছিলো না সে।সেভাবে কোনো দিন খেয়ালই করা হয়নি তার।
চালক বেশ ক’বার উভয় ঘোড়ার গায়েই চাবুক দ্বারা প্রহার করে চলছে।এমন দৃশ্য দেখে আফিমের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নাফিয়া।নিজের সামনে বরাবর দৃষ্টি স্থির রেখেই আফিমকে বলে ওঠে,
-আফিম প্লিজ গাড়ি থামাতে বলুন।
হটাৎ নাফিয়ার কি হলো তা বুঝতে সক্ষম হলো না আফিম।কিন্তু প্রশ্ন করবার জন্যে এটি সঠিক সময় বলে মনে হলো না তার।তাই সে বিনা প্রশ্নে চালককে গাড়ি থামানোর আদেশ দেয়।
গাড়ি থামতেই উভয়ই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।তারা নেমে দাঁড়াতেই চালক বলে ওঠে,
-কি হইছে স্যার?কইলেন আধা ঘণ্টা ঘুরবেন।এহন তো ১০ মিনিটও হইলো না।নাইমা গেলেন ক্যান?
উত্তরে আফিমের কিছু বলার আগেই নাফিয়া বলে ওঠে,
-নিজেদের একটু প্রশ্ন করুন তো,আপনারা কি আদৌও মানুষ?
নাফিয়ার এমন প্রশ্নের পেছনের কারণ না বুঝায় চালকের ব্রুদ্বয়ের মাঝে মৃদু ভাজ পরে।সে উল্টো প্রশ্ন করে ওঠে,
-ক্যান আপা?এডি কইতাছেন ক্যান?
-একটা নির্বাক প্রাণীর উপর এভাবে অত্যাচার করতে হাত কাঁপে না আপনাদের?
-এগো না মারলে এরা দৌড়াইবো না।এরা না দৌড়াইলে আমগো ব্যবসা চলবো ক্যামনে?আপনেরা মজা মাইরা ঘুরবেন ক্যামনে?
-এমন ব্যবসা আপনারা করবেনই কেনো যাতে নিরীহ প্রাণীগুলোর এতো কষ্ট পেতে হয়?আর মজা মেরে ঘুরা?এর জন্য এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে আমার যে একটা নিরীহ,নির্বাক প্রাণীর কষ্টের কারন হয়েছি আমি।
-কষ্ট দেওনের আপ্নে দেখছেন ডাই কি আপা?কয়দিন আগে পত্রিকায় আইছিলো এক চালক এমনে গাড়ি চালাইছে যে ঘোড়ার মুখ দিয়া রক্ত বাইর হইতাছিলো কিন্তু তাও ব্যাডায় চালানো থামায় নাই।ঘোড়ারে মাইরাই যাইতাছিলো।আর অন্য ব্যবসাইরা তো ঘোড়া গো খাইতেও দেয় না।এক একটা হুগনা ঘোড়া।গায় বল পায় না দৌড়ানোর তারপরেও ব্যাডারা পিডাইয়া হেগো দিয়ে দৌড়ায়।আমরা এইরাম কাম করি না।আমগো ঘোড়ার স্বাস্থ্য দেহেন।কি মোডাসোডা! ওগো দিয়া ব্যবসা করি আবার ওগো খাওয়াই ও।
লোকটার কথা শুনে চোখে পানি চলে আসে নাফিয়ার।মানুষ হলেও এদের মনুষ্যত্ব টা কোথায়?মানবতা কোথায়?দয়ামায়া কিছুই কি এদের নেই? এই প্রাণী গুলোর বাকশক্তি নেই।তারা নিজেদের কষ্ট মুখে প্রকাশ করতে ব্যর্থ কিন্তু এর মানে এমন তো না যে এরা ব্যথা পায় না।এদের তো আল্লাহ ব্যথার অনুভূতি দিয়েছেন,এদেরও আমাদের মানুষের মতোই ব্যাথার অনুভূতি হয়।
নিজের সামনে দাঁড়ানো লোকটার সাথে আর কোনো কথা বলার রুচি হলো না নাফিয়ার।চোখে ঘৃণা নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
-নিজেকে মানুষ মনে করলে দয়া করে নিরীহ প্রাণীদের কষ্ট দেওয়া ব্যবসা থেকে বিরত থাকুন।
কথাখানা বলে আর দাঁড়ায় না নাফিয়া।সোজা উল্টো দিকে ফিরে হাঁটতে আরম্ভ করে সে।
এতোটা সময় নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলো আফিম।নাফিয়ার মতো করে এভাবে সে কখনো ভেবে দেখেনি।আগেও ১-২ বার ঘোড়ার গাড়িতে চড়েছিলো সে কিন্তু ভাবেনি যে তার এই কয়েক মিনিটের ভালোলাগা টার জন্য একটি পশুর কতটুকু কষ্ট করতে হচ্ছে।যেখানে রিকশা,ভ্যান, প্রাইভেট কার থেকে শুরু করে এতো এতো যানবাহন আছে সেখানে এসব নির্বাক,নিরীহ প্রাণীর কষ্টের কারণ হওয়ার বিলাসিতা টা বাদ দিলেই হয়।
নাফিয়ার চিন্তাভাবনা এবং চালকের সাথে প্রতিবাদী স্বরে কথা বলা সবটাতেই মুগ্ধ আফিম।মেয়েটার বয়স কম হলেও ভয়,জড়তা এবং মুখ বুঝে অন্যায় সয়ে নেওয়া,সব কিছুতে অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়ার মতো গুন নাফিয়ার মধ্যে নেই।মেয়েটা সাহসী।

মন খারাপ করে হাঁটছে নাফিয়া,তার পাশেই হাঁটছে আফিম।মেয়েটার গোমড়া মুখ ভালো লাগছে না আফিমের।কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই আফিমের চোখ যায় তার সামনেই দাঁড়ানো একজন লোকের দিকে।হাতে সুগার ক্যান্ডি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটি।ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে আফিমের।যত টুকু সে চিনেছে নাফিয়াকে তাতে ধারণা করা যায় মেয়েটির সুগার ক্যান্ডি পছন্দ।

হাঁটতে হাঁটতে আফিমের গাড়ির কাছে এসে পৌঁছাতেই আফিমের দিকে তাকায় নাফিয়া।তাকাতেই দেখতে পায় ছেলেটার হাতে দু দু’টো সুগার ক্যান্ডি।একটি ক্যান্ডি খুলে তাতে সবে এক কামড় বসিয়েছে আফিম।নাফিয়া প্রথমে চমকে গেলেও এবার ঠোঁটে বড়সড় হাসি টেনে বলে ওঠে,
-সুগার ক্যান্ডি!!!
আফিম ভাব নিয়ে ব্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
-তো?
-আমার অনেকককক পছন্দ।
-তো?
নাফিয়া ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে,
-আমাকে একটি দিন না প্লিজ।
-নো।
-প্লিজ?
আফিম দ্বিগুণ ভাব দেখিয়ে বলে উঠলো,
-নো।
আফিমের কথাটি বলতে না বলতেই নাফিয়া ছোঁ মেরে একটি একটি কটন ক্যান্ডি নিজের হাতে নিয়ে নেয়।নাফিয়া এমন কিছু করবে তার জন্য আফিম মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।নাফিয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই মেয়েটি ফিক করে হেসে দেয়।ঠোঁটে দুষ্টু হাসি টেনে বলে ওঠে,
-সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বেঁকা করতে হয়।
-ওহ তাই!
কথাটি বলে আফিম নাফিয়ার দিকে তেড়ে আসার জন্যে অগ্রসর হতেই নাফিয়া দৌড়াতে আরম্ভ করে।ফুটপাতে তেমন মানুষ নেই দেখে দৌড়াতে অসুবিধে হলো না।নাফিয়ার পিছু পিছু আফিমও তাকে ধরার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়।উভয়ের ঠোঁটেই হাসি দৃশ্যমান।
ঠিক এমন সময়েই মেঘ গর্জে উঠে।ঝড়ের মতো বাতাস প্রবাহিত হয়ে বৃষ্টি আসার বার্তা দিচ্ছে।কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি নামবে।
আফিম-নাফিয়া উভয়ই দৌড় থামিয়ে আকাশ পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।বৃষ্টি নামার বার্তা পেয়ে ঠোঁটের হাসিটি আরো বৃদ্ধি পেলো নাফিয়ার।সে ঠোঁটে হাসি নিয়ে আফিমের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-আফিম,বৃষ্টি নামবে!আমি বৃষ্টিতে ভিজবো।
বলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে দু-হাত প্রসারিত করে নাফিয়া।আফিম তাকিয়ে আছে নাফিয়ার দিকে।তার ঠোঁটেও হাসি।কিন্তু হুট করে আফিমের মনে পরে সেদিন ওয়াশরুমে হওয়া ঘটনাটি।বৃষ্টিতে ভিজলে মেয়েটির জামা তার গায়ের সাথে লেপ্টে তাকে আবেদনময়ী করে তুলবে।তার শরীরের প্রতিটি ভাজ দৃশ্যমান হবে।নাফিয়ার এমন আবেদনময়ী রুপ একজন ব্যাতীত অন্য কোনো পুরুষের দেখার অধিকার নেই,মোটেও নেই।যদিও এই রাস্তায় মানুষ তেমন নেই তবুও এক-দুজন যারা আছে তারাও বা কেনো দেখবে?
এসব ভাবতেই আর সময় অপচয় করে না আফিম।নাফিয়ার হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে গাড়ির দিকে অগ্রসর হয় সে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here