আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে পর্ব -২২+২৩

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_২২
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

ভোরের পাখি ডাকছে। রাত বারোটার দিকে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হওয়ার পরেই যে যার বাড়ি ফিরেছে সবাই। সুজানার ঘুম পুরোপুরি ভাঙেনি তবে কাকপক্ষীর ডাক শুনতে পাচ্ছে।
মা ঘরের জানালা খুলে দিতেই ঘুমঘুম চোখে তাকালো সুজানা। মায়ের মুখ দেখে চোখে ঘষতে ঘষতে দিয়ে বলল

কয়টা বাজে আম্মা?

আটটা। আজ তো ভার্সিটি যাবিনা। আর কিছুক্ষণ পর উঠিস।

সুজানা গায়ে কাঁথা টেনে নিল। আজকে ক্যাম্পাসে যাবেনা, ঘুমও ভালো হয়নি। এখন না উঠাই ভালো। তবে, কিছু মুহূর্ত পার হতেই লাফ মেরে উঠে বসলো নিজেই । কাঁথা সরিয়ে নামতে নামতে বলল

আজকে না আমাকে অফিসে যেতে হবে । আমার অনেক কাজ আম্মা।

অফিসেও যাবি? টিউশনিতেও যাবি?

আজ তো ৩১ তারিখ। পড়িয়ে আসি আজ। আর আমার বলাও হয়নি উনাদের যে আজ থেকে আর পড়াতে যাব না। অফিসে দশটায় যাব। আমাকে যেতে বলেছে। জয়ন তো কাল থেকে।

সাজিয়া বেগম আশ্চর্যান্বিত চোখে চেয়ে রইলেন।

টিউশনিতে যাবিনা ওটা উনাদের আগে বলে রাখিসনি?

মা বলার সুযোগ সময় কোনোটাই হয়নি। আজ ওই বাড়িতে যাওয়ামাত্রই কথাটা বলে দেব।

উনারা কষ্ট পাবেন না? ধীরেসুস্থে বলে দিলে কি হতো?

সুজানা ওয়াশরুমে দরজা খুলে বলল

কষ্ট পাবেন না। সাইফ ভাই তো বলল অন্য কেউ পড়াতে যাবে কাল থেকে। আমি আবিদের আম্মুকে বুঝিয়ে বলব।

যা ইচ্ছে তাই কর।

সুজানা মুখ হাত ধুঁয়ে দোতলায় চলে গেল। কলিং বেল বাজাতেই রাশেদা বেগম দরজা খুলে দিলেন। সুজানাকে দেখে বললেন

তোকে ডাকতেই যাচ্ছিলাম।

সাইফ ভাই এখন আছে?

হ্যা এখনি বেরিয়ে যেত। যাহ কথা বলে আয়।

সুজানা সাইফের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। সাইফ ফাইলপত্র গুছানোর সময় সুজানা দরজায় টোকা দিল।

আসব?

আয়।

সুজানা ঘরে পা রাখলো। সাইফ বলল,

ফোন এসেছে?

না এখনো ফোন আসেনি।

ন’টায় দেবে তাহলে।

অফিসের বস কি মহিলা ?

হুমম । নইলে চাকরিটা তোর হতো না।

থ্যাংকিউ। আম্মাকে এজন্যই রাজী করাতে পেরেছি।

সাইফ হাসলো। বলল

ওই বাড়িতে বলে দিয়েছিস?

না। আজ বলব। ভাবছি ওনারা যদি রাগ করে?

রাগ কেন করবে? উনারা কি তোকে দশ হাজার টাকা বেতন দেবে? আজব! ওই অফিসে অনেক ছেলেমেয়ে কাজ করে। আমার বিশ্বাস আছে, তুই পারবি। কাজ কোনোদিন কম কোনোদিন বেশি থাকতে পারে। সবকিছুর আগাম প্রস্তুতি থাকা দরকার।

আচ্ছা।

সাইফ বেরিয়ে যাচ্ছিল। সুজানা বলল,

থ্যাংকিউ। তুমি না থাকলে কি যে হতো।।

সাইফ হেসে তার মাথা চাপড়ে দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল

বড় হয়ে গেছিস সুজু, তাই তোকে বিয়ে দিয়ে দেব।

সুজানা চেঁচিয়ে উঠে তার পেছনে ছুটে বলল,

তোমার মাথা।

আমার মাথা নয়। সত্যি।

বিয়ে তুমি করো। আমার বান্ধবীকে বসিয়ে রেখে আমার বিয়ে খাওয়া হচ্ছে?

তোর বান্ধবীকে তোর বিয়ে খাওয়াবো।

ধ্যাত।

সাইফ হাসতে হাসতে বেরিয়ে পড়লো।

রোজা এসে বলল

এই আপা তোমার বরের ছবি দেখাও।

কে বর টর? কে বলেছে এসব? কথাবার্তা হলেই বর হয়ে যায়? আরেকবার এসব বললে মেরে গাল লাল করে দেব। বে*য়া*দব।

রেগে বেরিয়ে গেল সুজানা। রোজা খিক করে হেসে উঠে বলল

আম্মা সুজু আপা রেগে গেছে হা হা।

মেয়েটা একদমই বিয়ে টিয়ের কথা শুনতে চায় না। আজব মেয়ে একটা।

সুজানা তিনতলায় গিয়ে ঘরে পা রাখলো। রান্নাঘরে গিয়ে চা নাশতা খেয়ে ঘরে গিয়ে সাদা আকাশী রঙা ব্যাগটা খুঁজে বের করে মেশিন ঘরে পা রাখতেই সাজিয়া বেগম বললেন

কি ওটা?

কাজ আছে আম্মা। আন্টির ব্লাউজগুলো আর কতদিন লাগবে?

অনেক কাজ। সবগুলো একসাথে দেব। এগুলো কার?

সুজানা অভিকের ট্র্যাকসুইটটা বের করে রাখলো। বলল

ওই বাড়ির ছোট কর্তার। লুজ হয় তাই ফিটিং করতে হবে।

ওদিকে রাখ। করে দেব।

নাহহহ।

বিস্মিত চোখে তাকালেন সাজিয়া বেগম।

কেন?

তোমার দক্ষ হাতের কাজ বুঝে যাবে। আমাকেই করতে হবে।

বুঝতে পারলাম না।

উনি আমাকে করতে বলেছে আম্মা।

সেলাই তো আমি করি।

আমি কি করে বলব কেন বলেছে? তোমাকে কষ্ট দিতে চায় না তাই বোধহয়। তুমি সরো আমি করে নেব।

পারবি না। আমাকে দে।

আম্মা স্যারের আদেশ মানতে হয়।

আচ্ছা, সাবধানে কিন্তু।

সন্দিহান চোখে চেয়ে রুমত্যাগ করলেন সাজিয়া বেগম। সুজানা ট্র্যাকসুইটা ফিট করে আগাগোড়া দেখলো। অনেক জায়গায় কুঁচকে গেছে। গেলে যাক। তাকে করতে বলেছে কেন? এসব কি তার কাজ?

____________________

ঘড়ির কাঁটা সাড়ে দশটার ঘরে। রোদের মাত্রা তীব্রতর। শাঁ শাঁ করে এগিয়ে যাওয়া গাড়ির পেছনে ধাওয়া করেছে ধুলো। পথচারী আর মানুষের কোলাহলে ব্যস্ত শহরে পথধুলোয় জর্জরিত সুজানা কয়েকবার কেশে নিল। সে অফিসের ঠিকানায় পৌঁছেছে বেশ খানিক্ষণ। সাহস পাচ্ছেনা এগোতে। পাশেই বসে আছে ক্লান্ত, ক্ষুদার্ত একটি কুকুর। জিহবা বের করে সুজানার দিকে তাকিয়ে হাঁপাচ্ছে। সুজানার মায়া হলো। ব্যাগের ভেতর থেকে বাটার বন বের করে ছুঁড়ে মারলো কুকুরটির দিকে। কুকুরটি গপাগপ খেয়ে তেড়ে এল সুজানার দিকে। ঘেউ ঘেউ করা শুরু করে দিল। সুজানা দোয়াদরুদ পড়ে বলল

কি সর্বনাশ! তোকে খেতে দিলাম বলে আমার দোষ হয়ে গেল? যাহ দূর হ। কি আজব ব্যাপার।

দ্রুত রাস্তা পার হয়ে গেল সুজানা। কুকুরটিও সাথে সাথে রাস্তা পার হয়ে গেল। সুজানার পেছন পেছন ছুটলো লেজ নেড়ে নেড়ে। সুজানা বিড়বিড়িয়ে বলল

মহাবিপদ তো। কেন আমার পেছনে লেগেছিস ভাই?

কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো। সুজানা চোখ তুলে সাদা বিল্ডিংটার দিকে তাকালো। দোতলায় যেতে বলেছে। পাশেই বিশাল একটি শো রুম। সাদা কাঁচ বাঁধা দরজা খুলে কেউ একজন উঁকি দিল বোধহয় আবার চলে গেল। সুজানা অফিসের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে না আর। গাড়ি বারান্দা পার করে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যাওয়ার সময় স্যুটবুট পড়া দু’জন পুরুষ মানুষকে দেখলো কথা বলতে বলতে নেমে আসছে। সুজানা সাইড চেপে দাঁড়িয়ে পড়লো। লোক দুটো তার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। সুজানা দোতলায় উঠতেই হ্যাংলা পাতলা একটা ছেলে এসে বলল

আপনিই কি সুজানা?

জ্বি।

আমার সাথে আসুন।

সুজানাকে ছেলেটা একটা অফিসরুমে নিয়ে গেল। অনেকেই ডেস্কে বসে আছে। ল্যাপটপে মনোযোগ। সুজানা সবাইকে ঘুরেফিরে দেখে নিল। সুজানা ডেস্কে গিয়ে বসার কিছুটা পরেই দরজা দিয়ে রূপবতী এক মহিলাকে ঢুকতে দেখা গেল। পড়নে মেরুন রঙা বোরকা, মাথায় সোনালী রঙা ঝমকালো হিজাব। প্রসাধনী ও হিজাবের উপর পরিহিত অলংকার। সুজানা ভেবেই নিল, ইনি নিশ্চয়ই কোনো মডেল হবে। মহিলা চলে গেল কর্মীদের সাথে কথা বলতে বলতে। সুজানাকে কিছু পরেই ডাকা হলো।

অফিসের দরজা খুলতেই কিছু আগের দেখা সেই মহিলাকে দেখে খানিকটা চমকালো সুজানা। ইনিই কি নীলাশা মজুমদার?

মে আই কাম ইন?

আসুন।

সুজানা ভেতরে পা রাখতেই নীলাশা মজুমদার চোখ তুলে তাকালো। কলম ঘুরিয়ে বলল

সাইফ ওয়াহিদের বোন আপনি?

জ্বি।

গুড। উনি আপনার কথা বলেছিল। বসুন, আপনার পোর্টফলিও নিয়ে এসেছেন সাথে করে? আইমিন রিসেন্ট ডিজাইন করেছেন এমন কিছু?

জ্বি, এনেছি।

দেখান।

জ্বি।

সুজানা ডিজাইন গুলো দেখাতেই উনি বললেন

আরও ইমপ্রুভমেন্ট দরকার। বাট নো প্রবলেম, আপনার টিম লিডার আপনাকে গাইড করবে। আপনি কাল থেকে জয়ন করবেন। আর এখন আমি আমার সেক্রেটারিকে বলে দিচ্ছি ও আপনাকে অফিস ঘুরিয়ে দেখাবে। আমাদের এখানে সবাই স্টুডেন্টরা কাজ করে । আপনার কোনো সমস্যা হবে না।

সুজানা মাথা দুলালো।

আপনি সিইউতে পড়েন?

জ্বি।

গুড। রাজন?

দরজার কাছ থেকে জবাব দিল একজন।

জ্বি ম্যাডাম।

উনাকে সবটা ঘুরিয়ে দেখাও। আর গাড়ি আসলে খবর পাঠিয়ে দেবে নইলে আমার দেরী হয়ে যাবে।

ওকে ম্যাডাম। সুজানা আপনি আসুন।

সুজানা উঠে এল। অফিস থেকে বেরিয়ে বড়সড় দম ফেললো। বাবারে দমটা আরেকটুর জন্য আটকে যাচ্ছিল।

____________________

আছরের নামাজ-কালাম সেড়ে চায়ের আড্ডা বসেছে কুঠির বাড়িতে। অনা আর আবিদ টিচার আসবেনা তাই খুশিতে দলছুট খেলছে। আহনাফ, আজাদ আর আজীম সাহেব মমতাজ বেগমের সাথে বসে খোশগল্পে মেতে ছিল। সবার কাজের ছুটি মিললে মাঝেমধ্যে এমন খোশগল্পের আসর বেশ ভালোই জমে উঠে তাদের। কতশত কথার ঝুপড়ি মেলে তখন।
বাচ্চাদের ছোটাছুটি দেখে তাদের সতর্ক করলো আনজুমা বেগম।
আজাদ সাহেব ডাকলো

ভাই চা খেতে আসো। দৌড়াদৌড়ি রাখো। আজ কি ওদের মাস্টার আসছেনা?

সালমা বেগম টি টেবিলে ট্রে রাখলেন। বললেন

কাল বিয়ে বাড়ি থেকে গিয়ে ঢুসে ঢুসে ঘুমোচ্ছে নিশ্চয়ই। আমার ব্লাউজগুলো কখন আনবে কে জানে?

আনজুমা বেগম হেসে বললেন

ও বিয়েশাদি নাকি এখন করবে না। ওর মা কাল ক্লাবে আমায় বললো। বিয়ের কথা শুনলেই নাকি কেঁদেকেটে সাগর বানিয়ে ফেলে। আর ওদিকে বড় ভাবি ছোট’র মতো ছেলের বিয়ে নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। সুজানা ভারী ফেঁসে গেছে। আর এদিকে আমাদের অভিটার কি হবে?

সালমা বেগম রুক্ষ গলায় বললেন

সবাই সুজানার মতো হবে নাকি?

আমি সেটা কখন বললাম? পড়ালেখা করে ওরকম মেয়ে সহজেই বিয়ে নিতে চায় না আজকাল। পড়ালেখা শেষ করতে চায় আর কি। আশিকও বিয়েশাদি করবেনা বলে অনেক কান্ডকারখানা করেছে। শেষমেশ যাও রাজী হলো সুজানা বেঁকে বসেছে। আমরা তো এখানে আসলে কেউ কিছু বলতেও পারিনা।

আমি পড়ালেখা করে ওরকম মেয়েই অভির জন্য আনব আপা । তোমার বড় ভাবিকে সুজানার জন্য হা করে বসে থাকতে বলো।

আজীম সাহেব চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে বলল

কথাবার্তা কতদূর এগিয়েছে?

অত এগোয়নি। মেয়ের পক্ষ থেকে এখনো স্পষ্ট উত্তর আসেনি। তাই কিছু বলা যাচ্ছেনা।

আহনাফ বলল

সুজানাকে রাজী করানোর দায়িত্ব তো আনিকার। আজ না হোক কাল তো বিয়ে করতেই হবে। তাছাড়া ওদের তো ভালোই লাগবে। কথা এতদূর গেল আমি তো জানিনা।

মমতাজ বেগম হেসে বললেন

আমাদেরকে, কে অতসব জানানোর প্রয়োজন মনে করে দাদুভাই?

আনজুমা বেগম জিভে কামড় দিয়ে বললেন

ছিঃ মা কি বলছেন এসব? আওয়াজ করছিনা কারণ মর্জিনা একটা কথাকে দশকান করে তাই। আজ বাড়িতে নেই তাই বলছি। সুজানার মা’ই বারণ করলো আপাতত ব্যাপরটা খোলাসা না করতে। উনি সিদ্ধান্ত জানাবেন খুব তাড়াতাড়ি। আর কথাবার্তা হয়ে পরবর্তী ভাঙন হলে মানুষে মেয়েকে ঘিরে বাজে কথা বলে। তাছাড়া ওর বাবা নেই, তাই ওর মা চিন্তায় থাকে আর কি। সুজানার পুরোপুরি সমর্থন পেলেই উনি জানাবেন বলেছেন।

ভালোই। তোমার ভাইয়ের বউয়ের চোখের প্রশংসা করতে হয়। ভালো মেয়েকেই পছন্দ করেছে ছেলের জন্য। সুজানার তো আর কোনো ছেলেপেলে পছন্দ নেই।

সালমা বেগম কথাটা শুনে বললেন

কথাটা কি আমাকে বললেন মা? আমি পছন্দ করি অমন মেয়ের ছেলেপেলের পছন্দ থাকে?

বৌমা এখানে সুজানা আর আশিকের কথা হচ্ছে। আমার দাদুভাইয়ের নয়। কেন তুমি ওকে টানছো শুধু শুধু?

আহনাফ বলল

আচ্ছা ও কোথায়? একবারও নীচে এল না।

আনিকা আর অভিক একত্রে এল ছাদ থেকে।

চারা লাগাচ্ছিলাম ছাদে।

অভিক পানি ভর্তি গ্লাস হাতে নিয়ে মমতাজ বেগমের পাশে বসলো। পানি মুখে দেয়ার আগে জানতে চাইলো…

কিসের কথা হচ্ছে এখানে?

মমতাজ বেগম বললেন

আমরা বিয়ের কথা বলছিলাম দাদুভাই। তোমার আর সুজানার।

পানি ছুটে গিয়ে সামনে ছিটকে পড়লো অভিকের মুখ থেকে। কেশে উঠতেই সালমা বেগম ছুটে গিয়ে মাথায় চাপড় দিতে দিতে বলল

আহ মা কিসব আজেবাজে কথা বলেন?

আমি বলেছি

অহ, আমার ভুল হয়ে গেছে দাদুভাই। কথাটা ওভাবে বলতে চাইনি।

সুজানা আর আশিকের বিয়ের কথা বলছিলাম।

কাশি আরও দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কাশতে কাশতে দাঁড়িয়ে পড়লো অভিক। সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো মুহূর্তে। সালমা বেগম দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁ দিয়ে বলল

ওমা হুট করে এ কেমন কাশি উঠে গেল অভি? চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে।

আনজুমা বেগম বললেন

অভি, একটু বস। হুট করে কাশি কি করে উঠে গেল? বোস না।

অভিক বসলো। কাশতে কাশতে গলার শিরা ফুলে উঠেছে । আনিকা পানি এনে বলল

নে নে পানিটা ধীরেসুস্থে খাহ আগে।

সদর দরজা মেলে দ্রুত ঢুকে এল সুজানা। বলল

ইশশ, খুব দেরী হয়ে গেল। রিকশা পাচ্ছিলাম না আজ। তাই….

পরক্ষণে বাড়িভর্তি লোককে একসাথে দেখে খানিকটা বিস্ময় নিয়ে প্রত্যেকের দিকে তাকালো এক-এক করে বিমূঢ় চোখে। থমকে গেল রক্তবর্ণে রঞ্জিত অক্ষিপটে চোখ পড়ায়। কয়েকটা শুকনো ঢোক নেমে গেল স্বরনালীর নীচ দিয়ে।

উনার চোখমুখের অবস্থা এমন কেন? সে কি আজও ভুল সময়ে এসে পড়েছে?

সালমা বেগম ভেঁজা চাহনিতে ছেলের দিকে তাকালেন। সুজানা এই কাশির ঔষধ?

চলবে………..#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_২৩
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

সবার উদ্বেগ চাহনিতে সুজানা বেশ বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পড়ে গেল। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সুজানা সবার মুখ দর্শন করে নিল আরও একবার। এখানে কি কিছু হয়েছে?

আবিদ তাকে দেখে ছুটে গেল। আঙুল টেনে ধরে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল

সুজান আছকে ছুতি নাই?

সুজানা তার সাথে মৃদু হাসলো। দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো “নাই “।

অনা গিয়ে বলল

সুজান অভির কাচি। অচুখ।

আবিদ গ্লাস দিয়ে পানি খাওয়ার মতো দেখিয়ে বলল

অভি পানি খাচচে, তাপোর কাচি উঠি গেচে । চুখ লাল হয়ি গেচে।

কথাগুলো শুনে সুজানার হাসি পেলে সে চুপ থাকলো। অন্যকিছু ঘটেছে এখানে। সে বেশ বুঝতে পারছে। কাশি উঠলে চোখ লাল হয়, চাহনি দুর্বহ নয়। সুজানা এতগুলো দিনে এটুকু বুঝেছে অভিক ফারদিনের চোখ তার দিকে এলেই মায়ার সাগরে পরিণত হয়। সুজানা সেটাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে বারবার। ছাত্রী হিসেবে স্নেহের চোখে অবশ্যই দেখতে পারে কিন্তু অমর্ষ চাহনিতে সেই তাকায় যার প্রবল অধিকারবোধ থাকে।

কিন্তু সুজানা কি এমন করেছে? আজকাল তার অনুপস্থিতিতে তাকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয় তা বেশ বুঝতে পারছে সে।

আরেহ ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন।

আনিকার কথায় ধ্যান ভাঙলো সুজানার। আবিদের হাত ধরে এগিয়ে যেতেই খুকখুক করে কেশে উঠলো অভিক। সে আবারও থেমে গেল। সালমা বেগম ছেলেকে হাত ধরে টেনে সোফায় বসালেন। পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললেন

পানিটা খা অভি। কথা শুনিস না আমার।

অনা কপালে হাত দিয়ে বলল

অভি তুমার বিশি অচুখ?

আনিকা বলল

হ্যা, অচুখ। আপনি ম্যাডামকে নিয়ে উপরে যান। অনেক খেলেছেন আজকে।

আচচা। সুজান চোলো চোলো ।

সুজানা তাদের সাথে যাওয়ার সময় আরও একবার তাকালো পিছু। তারপর সোজা হেঁটে চলে গেল।

সুজানা যেতেই মমতাজ বেগম বড়সড় একটা দম ফেলল। সালমা বেগম বললেন

মা আপনি কথা বলার সময় একটু হুশিয়ারে বলবেন। মুখে যা বলে আসে তা বলে দিলে তো হয় না।

বৃদ্ধা পানের মধ্যে সুপারি আর চুন লাগাতে লাগাতে বললেন

হ্যা, আমিই ভুল। তুমি সঠিক বৌমা। ছোট খোকা তোর বউকে বলে দে চোখ কান যেন খোলা রেখে চলে। কিছুদিন বাদে তো ছেলের বউ আসবে। নিজেও শ্বাশুড়ি হতে যাচ্ছে। আমার চাইতেও খারাপ শ্বাশুড়ি যেন নয় হয় তোর বউ।

বলেই তিনি দিয়ে চলে গেলেন ধীরপায়ে হেঁটে।

সালমা বেগম আজীম সাহেবের দিকে তাকালো। বলল

মা কি বলে গেল?

মায়ের বয়স হয়েছে। সব কথা কানে নিতে নেই সালমা।

______________________

সবগুলো পড়া একেবারে শুরু থেকে পড়িয়ে দু’জনকে ছড়া পড়তে দিল সুজানা। ওরা বইয়ে আঙুল টিপে পড়তে পড়তে সুজানার দিকে মুখ তুলে তাকালো। সুজানা বলল

একটা কাজ করতে পারবেন সুজানের জন্য?

তারা উৎসুক হয়ে তাকালো। সুজানা ব্যাগ থেকে অভিকের ট্র্যাকসুইটটার শপিং ব্যাগ বের করে বলল

এটা চাচ্চুকে দিয়ে আসুন।

অভি?

হুম?

সুজান অভির জুন্য কাপুড় আনচে?

হুমম।

আচচা।

আবিদ বলল

না। আমি যাবো।

সুজানা বলল

আচ্ছা আচ্ছা বাপু। দুজনেই নিয়ে যান। এক্ষুণি চলে আসবেন কিন্তু। হ্যা?

ওরা দুজনেই চলে গেল দৌড়ে। কিছু পরেই ফিরে এল ব্যাগটা হাতে নিয়ে। সুজানার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল

অভি বুলচে নিবেনা।

কেন নেবে না? এটা ঠিক করে দিয়েছি তো। বলবেন এটা সুজানা নিয়ে যাবেনা আর।

নাহহ অভি বুলছে সুজানকে যিতে।

আমাকে যেতে?

হুমম।

কপাল হাত দিল সুজানা। ব্যাগটা কেড়ে নিয়ে বলল

ওকে যাওয়ার সময় দেব।

হাতভর্তি ইমিটিশনের চুড়ি আর নতুন কানের দুল নাকের দুল পরিহিত মর্জিনা ট্রে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। টেবিলের উপর ট্রে রেখে বলল

বাপের বাড়ি থেকে মাত্রই ফিরলাম। এই বাড়ির মানুষ আমারে ছাড়া আন্ধা বুঝলা?

সুজানা হাসলো।

আপনাকে তো আজ সুন্দর লাগছে।

ছোটবাবু ও বলছে আমারে নাকি নতুন মেহমানের মতো লাগতেছে। কিন্তু মেহমান ভেবে কেউ তো আর বসায় বসায় একবেলা খাওয়াবো না। নতুন শাড়িডাও বদলাইতে পারলাম না, কাজ আর কাজ। বাপরে বাপ। নাও তোমার খানা। খাইয়্যা লও।

মর্জিনা যেতেই আবিদ গাল চেপে হেসে বলল

মুজ্জিনা লাল চাড়ি পচছে।

সুজানা ফিক করে হেসে উঠে বলল

আল্লাহ ওটা দাদু।

মুজ্জিনা দাদু।

সুজানা আবারও হেসে উঠে গাল টেনে দিয়ে মগ তুলে চুমুক বসাতেই ব্যাতিক্রমী স্বাদ লাগায় নাকমুখ কুঁচকে নিল। টের পেল তা কফি নয়। এত সুন্দর হয়েছে চায়ের রঙটা তাও বিস্বাদ ঠেকলো সুজানার কাছে। ঠিক ওই চোখের চাহনি যেমন ছিল।

_______________

রান্নাঘরে বাজার ঢোকায় আনিকা আসতে পারলো না। মর্জিনার মাধ্যমে খবর পাঠালো সুজানা যাওয়ার আগে যেন দেখা করে যায়। সুজানা অনা আর আবিদকে পড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিল। কখন আবার দেখা হয় তাদের সাথে। তারা এত আদরের মানে বুঝলো না তবে খুশি হয়ে সুজানাকেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সুজানা তাদের আদর করা শেষে অভিকের ঘরের দিকে উঁকিঝুঁকি দিল। ঘরটা হালকা আলোকিত। জানালার বাইরে বহুদূরে সন্ধ্যার তারাবিহীন খোলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। রিগ্যাল রকিং চেয়ারটা দুলছে। সুজানা ভেবেছিল হাওয়ায় দুলছে ওটি, খেয়াল করে দেখলো আসনটি একজন দখল করে বসে রয়েছে। বুঝতে বেগ পেতে হলোনা কে হতে পারে। নিশ্চিন্ত মনে প্রশ্ন করলো

ট্র্যাকসুইটটা কি রিডিংরুমে রেখে যাব, স্যার?

দুলতে থাকা রকিং চেয়ারটার স্পীড কমে এল। কিছুপরেই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো অভিক। হেঁটে গিয়ে ঘরের বাল্ব জ্বেলে দিয়ে বলল

ভেতরে আসুন।

সুজানা ভেতরে পা রাখলো। অভিক ফোনের চার্জার সরিয়ে, ল্যাপটপ চার্জিংয়ে রেখে বলল

বেডের উপর রাখুন। আপনার পারিশ্রমিক কত?

সুজানা ব্যাগটা বেডের উপর রেখে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়ে বলল

উম ওটার জন্য পারিশ্রমিক লাগবে না।

দাঁড়ান। যাবেন না।

সুজানা সত্যি সত্যি গেল না। দাঁড়িয়ে থাকলো। তবে ধাতে ভীষণ লাগলো তার। আর জীবনেও কোনো কাপড়চোপড় নিয়ে যাবেনা সে। যদিও আজকের পর এই বাড়িতে কখন আসবে সে জানেনা।

অভিক ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলতেই বেডসাইড টেবিল কেঁপে উঠলো ফোনটা বেজে উঠলো। ড্রয়ার থেকে সাদা কাগজে নিয়ে ফোনটার দিকে তাকিয়ে একপলক সুজানার দিকে তাকালো। সুজানা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অভিক ফোনটা রিসিভ করে লাউড স্পিকার করে দিল। সাইফ ওয়াহিদের এ সময় কি প্রয়োজন হতে পারে?

দুপাশেই সালাম আদান-প্রদান হলো। সুজানা অন্যদিকে মনোযোগ রেখেছে আচমকা পরিচিত গলার আওয়াজ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল সে। সাইফ ভাই ফোন করার সময় আর পেল না?

অভিক ফারদিন বলছি। আপনি সাইফ ওয়াহিদ?

জ্বি। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।

বলুন।

আমাদের টিমের একজন সদস্য আপনার বাচ্চাদের পড়িয়েছে গত একমাস। কাল থেকে অন্য একজন যাবে।

অভিক সুজানার দিকে অত্যাধিক বিস্ময় তাকালো। সুজানা তাকে পিছু করে কাঁচুমাচু করে দাঁড়ালো।

যিনি পড়াতেন উনি কেন আসবেন না আর?

ওহ হ্যা, তার অন্য কোথাও চাকরি হয়েছে। সে টিউশনিটা করতে চায় না তাই। কাল থেকে একটা ছেলে যাবে পড়াতে। আশা করি আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না।

জ্বি। রাখতে পারেন।

কলটা টুট টুট করে কেটে গেল। সুজানা ধীরেধীরে সামনে ফিরলো। চোখ ফ্লোরে রেখে বলল

আমি বলতেই যাচ্ছিলাম আবিদের আম্মুকে। কাল যিনি পড়াতে আসবেন তিনি আমার চাইতেও ভালো পড়ান।

অভিক কোনোরূপ প্রশ্ন করলো না। বলল

নীচে যান। আপুর সাথে যা বলার বলে নিন, আপনার পারিশ্রমিক নীচে গিয়ে হাজির হবে।

সুজানা মাথা নেড়ে রুমের বাইরে বেরিয়ে গেল। অভিক দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ডাকলো

সুজানা! আমার প্রশ্নের উত্তর।

সুজানা শুনলে নিশ্চয়ই ফিরতো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here