আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে পর্ব -২৪+২৫

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_২৪
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

সুজানার বক্তব্য শুনে সবাই অসীম বিস্ময় নিয়ে তাকালো একে অপরের দিকে। সবার বিস্ময়কর চাহনি দেখে সুজানা বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল। সবার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। আনিকা মুখ খুললো অনেক্ক্ষণ পর। ভারমুখে বলল,

মাত্র তো একমাস পড়ালেন। এটা ভারী অন্যায় হয়ে যাচ্ছে সুজানা।

সুজানা ধীরেসুস্থে বুঝিয়ে বলল

চাকরির পাশাপাশি ওদের পড়ানোটা খুবি টাফ হয়ে যাচ্ছে। নইলে যে করেই হোক পড়াতাম। সমস্যা নেই ওদের যে পড়াবে উনি অনেক ভালো পড়ায়।

সালমা বেগম এতক্ষণ চুপ ছিলেন। এবার সামনে এসে বললেন

তোমাকে দেখে তো মনে হয় ভাজা মাছ একদম উল্টে খেতে জানোনা। টিউশনি ছেড়ে দেবে এটা তো একবারও কাউকে বললে না। একটু ভালো পড়ায় বলেছে তাই দামে উঠে গেছ তাই না?

সুজানা কাঁচুমাচু করে মাথা নামিয়ে নিল। পেছন থেকে বৃদ্ধা ডাক দিয়ে বললেন

ছোট বৌমা মেয়েটা তোমার বাড়িতে আর আসবে? কেন এভাবে বলছ? শেষবার একটু মিষ্টি করে কথা তো বলতে পারো।

সালমা বেগম মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। এই মেয়ে এই বাড়িতে শেষবার কখনোই হতে পারেনা। এই মেয়ে উনাকে না জ্বালিয়ে এত সহজে ছাড়বে না। অসম্ভব।

অনা আর আবিদ দু হাতে মিনি কেক খেতে খেতে সুজানার কাছে এল। বলল

সুজান কালকে আসবেনা?

সুজানা মলিনমুখে সবার দিকে চোখবুলিয়ে খানিকটা নীচু হয়ে তাদের আদর করলো। বলল

আসব কোনো একদিন। আপনাদের কি করে ভুলি?

আচচা।

সুজানা মমতাজ বেগমকে সালাম করে বলল

আসি দাদু। ভালো থাকবেন। চুলের রঙ কিন্তু খুব গাঢ় হয়েছে।

বৃদ্ধা হেসে উঠলেন। বললেন

আমার ছোট দাদুভাই এনেছে মেহেদীটা। ভালোই রঙ। এই দেখো হাতটাও লাল হয়ে গেছে। তুমি কিন্তু মাঝেমধ্যেই এসো। আজ হোক কাল আত্মীয়ের বাড়িতে তো বউ হতে যাচ্ছ। বিনা দ্বিধায় আসতে পারো তুমি।

সুজানা মেকি হাসলো। আনজুমা বেগমকে সালাম করতে যেতেই উনি আটকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সুজানার মুখে হাত বুলিয়ে বললেন

এমন মেয়ে ঘরে ঘরে হোক। তোমার মা কত লাকি জানো?

আমি ভীষণ লাকি যে আমার আম্মা আমাকে সবকিছুতে সাপোর্ট করে। আম্মার জন্য দোয়া করবেন।

হ্যা অবশ্যই দোয়া। খুব ভালো থেকো। আমার বোনের চোখে একদম খাঁটি সোনা ধরা পড়েছে। ওর বাড়ি আলোকিত করে দেবে তুমি।

সুজানা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। আনিকা বলল

বড়মামী মায়ের ছোট বোন সুজানা। আমার সম্বন্ধ বড়মামীই নিয়ে গিয়েছিল।

ওহহ, আচ্ছা।

আনজুমা বেগম বললেন

কি আজব মেয়ে তুমি? মায়ের কাছ থেকে কিছুই জেনে নাওনি। এমন হলে চলে? বিয়ে, স্বামী আর সংসার এগুলোর জন্যই তো নারী জাতিদের এত লড়াই, এত সংগ্রাম। তোমার মাকে দেখো।
অবশ্য এখন এই বয়সটাতে ওসব গুরুত্বহীন মনে হতেই পারে তবে একদিন অনেকদূর অব্দি শেকড় গেঁড়ে গেলে না, পিছু ফিরে তাকাতেই হবে। মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারবেনা আর।

সুজানা বড়সড় একটা দম ছেড়ে দিল খুবই গোপনে। পিছুটান? পিছু ফিরে তাকালেই সে শুধু একটি নক্ষত্র দেখতে পায়। ওই সেগুন বাগিচার বৃষ্টিভেজা শেষবিকেলটা তার জন্য দায়ী।

আর একমুহূর্তও দাঁড়াতে চাইলো না সুজানা। চলে যেতেই উদ্যত হতেই সালমা বেগমের গোমড়া মুখ তাকে যেতে বাঁধা দিল। তারউপর এই মহিলার এত রোষ কেন? ছেলের চোখে সুজানার জন্য মায়া দেখা যায় বলে?

সুজানা সালাম করে বলল

সেলাই শেষ হলে কাপড়গুলো আমার ভাইকে দিয়ে পাঠিয়ে দেব আন্টি । আমার উপর কি রেগে আছেন আপনি?

সালমা বেগম চোখ তুলে সরাসরি চাইলেন সুজানার দিকে। মিনমিন করে বললেন

কোনো রাগ নেই। যেখানেই থাকো ভালো থাকো। তোমার অত সাধ্যি নেই আমাকে খুশি করার। তাই রেগে আছি কিংবা রাগ আছে ধরে নিলে কোনো সমস্যা নেই।

সুজানা নিজেকে সামলে নিল। এগিয়ে গিয়ে আনিকাকে বলল

আপনি ছোট একটা কেক চেয়েছিলেন। আমি আমার ভাইকে দিয়ে পাঠাবো। এক পাউন্ডের দিলেতো দিলে তো সবাই খেতে পারবেনা। তাই তিন পাউন্ডের একটা বানিয়ে পাঠিয়ে দেব। আমার উপর রাগ রাখবেন না। আমি নিরুপায়। আর আমাদের বাসায়ও যেতে পারবেন। যাবেন কেমন?

আনিকা মাথা দুলালো। চেষ্টা করব।

মমতাজ বেগম বললেন

আমাদের তো যেতে বললে না বোন।

সুজানা জিভের মাথায় কামড় বসিয়ে বলল

আপনিও যাবেন উনাদের সাথে।

যাব যাব। তোমার বিয়ে খেতে যাব। আমি কনেপক্ষে থাকব আর কি।

সুজানা সেসব কথা এগোতে দিতে চাইলো না। এসব কথা শুনে তার অস্বস্তি বাড়ে। আম্মাকে এবার পুরোপুরি বারন করে দেবে সে। কোনো বিয়ে-শাদির কথাবার্তা যেন তার সামনে না বলে।

মর্জিনা একটা কাগজ এনে উশখুশ করতে করতে সবার দিকে তাকালো। সুজানার পাশে এসে বলল

নাও তোমার জিনিস। বাবুর কাপড় সেলাই করে আনছো তার পারিশ্রমিক।

সুজানা দোতলায় তাকালো একপলক। শূন্য রেলিঙ। কাগজটা নিয়ে হাতের মুঠোয় পিষে নিয়ে বলল

আসি কেমন? বাবুরা আসি।

অনা আর আবিদ কার্টুন দেখা বন্ধ করে সুজানার দিকে চাইলো পিটপিট করে। সুজানা দরজার কাছে গিয়ে আরও একবার ফিরে চাইলো। অজানা কারণে চোখদুটো ভিজে উঠছে বারবার। যেন নোনাজল উতলে উতলে উঠছে। বন্ধনহীন মানুষগুলোর জন্য মনটা কেমন করছে। বন্ধন থাকলে কি হতো?

দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল সে। বাড়িটার গেইট পেরিয়ে গেল কিন্তু কেউ পিছু ডেকে জানতে চাইলো না “আপনি একা যেতে পারবেন “?

ঘোর সন্ধ্যার তারাবিহীন আকাশের নীচে ছাদের এককোনায় সুজানার সংজ্ঞায়িত সেই নক্ষত্রটি তখনো তার যাওয়া দেখছিল নিশ্চিন্তে।

ড্রাইভারকে দিয়ে কাছাকাছি একটা রিকশা রাখার বন্দোবস্তটা কিছুদিন আগে থেকে চালু হয়েছিল। আজ তার ইতি।

রিকশা পাওয়ায় বাড়ি পৌঁছুতে দেরী হলো না সুজানার। কারো সাথে কোনোরূপ কথা না বলে রুমের দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়েছে ক্লান্তি মেটাতে। হাতের মুঠোয় কাগজটা রয়ে গেছে এখনো। খুলতেই একটা একশ টাকার নোট পেল। সামান্য কাজটার জন্য একশ টাকাও অনেক বেশি। অকারণে চোখের কোণায় এসে জমা জলটুকু মুছে সুজানা কাগজটা ভালো করে মেললো সন্দেহের সাথে। কিছু লেখা থাকবেই। তার সন্দেহ মিলে যাওয়াতেই অবাক হলো না সে। কাগজটা মেলতেই দেখলো লেখাগুলো ভেসে উঠলো গুটিগুটি অক্ষরে।

নতুন জীবন, নতুন চাকরি সবকিছুর জন্য শুভকামনা। পড়াশোনায়ও মনোযোগ রাখবেন। চেনাজানার খাতিরে আপনার পরীক্ষার খাতাটা আমি আলাদা করে খুঁজে নিতে পারি । কিন্তু লেখার চাইতে বেশি নাম্বার দিতে পারিনা। আপনি আমার একটা ভালো ছাত্রী সুজানা। আপনার উপর বিশ্বাস আছে আমার।

সুজানা কাগজটা মোচড়ে নিল। ডুকরে কেঁদে উঠলো আপনাআপনি।

______________________

অনেকগুলো দিন পর বটতলী রেলওয়ে স্টেশনে বন্ধুমহলের ভীড় জমে উঠেছে। রঙিন শাটলে জানালা দিয়ে মুখ বের করে উদাসী হয়ে তাকিয়ে থাকতেই বন্ধুদের চোখে পড়লো সুজানাকে।
শান্তা জানতে চাইলো

কি হলো দোস্ত? কোনো সমস্যা?

সুজানা মাথা দুলালো দুপাশে। বলল

উহুম, অনেক নোট বাকি পড়ে আছে। অনেক পড়াও জমে গেছে। কখন কি করব কে জানে? পরীক্ষার দিনও এগোচ্ছে। এত প্যারা আর নেয়া যাচ্ছেনা।

মেহুল বলল

তুই ওসব নিয়ে ভাবছিস কেন? আমরা সবাই তোর দলে। অনেক পড়া জমিয়ে ফেলেছি। তাই বলে টেনশন করে মাথা নষ্ট করার কোনো মানে আছে?

শান্তা বলল

আরেহ চাপলেস থাক দোস্ত।

আহির বলল

আজ থেকে তোর চাকরিতে জয়ন না?

হুমম।

অভিক স্যারের বাড়ির টিউশনিটা ছেড়ে দিলি?

হুমম।

সবাই একে অপরের দিকে তাকালো।

তোর নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।

মেহুল বলল

আমি সাইফের কাছ থেকে শুনেছি কিছু।

সুজানা বিস্ময় নিয়ে বলল

কি শুনেছিস?

সবাই কৌতূহলী হয়ে তাকালো।

নিখিল বলল

কি? বিয়ে টিয়ে নাকি? তারমানে বিয়ে জমবে? ওরেহ মেহুল তোর আগে সুজানা তো..

সুজানা থামিয়ে দিয়ে বলল

চুপ করবি তোরা? নাকি নেমে যাব?

সবাই চুপ করে বসলো।

কোনো বিয়েটিয়ে আমি এখন করছিনা। হ্যা এটা সত্যি কথাবার্তা হচ্ছিল। মেহুলেরও তো এমন হয়। এখানে নাচানাচির কি আছে? তোরা চাস আমার বিয়ে হয়ে যাক এখন?

একদম না বান্ধবী।

তাহলে একদম চুপচাপ থাক।

জায়িন বলল

এক পড়ালেখা মাথা নষ্ট করে দেবে ভাই। তারমধ্যে তোরা বিয়ে-শাদির কথা ভাবিস কি করে সেটাই বুঝিনা।

নিখিল তার মাথা চাপড়ে দিয়ে বলল

মেয়ে হলে এতক্ষণে আমি চার বাচ্চার মা হইতাম শ্লা। কোনোকিছুর চাপ নাই। শুধু ওয়াহ ওয়াহ সামলাও। কিন্তু আফসোস আমারে কেউ বিয়ে করার কথা বলেনা।

সবাই হেসে উঠলো একসাথে। সুজানাও হেসে উঠলো তাদের সাথে।

নিখিল হাসতে হাসতে বলল

মেয়েরা বিয়ে বললে নিজেরাই কাঁদে, আর ছেলেরা বিয়ের কথা বললে ছেলের বাপ মা কাঁদে।

সবাই আরেক দফা হেসে উঠলো।

সুজানা হাসি থামিয়ে বলল

থামবি! সারাক্ষণ কেমনে ফাইজলামি করিস।

পুরোটা পথ বন্ধুমহলের মাতামাতির হাসাহাসির তালে কেটে গেল।

ক্যাম্পাসে পৌঁছে ক্লাসের দিকে ছুটলো সবাই সময় দেখে। সুজানা পুরো তিন চারটা ক্লাস করলো এক নাগাড়ে। একটা ক্লাসেও তার মন বসলো না।

_____________

চায়ের ট্রে’র মাঝখান থেকে কফির মগটা নিয়ে অভিকের দিকে বাড়িয়ে দিলেন সালমা বেগম । বলল

অভি কফিটা নে।

অভিক কফিটা নিল এক হাতে অন্য হাতে ফোন। সালমা বেগম উঁকি দিয়ে বলল

ফোনে কাকে দেখছিস?

অভিক মায়ের প্রশ্নে চোখ তুলে তাকালো। ফোনটা দেখাতেই সালমা বেগম দেখলেন ইংরেজি ভাষায় কি কতগুলো লেখা। আজিমুল ফারদিনের পাল্লায় পড়ে লেখাপড়া ছেড়ে এই বাড়িতে বসতি গড়েছে সেই কখন, পড়ালেখা সব ভুলার পথে অত ইংরেজি মাথায় ঢুকেনা আজকাল।

অনা আর আবিদ এসে অভিকের গলা জড়িয়ে ধরলো।

অভি অভি কিকেট খিলবো।

এখন পড়ার সময় জুনিয়র। রিডিংরুমে যান। টিচার আসবে।

সুজান আচবে না।

অন্য টিচার আসবে।

না, যাবু না।

আনিকা এসে বলল

যাও দু’জন গিয়ে চুপচাপ পড়তে বসো। নইলে তোমাদের পাপাকে ফোন দিচ্ছি। বলব আসার সময় যাতে কিছু না আনে। খালি হাতে ফেরে।

আম্মু পোঁচা।

হ্যা পঁচা। যাও পড়তে যাও। সুজানকে বলব খুব মার দিতে।

সালমা বেগম বললেন

সুজানা?

আনিকা থমকে গেল।

ওহ সরি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। অভি এদের কিছু বল।

কলিং বেল বেজে উঠলো তক্ষুণি। মর্জিনা দৌড়ে গিয়ে খুলে দিতেই শ্যামবরণ হ্যাংলা পাতলা একটা ছেলেকে দেখে বলল

পড়াতে আসছো?

জ্বি।

অভিক এগিয়ে গেল। ছেলেটা সালাম জানালো।

আসসালামু আলাইকুম স্যার।

অভিক হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেইক করে বলল

ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমি কি চিনি?

আপনি চিনবেন না তবে আমি চিনি। আমি কমার্স কলেজের স্টুডেন্ট।

গুড জব। ভেতরে এসো। ওদের ধৈর্য নিয়ে পড়াতে হবে। ভীষণ দুষ্টু।

পারব আমি।

অল দ্য বেস্ট।

টিচারের কাছে কোলে করে দিয়ে আসলো অভিক। কোনোমতেই দুজনে পড়তে বসবেনা। এত বিচ্ছু হলে চলে?

অভিক দোতলা থেকে নেমে এসে বসতে যাবে তখনি আবারও কলিং বেল বেজে উঠলো। মমতাজ বেগমকে ধীরপায়ে হেঁটে আসতে দেখে অভিক এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে এনে সোফায় বসিয়ে দিতেই বৃদ্ধা তাড়া দিয়ে বললেন

আগে দেখো কে এসেছে?

অভিক দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল

আন্টি দরজাটা কেন বন্ধ করে?

দরজা খুলে দিতেই মালিকে দেখে ভুরু কুঁচকে এল তার। মালি কাগজের কার্টুন বাড়িয়ে দিয়ে বলল

বাবু অল্পবয়সী এক ছোকরা এটা দিয়ে গেছে। বলছে সুজানা নাকি পাঠাইছে।

অভিক কার্টুনটা দেখলো। নিয়ে গেল ভেতরে। মমতাজ বেগম জানতে চাইলেন

এটা কি দাদুভাই?

কেক। সুজানা পাঠিয়েছে।

বৃদ্ধার চোখমুখ উজ্জ্বল দেখালো।

তোমার জন্য?

অভিক হাসলো।

আমার জন্য কেন কেউ কেক বানাবে?

তুমি একটা ভালোবাসা দাদুভাই।

অভিক কার্টুন খুলতে খুলতে আবারও হাসলো। কার্টুনটা খুলতেই বেরিয়ে এল একটা চকলেট কেক। আনিকা এসে বিস্ময় নিয়ে বলল

ওমা কেক পাঠিয়েছে? এটা কয় পাউন্ড হবে রে অভি?

চার।

দেখেছিস কেক পাঠিয়ে দিয়েছে। সুজানার কাছে থাকলে আমি ওর কাছ থেকে শিখে নিতাম। ইশশ কি সুন্দর।

শিখে নাও নাতবৌ।

কিভাবে দাদু?

সুজানাকে তোমার কাছে নিয়ে আসো।

উনি আসবেন না।

এমনিএমনি কেন আসবে? বন্ধু করে নিয়ে এসো।

বন্ধু? মানে…..

অভিক বলল

আপু কাটার নিয়ে এসো। আনিকা কাটার আনতে ছুটলো। এল সুজানার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে।

আপনি তো চার পাউন্ডের কেক পাঠালেন সুজানা। এত সুন্দর হয়েছে ডেকোরেশনটা। খেতে নিশ্চয়ই খুব মজা হবে। আরেকটা গুড নিউজ আপনার টিচার কিন্তু কেকটা বেশ ভালো করে দেখছে।

উনি খাবেন?

হুমম।

সত্যি?

আরেহ হ্যা। আমি কাটার নিয়ে যাচ্ছি।

আনিকা সেখানে যেতেই অভিক চোখ তুলে বলল

কার সাথে কথা বলছ?

না, এমনি। তুই কাট।

অভিক জাস্ট এক পিস কেটে মমতাজ বেগমকে খাইয়ে দিল । নিজেও একটু মুখে দিল। আনিকা বলল

কেমন হয়েছে রে অভি?

খুব মজার কেক যেমন হয়। তার চাইতে একটু বেশি।

পরোক্ষ প্রশংসায় ফোনের ওপাশে সুজানা খুশি হয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলো।

আনিকা বলল

ভালো করে প্রশংসাটুকু করতে পারিস না গা*ধা।

চলবে…….#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_২৫
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

আনিকা কেকের পিস নিয়ে খেয়ে বলল

সুজানা আসলেই টেস্ট হয়েছে। ভীষণ সফট হয়েছে। কয়টা ডিম ইউজ করেছেন?

আম্মা বেক করেছে। আমি জাস্ট ডেকোরেশন করেছি। এই প্রথম পুরো কেক ডেকোরেশন করলাম।

মনেই হচ্ছে না। যাইহোক আপনি আপনার মায়ের মতোই ব্রিলিয়ান্ট।

থ্যাংকস।

আচ্ছা আপনি কি বাইরে? গাড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

হ্যা তো। আমি তো অফিসের নীচে দাঁড়িয়ে। মাত্রই গাড়ি থেকে নামলাম। ভাইকে দিয়ে কেকটা পাঠিয়েছি। দুজনেই একসাথে বেরিয়েছি বাসা থেকে। যাইহোক আমার কষ্ট স্বার্থক।

আনিকা হাসলো। বলল

আপনার স্টুডেন্টরা এখন নতুন টিচারের কাছে পড়ছে। টিচারের কেক দেখলে তো হামলে পড়বে।

হ্যা হ্যা আমি তো ওদের জন্যেই পাঠিয়েছি।

আনিকা হেসে উঠে অভিককে বলল

হায় হায় অভি তোর স্টুডেন্ট কি বলছে দেখ।বলছে কেকটা নাকি বেবিদের জন্য পাঠিয়েছে তোর জন্য না।

সেটা কেকের উপরে লিখে দেয়া উচিত ছিল উনার।

সুজানা শুনে জিভে আলতো করে কামড় বসালো। সে ভেবেছে স্যার পাশে নেই। বসে বসে কথা শোনা হচ্ছে। সে আর কোনো কথাই বলবে না।

আনিকা হেসে বলল

সুজানা আপনার টিচার কি বললেন দেখলেন তো?

হুম, পরেরবার লিখে দেব।

পরেরটাতে যেন আমার নাম লেখা থাকে। এবারেরটা তো বেবিদের জন্য। পরেরটা আমার নামে হোক।

সুজানা ওপাশে মৃদু হাসলো। মমতাজ বেগম হাসলেন। আনিকাকে বললেন

নাতবৌ তুমি কেন মধ্যস্থতা হিসেবে কাজ করছ? ফোনটা দাদুভাইকে ধরিয়ে দাও। কথা তো তারা বলছে। তুমি শুধু শুধু কষ্ট করছ।

আনিকা হেসে অভিকের দিকে চাইলো। অভিককে দেখে মনে হলো না সে কথাটা অত গায়ে মেখেছে। কেক খাওয়ায় মনোযোগ রেখে ফোনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

আনিকা ফোন দিয়ে দিতেই সুজানা ওপাশ থেকে বলল

আচ্ছা ম্যাডাম এখন রাখি। হ্যা?

হুম। রাখতেই পারেন। কিন্তু আমার ট্র্যাকসুইটটার কি অবস্থা করেছেন? ওটা কুঁচকে গিয়েছে কেন?

আনিকা বলল

হুহ এই তোর জরুরি কথা?

অভিক কেকটা ঠেলে দিয়ে বলল

মা আর জেম্মাকে দেখাও।

ওকে।

আনিকা কেকটা নিয়ে চলে গেল। সুজানা ওপাশে চুপচাপ। অভিক বলল

এখন ভয় পেয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।

সুজানা সাথে সাথে প্রতিবাদ করে উঠলো।

একদম না। কেন ভয় পাব? আপনিই তো বলেছিলেন আমাকে করতে কাজটা। আমি কি অত পারি নাকি? আম্মা করলে কুঁচকাতো না।

আপনার অজুহাত আমার চাইনা। আপনি অজুহাতের রাণী। ওটা আমি ওয়ার্ক আউটের সময় পড়ি। আমি কুঁচকে যাওয়া ড্রেস পড়িনা। ট্র্যাকসুইটটা ঠিক করে দেবেন। ব্যস। ওটা আপনি অব্দি পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার।

সুজানা কিছু বলার আগেই ফোনটা টুট টুট শব্দ করে কেটে গেল। অভিক বাকি কেক টুকু মুখে পুরে ফোনটা টি টেবিলে রেখে চলে যেতে উদ্যত হবে তখনি বৃদ্ধা জানতে চাইলেন

অজুহাতের রাজার খোঁজে আমি।

অভিক চোখতুলে বিমূঢ় চোখে চাইলো। বলল

আই থিংক সেটার খবর তোমাদের কাছে ভালোই আছে। আজকাল তো সেসবের বেশ চর্চা হয় এই বাড়িতে। সকাল সন্ধ্যা। যাইহোক কাজ আছে আমার।

হাত ঝেড়ে উঠে গেল অভিক। যেতে যেতে শুনলো

ভাই মনে হচ্ছে রেগে কথা বলছে।

রাগ আমার ধাতে নেই। ড্রপ দিজ ম্যাটার প্লিজ।

নাতির কথা শুনে মৃদু হাসলেন বৃদ্ধা।

_____________________

সুজানা অফিসের ডেস্কে গিয়ে বসতেই সেদিনের ছেলেটা কথা বলতে এগিয়ে এল।

হ্যালো সুজানা। কেমন আছেন? কাগজপত্র সব এনেছেন?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। হ্যা এনেছি। ম্যামের কাছে যেতে হবে?

নো । ম্যাম আসবেন। এন্ড গুড নিউজ একটা কোম্পানির সাথে আমাদের বেশ ভালোই ডিল হয়েছে। আপনাকে মেবি ওখানকার ব্র্যান্ড ডিজাইনের দায়িত্বটা দেয়া হবে।

আচ্ছা এটা তো এজেন্সির মতো? ডেভেলপার আছে?

না। আপাতত মার্কেটার এবং ডিজাইনাররা কাজ করছে।

আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি।

ওদের কথাবার্তার মাঝখানেই নীলা মজুমদার এল। সবাই গুড ইভিনিং জানাতেই উনি সবার সাথে হেসেখেলে কথা বলে সুজানার দিকে এগিয়ে এল। নীল রঙা আইডি কার্ডের ফিতা সুজানার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বলল

আমার সাথে আসুন ম্যাডাম। অনেক কথা আছে।

সুজানা মৃদু হাসলো। ম্যামকে তার ভারী পছন্দ হয়েছে। সুন্দর মহিলাটির মনটাও নিশ্চয়ই সুন্দর। নইলে এমপ্লয়িদের ম্যাডাম বলে সম্বোধন করাটা যে সে পারেনা।

নীলা যাওয়ার কিছু পরেই সুজানা উনার অফিসের কামরায় গেল। নীলা খুশি হলো। বলল

বসুন সুজানা। সাইফ ওয়াহিদ সম্পর্কে কতটুকু জানেন?

ততটুকুই জানি যতটুকু জানলে আর জানা লাগেনা।

গুড।

ও আমার বন্ধু হয়। আপনি জানেন?

সুজানা বিস্ময় নিয়ে তাকালো।

বন্ধু?

হুমম। আমরা কলেজে একসাথে পড়েছি। ও খুবই ট্যালেন্ডেট পার্সন। আপনি দেখুন ও বিসিএস দিচ্ছে আর আমি বিজনেস সামলাচ্ছি।

একটা প্রশ্ন করব যদি কিছু মনে না করেন।

হুমম।

আপনি ম্যারিড?

নীলা হেসে উঠলো।

নো নো। একজনের পেছনে নিজের জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করার পর আর কারো সাথে জড়াতে ইচ্ছে হয়নি। নিজেকে ব্যস্ত করে নিয়েছি। তুমি সাইফের কাছের বোন তাই বলে ফেলেছি। দেখো আবার। হাউএভার, আমরা কাজের কথা শুরু করতে পারি।

সরি ম্যাম। আপনাকে কষ্ট দেওয়াটা উদ্দেশ্য ছিল না।

ইট’স ওকে সুজানা। সাবধান ভুল মানুষের পেছনে সময় ব্যয় করোনা। ওহ সরি তুমি বলা শুরু করে দিয়েছি।

শুনতে ভালো লাগছে। তুমি বলতে পারেন। আপনার ছোট বোনের মতোই তো।

ওকে ডান। তুমি করেই বলি। যে কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম সেটা হচ্ছে রিসেন্টলি আমরা যে ব্র্যান্ড ডিজাইনটা নিয়ে কাজ করব সেটা হচ্ছে বাবার এক বন্ধুর কোম্পানির জন্য। কোম্পানিটা রিসেন্টলি লঞ্চ করেছে। সো তাদের কাজগুলি আপনাকে করতে হবে।

সুজানাকে শঙ্কিত দেখালো।

আপনি ভাবছেন আমি পারব?

কেন নয়? সাইফ আমাকে বলেছে তুমি গত ছ’মাস আগে থেকে শিখে আসছ। আর তোমার পোর্টফলিও দেখেছি আমি। বিশ্বাস রাখো নিজের উপর। পারবে।

আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব ম্যাম।

অল দ্য বেস্ট সুজানা। এখন ডেস্কে যাও। আজ তেমন কাজ নেই। মেইন কাজ কাল থেকে। আমি তোমাকে উনাদের ওয়েবসাইটটা দিচ্ছি, ওটা থেকে অনেক ধারণা নিতে পারবে তুমি। আজ শুধু ওই ওয়েবসাইটটা ভিজিট করো। এবং ক্রিয়েটিভ ডিজাইন আইডিয়া নিয়ে রিসার্চ করো।

ওকে ম্যাম।

সুজানা ডেস্কে গিয়ে বসলো।
কাজ এবং কলিগদের সাথে অল্প আলাপসালাপ সেড়ে কথাবার্তা শেষে বেরিয়ে এল অফিস থেকে। এশার আজান পড়ে গেছে অনেক আগে। সময় দেখলো ন’টা বাজে। যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরতে হবে। গাড়িতে উঠার সময় সেদিনের কুকুরটা ছুটে এল তার দিকে। সুজানা বড়সড় দম ফেললো। ইশশ ভাগ্যিস সে ঠিক সময় গাড়িটা পেয়েছে।

বাসার কাছাকাছি নামতেই সুজানা দেখলো গেইটের পেছনেই মা দাঁড়িয়ে আছে। সুজানা মাকে দেখে হেসে ফেলল।

এখানে কেন আম্মা? আমি আসছি বললাম না?

আমার তো চিন্তা হয়। মা হ বুঝবি।

সবসময় এই কথা বলে।

সাজিয়া বেগম মাথা নেড়ে বললেন

তুই তোর সন্তানসন্ততিকে চোখের আড়ালও করবি না। আমি তো হাতের বাইরে ছেড়ে দিয়েছি। আল্লাহ দেখবে।

সুজানা হতাশ। তার মা’টাকে কোনো কিছু বুঝানোর সাধ্যি নেই।

_______________

ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হৈচৈ হাসি তামাশা চলছে অবিরত। কিছু আগেই সম্পন্ন হওয়া ক্লাসের মোর্শেদ স্যার তথা তাদের টাকলু স্যারকে নিয়ে।

হৈহুল্লোড় হাসাহাসি পিনপতন নীরবতা ঢেলে সবার প্রিয় স্যারটি প্রবেশ করলো। সবাই ফিসফিসানি বন্ধ করে জানতে চাইলো

স্যার কেমন আছেন?

স্যার মৃদু হেসে উত্তর দিল,

আপনারা ভালো থাকতে দিচ্ছেন কই? যে মাছের বাজার বসিয়েছেন। যাইহোক, অনেকগুলো দিনপর মাছের বাজার দেখলাম। Interesting!

স্যার আমরাও হ্যাপী।

অভিক অদ্ভুত চোখে তাকালো তাদের দিকে। বলল

কান ধরে সবাইকে দাঁড় করিয়ে রাখব। ডিসিপ্লিন এখনা না শিখলে শিখবেন কেমন?

সবাই যেন ভ্যাঁবাছ্যাঁকা খেয়ে গেল। মাঝসারিতে বসা সুজানা মেহুল আর শান্তা একসাথে ফিক করে হেসে উঠলো। সুজানা বলল

ভালোই বাঁশ দিয়েছে।

বাকিরা কাঁচুমাচু করে তাকালো।

আমরা লেসন শুরু করতে পারি?

সবাই সমস্বরে আওয়াজ তুললো।

ইয়েস স্যার।

অভিক লেসনের ফাঁকে ফাঁকে তার ব্যাক্তিগত কিছু লেসনে মনোযোগ দিতে ভুলেনি আজও।

সুজানা জীবনেও এত ভুল কখনোই করেনি যতটা ভুলভাল নোট আজ সে খাতায় তুলেছে। হয়ত এলইডি স্ক্রীনের পাশেরজনকে একটু বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে?

তারা দুটো মানুষ আড়ালে আবডালে একে অপরকে দেখে নেয় রোজ। তাদের “সে” আশেপাশে থাকলে সবটা সুন্দর লাগে, ভালো লাগে, প্রশান্তি লাগে।

**

সুজানা ক্লাস শেষে লাইব্রেরিতেও গিয়েছে। ফেরার পথে একটা ছেলে বই ধরিয়ে দিয়েছে তার হাতে। আর বলেছে অভিক স্যার পাঠিয়েছে। সুজানা নিল। বন্ধুদের বিস্ময়কর চাহনি তার দিকে নিক্ষিপ্ত। তাদের অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর সুজানা এড়িয়ে গেল। তাদের কি বলবে সে?

বাড়িতে গিয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে বইটা খুললো সে। বইটার মাঝখানেই একটা চিরকুট।
তাতে লেখা,

সুজানা!
বইটা জাস্ট অজুহাত। একটা প্রশ্ন জানার ছিল আমার।
কাল রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।

একটা অন্ধকার ঘর
সেখানে আপনি
এবং অনেকগুলো ছায়া নৃত্য করছে আর আমি

এটার ব্যাখ্যা দিন। এবং এটা সত্যি আগের সব প্রশ্ন আমি ভুলে গিয়েছি তাই উত্তর জানতে চাইবো না। আপনি জাস্ট এটার উত্তর দিন।
কিভাবে আমাকে উত্তরটা জানাবেন তাও বলে দিচ্ছি। ফোনে মেসেঞ্জার ওপেন করুন। অভিক ফারদিনের নামের পাশের সবুজ বাতি কিন্তু রোজ চলে। আপনার চোখের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে চোখে পড়েনা।

সুজানা ফোন হাতে নিয়ে মেসেঞ্জার ওপেন করলো। অভিকের আইডিতে অলরেডি মেসেজ পাঠানো তার দিক থেকে। এসব উনার কাজ, ওইদিন কমেন্ট পড়ে হাসাহাসি সময় উনি সুজানার ফোন থেকে মেসেজ পাঠিয়েছিল নিজের ফোনে।

সুজানা মেসেজ পাঠালো

বইটা পড়া শেষ হলে উত্তরটা নিয়ে হাজির হবো। আমি জানি বইটা অজুহাত না।

উত্তর এল।

ইনটেলিজেন্স! কিন্তু সময় অতিক্রম হয়ে গেলে আমি এই স্বপ্নটাও ভুলে যাব সুজানা।

না ভুলে যাবেন না।

আপনাকে ভুলব না। স্বপ্ন ভুলার কথা বলছি। আপনাকে ভুলা তো অসম্ভব। আপনি আমার আত্নীয়ের বাড়িতে বউ হতে যাচ্ছেন। একদম অসম্ভব।

সুজানা হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো।

আহ! তার এসব শুনতে ভালো লাগেনা।

চলবে…..

ওয়াইফাই চলে যাওয়ায় আপলোডে দেরী হয়েছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here