#আমারে_দিলোনা_ভুলিতে।
#পর্ব_৬।
#লেখা_আরজুমান_তাশা।
“ভিডিও কল রিসিভ হতে নিবেদিতার বাহুতে ব্যান্ডেজ দেখে চন্দ্রা আতংকিত হয়ে চিৎকার করে বলে,
” নিবি কি হয়েছে তোর হাতে?
চন্দ্রার কথায় নিবেদিতা তার বাহুতে চোখ বুলিয়ে স্বভাবসুলভ হেসে চন্দ্রাকে আশ্বস্ত করে বলে,
“তেমন কিছু হয়নি। সামান্য কেটে গিয়েছে৷
চন্দ্রা চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে,
” কিভাবে?
“ক্রিমিনাল ধরতে গিয়ে৷ আচ্ছা বাদ দে।তোর কি অবস্থা বল? সব কেমন চলছে?
চন্দ্রা ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
” এইতো ভালোই চলছে। ক্যাম্পিংয়ে এসে অনেক কিছু শিখছি। নানান ধরনের মানুষের সাথে মিশছি। মোটামুটি সব ভালো। আমি খুব উপভোগ করছি।
” ক্যাম্পিং কবে শেষ হবে?
” প্ল্যান তো একমাসের। হয়তো তার থেকে বেশি সময় লাগবে।
“ওহহ!
চন্দ্রা তাড়া দিয়ে বলে,
” আচ্ছা বাই। পরে কথা বলবো।
নিবেদিতা হাসিমুখে বলে,
“ওকে বাই। ভালো থাকিস।
” তুইও ভালো থাকিস
লাভ ইউ।
“লাভ ইউ টু
চন্দ্রার কল কেটে যাওয়ার পর নিবেদিতা স্মিথ হেসে বসা থেকে উঠে শোয়ার রুমে চলে আসে৷ শান্ত হয়ে বিছানার একপাশ করে আহত হাতের দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে থাকা ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে৷ নিবেদিতা ড্রয়ারে হাত বাড়িয়ে রক্তে রাঙানো উল্লাসের রুমালটা বের করে৷ সেটা ওলট-পালট করে একধ্যানে চেয়ে থাকে৷ তারপর রুমালটাকে লক্ষ্য করে বলে,
” লোকে বলে সময়ের সাথে সাথে মানুষের পরিবর্তন হয়৷মানুষ পছন্দ পরিবর্তন হয়৷ইচ্ছে -অনিচ্ছের পরিবর্তন হয় ভালো খারাপের পরিবর্তন হয়৷ এবং কি অনুভূতিও নাকি বদলে যায়৷কথাগুলো আসলেই সত্য। আমারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তোমার প্রতি আমার যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিলো তা একবিন্দুও কমলোনা উল্লাস। আপনি জানেনই না আমি আপনাকে এখনো কতটা ভালোবাসি। কতটা আপনাকে ভেবে আমি কষ্ট পায়।
” উশানের সময় আজকাল সহজে কাটতে চায়না। কাজ পাগল উশানের আজকাল কাজের প্রতি চরম অনিহা। চারপাশ তার কাছে এখন বিষাদময় হয়ে গিয়েছে। ‘দূরত্ব বাড়লে নাকি গুরুত্ব বাড়ে।’ চন্দ্রা ঢাকায় যাওয়ার পর থেকে উশান হারে হারে বুঝতে পারছে চন্দ্রার কতটা প্রয়োজন তার জীবনে৷ অথচ চন্দ্রা যখন তার আশেপাশে ছিলো উশান তখন তেমন গুরুত্বই দিলোনা। অনেকটা হেলাফেলা করে চলেছে৷ উশান এখন প্রতি মুহূর্ত এখন রিয়েলাইজ করে সম্পর্কে সেক্রিফাইসটা চন্দ্রা একাই করে গিয়েছে। শুধুমাত্র তার জন্য তাদের সম্পর্ক ঠিকে আছে। উশানতো সম্পর্ক ঠিকে রাখার মতো কিছুই করেনি। উশানের এখন অনুতাপ হচ্ছে। ভীষণ রকমের অনুশোচনায় দিন কাটাচ্ছে৷ চন্দ্রা ঢাকায় গিয়েছে আজ পনেরো দিন হতে চলেছে। কিন্তু চন্দ্রার সাথে কোন কন্ট্রাক্ট সে করতে পারেনি৷ চন্দ্রা এই পনেরো দিনে শুধু ঢাকায় পৌছে কল করেছিলো। এরপর আর করেনি। উশান অনেক বার কল করেছিলো কিন্তু কোন রেস্পন্স পায়নি। একদিকে দুশ্চিন্তা আর অন্য দিকে সম্পর্ক হেলাফেলা করার অনুশোচনা উশানকে দগ্ধ করে দিচ্ছে৷ উশান আর নিতে পারছেনা৷ চন্দ্রার সাথে যদি কন্ট্রাক্ট করতে না পারে তবে উশান নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে। চোখ বুজে উশান আকাশ কুসুম ভাবতে থাকে।
উল্লাস উশান উদাসীন বসে থাকতে দেখে মাথা হেলিয়ে উশানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে সজোরে উশানের কাধে চড় মেরে বলে,
“কিরে কি অবস্থা?
উল্লাসের চড়ে উশান ভয়ে ভড়কে যায়। উল্লাসকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
” শালা তুই কি আমার জান নিবি?
উশানের কথায় উল্লাস পিঞ্চ মেরে বলে,
“ওহহো গোয়েন্দা সাহেব তো সেই ক্ষেঁপেছে!
উশান নারাজ গলায় বলে,
“ফান করিস না।
উল্লাস উশানকে আগাগোড়া দেখে উশানকে বুঝার চেষ্টা করে।মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারছে উশানের মন মেজাজ কিছু ঠিক নেয়৷উল্লাস উশানের কাধে হাত রেখে জোশের গলায় বলে,
” এক ম্যাচ হয়ে যাক!
উশান মনমরা করে বলে,
“নাহ দোস্ত।
উল্লাস উশানের পাশে বসে পেরেশানি হয়ে জিজ্ঞেস করে,
” তো কি হয়েছে? এতো কি নিয়ে ভাবছিস।
উশান উল্লাসের মুখের দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস গলায় বলে,
“আমি একটা ডিসিশন নিয়েছি।
” কি!
” বিয়ে করবো৷
“এ্যাহ!
উশানের কথায় উল্লাস বেশ সারপ্রাইজড হয়ে যায়৷ পরমুহূর্তে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলে,
” বিয়ে করবি ভালো কথা। এটা তো খুশির সংবাদ৷ কিন্তু তুই মুখটারে বাংলার পাঁচ বানায় রাখছোস কেন?
উশান বিষন্ন গলায় বলে,
“যাকে বিয়ে করার কথা ভাবছি তার সাথে কোন কন্ট্রাক্ট আমি করতে পারছিনা৷
উশানের কথায় উল্লাস উত্তেজিত হয়ে বলে,
“মেয়ে কি ভেগে গেছে?
বিরক্তি নিয়ে উশান বলে,
” ধুর ব্যাটা। আমার গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করার কথা ভাবছি। ও কিছুদিন আগে ঢাকায় গিয়েছে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর ওর সাথে আমি আর কোন কন্ট্রাক্ট করতে পারছিনা৷
উশানের কথায় উল্লাস ঠেস মেরে বলে,
“যদি গার্লফ্রেন্ডকেই তুই খোঁজে না পাস তাহলে তুই কিসের গোয়েন্দা? আমার তো তোকে সন্দেহ হচ্ছে তুই আদৌ গোয়েন্দা তো?
উশান ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলে উদাস গলায় বলে,
” আমার জীবন তেজপাতা হয়ে যাচ্ছে আর তুই মজা লস! বিপদে নাকি বন্ধুর পরিচয়। তুই ভালোই বন্ধুর পরিচয় দিচ্ছিস!
বন্ধুর সেন্টি মার্কা কথা শুনে উল্লাস ড্যাবড্যাব করে উশানের মুখের দিকে চেয়ে তাকে। উশানের এমন ইমোশনাল কথাবার্তা উল্লাসের মগজে ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের সংলাপের মতো মনে হলো। উল্লাস গলা ঝেড়ে বলে,
“আচ্ছা ভাই এতো সেন্টি খাইস না। তুই তোর প্রেমিকার বন্ধু বান্ধবের সাথে যোগাযোগ করে দেখিস নি?
উশান আবারও ফুস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে আহত গলায় বলে,
” আমি কখনো ওর কোন ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করিনি৷ ওর ফ্রেন্ড সম্পর্কে আমার কোন আইডিয়া নেই।
উশানের কথায় উল্লাস আফসোস করে বলে,
“আরে আহাম্মক! তোর প্রেমিকা কখনো তার ক্লোজ ফ্রেন্ডের ব্যাপারে কিছু বলেনাই?
উল্লাসের কথায় উশান ফ্যালফ্যাল করে উল্লাসের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জরুরি গলায় উল্লাসকে বলে,
” এক মিনিট!
উল্লাস পকেট থেকে তার মোবাইল বের করে কিছু একটা চ্যাক করে। চ্যাক করার পর উশানের মুখ থেকে দুশ্চিন্তা চলে গিয়ে মুখে একরাশি আনন্দ এসে ভর করে৷ উশান উল্লাসের দিকে মোবাইল থাক করে ধরে উল্লাসিত গলায় বলে,
“পেয়ে গিয়েছি৷
উল্লাস মোবাইলের স্কিনে তাকাতে সে থঁ হয়ে যায়।দুটো হাস্যোজ্জ্বল মুখ। একজন আরেকজনের জনের গলা আকড়ে ধরে আছে। দেখে বুঝায় যাচ্ছে তাদের দুজনের ভালো বন্ডিং। উল্লাস তার অজান্তে উশানের মোবাইল হাতে তুলে নিয়ে ছবির দিকে চেয়ে তাকে৷ছবিটাতে আর কেউ না, চন্দ্রা আর নিবেদিতা৷উল্লাসকে অন্য ধ্যানে দেখে উশান উল্লাসকে হাল্কা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,
” কিরে তোর আবার কি হইলো!
উল্লাস কিছুটা চিন্তিত গলায় বলে,
“তোর প্রেমিকার নাম, চন্দ্রা নাকি নিবেদিতা?
উল্লাসের মুখে দুজনের নাম শুনে উশান ভীষণ অবাক হয়ে যায়। অবাক গলায় বলে,
” তুই এদের চিনিস?
উল্লাস ভাবলেশহীন গলায় বলে,
“হ্যাঁ।
উশান চট করে উল্লাসের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে কিছু গেস করে বলে,
” নিবেদিতা সে না,যাকে তুই ভালোবাসিস?
উল্লাস চুপ করে থাকে৷ উল্লাসকে চুপ থাকতে দেখে উশান উল্লাসের কাঁধে হাত রেখে চুপ করে থাকে৷হঠাৎ উশানের মাথায় একটা প্রশ্ন জেগে উঠে। উশান উত্তেজিত গলায় বলে,
” তারমানে তো নিবেদিতার থেকে আমি চন্দ্রার খোঁজ জানতে পারবো। আর তুই জানিস নিবেদিতা কোথায় সেটা।
উল্লাস শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“নিবেদিতা,আর আমি একই জায়গায় কাজ করি৷ কিন্তু সে কোথায় থাকে বা তার কন্ট্রাক্ট নাম্বার আমার কাছে নেই৷
উশান অবাক গলায় বলে,
” মানে কি?
উশানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে উল্লাস সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে উদাস গলায় বলে,
” নিবেদিতা আমাকে সবসময় ইগনোর করে চলে৷
কথাটা বলে উল্লাস স্মিথ হাসলো। কথার সুর পাল্টে বলে,
“কাল নিবেদিতা ফিল্ডে থাকবে।আমি ওর সাথে কথা বলে চন্দ্রার ব্যাপারে জানার চেষ্টা করবো৷ এখন আমি যাই৷
” চল এক সাথে যায়।
উল্লাস তার নিজস্ব লাইব্রেরির সামনে এসে আলো ঝালিয়ে দেয়৷ নিজ হাতে একটু একটু সে এই লাইব্রেরি তৈরি করেছে।। ব্যক্তিগত লাইব্রেরি৷যখন মানুষের মন ভালো থাকেনা তখন শরীরের জোর কমে যায়৷ দেহ অনেকটা ঝিমিয়ে পরে। দেহ চায় তার শরীর শূন্যে ভেসে যাক। দেহ মুক্তি পেতে চায়৷ মনের জোর কমলে মানুষ ভেঙে পড়ে। নিজের জাহির করতে পারেনা। উল্লাস তার ক্লান্ত দেহ নিয়ে স্টাডি টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়৷ নির্লিপ্ত ভাবে টেবিলে উপর থাকা জিনিসগুলো দেখতে থাকে কিছুক্ষণ৷ এরপর গুটিগুটি পা ফেলে তার বিশাল চেয়ারে এসে বসে পরে৷ চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা ডেক্সের উপর আঙ্গুল ঘুরাতে থাকে৷ মস্তিষ্কে বারবার ভেসে উঠছে নিবেদিতার প্রতিচ্ছবি৷ নিবেদিতার চেহারা মস্তিষ্কে ভেসে উঠলে উল্লাস ঠোঁট বেঁকে হেসে বলে,
” আহ্ নিবেদিতা আহ্। এতো ভালো অভিনেতা কি করে হলে?
কথাটা বলে উল্লাস মাথা উচু করে ছাদের উপর তাকালো। দৃষ্টি স্থির৷ মন অস্থির। বুকের ভিতর এক নিদারুণ যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটাকে সহস্র পিঁপড়ে খামচে ধরে আছে৷ উল্লাস ধীরে চোখ বুজে হা করে লম্বা করে শ্বাস ফেলে। উল্লাসের স্মৃতিতে সে দিনটা সজাগ হয়ে উঠে যেদিন নিবেদিতা উল্লাসকে বলেছিলো,
“আপনি খুব সুন্দর৷
কথাটা উল্লাসের কানে এখনো বাজে৷ কথাটা তীরের মতো এসে উল্লাসের হৃদয়ে এসে গেঁতেছে। আর এখনো সে গাঁতা’তে আছে। এই তীর টা তার হৃদয় থেকে কখনো বের হিসেবে আসবেনা। থেকে যাবে আজীবন৷ ”
(#চলবে…)